Swati Banerjee

Classics

3  

Swati Banerjee

Classics

স্বাধীনতা আন্দোলন

স্বাধীনতা আন্দোলন

4 mins
651


শ্রীচরণেষু শাশুড়িমা,

 এই চিঠি যখন তোমার হাতে তখন আমি অনেক দূরে ,তোমাদের নাগালের বাইরে |

 প্রথম দিন থেকে তোমাকে মা বলে ডাকতে আামার একটুও কষ্ট হয়নি|

তোমরাও আমাকে আপন করেই নিয়েছিলে|

 তোমার ছেলে বাইরে চাকরি করতো তাই কয়েক মাসের মধ্যেই আমি তার কাছে চলে গেলাম ,সাথে তুমি গেলে সংসার গুছিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে আসতে | বয়েসটা খুবই কম থাকায় তোমার কাছে সংসারের খুঁটিনাটি বুঝে নিতে আমার কখনো খারাপ

লাগেনি|

সপ্তাহ দুই পরে তুমি ফিরে এলে | তারপর শুরু হলো আমার একার গিন্নীপনা | ছোট্ট বাড়ি ,নতুন বর , নতুন জীবন | তোমার চিঠি পেতাম মাঝে মাঝেই ,সম্বোধন থাকতো..."কল্যাণীয়া বৌমা" ....আর তারপর উপদেশের বন্যা | চিঠির এমাথা ওমাথা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও দুটো মমতাভরা শব্দ দেখতে পেতাম না | ভাবতাম যাকগে ...সব মায়েরা তো একরকম হয় না ,ইনি হয়তো এমনই,এর মধ্যেই 'হয়তো' ওনার স্নেহ লুকিয়ে থাকে |

 প্রতিবছর পুজোয় বাড়িতে এসেই দেখতাম আমার জন্য নতুন শাড়ি কিনে রেখেছো | নতুন জীবন আমার ,মনে কতো আশা নিয়ে থাকতাম যে তোমার ছেলের সাথে গিয়ে নতুন শাড়ি কিনবো ! হায় !সে সাধ আমার অপূর্ণই রইলো | অবশ্য তোমার ছেলেরও ওসব কাজে বিশেষ উত্সাহ ছিলো না |

আমার কোন্ গয়না ভেঙে কোন নতুন গয়না হবে , কোথাও গেলে কি শাড়ি পরবো ,সবই তুমি ঠিক করে দিতে | তুমি চিরকাল স্বাধীন জীবন কাটিয়েছো ,তাই এসব নিজে করেই আনন্দ পেতে | কিন্তু কখনো ভেবে দেখোনি যে অন্যদের কিসে আনন্দ |

  এভাবেই আমি অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম | দিন গড়িয়ে চললো ,বাচ্চারা বড়ো হলো ,তাদের পড়াশোনার খাতিরে তোমার ছেলেকে বাইরে ফেলে রেখে চলে আসতে হলো |

  শুরু হলো আর এক নতুন অধ্যায় | দশবছর দুই বাচ্চা নিয়ে একা সংসার করে বোধহয় কিছুটা স্বাধীনতাবোধ জন্মেছিলো ,সেসব আবার মনের অতলে তলিয়ে গেলো |

  প্রতিদিন তোমাকে জিজ্ঞেস করতে হতো জলখাবার কি দেবো ,কিন্তু অন্যদের যা দিতাম তাই খেতো সে বিশেষ কিছু হোক বা সাধারণ | পুজোর বাসন যদি কখনো মেজেছি তো তুমি বলেছো ," আমি কি তোমাকে বলেছি বাসন মাজতে?" ,পুজো করে নিচে নামতে দেরী হলে যদি রান্না শুরু করতাম তো তাতেও তুমি রেগে যেতে | দুপুর দেড়টার পাঁচমিনিট আগে ভাত বাড়লে বলতে এতো তাড়া কিসের আর পাঁচমিনিট দেরী হলে বলতে" আজ কি কারুর খাওয়াদাওয়া নেই ? "তোমায় বুঝে উঠতেই পারিনি কোনোদিন |

 এমন নয় যে এসব রোজই ঘটতো কিন্তু ক্রমশঃ আমার মন ভেঙে গিয়ে নতুন মন গড়ে উঠছিলো যেটা অপেক্ষাকৃত কঠিন |

  স্বাধীনতা তোমার পরম প্রিয় জিনিস কিন্তু অন্যকে তা দিতে পারোনি | তুমি কি করে জানবে পরাধীনতা কি জিনিস |

    আচ্ছা একটা কথা বলো , আমি কি কখনো শখ করে কিছু কিনতে পারতাম না....সংসার তো তোমার ছেলেই চালাতো ,তাই না?

 কিন্তু পারিনি ,তোমার প্রভাব এতো প্রবল আার প্রকট যে আমরা সেখানে প্রচ্ছন্ন হয়ে যেতাম | সংসারের কোনো জিনিস তার স্থান পরিবর্তন করলে তুমি বাধা না দিলেও খুব যে খুশি হওনি তা বোঝা যেতো | তোমার ছেলে বাইরে থাকায় আর বাবার কোনো বক্তব্য না থাকায় তোমার ছত্রছায়াতেই 'বুড়ো' হতে লাগলাম |

  ক্রমশঃ আমার সহনশীলতা ,ধৈর্য্য বাড়ছিলো আর উচ্ছলতা কমে যাচ্ছিলো | তুমি কিন্তু কখনো আমায় লোকের সামনে অসম্মানও করোনি | কোনো সিদ্ধান্ত নিতে তুমি আমার সাথে আলোচনা করতে ঠিকই কিন্তু শেষ সিদ্ধান্ত হতো তোমার | সবাই তোমার জেদ আর মনের জোরের কাছে হেরে গিয়ে এটা মেনেও নিতো |

বয়েস তোমার বাড়ছিলো তাই স্বাধীনচেতা হওয়া সত্বেও সাংসারিক সব ব্যাপারে তুমি ক্রমশঃ আমার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলে , রান্না তুমিই করতে কিন্তু আমি সব গুছিয়ে দিতাম | তোমার পাশে আমায় অতন্দ্র প্রহরীর মতো থাকতে হতো | তোমার এতে হয়তো গর্ববোধ হতো যে তোমার বৌমা কতো ভালো কিন্তু আমার অস্তিত্ত্ব একটু একটু করে নিঃশেষ হচ্ছিলো|

হঠাত্ অসুখে পড়লাম বিছানায় ,এক দুদিন নয় ,টানা পাঁচ ছ'মাস পড়ে রইলাম | শুয়ে দেখতাম কি অক্লান্ত পরিশ্রম করে তুমি সংসারটা সুষ্ঠভাবে চালাবার চেষ্টা করছো | খুব কষ্ট হতো দেখে | উঠে দাঁড়িয়ে অনুমতি আদায় করলাম রান্নার , তুমি রাজী হলে কারণ তুমি নিজেও নিজের কষ্ট বুঝতে পারতে |

আবার সংসার তার পুরোনো গতিতে ফিরতে লাগলো একটু একটু করে | তোমাকে দেখে মনে হতো তুমি বোধহয় স্বস্তি পয়েছো | সে মনে হওয়া যে ভুল তা অচিরেই টের পেলাম |

সেদিন মাসি এসেছিলেন ,তোমরা চা খেতে খেতে গল্প করছিলে ,আমি ঘরে ঢুকতে গিয়ে কানে এলো ,মাসি বলছেন ,"দিদি এখন কি তাহলে বৌমাই সব রান্নাবান্না করে ?" তুমি উত্তর দিলে, "হ্যাঁ রে এখন আমি পরাধীন |"

  এর আগেও তোমার কথায় এই ধরণের মানসিকতার প্রকাশ পেয়েছি ,কারণ তুমি সবসময় বলতে ছেলের সংসারে আছো |

আচ্ছা, সংসার যে চালায় তারই হয়ে যায় কি?না গো , সবাই একসাথে একটা সংসার গড়ে তোলে | যাই হোক তোমার কথায় তখন কান দিইনি ,কিন্তু সেদিন কেনো কথাটা বড়ো কানে লাগলো | আমার একমাত্র সম্পদ অভিমান ,সে আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো |

  বুড়ো বাবাকে ঘরে বসিয়ে সব দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ছেলে তাকে আরাম দিলে সে সুপুত্র আর বৌমা যদি সংসারের কাজ নিজে করে শাশুড়িকে বিশ্রাম দিতে চায় সেটা স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া ?

   মেয়ে করলেও কি এটাই মনে হতো? তবে যে বলো বৌমা মেয়ের মতো ! ঠিকই বলো ,মেয়ের মতো' কিন্তু মেয়ে নয় | যাক্ এসব প্রশ্নের উত্তর আর আমার চাই না |

 আজ তোমাকে মা বলে ডাকতে পারলাম না ,কারণ আমার মা ডাকের মূল্য তুমি বুঝতেই পারোনি ,আশি পার করেও তোমার কাছে তোমার স্বাধীনতাটাই দামী রয়ে গেছে |

  আজ পনেরোই আগস্ট ,একদিন সমগ্র ভারতবর্ষ অনেক আন্দোলনের পর তার সন্তানদের রক্তের বিনিময়ে দু'শো বছরের দাসত্ব ঘুচিয়ে ফিরে পেয়েছিলো স্বাধীনতা| সমস্ত ভারতবর্ষের সাথে তুমি তোমার নিজের স্বাধীনতা দিবস পালন কোরো তোমার সংসারের সবাইকে নিয়ে |

 সংসারে থেকে আন্দোলন করা আর আমার হলো না | মনে কোরো এটাই আমার আন্দোলন আর প্রতিবাদ |

 হয়তো আমিও কোথাও সেভাবেই শান্তি খোঁজার চেষ্টা করবো |

প্রণাম জানাই...

     তোমার পুত্রবধূ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics