Abanti Pal

Romance Fantasy Others

4.0  

Abanti Pal

Romance Fantasy Others

শিকড়ের টানে

শিকড়ের টানে

9 mins
300



 পড়ন্ত বিকেলের গেরুয়া আলোয় অনুপমা দেখতে পেল, অনেক ওপরের আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে জেট-প্লেনটা পুবদিকে। ওর নিজের দেশেই যাচ্ছে হয়তো, ভাবতেই মনের ভেতরে সেই সুপ্ত বেদনাটা চিনচিন করে উঠল। 


মাসছয়েক হতে চলল বিদেশে এসেছে কাজের সূত্রে, কিন্তু এই ঝাঁচকচকে মেক্সিকো সিটির হালহকিকতে এখনো রপ্ত হয়ে উঠতে পারেনি অনুপমা ভালোভাবে। বড্ড ঠান্ডা এই শহর, হাজারো লোকের ব্যস্ত সমাগমেও, কোথাও যেন প্রানবিন্দুটি নেই। সকলের চোখে ধরা দেওয়া এই স্মার্ট, রূপসী, সবকিছুর সাথে মানিয়ে চলা, কর্মদক্ষ মেয়েটি আসলেই যে মনের গহীনে প্রবলভাবে দেশকাতুরে, শয়নে-জাগরণে হাতছানি দেয় ফেলে আসা মাটির স্মৃতিরা, সেটা একমাত্র ও ছাড়া আর কারুর অনুভব করার ক্ষমতা নেই।


তবুও ভুলতে হবে সেসব স্মৃতিদের, হারিয়ে ফেলতে হবে ফেরার টান, ডুবিয়ে রাখতে হবে নিজেকে হাজারো কাজের মাঝে। তাই জন্যই সব ছেড়ে আসা নয় কি, নিজের অতীতটাকে ভুলে থাকার জন্য? 

সেই কারণেই তো অফিসের ম্যানেজার রক্তিমদা যখন সবেমাত্র এক বছরের কর্মঅভিজ্ঞ ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল

'অনসাইট যাবি?'

তখন মুহূর্তমধ্যে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল অনুপমা। 


'আরে দু'মিনিট ভাব, ভেবে বল অন্তত! এতো বড়ো সিদ্ধান্ত হুট করে নিয়ে নিলি?' 


'আমার ভাবা হয়ে গেছে রক্তিমদা' নির্লিপ্ত কন্ঠে উত্তর দিয়েছিল ও পরক্ষনেই।


'দেশ ছেড়ে দীর্ঘদিন থাকতে হবে কিন্তু। ভাবনাচিন্তা কর, কাল সকালে এসে উত্তর দিস' বহুজাতিক সংস্থায় নতুন প্রবেশ করা মেয়েটার অনভিজ্ঞতার জন্যই হয়তো এই বাড়তি সময়টুকু দিতে চেয়েছিল ওর ম্যানেজার। তবে সেটার প্রয়োজন হয়নি। অনুপমা যে ভীষণভাবে চাইছিল ওর চেনা থেকে হঠাৎ অচেনা হয়ে যাওয়া প্রানের শহর থেকে দূরে, বহুদূরে চলে যেতে।


কলকাতা শহর ওর জন্মস্থান। জীবনের সমস্ত ভালোবাসা মন্দবাসা এই শহর ঘিরে। দখিনা ঝুলবারান্দায় ছোটবেলার পুতুলখেলা, কিশোরীবেলায় শরতের আকাশে মেঘের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে সূর্যালোকের সাথে লুকোচুরি খেলা, সদ্য যৌবনা হয়ে কলেজবেলায় উন্মত্ত প্রেমের জোয়ারে ভেসে উত্তর কলকাতার অলিগলি ঘুরেফিরে বেড়ান প্রেমিকের হাতে হাত রেখে, চাকরিসূত্রে অনেক ভোরবেলায় প্রেয়সীরূপ শহর দেখা থেকে গভীর রাতের ফেরার সময় নিঝুম জনশুন্য নগরীর অব্যক্ত ইশারা বোঝা... এই শহর সহস্র রূপে ধরা দিয়েছে ওর চোখে, এই শহর সবটুকু দিয়েছে ওকে। এক মায়াবী আবেশের আস্তরণে আগলে রেখেছে ওর অনুভূতিকে সযত্নে। দিয়েছে হিমাঘ্নকে।


হিমাঘ্নর সাথে অনুপমার আলাপ কলেজে। পরিচয় থেকে প্রেম অবধি গড়িয়েছিল অনায়াসেই। দুজনে আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিল তিলোত্তমা শহরকে, তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুরে বেড়িয়েছিল পরস্পরকে চেনার সাথে সাথে। সকালে নববধুর লাস্যময়ী রূপ থেকে রাত্রের রহস্যময়ী নারী - এই শহর ওদের দৃষ্টিতে নতুনভাবে ধরা দিয়েছিল নিজেকে, অনন্যভাবে। 


কিন্তু তারপর... কোথায় যেন তাল কেটে যাচ্ছিল অনুপমা আর হিমাঘ্নর মধ্যে, চাকরির জাঁতাকলে পড়ে যান্ত্রিক হয়ে উঠছিল ওরা ক্রমশ। দিবারাত্রি স্নায়ুর ওপর চাপ ফেলছিল এই হঠাৎ কলেজের খোলামেলা জীবন থেকে অফিসের বেড়িতে আটক হয়ে যাওয়া বিকেলগুলো। 

হারিয়ে যাচ্ছিল কথারা ক্রমশই, হারিয়ে যাচ্ছিল স্বল্পেই উপলব্ধ হওয়া জীবনের রঙ্গীন চমক-জমক। কিন্তু তাও একে অপরকে ধরে রেখেছিল ওরা, বুঝেছিল কর্মব্যস্ত জীবন বুঝি এমনই হয়! 


নিজেদের ভালোবাসার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ছিল অনুপমার। 

কিন্তু এক আষাঢ়ের সন্ধেবেলা, এক অযাচিত তুফান এসে ওর জীবনটা আমূল পাল্টে দিলো।

সেদিন হিমাঘ্নর খুব জ্বর হয়েছিল, অফিস যেতে পারেনি। তাই অফিস ফিরতি পথে অনুপমা ভাবল, ওর সাথে দেখা করে যায় ওর বাড়িতে গিয়ে। কিন্তু হায় নিয়তি! ও কি আর জানতো যে ওর চোখের আড়ালে, ওর সাথে ভালোবাসার নাটক করে হিমাঘ্ন অন্য কারোর সাথে সংসার পাতার চিন্তাভাবনা করছে?

হিমাঘ্নদের ডাইনিং রুমে ঢুকতেই অনুপমা দেখতে পেলে ওর বাবা-মা বেশ কয়েকজন অপরিচিত লোকজনের সাথে কথাবার্তা বলছে। কারুর বিবাহের তারিখ নির্ধারিত করা হচ্ছে। সবার মধ্যে হিমাঘ্নকে দেখে কিন্তু অনুপমার একবারও মনে হয়নি ও অসুস্থ। 

অনুপমা ঢুকতেই যাচ্ছিল ঘরে, যখন কথাটা কানে এসে তীরের মতন বেঁধে 

'দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বিয়েটা তাহলে হচ্ছে তুলি!' একজন ভদ্রমহিলা বলছিলেন একটা মিষ্টি মতন মেয়ের গাল টিপে। 


মেয়েটা লজ্জিত হয়ে কিছু একটা বলল ফিসফিসিয়ে আর তাতে অট্টহাসির রোল উঠলো ঘরময়। 


তারপরই শোনা গেল হিমাঘ্নর কণ্ঠস্বর  

'আমার কেন আপত্তি থাকবে পাগলি! আমি তো কবে থেকেই এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম'


'খুব খুশি আমি, তুমি ভালোভাবে না ম্যানেজ করলে মা বাবাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছিলাম না আমি, যে আমার পক্ষে আর কাউকেই বিয়ে করা সম্ভব নয়' গদগদ হয় বলেছিল মেয়েটা।


' হুম, সহমত আমিও' বলে চোখ টিপে মিচকি হেসেছিল হিমাঘ্ন। 


আর একমুহুর্তও দাঁড়াতে পারেনি, দৌড়ে বেরিয়ে এসেছিল অনুপমা হিমাঘ্নদের বাড়ি থেকে সেদিন। হতবাক হয়ে ভেবেছিল শুধু, কেন ওর সাথে এই প্রতারণা? এত বছরের প্রেম নিবেদন কি শুধুই নাটক ছিল? ওর সাথে ছিনিমিনি খেলা ? কিন্তু কেন? ভীষন অভিমানে সেদিন শুধু হিমাঘ্নর বাড়ি থেকে নয়,ওর জীবন থেকেও বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো অনুপমা, নিঃশব্দে, নির্বিবাদে। 

সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে দিয়েছিল হিমাঘ্নকে ওর জীবন থেকে। ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া, অফিস চত্বর সব জায়গাতেই অধরা থেকে গিয়েছিল। হিমাঘ্ন যখন চোখের আড়ালে ওকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, তখন ও যাক চোখের সামনে থেকে সরে। সবরকম কৈফিয়তের প্রয়োজন শেষ হয়েছে দুজনের মধ্যে। 


এরপর বহুবার হিমাঘ্ন চেষ্টা করলেও, নিজের কাছে পৌঁছতে দেয়নি ওকে অনুপমা। আস্তে আস্তে চেনা শহর ওর চোখে হয়ে উঠছিল বিষাক্ত, বিভীষিকাময়। যে শহর একসময় ওকে ইশারায় কত জাদুর হদিস দিত, আজ তারা বুদ্বুদ হয়ে কবেই হারিয়ে গেছে বেঠিকানায়। আড়ালে তারাই বুঝি বিদ্রূপের হাসি হেসে ব্যঙ্গ করতে লাগলো - বড্ড বেশি স্বপ্ন দেখে ফেলেছিল যে মেয়েটা! বড়ো সর্পিল, প্যাঁচানো, ফনাধারী লাগে ওর আজকাল এই ধোঁয়াশাময় শহরকে। শ্বাসরোধ হয়ে আসে অনুপমার ধীরে ধীরে। কলেজ স্ট্রীটে পুরনো বইয়ের গন্ধ, আর্মহারস্ট স্ট্রীটে হিমাঘ্নর হাতে হাত ধরে হাঁটা, ভিক্টোরিয়ার বাগানে ওদের নিবিড় প্রেমালাপ, পার্কস্ট্রীটের জনবহুল রাস্তায় মিশে যাওয়া... এই সবকিছুর স্মৃতিরা এক নীরব শূন্যতা দিয়ে গেছে ওর মনে, যেখানে হাহাকারের ঝঙ্কার বড়ো অসহনীয়। আর কোনোদিনও ফিরে আসবে না ওর জীবনে আনন্দ নিয়ে। নিঃসঙ্গ একাকী করে দিয়ে, এই শহর বুঝি অকালে কেড়ে নিয়েছে ওর যৌবন। এই জটিল শহরকে অনুপমা চেনে না, মুখোশের আবরণে থেকে কারা যেন ওর দমবন্ধ করে দিতে লাগলো ক্রমাগত। 


কোনো কোনো দিন অফিস ফিরতি পথে বাসে উঠতে ভুলে গিয়ে, দাঁড়িয়ে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাস স্ট্যান্ডে। ব্যস্ত শহরের গতি রাত বাড়ার সাথে সাথে শিথিল হয়ে আসতো, ও একলা পথিক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো তীব্র যন্ত্রণাকে ফাঁকি দিতে, ওই খামখেয়ালী জনস্রোতের মধ্যে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিবিন্দু আবছা করে দিত ওর দৃষ্টি। ক্লান্ত অবসন্ন মন হুহু করতো এই সব কোলাহলময় তবু ফাঁকা সন্ধ্যাবেলায়। সম্প্রতি হিমাঘ্নর কেনা তিন-কামরার ফ্ল্যাট ওরা দুজনে মিলিয়েই পরিপাটি করে গুছিয়ে নিচ্ছিল ধীরেসুস্থে। আজ সেই স্বপ্ন নীড় নিছকই তাসের ঘর মনে হয়!


তাই অবশেষে যখন শহর ছেড়ে যাওয়ার অবকাশ এলো, তখন আর দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি অনুপমাকে। ভেবেছিল, কলকাতা থেকে দূরে সরে গিয়ে হয়ত হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। 

কিন্তু আজও যে স্মৃতিরা নির্মমভাবে তাড়া করে বেড়ায় ওকে অহরহ। হাজারো কাজের মধ্যেও পরিত্রাণ মেলেনা ওর। ভালোবাসাকে ভোলা কি আর অতই সহজ! আজ বোঝে, ওর কাছে ওই একটা মানুষই হয়ে উঠেছিল ওই শহরের প্রাণ আর প্রতীক, যার থেকে দূরে সরে গিয়ে শহরটাই বদলে গেল। প্রাণের শহর জায়গা বিশেষে নয়, আসলে তৈরি হয় ভালোবাসার মানুষদের নিয়ে। তাদের দিয়েই বর্ণিত হয় সে জায়গার চরিত্র। তাই তো আর ওখানে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারেনা অনুপমা। একের পর এক পুবগামী জেট-প্লেনগুলোকে দেখে শুধু নিশ্চুপে।


মেক্সিকোতে এসে বন্ধুবান্ধব যে কম হয়েছে সেটা কিন্তু একেবারেই নয়। কিন্তু তাও অনুপমা বড্ড একলা মনে করে নিজেকে। কিছুতেই যেন খাপ খাওয়াতে পারে না পারিপার্শ্বিকতার সাথে। এরকম যে আর কতদিন চলত বলা যায় না কিন্তু বিধাতার একদিন মনে হলো, যথেষ্ট হয়েছে!

সেদিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে অফিসের জন্য বেরোতে যাবে, এমন সময় অনুপমার দরজার ঘন্টিটা টুং-টাং শব্দে বেজে উঠলো। 

এই সময় আবার কে এলো? মনে মনে ভাবল অনুপমা। আজ তো কারো সাথে অফিস যাওয়ার কথা নয়, সরাসরি নিজেই অফিসে চলে যাবে ঠিক করেছিল। ফেরার পথে অবশ্য তনিমার সাথে সুপারমার্কেট হয়ে ফেরার কথা। চিন্তাভাবনা করতে করতে দরজাটা খুলতে গেল অনুপমা। কিন্তু দরজাটা খুলেই একেবারেই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কি দেখছে ও? এতদিন পরেও একইভাবে হিমাঘ্ন ওর মনে গেঁথে রয়েছে। নাহ, চোখের ভ্রম। 


দরজাটা বন্ধ করতে যাবে, এমন সময় হিমাঘ্নর 

কণ্ঠস্বর ভেসে এলো

'ভেতরে আসতে পারি?'


এবারে সত্যি চমকে উঠলো অনুপমা। মনে হল বহুদিন পর কোন ঘোরের আচ্ছন্ন ভাব কাটিয়ে কেউ যেন ডাকছে ওকে, কিন্তু ও চাইতেও সাড়া দিতে পারছেনা। সত্যিই হিমাঘ্ন দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে? দেশ, সমুদ্র সব পেরিয়ে এতদূর ওকে খুঁজে এখানে এসে পৌঁছেছে! কিন্তু প্রকাশ্যে, অনুপমা কঠিন গলায় বলল

'এখানে কি ভেবে?'


'ভেতরে আসব?' আবারও সম্মতি চাইলো হিমাঘ্ন। 


'এসো' ভেতরের ঘরে নিয়ে এল অনুপমা ওর অপ্রত্যাশিত অতিথিকে। 'অফিসে বেরোব, দেরী হয়ে যাচ্ছে। যা বলার তাড়াতাড়ি বল'


'দু'দণ্ড বসবে অনু? সেই বহুদূর থেকে এসেছে আমি তোমার খোঁজে। দশটা মিনিট দাও, পুরনো দিনের খাতিরে অন্তত। আমাকে বোঝার অবকাশ দাও একবার' 


'যা বোঝার তা তো অনেকদিন আগেই বোঝা হয়ে গেছে। আমি বোঝা হয়ে থাকতে চাইনি তোমার কাছে, তাইতো সরে এসেছিলাম নিজে থেকে। এখন আবার কেন বৃথা এই বোঝার ওপর সময় অপব্যয় করতে এসেছ?'


'আমার কথা একবার শোনো লক্ষ্মীটি' বলল হিমাঘ্ন। 


'কি আর শুনবো বলো? যা দেখার সে তো দেখে এসেছে অনেকদিন আগেই। শোনার দরকার আর পড়বে না' গড়গড় করে বলে তারপরও একটুও না থেমে বলে চলল অনুপমা, 'তারপর কেমন আছো? বিয়ে হয়ে গেছে? তোমার বউ কোথায়? তাকে কোথাও দেখছি না তো? এনেছ তাকে সঙ্গে? না কি তার সাথেও বিচ্ছেদ হয়ে গেছে?'


হতবাক হিমাঘ্ন করুণভাবে হাসল একবার, তারপর বলল 'আমাদের সম্পর্ক তো এই ছিল না অনু! আমাদের স্তম্ভ ছিল বিশ্বাস। সেটা এত সহজে কি করে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল? কি তোমার আক্ষেপ? কোথায় তোমার যন্ত্রণা? একবার তো আমাকে বুঝিয়ে দাও কি ভুল করেছি আমি? কোন বউয়ের কথা বলছ? কতবার তোমার কাছে আসতে চেয়েছি, বুঝতে চেয়েছি কি এমন অন্যায় করলাম আমি যার জন্য তুমি আমাদের দুজনকে এভাবে শাস্তি দিচ্ছো। আমি তো বুঝতেই পারলাম না কেন এই সম্পর্ক ভেঙে দিলে। না, আমি কিন্তু আজও মানি যে তুমি আমাকে ভালোবাসো। খুব খুব অভিমান হয়েছে না আমার উপর? বলোনা একবার আমাকে কি ভুল করেছি আমি? সেই জন্যই তো এত দূর ছুটে এলাম' 


'এখনো এত নাটক চালিয়ে যাচ্ছ?' তীক্ষ্ণ স্বরে বলল অনুপমা, 'ভেবেছ হয়ত কিছুই জানিনা! দিনের পর দিন প্রতারণা করে গেছ আমাকে। তাহলে শোনো আজ সামনাসামনি বলি, যখন এখনো অস্বীকার করে চলেছ। শেষ যেদিন অফিস যাওনি তুমি, জ্বর হয়েছিল জানিয়েছিলে। সেদিন আমি সন্ধ্যাবেলায় তোমার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম তোমার বাড়িতে। কিন্তু গিয়ে কি দেখলাম জানো? দেখলাম তুমি পাত্রীপক্ষের সাথে গল্পে, মশকরায় মশগুল। এতদূর এগিয়ে গেলে আমাকে না জানিয়ে? কি ভুল করেছিলাম আমি? কি অসম্পূর্ণতা ছিল আমার মধ্যে যার জন্য তোমাকে লুকিয়ে-চুরিয়ে এত বড় পদক্ষেপ নিতে হলো? একবার আমাকে না হয় বলে দেখতে পারতে আমার কমতি? আমি চেষ্টা করে দেখতাম। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ আমাদের মধ্যে স্তম্ভ বিশ্বাস। আর সেই বিশ্বাসকেই ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছিলে তুমি সেদিন, এক লহমায়। সুখে থাকো তুমি। আমাকে আমার মতন থাকতে দাও। ভালো আছি, ভালো থেকো। এবার বিদায় নাও, আমার সত্যিই দেরী হয়ে যাচ্ছে অফিসের '


'কি যা তা বলছো তুমি অনু!' স্তম্ভিত শোনায় হিমাঘ্নকে। 'আমার বিয়ে? পাত্রীপক্ষের সাথে গল্প করছিলাম? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? সেদিন তো আমার মামাতো বোনের জন্য বিয়ের কথাবার্তা চলছিল আমাদের বাড়িতে'


'মানে? তোমার মামাতো বোন হলে তার বিয়ের কথা তোমাদের বাড়িতে কেন হতে যাবে? আর সেই বা কেন লজ্জিতভাবে তোমার সম্মতি নিতে যাবে?' চমকে ওঠে অনুপমা।


'আমার মামার বাড়ি কলকাতা থেকে অনেক দূরে। মামাতো বোন তুলির একজনের সাথে প্রেমপর্ব চলছিল, কিন্তু উভয়পক্ষের বাড়ি থেকে কেউই মেনে নিচ্ছিল না। আমি মধ্যস্ততা করি, প্রস্তাব দিই পাত্রপক্ষকে আর মামাদেরকে মুখোমুখি বসে একবার আলোচনা করার। তারপরেও অসম্মত থাকলে না হয় আর এগোনো হবে না বিয়ের কথা। আমাদের বাড়িতে ডেকে নেওয়া হয় ওদের সবাইকে' এতটা বলে একটু থামে হিমাঘ্ন। 

উঠে যায় সামনের আর্শি লাগানো প্রশস্ত জানলাটার সামনে। কত স্বচ্ছ কাঁচ জানলাটার, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে জেগে ওঠা ব্যস্ত শহরকে। মানুষের ভাবনার রেখা যে কেন এত জটিল, কেন নয় সাধারন এই কাঁচের মতন? ওদের সম্পর্ক কি এতটাই দুর্বল? হায় ঈশ্বর!


দীর্ঘশ্বাসের সাথে উঠে আসে অভিযোগ

'তুমি কিছু না জেনে, না জিজ্ঞাসা করে, না বুঝে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে এই কারণে? আমার থেকে দূরে চলে গেলে অকারনেই। কোন মানে হয় অনু!'


স্তম্ভিত বাকরুদ্ধ অনু ততক্ষনে ধপাস করে বসে পড়েছে মাটিতে। তীব্র দহনে ওর পায়ের তলা থেকে বুঝি মাটি সরে যেতে লাগল। চোখ হয়ে উঠল ঝাপসা, আবেগ হারালো ভাষা। কতক্ষন এভাবে চুপচাপ ছিল দুজনে, কেউই জানে না।


একসময় অনুপমা বলে উঠলো 

'পারলে ক্ষমা করে দিও আমাকে হিমু। এরপর আর কোন মুখে তোমার দিকে তাকাবো, কিভাবে তোমার কাছে যাবো আমার জানা নেই। আমাকে আমার মতন ছেড়ে দাও। এই অধমের দিকে তাকিয়ো না। ফিরে যাও তুমি, ফিরে যাও। সুখে থেকো, ভুলে যেও আমাকে'


হিমাঘ্ন আস্তে আস্তে মাটিতে এসে বসল অনুপমার পাশে। 'ফিরে চলো অনু। আমার শহর যে তোমাকে ছাড়া বড্ড ফাঁকা'


জড়িয়ে ধরলো হিমাঘ্ন অনুপমাকে। সব বাঁধ ভেঙে গেল, হুহু করে কেঁদে উঠলো অনুপমা। চোখের জল সরে গিয়ে, ধীরে ধীরে স্বপ্নময় রঙিন কলকাতা শহর ফিরে আসতে লাগলো ওর চোখে। ফিরতে হবে, ওর নিজের শিকড়ের কাছে, নিজের প্রিয়তমর কাছে। নিজের ভালোবাসার মানুষদেরকে দিয়ে তৈরি ওর প্রাণোচ্ছল শহরকে ভুলে থাকা যায়, এ কার সাধ্য!


আমার মুখর শহর, প্রাণের শহর দিবানিশি আমায় টানে,

তার 'পরেতেই ফিরবো আমি, তারে রাখবো জয়গানে!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance