AYAN DEY

Drama Romance

3  

AYAN DEY

Drama Romance

সেদিন যে রাগিণী

সেদিন যে রাগিণী

8 mins
281


( রবি ঠাকুরের " দুই বিঘা জমি " অনুপ্রাণিত ) উমেশ আর্ট কলেজের ছাত্র । দুকুলে তার কেউ নেই । অ্যাকাডেমিতে নিজের আঁকা ছবি বেচে রোজগার যেটুকু যা । দক্ষিণ কোলকাতার একটি ফ্ল্যাটবাড়ির নীচের তলার একটি ঘর এখন তার ঠিকানা । নামী শিল্পীদের কাছে সমাদৃত হলো উমেশের একটি ছবি । মহাভারতের ও রামায়ণের সব চরিত্রের সংযোগে একটি অসাধারণ কাহিনী বর্ণনা করেছে উমেশ । ক্যানভাসের সামনে দাঁড়ালে মুগ্ধ হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেতে পারে । অ্যাকাডেমি , কলামন্দির হয়ে আরও সব নামী জায়গায় প্রদর্শনে ছবিটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হলো । একদিন নিজের ঘরে বসে হঠাৎ একটি অজানা নম্বরে ফোন , " হ্যালো উমেশ বিশ্বাস বলছেন ? " " হ্যাঁ বলছি বলুন । " " আমি রাগিণী চ্যাটার্জী । আমার জেঠু মোহন চ্যাটার্জী একটি অ্যাড এজেন্সিতে কাজ করেন । তো আপনার কাজ দেখে উনি ভীষণ ইম্প্রেসড । কয়েকটা বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংয়ের ছবি যদি আপনি ... " " ওহো আপনি মোহনবাবুর ভাইঝি । উনি তো কালই এসেছিলেন কলামন্দিরে । উনি এমন প্রস্তাব দেবেন আমার মতো একজন সখের আর্টিস্টকে এতো স্বর্গ পাওয়া ম্যাডাম ... " " এ কি বলছেন ! আপনি যা এঁকেছেন তা একদশকের শ্রেষ্ঠতম বলা হচ্ছে । আপনি তবে রাজি তো ? " " অবশ্যই । " মোহনবাবুর অফিসে গিয়ে উমেশ দেখে ব্যাপার আরও কিছু গভীর । বিজ্ঞাপনের কাজ হয় বটে তবে মোহনবাবু তাঁকে বলেন , " ভারতে মোট ১২২ টা বড়ো প্রতিষ্ঠানে সাজানোর জন্য ছবি লাগবে । আমার কোম্পানি এই কাজটিও করে থাকে বিজ্ঞাপনে পাশাপাশি । আই.টি.সির দুটি হোটেলের দায়িত্ব তোমায় দিলাম । " চমকটা এতটাই ছিলো যে মুখ দিয়ে কথা সরছিলো না উমেশের । তার অবাক চাহনি দেখে মোহনবাবু বলেন , " আরে এত অবাক হচ্ছো কেন ? তোমার কাজ দেখেই ওরা সম্মতি দিয়েছে । " কাজ শুরু করে দিলো উমেশ । রোজগারও হলো প্রচুর । নাম হলো দেশম​য় । কিন্তু এতকিছুর ভিত্তি ছিলো তার সেই দুটো ঘরের ফ্ল্যাট । তার সব আঁকার সরঞ্জাম , তার এতবছরের মেহনতের সব রহস্য ওই ঘরেই । এমনকি তার এই দুই হোটেলের কাজের প্রাথমিক স্কেচগুলোও এই ঘরেই বসে তৈরী । তারপরই তো হোটেলে গিয়ে সেগুলোর বাস্তবায়ন । ও রাগিণীর কথা বলা হয়নি অনেকক্ষণ । ইতিমধ্যে রাগিণীর সাথে উমেশ ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে । রাগিণী বীণা বাজায় । জেঠুর কাছেই মানুষ । তারও ছোটোবেলায়ই বাবা মা ছেড়ে গেছে তাকে । স্টেজ শো তো করেই , মাঝেমধ্যেই রবীন্দ্র সদন , নজরুল মঞ্চে শো থাকে । একদিন কাজ থেকে ফিরছে সরোবরে দেখা করার কথা বলে উমেশকে রাগিণী । " কি মশাই , কাজে এত্ত বিজি যে আমাকে ভুলেই যাচ্ছেন যে ! " " রেগো না রাগিণী , মাথায় দাও চিরুনি । " বলে নাকটা ধরে নাড়িয়ে দিলো উমেশ । " শোনো না তোমায় আজ একটা কথা বলবো বলে ... " " এই শোনো না , জেঠুকে এই এই কাগজগুলো দিয়ে দিও না ... " " সে হবে ক্ষণ । তোমায় কিছু ... " " আর বোলো কিছু রং আনানোর ব্যবস্থা করতে হবে ... এখানে পাচ্ছি না । " " ওফ হো ... তুমি যে দেখছি আমার কথায় কানই দিচ্ছো না ! আমি তোমায় ভা ... " " ভালোবাসি ভালোবাসি , সেই সুরে কাছে দূরে ... " গান জুড়ে দিলো উমেশ । কাঁধে মাথা রেখে মুগ্ধতায় চোখ বুজে রইলো রাগিণী । গান শেষে উমেশ বললো , " কিন্তু রাগিণী , আমার ওই ছোট্টো ফ্ল্যাটে তুমি ... " " আহা ! এতো পয়সা কি জন্যে রোজগার করছো ? বড় ফ্ল্যাট কিনতে পারবে না ? " " তা পারবো কিন্তু ওই ঘরটা বড়ো পয়া । " " বেচবে কেনো ? ওটার সাথেও আরও একটা কেন আমাদের জন্য ! " " আচ্ছা , আমি দেখছি । " এরপর নতুন ফ্ল্যাট কিনলো উমেশ পুরোনো বাড়ির কাছেই । তবে এটা ৩ বেডরুম । সক্কাল সক্কাল পুরোনো ফ্ল্যাটে কাজ সেরে হোটেল উদ্দেশ্যে রওনা হয় উমেশ । মোহনবাবু উমেশ রাগিণীর বিয়ের তারিখ ঠিক করলেন । বিয়ের ডেটও এসে গেলো । এর মধ্যে মাঝেমধ্যে তার কাছে এক নম্বর থেকে ফোন আসতে লাগলো । খুব নিম্নরুচি সম্পন্ন অস্লীল বিজ্ঞাপনের জন্য হোর্ডিং করানোর জন্য ফোন । প্রাথমিকভাবে মতপোষণ করলেও বিজ্ঞাপনের নমুনা ফোনে পেয়ে মুহূর্তে না করেছিলো । কিন্তু তা সত্ত্বেও বারে বারে ফোন । এক দুবার তার প্রতি হুমকি । হুমকি বাস্তবে রূপও নিলো । ফুলশয্যার রাতে খবর এলো তার পুরোনো ফ্ল্যাটে আগুন । বন্ধু তপন এসে খবর দিয়ে গেলো । সুখের দিনে এমন এক খবরে সে পাগলের মতো হয়ে ছুটে গেলো সেই জ্বলন্ত ফ্ল্যাটের দিকে । সে একাই ঢুকতে যাচ্ছিলো তার ঘরে । লোকেরা তাকে টেনে ধরলো । হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করলো উমেশ । কলেজের প্রিয় স্যারের থেকে গিফট পাওয়া ক্যানভাস হোল্ডার থেকে নিয়ে তার ছোটবেলা থেকে ব্যবহার করা সব তুলি , বিদেশী প্যাস্টেল রং , দেশী জলরঙের প্যালেট , ১০০ এর ওপর ক্যানভাস - এসবকিছু মুহূর্তে ছাই হয়ে গেলো । সে ভেবে পেলো না কী করবে ? ইতিমধ্যে রাগিণীও বেনারসী সাজে এসে দাঁড়িয়েছে । উমেশকে সে বোঝালো যে এগুলো সে আবার কিনতে পারবে তাই যেন ভেঙ্গে না পড়ে । উমেশ মন থেকে একেবারে ভেঙ্গে গেলো । কাজের জন্য নতুন জিনিসপত্র কিনলেও সেই উৎসাহ আর তাগিদ রইলো না । এর মধ্যেই ঘটে গেলো আরও একটা ব্যাপার । একদিন সকালে নিজের নতুন ফ্ল্যাটেই বসে ছবির কাজ করছে । হঠাৎ ফোনে দু-তিনটে পরপর মেসেজ ঢুকতে উমেশ বলে , " রাগিণী দেখো তো কী মেসেজ ? " " হ্যাঁ দেখছি । উমেশ .... এ কি ? এ কি হলো ... তোমার ব্যাঙ্ক থেকে ৫লক্ষ তোলা হয়েছে , তুমি কোনো ট্রানস্যাকশন করেছো ? " " ৫ লক্ষ টাকা মাথা খারাপ নাকি ... আমার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সই তো ওটা এখন । কই দেখি ? " মেসেজ দেখে চমকে গেলো উমেশ । তার অ্যাকাউন্টে ৫ লাখ উধাও । সেদিন ভি.আই.পির ধারে প্রথম একটা ছোটো এ.টি.এমে প্রয়োজনে টাকা তুলেছিলো । এটা কি তারই ফল ? স্কিমিং এর অভিযোগ দাখিল হলো কারণ জ্ঞানবশত কাউকেও এ.টি.এম পিন বলেনি সে । কাজ চালানো মুশকিল হয়ে গেলো । রাগিণী ওকে সামলাতে চাইলো কিন্তু সম্ভব হলো না । কাজে স্পৃহা নেই । হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে রাগিণী পাশে বা ঘরের কোথাও উমেশকে দেখতে না পেয়ে ভয় পেয়ে গেলো । জেঠুকে ফোন করলো । " জেঠু জেঠু উমেশকে কোত্থাও পাচ্ছি না ! " " বলিস কী ? দাঁড়া মা , আমি দেখছি । ও বেচারা মনে মনে শেষ হয়ে গেছে । ওর সব সম্বল শেষ , ওর সাধের স্টুডিও পুড়ে শেষ , ও তো দিশেহারা এখন । আমি দেখছি মা , কাঁদিস না শক্ত হ । " ওদিকে কাউকে না জানিয়ে পথে বেরিয়ে পড়লো উমেশ । সাথে শুধু দুটো তুলি আর জলরঙের প্যালেট ভরা ঝোলা । এধার ওধার ঘুরে বেড়াতে লাগলো । যেমন তেমন করে বর্ধমান পৌঁছে গেলো । চলে গেলো নদীয়া , চলে গেলো বাঁকুড়া । শেষে পুরী , ওড়িশা । প্রথম প্রথম বিনাভাড়ায় গিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়ছিলো । সে এবার পথে পথে দেওয়ালের গায়ে ছবি এঁকে বেড়ালো । লোকে দেখে টাকা দিতে লাগলো । কোনোভাবে দিন গুজরান হতে লাগলো । সে ভাবলো ভগবান বোধহয় তাকে বিস্তৃত বিশাল ক্যানভাস দিতেই এমন বুদ্ধি করেছেন । বাঁকুড়ায় প্রথম তাকে উমেশকে শিল্পী বলে চিনতে পারলো অমিতেশ বর্মণ । তিনি নিজেও এক প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী । বিদেশে তাঁর ছবি যায় । কোলকাতায় পৌরাণিক যে ছবি এঁকে উমেশ নাম করেছিলো তা তিনি দেখেছেন । তাঁর প্রতিনিধিও ছিলো ওখানে , তাঁরাই খবর দেন । উমেশ এসব শুনে ভাবলো অমিতেশ হয়তো কোনো সাহায্য করবেন , তাই তাঁর থেকেও পালালো সে । উপস্থিত হলো এক্কেবারে পুরী । খবর কিন্তু পৌঁছে গেলো অমিতেশের কাছে । তিনি ওড়িশা গভর্ণমেন্টে খবর দিলেন ডিটেলস সহ । পুরীর রাস্তার দেওয়ালে উমেশকে কাজ দিতে সরকার খোঁজ করতে লাগলেন । পাওয়াও গেলো । কিন্তু সে কাজেও দুদিনের বেশী মন টিকলো না । এদিকে অমিতেশ বাবু চিনতেন মোহনবাবুকে । ফোন করে জানালেন উমেশের কথা । ওড়িশা সরকারের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারা গেলো কোয়ার্টার থেকে উমেশ পালিয়েছে । উমেশ এক্কেবারে আদিবাসী এলাকায় চলে গেলো । তাদের সাথে মিলেমিশে এক হয়ে গেলো । তাদের থেকে নতুন নতুন উপাদানে রং তৈরী করে ছবি আঁকতে লাগলো । আদিবাসীরা মাথায় করে নিলো উমেশকে । এদিকে ওড়িশার প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামে উমেশকে পাওয়া যাওয়া দুষ্কর । তবু সার্চ চলতে লাগলো । কিন্তু বিফলে যেতে লাগলো । এদিকে রাগিণী অস্থির হয়ে উঠলো । জেঠুর কোনো সান্ত্বনাই আর কাজে আসছে না । খাওয়া দাওয়া অনিয়মিত । দুমাসে নিজের রূপ রং বদলে ফেললো । রুগ্ন চেহারা , উসকো খুসকো চুল । আরও দুমাস পর একদিন সকালে নিজের কুঁড়েতে উমেশ ঘুম ছেড়ে উঠে বাইরে বেরিয়ে এলো । এধার ওধার ঘুরে এক আদিবাসী বন্ধুর থেকে এক কাগজের টুকরো পেলো । তাতে একটা খবর পেয়ে চমকে গেলো । " চ্যাটার্জী অ্যাডের প্রধান মোহন চ্যাটার্জীর ভাইঝির পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু । " হেডলাইন দেখে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো । মুহূর্তে সব ছেড়ে কোলকাতার উদ্দেশ্যে এগোলো । ওটা দুদিন আগের কাগজ । তাই গিয়ে লাভ হলো না । আর মোহনবাবু স্ট্রোকে বিছানায় । চেনা লোকেরাও কেউ তাকে চিনতে পারলো না । তার মাথাভরা ঝাঁকরা চুল , ছেঁড়া ফতুয়া ... সেও চেনাতে চায় না সে কে । তার সেই ফ্ল্যাটের কাছে গিয়ে দেখলো পোড়া ঘরগুলো এখন সব ঠিক । নতুন লোক এসেছে । পরের ফ্ল্যাটেও বোধহয় মালিকানা গেছে বা থাকতেও পারে , ও নিয়ে তার আর কোনো আগ্রহ নেই । একবার রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে রবীন্দ্র সরোবরে তার অনেক দিনের চেনা জায়গায় গেলো । চারদিকটা এমন অপরিচিত হয়ে গেছে যে অন্তত এখানে যদি কিছু স্বস্তির হাওয়া মেলে । সরোবরে কয়েকটা বেঞ্চে বসে বসে ইতি উতি চাইতে লাগলো । লোকে বিকারগ্রস্ত ভাবতেই পারে । তার উপর হঠাৎ নিজের সাথে কথা বলায় লোকে পাগল বলে উঠলো । সে যেন শুনতে পেলো রাগিণীর কন্ঠস্বর , " মশাইয়ের শুধু আমায় নিয়ে ভাবার সম​য় নেই না । " " আহা রাগ কোরো না রাগিণী , মাথাও দাও চিরু... " শেষ করার আগেই ডুকরে কেঁদে উঠলো । দিগন্ত কাঁপিয়ে " আমার যেদিন ভেসে গেছে " রবীন্দ্রসঙ্গীতের শেষভাগটি গাইতে শুরু করলো । " সেদিন যে রাগিণী গেছে থেমে ..."


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama