Sanghamitra Roychowdhury

Romance

2  

Sanghamitra Roychowdhury

Romance

সেদিন বৃষ্টিতে

সেদিন বৃষ্টিতে

6 mins
1.5K


"জানি না কেন তোমায় এত ভালো লাগে" অপছন্দের সেই সেলফোনে টাইপ করল জয়ী... আর সেন্ডও করে দিলো। তারপর কথা হারিয়ে ফেললো জয়ী। আর কি টাইপ করবে খুঁজেই পাচ্ছে না যেন! সেলফোনটা হাতে নিয়ে জানালার বাইরে ওদের বাগানের মাথায় জমাট বাঁধা ঝুপসি অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইলো একদৃষ্টে। সন্ধ্যের অন্ধকার ঘন হয়ে রাত নেমেছে অনেকক্ষণ। ঘরের আলো জ্বালেনি ইচ্ছে করে। অন্ধকারেই যেন নিজের অন্তরাত্মার সাথে বোঝাপড়ার কথোপকথনটা ভালো হয়। বিছানায় বসে দেওয়ালে পিঠের ঠেকনা দিয়ে রেখেছে জয়ী। অন্ধকার ঘরে সেই মূহুর্তে জয়ীর অবয়ব যেন নেমে এসেছে জীবনানন্দের পাতা থেকে...... মুখ তার কবেকার শ্রাবস্তীর কারুকার্য....!


কাল বিকেলে বাড়ি ফেরার পর থেকেই জয়ী চেষ্টা ফোন করে অন্ততঃ একবার একটা কৃতজ্ঞতা জানায়, ঐ সুন্দর মূহুর্তগুলোর জন্য। কিন্তু পারে নি, কোথা থেকে রাশিকৃত সংকোচ এসে জয়ীকে আষ্টেপৃষ্ঠে যেন একেবারে নাগপাশ বন্ধনে বেঁধে ফেলেছে। তাই আজ এই সেলফোনের আশ্রয় নিয়ে জয়ী জানাতে বসেছে নিজের মনের খোলাপাতায় সঙ্গোপনে ফুটে ওঠা আখরগুলির কথা। কিন্তু এখানেও তো জয়ীকে সেই আড়ষ্টতাই ঘিরে ধরছে। তবুও মনে একরাশ জোরালো যুক্তি জড়ো করে জয়ী আবার টাইপ করা শুরু করলো সেলফোনের কি-বোর্ডে। আর টাইপ করে লিখতে লিখতেই জয়ী হারিয়ে গেছে স্মৃতির অতল গভীরে...... বেশ অনেকগুলো দিন-মাস পিছিয়ে।


রোজই কলেজ বা টিউশন সেরে ফেরার পথে জয়ী দেখে, পাড়ার গলিতে ঢোকার মুখের মোড়ে বেণুদার চা-তেলেভাজার দোকানের সামনে একধারে পাতা বেঞ্চিটায়, আর পাশের বন্ধ পড়ে থাকা একতলা পুরনো বাড়িটার ভাঙাচোরা রোয়াকে বসে এপাড়া ওপাড়া মিলিয়ে গোটাকতক বিশ্ববখাটে ছেলে ছোকরার একটা দল। রোজই বসে থাকে। অন্ততঃ জয়ীরা যতদিন এপাড়ায় ততদিন ধরে যখনই বিকেলে বা সন্ধ্যায় পাড়ায় ঢোকে বা বেরোয় পাড়া থেকে, এই ছেলেগুলোর দলটাকে ঠিক বসে থাকতে দেখে। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, বারোমাস, তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই বোধহয়।


জয়ীরা এপাড়ায় নতুনই বলা যায়, বছর দুয়েক হোলো। ছোট একটা বাড়ি বাগানসমেত, কাগজের বিজ্ঞাপনে খোঁজ পেয়ে যোগাযোগ করে বাবা-মা দেখে যায়, তারপর একদিন জয়ীকে নিয়ে আসে। আজন্ম ভাড়া বাড়িতে ঘুপচি দমবন্ধ করা ঘরে থেকে থেকে বিরক্ত, ওদের এই খোলামেলা বাড়ী আর আশপাশের মধ্যবিত্ত পরিবেশ খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছিলো। তারপর কিছুদিনের মধ্যেই বাড়িটা কিনে এপাড়ায় থাকতে আসা, এবং এসেই আবিষ্কার করা যে এপাড়ায় ওর কলেজের ক্লাসের আরো দুই বন্ধুও থাকে। ওরা অবশ্য এপাড়ার পুরনো বাসিন্দা। পাড়ার লোকেদের কিছু কিছু চিনেছে ওদের মাধ্যমেই। তবে ঐ মোড়ের মাথার আড্ডার ছেলেগুলোর সকলকে নামে না চিনলেও মুখে চিনে নিয়েছে জয়ী।


অবাক হয়েছে ওর বন্ধুদের মুখ থেকে জেনে যে ঐ আড্ডার মধ্যেকার কয়েকটি ছেলে তো স্কুল কলেজ ইউনিভারসিটির কৃতী ছাত্র। ক'জনের খেলাধূলায় পারদর্শিতা আছে। তবে ওরা ওখানে ওভাবে বসে বসে রোজ আড্ডা দেয় কেন? এটা জয়ীর মাথায় ঠিক ঢোকে নি। আরো ঢোকে নি মাথায় ওদের আড্ডা থেকে উড়ে আসা কিছু তির্যক মন্তব্য বা হাসির রোলই বা পথচলতি মানুষদের উদ্দেশ্যে কেন? এইভাবে রকবাজি আড্ডা দেওয়া ব্যাপারটা কে জানে কেন ঠিক মন থেকে মানতে পারে না! বড়ো কুৎসিত কুরুচিপূর্ণ লাগে। তাই হয়তো ঐ আড্ডার ছেলেগুলোর সম্পর্কে অবচেতনেই জয়ীর মনে এক তিক্ত বিতৃষ্ণা জন্ম নিয়েছে।


এছাড়া অপছন্দের আরো কারণ হোলো জয়ী ছোট থেকেই রক্ষণশীল গার্লস স্কুলে পড়েছে। তাই হয়তো জয়ীর মনে ছেলেদের সম্পর্কে একটা বিজাতীয় মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গী প্রোথিত হয়ে আছে। ওর বন্ধুরা এই নিয়ে জয়ীর সঙ্গে রসিকতা করতেও ছাড়ে না। এই সেদিন পর্যন্ত জয়ী তো সেলফোনও ব্যবহার করতো না। বাবা একরকম জোর করেই জয়ীকে সেলফোনটা কিনে দিয়েছে কলেজের থার্ড ইয়ারে এসে। বন্ধুদেরকে সবসময় সেলফোনে ব্যস্ত থাকতে দেখেই জয়ীর মনে একরকম অপছন্দ আর বিরাগ তৈরী হয়েছিলো, আসলে জয়ী বন্ধুদের সাথে বসে সামনাসামনি গল্প করতেই বেশী ভালোবাসে। বন্ধুত্ব যেন কিছুটা আলগা হয়ে যাচ্ছিলো ঐ সেলফোনে সবাই ব্যস্ত থাকার দৌলতে।


তবে আজ জয়ী আবিষ্কার করেছে মনের গভীরতম কোণের কিছু কিছু অন্তরঙ্গ কথা বলার জন্য যেন অপছন্দের ঐ সেলফোনটাই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আপনজনের ভূমিকা নিতে পারে। তাই জয়ী আজ সেলফোন নিয়ে বসেছে, একবার টাইপ করলো পরের লাইন, আবার ডিলিট করলো, আবার টাইপ করছে নতুন করে, মনোমত ভাবে মনের কথাটা ঠিক ব্যক্ত করতে পারছে না।

জয়ী আবার স্মৃতি পাথারে ডুব দিলো.....


এই তো সেদিন টিউশন সেরে বাড়ি ফিরছিলো জয়ী, সঙ্গে ছাতা নেই। এদিকে বড়ো বড়ো ফোঁটায় তেড়েফুঁড়ে বৃষ্টি পড়ছে চড়বড়িয়ে। অটো থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে পয়সা ফেরত নিতে নিতেই আধভেজা হয়ে গেলো জয়ী। গলিতে ঢোকার ঠিক সময়টাতেই আবার লোডশেডিং। অন্ধকারে মোড়া চারপাশ, দোকানে দোকানে জেনারেটরের আলো জ্বলবে, তবে একটু সময় নেবে। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে, চোখ চলছে না অন্ধকারে। বেণুদার দোকানে একটা মোম আর জ্বলন্ত গ্যাস ওভেন থেকে ছিটকে আসা এক চিলতে আলোয় জয়ী দেখলো আড্ডাটা চলছে ঠিকই, তবে সংখ্যায় কিছু কম, বেঞ্চিটা দোকানের ডালাতোলা ঝাঁপের তলায় টেনে নিয়ে বসেছে ওরা। দু-একজন খদ্দের যারা, তারা দোকানের ভেতরদিক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। জয়ী আড়চোখে দেখে নিয়ে মনে ভয় নিয়েই অন্ধকারেই গলির পথে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলো।


হঠাৎ পিছনে জোরে জোরে পায়ের শব্দ। সেই কোঁকড়া চুল লম্বা ছেলেটা একেবারে জয়ীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এক হাতে একটা খোলা বড়ো ছাতা, আরেক হাতে জ্বালানো মোবাইল ফোনের টর্চটা। গম্ভীর গলায় দু'টি লাইন,

"সঙ্গে তো ছাতা নেই, এত ভিজলে জ্বরে পড়ে তো পরীক্ষা টরীক্ষা একেবারে মাটি হবে গুড গার্লের।"

জয়ী ভারী বিরক্ত, এই গায়ে পড়া আলাপ জমানোর চেষ্টায়। তবে যতটা বিরক্তি মুখে দেখালো, ততটা বিরক্ত কিন্তু মনে মনে হয় নি। বরং ঐ গম্ভীর গলার স্বরে এক ভালোলাগার আবেশ তৈরী হয়েছে মনে।


পাড়ার বন্ধুদের কাছে আগেই শুনেছিলো, ছেলেটির নাম দেবব্রত, পাড়ায় সবাই দেবু বলেই ডাকে। পড়াশোনায় তুখোড়, খেলাধূলাতেও পটু, ইউনিভার্সিটি শেষ করে এখন সিভিল সার্ভিসের জন্য তৈরী হচ্ছে। মোবাইল টর্চের হালকা আলোতেও দেবব্রতর চোখের মুগ্ধতা পড়তে পেরেছে জয়ী।


এক ছাতার তলায় মৌনী দু'জনেই, হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি এসে গেছে। সঙ্গে ছাতা নিতে ভুলেছিলো জয়ী, এদিকে বৃষ্টি। তাই জয়ীর মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো চিন্তিত মুখে। জয়ীর সাথে দেবব্রতকে দেখে ডাকলো জয়ীর মা। পাড়ার ছেলে, পরোপকারী ভালো ছেলে বলে সুনাম খুব। চেনে জয়ীর মাও। আন্তরিকতার ডাক, "এসো দেবু, ভেতরে এসো, এককাপ চা খেয়ে যাও।"

দেবব্রত বিনীতভাবে বললো, "আজ না কাকিমা, আজ একটু কাজ আছে। ও ভিজে ভিজে আসছে দেখে ওকে একটু ছাতা ধরে এগিয়ে দিলাম। অন্য একদিন আসবো।"


জয়ী ততক্ষণে বারান্দায় উঠে পড়েছে, আবছা আলো অন্ধকারে দেবব্রত ছাতা মাথায় নিজের বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছে।

এরপরে কিছুদিন ধরে ফেরার পথে জয়ী দেবুর দেখা হতে লাগলো। টুকটাক দু'একটা কথা হতে থাকলো। প্রসঙ্গ কেরিয়ার, দেশ-কাল, এমনকি বেণুদার তেলেভাজা নিয়েও। এর বেশী কিছু নয়। মুগ্ধতা হয়তো দু'তরফেই, কিন্তু কেউই ভাঙছে না নিজের নিজের মনের ভাব একে অপরের কাছে।


তবে কাল একটা কাণ্ড হয়েছে। কলেজের পরে জয়ী একাই গিয়েছিলো একটা বইয়ের সন্ধানে কলেজ স্ট্রিটে। বইপাড়ায় ঘুরতে ঘুরতেই হঠাৎ মুখোমুখি দেখা দেবব্রতর সঙ্গে ঠিক সংস্কৃত কলেজের সামনের রাস্তায়। বর্ষা শেষ, তবুও ভ্যাপসা গরমে নাজেহাল মানুষ। জয়ীর ঘামে ভেজা লালচে মুখ দেখে দেবব্রত বললো, "গরম লাগছে খুব, একগ্লাস করে শরবত খেলে মন্দ হয় না।" দেবুর চোখে কৌতুক মেশানো দুষ্টু মিষ্টি আহ্বান। জয়ী এড়াতে পারলো না। অবশ্য জয়ী এড়াতে চাইছিলোও না, বরং উপভোগ করছিলো। তারপর প্যারামাউন্টে ঢুকে দু'জনে দু'গ্লাস পেস্তা লস্যি খেয়ে বাসস্টপের দিকে এগোলো। ওখান থেকে সোজা সোদপুরে আসার কোনো বাস নেই। বাস পাল্টে শ্যামবাজার হয়ে দু'জনে একসাথেই বাড়ির পথ ধরলো। পথে তেমন কথা হতে পারে নি। পাড়ার মোড়ের একটা স্টপেজ আগেই দেবব্রত নেমে গেছে বিদায় জানিয়ে। মুখে কিছু বলে নি, তবে জয়ী পরিষ্কার বুঝেছে, দেবব্রত বেণুদার দোকানের আড্ডাটাকে এড়াতে চাইলো, জয়ী সঙ্গে আছে তাই। জয়ীও মুখে কিছু বলে নি, তবে নিজের ষষ্ঠেন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করেছে অনেক কিছু..... অনেক অনেক কিছুই।

অনেকদিন আগেই দু'জনের মধ্যে ফোন নম্বর দেওয়া নেওয়া হয়েছিলো বটে, তবে দু'জনের কেউই কোনোদিন ফোনালাপ বা মেসেজ করে নি। দু'জনেরই ভাবখানা..."পহেলে আপ, পহেলে আপ।"

মনে হতেই জয়ী হেসে ফেললো নিজের মনে। আর সব দ্বিধা সংকোচ জড়তা ঝেড়ে ফেলে টাইপ করতে বসেছে মেসেজ, সেলফোনটা নিয়ে... নিজের মনের কথা। নিজের অনুভূতির কথা, স্রোতের বিপরীতে গিয়ে। আবার জয়ী লিখলো, "কালকের দুপুরটার জন্য অনেক ধন্যবাদ।"


জয়ী ভাবছে, ভাগ্যিস সেদিন বৃষ্টি হয়েছিলো, ভাগ্যিস সেদিন লোডশেডিং হয়েছিলো। আর ভাগ্যিস সেদিনই জয়ী ছাতা নিতে ভুলেছিলো। আজ বোধহয় শুক্লা সপ্তমী কিম্বা অষ্টমী হবে, অর্ধচাঁদ আকাশে। জয়ীর মনের অর্ধচাঁদটাকে পূর্ণচাঁদের রূপ দিতে জয়ী টাইপিং শেষ করে মেসেজটা সেন্ড করে দিলো।


জয়ীর অপছন্দের সেলফোনই আজ বুকে করে জয়ীর মনের কথা পৌঁছতে যাচ্ছে দেবব্রতর কাছে , জয়ীর দূত হয়ে, একটা নতুন সম্পর্কের সূচনা করতে। প্রথম দ্বিতীয় মেসেজ পাঠানোর পরই জয়ীর প্রাথমিক জড়তাটা কেটে গেছে। তৃতীয় মেসেজটাও জয়ী টাইপ করে ফেললো, "প্রিয় দেবব্রত, সোমবার দেখা কোরো বিকেলে চারটে নাগাদ, কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে। শুভেচ্ছান্তে....

তোমার জয়ন্বিতা।"

টিংটিং টিংটিং করে রিপ্লাই ঢুকছে জয়ীর সেলফোনে, বড়ো বড়ো স্মাইলি স্টিকার, বিরাট বড়ো থাম্বস আপ, তারপর ছোট্ট মেসেজ ছোট্ট একটা স্মাইলি দিয়ে, "ওকে".... সেন্ডার দেবব্রত।


শেষ নয়, কাহিনী সবে শুরু।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance