সবুজ স্বপ্ন
সবুজ স্বপ্ন


"আচ্ছা দাদু, গাছ আমাদের কষ্ট সত্যি বুঝতে পারে?" সরল প্রশ্ন সাত বছরের তিতলির।
রোজ বিকালে সে দাদুর সাথে এক ঘন্টা বাগানে কাটায়। দাদু গাছের গোড়ায় জল দেয়। আর ও স্প্রে করে দেয় গাছগুলোর গায়ে। ওর খুব মজা লাগে তাতে। ওর ভাষায় বলে গাছের স্নান করাচ্ছি। তারপর দাদু নাতনি দুজনে মিলে বড় গোলাপখাস আম গাছটার নিচে পাতা কাঠের বেঞ্চেতে বসে। সেখানে বসে রোজ চলতে থাকে তিতলির প্রশ্নের বন্যা। একমাত্র দাদুই ওর সব প্রশ্নকে এড়িয়ে না গিয়ে গুরুত্বসহ উত্তর দেয়। আজও চলছে সেই পর্ব।
"বুঝতে পারে বৈ কি? এই যে ধর এই গরমে আমাদের হাসফাস অবস্থা। তাই দেখেই তো ওরা সবুজ পাতা দোলায়। হাওয়া দেয় আমাদের।" দাদু মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে উত্তর দেয়।
"গাছেদের কষ্ট হলে, অসুখ হলে আমরা তা বুঝি?"
"কিছু কিছু বুঝি। আবার কিছু কিছু বুঝিনা। এই ধর, পোকা লাগলে গাছ নষ্ট হয়। সেটা বুঝি। কীটনাশক স্প্রে করে দি। গরম বাড়লে ওদেরও কষ্ট হয়। নুয়ে পড়ে, তাই বেশি করে জল দি।"
"যখন ঝড় হয়, ধূলা ওড়ে ... যখন বৃষ্টিতে ভেজে .... তখন ওদের কি আমার মতো মাঝেমধ্যে জ্বর হয় দাদু? কে ওদের গা ছুঁয়ে দেখে জলপট্টি দেয়?"
ছোট্ট তিতলির প্রশ্নটা শুনে এবার চুপ করে যান বৃদ্ধ ভবতোষ বাবু। নাতনিকে কি উত্তর দেবেন ওর জানা,নেই। গাছের মানুষের মতো হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, মস্তিষ্ক এসব আছে কিনা তাও ঠিকঠাক ওর জানা নেই। তিতলির ফুসফুস জন্মগতভাবে দুর্বল। তাই আজকালকার এই দূষিত বাতাসে বেশিক্ষণ থাকলেই, ওর জ্বর আসে। ঘরের বাইরে গাড়ি ঘোড়ার পাকা রাস্তায় বেরলেই অক্সিজেন মাস্ক পরতে হয়। তাও রক্ষে পাওয়া যায় না। বাচ্চা মানুষ, গুরুত্ব না বুঝে নিজেই কখনো কখনো খুলে ফেলে তা। তাতেই বিপত্তি বাড়ে।
মাঝেমধ্যে নিজের মনে বসে ভাবেন ভবতোষ বাবু, তিতলির এই অসুখ এতোটা বাড়ত না যদি আজকের এই উন্নত সভ্যতার দাপট সবুজকে মাড়িয়ে তার উপর রুক্ষমূর্তি ধারণ না করতো। আজকাল শান্তিতে এক টুকরো বাতাসে শ্বাস নেওয়া দায় হয়ে উঠেছে। একটা খাটি পুষ্টিগুণের ফল সবজি পাওয়া দুষ্কর। এমনকি সুষম খাদ্য থেকে শুরু করে শিশুদের গুঁড়ো দুধ ... সবেতেই ভেজাল। কৃত্তিমতা এক এক করে মানুষকে সবুজ থেকে নির্ভরতা সরিয়ে ওষুধের জালে জড়িয়ে ফেলছে ব্যবসার খাতিরে। কিছু মানুষের অধিক প্রপ্তির নেশায় লোভ আর লালসার শিকার হচ্ছে আবালবৃদ্ধবনিতা। তাই ভবতোষ বাবুর তাই মনে হয়, সবচেয়ে বড় দূষণ হয়েছে মানুষের রুচির আর রিপুর।
তাই নিজের বাড়ির এক কাটা জমির উপর উনি সযত্ন সহকারে গড়েছেন একটি বাগান। সে বাগানে একদিকে যেমন রয়েছে বড় বড় ফলের গাছ, তেমনি অন্যদিকে রয়েছে রকমারি ফুলের গাছের বাহার। আর প্রতিটি ছুটির দিনে এই বাগানে বসে ভবতোষ বাবু 'সবুজ স্বপ্ন' নামক আখড়াটিকে চালায়। সেখানে আশপাশের বাড়ি বা ফ্ল্যাট থেকে আসে তিতলির মতোই ক্ষুদে ক্ষুদে সব ভবিষ্যৎ যাত্রী। সপ্তাহে এক ঘন্টা করে এখানে থেকে ভবতোষ বাবুর থেকে ভবিষ্যৎ প্রজম্ম হাতে কলমে শিক্ষা নেয়, প্রকৃতিকে যত্ন করার। আর এক একটি অসাধারণ পুরানের গল্পের মধ্য দিয়ে প্রকৃতির মাহাত্ম বোঝার। হয়তো খুব কম তারা সংখ্যায়, তবু কয়েকজন মা বাবা তো অন্তত এই ইঁদুর দৌড়যুক্ত স্ট্যাটাসের যুগে, বাচ্চাদের এখানে কিছু সময়ের জন্য পাঠানোকে একটা গুরুত্বপূর্ণ একটিভিটি বলে মনে করছে। আর তিতলিও ওদের সাথে থেকে তখন একাত্ম হয়ে যায় সবুজের সমারোহে। এইভাবেই সবুজ স্বপ্নের শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ একটা পরিবেশে শ্বাস নেয় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে ওদের মধ্যস্থ কচি সতেজ প্রাণগুলো। এই দৃশ্য চাক্ষুষ করতে করতে ভবতোষ বাবু কখনো কখনো আনন্দে আত্মহারা হয়ে আবৃত্তি করে ওঠেন কবি সুকান্তের ছাড়পত্রের লাইনগুলো ....
"এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি,
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে, আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস।"
(সমাপ্ত)