স্বপ্নের ডানা মেলে
স্বপ্নের ডানা মেলে
ছোটবেলায় খেলনা প্লেন চালাতে চালাতে রেবার শখ হয়, বড় হয়ে পাইলট হবে। প্লেন নিয়ে নীল আকাশের মেঘের রাজ্যে পাড়ি জমাবে। আর তার এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অখিলবাবু। রেবা অখিলবাবুর একমাত্র মেয়ে। অখিলবাবু একটি সরকারি হাই স্কুলের গণিতের শিক্ষক। বরাবরই তিনি মেয়ের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন। অখিলবাবুর স্ত্রী গীতাদেবী'রও এ বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই। রেবা ছোটবেলা থেকেই খুব মেধাবী। স্কুলের টপারের পাশাপাশি খেলাধুলাতেও তুখোড়। তাছাড়াও রেবা খুবই লড়াকু একটি মেয়ে। কোনদিন অন্যায়ের সাথে আপোষ করেনি, তার এই দস্যিপনা কাজের জন্য তার মা-বাবাকে অনেকের কাছে মেয়ের নামে নিন্দাও শুনতে হয়েছে, শুনতে হয়েছে মেয়েকে লাগাম দেওয়ার কথা। কিন্তু অখিলবাবু আর গীতাদেবী কারো কোন কথাকেই সেরকম ভাবে গুরুত্ব দেননি।
পাশের পাড়ার ঘোষগিন্নী এসেছেন নাতনির অন্নপ্রাশনের জন্য নিমন্ত্রণ করতে। অখিলবাবু বাড়িতে ছিলেন না। গীতাদেবী আর রেবাই রয়েছে ঘরে। রেবা পাশের ঘর থেকে ঘোষগিন্নী আর তার মায়ের কথোপকথন সবই শুনতে পাচ্ছে।
------"নাতনি হয়েছে, খুব ভালো।"
------"আর ভালো, মেয়ে সন্তান হওয়ার যে কত জ্বালা, চেয়েছিলাম তো নাতি। সোনার আংটি বাঁকা হলেও ভালো।"
------"কেন দিদি? এরকম ভাবে বলছেন কেন?"
------"তা বলবো না? যা দিনকাল পড়েছে! খবরের কাগজ, টিভির চ্যানেল, খুললেই শুধু ধর্ষণ আর ধর্ষণ। জানেন তো দিদি ,মেয়েগুলো আজকাল খুবই উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠেছে। কত ছোট ছোট জামা কাপড় পরছে, ছেলেদের সাথে ঘুরতে যাচ্ছে। সে যাই হোক, আপনার মেয়েও তো উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে শুনলাম। তা বিয়ে দেবেন না?"
এইসব কথা শুনে রেবা পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। গীতাদেবী বুঝতে পেরেছেন রেবার কানে সব গেছে। এবার না ও দুটো কথা শুনিয়ে দেয়। রেবা কিছু বলতে যাবে, তখনই গীতাদেবী ওর দিকে চোখ গোল পাকিয়ে, ওকে চুপ করতে বলে। ঘোষগিন্নীর কথায় রেবার সারা শরীরটা ঘিনঘিন করতে থাকে। গীতাদেবীর জন্য ঘোষগিন্নীর কথায় সে প্রতিবাদ করতে পারেনি। ঘোষগিন্নী চলে যাওয়ার পর রেবা তার মা গীতাদেবীর ওপর রাগ করে বসে।
------"সব কথায় রাগ করতে নেই মা। জানি, উনি অন্যায় বলেছে, কিন্তু উনি যে আমাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ..."
গীতাদেবীর পুরো কথা না শুনেই রেবা আবার তার ঘরে চলে যায়। মা বুঝতে পারেন যে, তার মেয়ের রাগ হয়েছে। কারণ ও তো কোনদিনও অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে চায়না।
পরেরদিন পাড়ায় ঘটলো আরেক ঘটনা। অখিলবাবুর এক বন্ধু, শ্যামাপ্রসাদের মেয়ে মৌ। অনেকদিন ধরেই নাকি মৌ-কে অনেকগুলো ছেলে বিরক্ত করছে, বাজে কথা বলছে, এমন কি একদিন ভয় দেখিয়ে তাড়াও করেছে। এইসব কথা শ্যামলবাবু অখিলবাবুকে জানায়। তখন অখিলবাবু থানায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। রেবাও সেখানে যাবে দেখে বায়না করে। মায়ের বারণ সত্বেও রেবা তার বাবা, শ্যামলবাবু, আর মৌ এর সাথে থানায় যায়।
-----"ডাইরি করার আছে।"
-----"কি ব্যাপারে?"
-----"আমার মেয়েকে কতগুলো ছেলে প্রতিদিন বিরক্ত করছে, সেদিনকে তাড়াও করেছে।"
-----"তা অন্য কিছু করেনি তো?"
-----"মানে?"
-----"না মানে শুধু তাড়া'ই তো করেছে। তা গায়ে হাত তো দেয়নি। আর প্রেমঘটিত কোনও কারণ নেই তো? আপনার মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছেন?"
-----"থাক্। আপনার আর ডাইরি নিতে হবে না।"
-----"আহ্! রাগ করছেন কেন? ছেলেগুলোর নাম লিখে যান, আমরা দেখছি।"
থানার অফিসারের কথা শুনে মৌ এর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। মেয়ে হওয়ার অপরাধে দোষটা যেন ওরই। শ্যামাপ্রসাদবাবুও থানার অফিসারের সাথে কথা বলে হতবাক হয়ে যান। থানা থেকে বেরিয়ে রেবা ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করলো-"এটা তো স্বাধীন দেশ। এই স্বাধীন দেশে সত্যিই কি মেয়েরা স্বাধীন?" মেয়ের এই কঠোর বাস্তব প্রশ্নে অখিল বাবু সেদিনকে কিছুই বলতে পারেননি।
তারপর রেবা হঠাৎ করেই মনোস্থির করে বসে যে সে ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স'এ যোগ দেবে, ফাইটার পাইলট হবে। রেবার ঠাকুরদাও সেনাবাহিনীতে ছিল, কিন্তু রেবা এতদিন চেয়ে এসেছে সে পাইলট হবে, কিন্তু হঠাৎ করে মেয়ের এই বায়ুসেনাতে যোগদান করার বিষয়টাকে অখিলবাবু ঠিক মেনে নিতে পারেননি। কারণ যুদ্ধবিমান ওড়ানো খুবই চ্যালেঞ্জিং একটি বিষয়।
------"তা একজন সাধারণ পাইলটের কি বিমান উড়াতে কোন ঝুঁকি নেই?"
মেয়ের এই প্রশ্নে আবার অখিলবাবু শান্ত হয়ে যান। অবশেষে মেয়ের ইচ্ছাকেই গুরুত্ব
দেন। শুরু হল রেবার কঠিন পরিশ্রমের লড়াই।
জয়পুর থেকে ৮৯শতাংশ নম্বর পেয়ে বি টেক পাস করলো রেবা। বায়ুসেনার যোগদানের প্রস্তুতির শুরু সেখান থেকেই। যুদ্ধবিমান উড়াতে চায় রেবা। পাশাপাশি ছিল ওর গতির খিদে। জীবনকে গতিময় রাখতে যুদ্ধ বিমান চালাতে চেয়েছিল রেবা।
গ্র্যাজুয়েশন প্যারেডের পর ১৩ জন মহিলা ট্রেনি সহ মোট ১১৩ জন ফ্লাইট ক্যাডেট ফ্লাইং অফিসার হিসেবে যোগ দিলেন। এদিন বায়ুসেনা পেল আরও একজন মহিলা ফাইটার পাইলট, ফ্লাইং অফিসার রেবা বসু। বিমানবালা রেবা ভাবছে, হয়তো সেও একদিন উড়ে যাবে শত্রুর আকাশে।
পাঁচ বছর পর... রেবা নিজের স্বপ্ন পূরণের পাশাপাশি বাবা মায়ের মুখও উজ্জ্বল করেছে। সাথে গোটা দেশের। শত্রুদের ডেরায় বোমা ফেলে এসে রেবা বসু সারা দেশে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছেন। ১৫ই আগস্ট-র দিন 'বায়ুসেনা পদক' দিয়ে রেবাকে সম্মান দেওয়া হয়। তার সাহসিকতাকে কুর্নিশ জানানো হয়। মঞ্চে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার পেলেন রেবা।
প্রেস কনফারেন্স'এ স্বাধীনতা দিবসের দিন বিশেষ সম্মান পাওয়ার অনুভূতি রেবার কাছে জানতে চাওয়া হলে রেবা বলে- "কবিগুরুর কথায়- 'নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেহ নাহি দিবে অধিকার'। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে নারীরাই নারীদের শত্রু হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ঘরে ঘরে শাশুড়ি বৌমার অশান্তি। ঘরের বৌ'এর ওপর অকথ্য অত্যাচার, তাকে গাইতে দেওয়া যাবে না, চাকরি করতে দেওয়া যাবে না। আবার শেষ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে যাচ্ছেন বৃদ্ধ বাবা-মা। কেন? একুশ শতকের সমাজ যদি এমন বস্তাপচা ধ্যান-ধারণা নিয়ে চলে তবে মেয়েদের বেঁচে থাকার বাস্তবতা কোথায়? প্রথমে সব নারীদের সচেতন হতে হবে। একজন আরেকজনকে দোষ না দিয়ে তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। যদি কোন নারী অন্যায় করে সত্যিই সে শাস্তি পাবে। কিন্তু বিনা দোষে তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে না।
সমাজে ভালো কিছু করলেই তো সম্মান পাওয়া উচিত। তাহলে যেসব নারীরা দিনরাত পরিশ্রম করে তাদের ঘর সামলাচ্ছে তাদের তো কোনো সম্মান নেই। কে দেয় তাদের সম্মান? সতী-সাধ্বী প্রমাণ করতে সীতাকে কেন অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছিল? দ্রৌপদীকে কেন পাশা খেলার বাজি হতে হয়েছিল? কেন নারীকেই দিতে হয় তাদের আত্ম বলিদান? বেশিরভাগ কন্যা ভ্রুণ'কেই কেন পৃথিবীর আলো দেখতে বঞ্চিত থাকতে হয়? নারীকেই কেন বুকে পাথর চাপা দিয়ে খুন করতে হয় তার সুখের স্বপ্ন গুলোকে?ছোট পোশাক পরলে সমাজে দোষটা মেয়েদেরই হয়। কিন্তু সমাজ বুঝতে চায় না যে, তাহলে ওই ছোট্ট নিষ্পাপ শিশুগুলোর কি দোষ? ওই হিংস্র জন্তুগুলোতো পথশিশু কন্যা, পৌঢ়া, তিলোত্তমা ছাড়ছে না কোনো নারীকেই।
আমরা তো স্বাধীন। তাই স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে সেই সুযোগ নিচ্ছেন দেশের অনেক আমলারাই, সত্যের জন্য বলতে গেলে যেখানে ঘুষ দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেখানে আবার আমরা কিসের স্বাধীন? মাতৃত্ব ,নারী আন্দোলন প্রভৃতি তাহলে কথার কথা ছাড়া আর কি? একটি মেয়েকে জানি, যে অ্যাসিড আক্রান্ত হওয়ার পর জীবন্মৃতের মত দিন কাটাচ্ছে। কি অপরাধ তার? সে এক পুরুষের লালসার শিকার হতে চায়নি, এটাই তার দোষ? কথায় আছে, 'নারী তুমি অর্ধেক আকাশ' বলে পুরুষ যতই সোহাগ করুক, নারী যতক্ষণ না তার পায়ের মাটি শক্ত করছে ততক্ষণ তার মুক্তি নেই।
এবার রইল বাকি আমাদের কথা, মানে আমার মতো একটি মেয়ের কথা। আজ এই সম্মান পেয়ে আমি সত্যিই খুব খুশি। এই সম্মান আমি আমার বাবার জন্য পেয়েছি। যে আমাকে সবসময় সাহায্য করেছে। আমার ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিয়েছে। আমিও একদিন সাধারণ মেয়েই ছিলাম। কিন্তু স্বপ্নটা ছিল আকাশ ছোঁয়ার। আর এই আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে অনেক নারীকেই প্রথমে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছিল কারণ অনেকেই আগে মনে করতো, মহিলারা শারীরিকভাবে দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ বিমান চালানোর উপযুক্ত নন। বিশেষত অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায়। তারাই আজ ভারতীয় তরুণীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে যুদ্ধবিমানের দায়িত্ব তুলে দিচ্ছেন। কারণ আমরা লড়তে জানি। আর এই লড়াই অর্ধেক আকাশের লড়াই নয়। পুরুষের সঙ্গে টক্কর নয়। গতিকে ভালোবেসে তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া। যুদ্ধবিমান নিয়ে আকাশের বুক চিরে শত্রু ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার বাসনা দুচোখে।মুক্ত বিহঙ্গের মত আকাশে ওড়ার স্বপ্ন। যে স্বপ্নকে আমি সত্যি করতে পেরেছি।
সমাজ আর পরিবারের একটু সাহায্যতেই নারীদের স্বপ্নগুলো ডানা মেলে আকাশে উড়তে পারে, বাস্তবায়িত হতে পারে। আর সেই সাহায্য যদি না পাওয়া যায়, তাহলে তা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা নারীকেই করতে হবে।
'বল, বল, বল সবে, শত বীণা-বেণু-রবে,
ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।'
'জয় হিন্দ'"
রেবার এই বক্তব্যে আজ শুধু তার পরিবার নয়, পুরো নারীজাতি সহ, গোটা ভারতবাসীর বুক গর্বে ভরে উঠলো।