STORYMIRROR

Nandita Mondal

Romance Others

3  

Nandita Mondal

Romance Others

সেদিন ছিল কোজাগরী

সেদিন ছিল কোজাগরী

9 mins
293


"চোখের আলোয় দেখে ছিলেম চোখের বাহিরে

অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহিরে ....."


গ্রিন রুমে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে এক মনে শুনে যাচ্ছে অনিকেত। নয়নার কন্ঠে যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। যে আকর্ষণের টানে নয়নার শ্রোতাবৃন্দ আবিষ্ট হয়ে থাকে তার গানে। গানের মাধ্যমে সবাইকে এক অন্য জগতে নিয়ে যাবার ক্ষমতা রাখে নয়না , সেখানে শুধুই মনোমুগ্ধতা, ভাবনাহীন আবেগ-অনুভূতিময় সে জগত। কিন্তু অনিকেতের আবিষ্টতা শুধু নয়নার গানে নয়, সমগ্র নয়নাতেই। নয়নার ঐ দীর্ঘ পল্লবিত বড় টানা টানা চোখে নিজেকে হারিয়ে ফেলাতেই অনিকেতের আনন্দ।


হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে অনিকেত চোখ খুলতেই দেখে সামনে নয়না

- কখন এলে?

স্মিত হাসি হেসে অনিকেত বলল- অনেকক্ষন। তোমার গান শুরু হওয়ার আগেই।

ন- যাক্ তুমি যে তোমার কাজ সেরে আসতে পেরেছ এই অনেক।

অ- তোমার গানের অনুষ্ঠান আর আমি আসব না ! আজ পর্যন্ত হয়েছে কখনও এমন ?

চেয়ার টেনে নিয়ে নয়না বসে পড়ল। তারপর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- জানো অনি (এই নামেই নয়না অনিকেতকে ডাকে) আজ গান গাওয়ার সময় কিছুতেই মনটা বসছিল না। মনটা বড় অশান্ত হয়ে উঠছিল। ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারছিলাম না।

অনিকেত নয়নার সামনে হাটু মুড়ে বসে নয়নার একটা হাত নিজের হাতে টেনে নিল। তারপর একটা কপট গম্ভীর ভাব নিয়ে বলল-

নিশ্চয় আমার জন্য বল? তুমি ভাবছিলে প্রতিবারের মতো এবারেও আমি শেষ সময়ে ঢুকব। কি ঠিক বলেছিতো?

নয়না বুঝতে পারল অনি কথা ঘোরানোর জন্য , ওর মুখে হাসি এনে তার ভাবনাটাকে লঘু করার জন্য একটা অপটু অভিনয় করল। নয়না হেসে উঠে পড়ল।

- থাক আর অভিনয় করতে হবে না। খুব বাজে অভিনয় করো। এই বলে নয়না খিল খিল করে হেসে উঠল।

অ- যথাজ্ঞা ! বেগম সাহেবা ! আর অভিনয় করছি না , এবার তবে ফেরা যাক। রাতে ডিউটি আছে। যেতে দেরী হলে আমার রুগীরা আবার গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। তাদের মান ভাঙানো আবার বড় কষ্ট।

দুজনেই প্রাণ খুলে হেসে উঠল।


       একবার রাউন্ড দিয়ে এসে অনিকেত নিজের চেয়ারে বসল। ডিউটিরত নার্সকে যাবতীয় নির্দেশ সে দিয়ে এসেছে। তার বসার জায়গার বিপরীতে একটা বড় জানলা। ঘরের ভেতরের বড় আলোটা নিভিয়ে মৃদু নরম আলোটা জ্বালালো । আঃ বড্ড নরম এই আলো । শরীরটা যেন শীতল হতে চাইছে। চেয়ারে শরীরটাকে এলিয়ে দিল অনিকেত। জানলার বাইরে শুক্লা একাদশীর চাঁদ। টেবিলের ওপর চাঁদের আলো এসে পড়ছে। জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে অনিকেত। নানা কথা তার মনে আসা যাওয়া করছে। চার বছরের সম্পর্ক তাদের। এই হাসপাতালেই সে প্রথম দেখে সে নয়নাকে । একটা ছয়- সাত বছরের ছেলেকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে এসেছিল। তারপর ও দেখে নয়নাকে এক অনু্ষ্ঠানে। সেখানে নয়নার গান শুনে এক ভালোলাগা তৈরী হয়। নিজে গিয়ে আলাপ করে নয়নার সাথে। বড় ভালো লেগেছিল এত সাজগোজ মেকআপের পেছনে সাদামাটা মেয়েটাকে। সেই শুরু হল তাদের ধীরে ধীরে একে ওপরের কাছে আসা। সব থেকে বেশি টানে তাকে নয়নার চোখ। যেন কি এক রহস্য আছে সেই চোখে। গভীর সমুদ্রের অপার রহস্য।

দীর্ঘ পল্লবিত চোখ দুটি যেন পরক্ষণেই গভীর সমুদ্রে রূপান্তরিত হল । অনিকেত সেই সমুদ্রে মাঝ বরাবর ভেসে আছে । আস্তে আস্তে সে যেন তলিয়ে যাচ্ছে। হাত পা ছুড়ে প্রাণপণ চেষ্টা করছে অনিকেত ওঠার কিন্তু যত চেষ্টা করছে তত তলিয়ে যাচ্ছে .........হঠাৎ করে এলার্মের শব্দে অনিকেত হকচকিয়ে ওঠে। একটু ধাতস্থ হয়। তারপর তার স্বপ্নের কথা মনে পড়তে সে নিজের মনেই হেসে ওঠে। ঘড়ি দেখে সাড়ে ছটা বাজে। চোখে মুখে জল নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে।


                 (দুই)



একটা হলুদ রঙের এমব্রয়ডারী করা হাউসকোট পড়া, ঢেউ খেলানো লম্বা চুল গুলোর কিছু বালিশের ওপর পড়ে বাকি বিছানা থেকে ঝুলছে। চোখের ওপর আগের দিনের অনুষ্ঠানে পড়া কাজলের হাল্কা আভা চোখ দুটিকে আরও সুন্দর করেছে। মৃন্ময়ী দেবী এসে জানলার পর্দা সরাতেই নতুন সকালের নতুন সূর্যের প্রথম আলো নয়নার মুখের ওপর পড়ল। হলুদ চাঁপা রঙের মুখটা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মৃন্ময়ী দেবী এসে নয়নার মাথায় হাত বোলাতেই নয়না তার ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে তার কোলে মাথা দিয়ে শুলো । মৃন্ময়ী দেবী তার নাতনীর মুখের দিকে স্থির ভাবে চেয়ে রইলেন। মুখটায় যেন অদ্ভুত এক মায়া জড়ানো। তার নাতনীর মুখটা যেন সম্পূর্ণ তার বৌমার আদলে। মা মরা মেয়েটাকে তো তিনিই মানুষ করলেন। ঠিক যেমনটি তার বৌমা চেয়েছিল। বাড়ির বড় ছেলে ঋষিকেশ , নয়নার বাবা যখন বিদেশে পুরোপুরি স্থায়ী হয় তখন নয়নার ভাই তার মায়ের পেটে। তাই তাদের রেখে একাই পাড়ি দিয়েছিল তাদের বাবা। দীর্ঘ অদর্শনে বহুদিনের অটুট সম্পর্কেও টান কমে আসে। মানুষের মন বড় অবোধ্য। নয়নার মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা আসে। কয়েকমাস থেকে তার ভাইকে নিয়ে চলে যায়। নয়নাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু নয়নার ঠাম্মা যেতে দেয়নি ; নয়না নিজেও যেতে চায়নি তার ঠাম্মাকে ছেড়ে, এ বাড়ি ছেড়ে, তার চেনা পরিচিত জনদের ছেড়ে বহু দূরে অজানা জায়গায় অচেনাদের ভিড়ে।

ন- কী দেখছো বলত তুমি ঠাম্মী?

মৃ- তোর মুখটা দেখলেই তোর মায়ের কথা মনে পড়েরে দিদিভাই। আজ যদি তোর মা বেঁচে থাকত লোকে দেখে বলত যেন দুই বোন।

নয়না তার ঠাম্মীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বাইরে জানলার দিকে মুখ ঘোরালো। কিছুক্ষণ উভয়েই চুপ। তারপর নয়না বলে উঠল- আচ্ছা ঠাম্মী বিদেশের মানুষেরা কী জাদু জানে? যে যায় সে আর ফেরে না কেন?

মৃন্ময়ী দেবী বুঝলেন ছোটবেলার আঘাত টা নয়নার ভেতরে এখনো অন্তঃসলিলা হয়ে বইছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন - নতুন জায়গা নতুন মানুষ নিয়েই সময় পেরিয়ে যায় । তাই পুরোন মানুষ গুলোকে মনে পড়ার সময় হয় না হয়ত।

নয়না সাথে সাথে বলে ওঠে- আমি কেন পারি না ঠাম্মী পুরোন মানুষদের ভুলতে ! বাবা ভাই যেমনটি পারে আমি তেমন পারি না কেন ?

মৃন্ময়ী দেবী নয়নার চিবুকটা আলতো করে ধরে একটু নাড়িয়ে হেসে বললেন- কারন তুই যে তোর মায়ের মতন। তা দিদিভাই তোমার সেই নতুন মানুষটার খবর কী?

নয়না লজ্জা পেয়ে তার ঠাম্মীর কোলে মুখ লুকালো ।



"আনন্দ আশ্রম" এই একটি মাত্র জায়গা হল নয়নার মন ভালো করার জায়গা। ছোটো কচি কাচাদের কলকল আর তাদের 'দিদি দিদি' ডাক নয়নার মন হাল্কা করে দেয়। এখানকার বাচ্চাদের গান শেখায় নয়না । অনিকেতও আসে এখানে। আজও আসার কথা। আজ তিন্নির জন্মদিন। তাই নয়না একটু ছোট্টো আয়োজন করেছে। তাই চারদিক শুধু হৈহৈ। ছোটো ছেলে মেয়েরা সব ছোটাছুটি করছে। এখানকার ছোটো ছেলে- মেয়েদের ছোটো ছোটো খুশি গুলো নয়না তাদের দেওয়ার চেষ্টা করে। নয়না বসে বসে দেখছিল বাচ্ছাদের মুখের হাসি গুলো। এমন সময় আশ্রমের ললিতা দি এসে পাশে বসল নয়নার ।

ল- (হেসে)তুমি কি সুন্দর করে বাচ্ছাদের মন জয় করে ফেলো। তুমি আছ বলেই এই বাচ্ছা গুলো একটু আনন্দ পায়।

ন- বারে ! আর তোমরা বুঝি নেই? তোমরা না থাকলে তো বাচ্ছা গুলোর মাথা গোঁজার জায়গা থাকত না।(একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে) বাপ - মা কি হয় , কেমন হয় তা তো এরা কোনো দিন জানলো না।

ল- বাপ- মা এর জায়গা কি কেউ নিতে পারে ? আমরা তো শুধু কর্তব্য টুকু করে যাচ্ছি।

কথাটা নয়নার অন্তরে গিয়ে লাগে। এমন সময় তিন্নি এসে নয়নার শাড়ির আঁচল টেনে জিজ্ঞাসা করে-

অনি দাদা কখন আসবে? অনি দাদা এলে তবে তো কেক কাটব? কখন আসবে ? খিদে পেয়ে যাচ্ছে যে। মুখটা কাচুমাচু করে তিন্নি।

তিন্নির মুখ দেখে নয়না হেসে ফেলে। সত্যিই তো অনিকেত আসতে দেরী করছে কেন ? উফফ সত্যি! এই মানুষটাকে নিয়ে আর পারা যায় না । কোনো জায়গায় ঠিক সময়ে পৌছায় না শুধু নিজের ডিউটি ছাড়া।

নয়না তিন্নির গাল দুটো টিপে দিয়ে বলে- ঠিকই তো ।এত দেরী হলে খিদে তো পাবেই । তোমার অনি দাদা এলে তাকে শাস্তি দিও কেমন? এখন চলো কেক কাটি। তিন্নি লাফাতে লাফাতে চলে গেল।


                 (তিন)


        কালের প্রবাহমান ধারায় দিন এভাবেই কেটে যায়। নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে অনিকেত - নয়নার চার হাত এক হয়। মধুচন্দ্রিমায় এসেছে তারা এক ছোটো পাহাড়ী গ্রামে । সামনের পাহাড়ের ওপর পূর্ণিমার লাল বড় চাঁদ , তার ওপর দিয়ে তুলোর মতো পুঞ্জিকৃত মেঘ গুলি ভেসে চলে যাচ্ছে। জ্যোৎস্নার আলোয় চারদিক অদ্ভুত সুন্দর মায়াময় হয়ে উঠেছে। মনোরম শীতল হাওয়া তাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে।নিজের চাদরের মধ্যে নয়নাকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরল অনিকেত । অনিকেতের উষ্ণ ছোঁয়ায় এক শিহরণ জাগে নয়নার মনে- শরীরে।


আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে

বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ॥

যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে--

এই নিরালায় রব আপন কোণে।

যাব না এই মাতাল সমীরণে ॥

আমার এ ঘর বহু যতন ক'রে

ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।

আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে

যদি আমায় পড়ে তাহার মনে

বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ॥


অ- কতদিন পর একান্তে তোমার গান শুনলাম নয়না । নয়না অনিকেতের বাহুর ওপর মাথা রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। নয়নাকে চুপ থাকতে দেখে অনি ঠেলা দেয় নয়নাকে ।

ন- এই সুন্দর মুহুর্ত গুলোকে অনুভব করতে দাও অনি।

দুটি মানুষের উষ্ণ ঘন নিঃশ্বাসে মুহূর্ত আরও গভীর হয়ে ওঠে ।

আদরে -ভালোবাসায়, রাগ- অভিমান খুনসুটিটে নয়না - অনিকেতের জীবনতরী পাল তুলে সময়ের স্রোতে বয়ে চলেছে। নয়না ঠিক করেছে আশ্রমের বাচ্ছাদের নিয়ে অনুষ্ঠান করবে। সেই মতো চলছে প্রস্তুতি।


     তাড়াতাড়ি ঘড়ি দেখে নিল অনিকেত । আজ নয়নার বহু আকাঙ্ক্ষিত আশ্রমের বাচ্ছাদের নিয়ে অনুষ্ঠান। এর জন্য নয়না অনেক পরিশ্রম করেছে। বারবার সে অনিকেতকে বলেছে আজ যেন সে দেরী না করে। কোনো অজুহাত চলবে না আজ। অনিকেত ও সেই মতো ডিউটি সেরে হাসপাতাল থেকে বেরোনোর জন্য তৈরী হল। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে অনিকেত একবার আকাশের দিকে চেয়ে দেখল। পড়ন্ত বৈকালে গোধূলি তার লালচে আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। একটা আড়মোড়া ভেঙে সে নিজের গাড়ির দিকে এগোতে যাবে। এমন সময় তার চোখ যায় এক পলিথিন এ মোড়া একটা পুটলি ওপর। কয়েকটা কুকুর ঘিরে দাড়িয়ে আছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে কৌতুহল বশত নিজেই এগিয়ে যায় অনি। গিয়ে যা দেখল তাতে তার ভেতরটা আঁতকে উঠল।



' তুমি যে ভাবে পারো ব্যবস্থা করো। এতদিন আমি ওর যত্ন নিলাম দেখভাল করলাম আর আজ হোমে পাঠাতে হবে বললেই হল! আমি ওকে হারাতে চায় না। ' - বলে নয়না কাঁদতে কাঁদতে বিছানার ওপর বসে পড়ল। অনিকেত নয়নার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে বোঝানোর চেষ্টা করে - 'তুমি কেন বুঝছ না? চাই বললেই পাওয়া যায় না । অনেক নিয়ম আছে, পদ্ধতি আছে। তারপর তুমি তাকে পেতে পারো। তার ওপর বাচ্ছাটা দৃষ্টিহীন। আর এর মধ্যে যদি বাচ্চাটার কোনো বৈধ দাবিদার আসে তখন কি করবে? '

ন- 'বৈধ দাবিদার মানে? বৈধ দাবিদার থাকলে কেউ ঐ একরত্তি মেয়েটিকে ঐ ভাবে ফেলে যায়! আমি চাই না ঐ বাচ্চাটা অনাথ পরিচয়ে বড় হোক।' কান্নায় কথা জড়িয়ে আসে নয়নার -'ও যে বড় মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছে গো আমায়'। কথাটা অনিকেতের হৃদয় স্পর্শ করে।


     নয়না যেমন তার মাতৃ- পিতৃহীন জীবনের সাথে ঐ ছোট্টো শিশুটির জীবনের একাত্ম অনুভব করত। তেমনি অনিকেতও নিজের জীবনে দমিয়ে রাখা শূন্যতার উপস্থিতি অনুভব করতে পারে। নয়নার জীবনে তাও মৃন্ময়ী দেবী ছিলেন। কিন্তু অনিকেতের জীবনে? তারও তো পরিচয় ছিল একসময় 'অজ্ঞাত পরিচয় শিশু'। তাকেও যদি কেও এই ভাবে মায়ায় জড়িয়ে ফেলত তাহলে হয়ত তার শৈশব- কৈশোর অন্যরকম হত। বহুদিন পর নিজের জীবনের অতীত ছবি ভেসে ওঠে স্মৃতিপটে, নিজের অজান্তেই কখন চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। তাই অনিকেত ও এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। 

      দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর আজ 'দৃষ্টি'কে নিয়ে বাড়ি ফেরে অনিকেত। হ্যা " দৃষ্টি " এই নামই তো রাখতে বলেছিল নয়না । নয়নার অ্যাক্সিডেন্ট এ যখন অনি ভেঙে পড়েছিল , আবার নতুন করে একা হয়ে যাবার ভয় আঁকড়ে ধরেছিল তখন নয়না তার শেষ সময়ে তার অনির কাছে কথা চেয়ে নিয়েছিল - ' আমার দৃষ্টিতে দৃষ্টি যেন তার নয়ন ফিরে পায়। ' আজ নয়নার দুই চোখের আলোয় দৃষ্টির নয়ন থেকে আঁধার সরে গিয়ে তার ভুবন আলোয় ভরে গেছে। যে নয়নার দুই চোখের গভীরতায় অনি নিজেকে হারিয়ে ফেলত , দৃষ্টির দুই নয়নের দ্বারা অনি তার নয়নাকে ফিরে পেয়েছে।

বিছানার এক পাশে শুয়ে আছে ছোট্টো দৃষ্টি। অনিকেত স্নেহমাখা চোখে নিষ্পলক চেয়ে আছে সুন্দর মায়া মাখা মুখটাতে । অনেক দায়িত্ব তার । ভবিষ্যতে তাকে হয়ে উঠতে হবে মাতা ও পিতা। জানলাটা খুলে দিল অনিকেত । একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল তাকে ছুয়ে। আজ কোজাগরী পূর্ণিমা। জ্যোৎস্নার আলোয় ধরা স্নান করছে। ঘরের ভেতর টেপ রেকর্ড থেকে ভেসে আসছে নয়নার বহু দিন আগের রেকর্ড করা গান-


"অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ--


তুমি করুণামৃতসিন্ধু করো করুণাকণা দান ॥


     শুষ্ক হৃদয় মম  কঠিন পাষাণসম,


প্রেমসলিলধারে সিঞ্চহ শুষ্ক নয়ান ॥


যে তোমারে ডাকে না হে তারে তুমি ডাকো-ডাকো।


তোমা হতে দূরে যে যায় তারে তুমি রাখো রাখো।


     তৃষিত যেজন ফিরে  তব সুধাসাগরতীরে


জুড়াও তাহারে স্নেহনীরে, সুধা করাও হে পান ॥


তোমারে পেয়েছিনু যে, কখন্‌ হারানু অবহেলে,


কখন্‌ ঘুমাইনু হে, আঁধার হেরি আঁখি মেলে।


     বিরহ জানাইব কায়, সান্ত্বনা কে দিবে হায়,


বরষ বরষ চলে যায়, হেরি নি প্রেমবয়ান--


দরশন দাও হে, দাও হে দাও, কাঁদে হৃদয় ম্রিয়মাণ



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance