সাক্ষাতে ঈশ্বর-রবি
সাক্ষাতে ঈশ্বর-রবি


(বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ২০০তম জন্মদিনে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ।)
স্থানঃ স্বর্গের নন্দন কানন
রবি ঠাকুরঃ শুভ জন্মদিন পণ্ডিতমশাই।
বিদ্যাসাগরঃ এসো এসো রবি। ও সব জন্মদিন টন্মদিন নিয়ে এখানে আবার আলোচনা কেন?
রবি ঠাকুরঃ আপনি নমস্য, প্রাতঃস্মরণীয়, প্রতিটি বাঙালী আপনার কাছে ঋণী। আপনার আবির্ভাব লগ্ন বাংলার ইতিহাসে এক মহেন্দ্রক্ষণ। অতএব, এইদিন নিয়ে উৎসাহ তো থাকবেই!
বিদ্যাসাগরঃ কোন বাঙালীর কথা বলছো রবি? আজকের বাংলায় আর প্রকৃত বাঙালী কোথায়? যারা তোমার 'আমাদের ছোট নদী' পড়ে নি, পড়েছে - Humpty Dumpty', 'আতা গাছে তোতা পাখি' পড়ে না, পড়ে 'Twinkle Twinkle', এমনকি আমার 'বর্ণপরিচয়'কেও পড়ার আগে তার ইংরাজী অনুবাদ খোঁজে, তারা কিভাবে আবার বাঙালী হয়ে উঠলো? বিদেশী ভাষা আমিও পাঠ করেছিলাম, কিঞ্চিৎ বুৎপত্তি লাভও করেছিলাম। ইংরেজী সাহিত্যের 'Comedy of Errors' পাঠ করার পর মাত্র একপক্ষকালে তার বঙ্গানুবাদ করে, আমি 'ভ্রান্তিবিলাস' রচনা করেছিলাম জানো? আর এরা কিসের টানে নিজেদের মাতৃভাষাকে ভুলতে বসেছে বলতে পারো?
রবি ঠাকুরঃ আপনার ব্যথিত হৃদয়কে আমি উপলব্ধি করতে পারি। আপনার কথাগুলিও সর্বৈব সত্য। বাংলা ভাষা শিক্ষার মান দ্রুত নিম্নগামী। বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালীদের আগ্রহ ও আকর্ষণ কমছে - অন্তত শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে তো বটেই। এখন বাংলা ভালো করে বলতে পারার চেয়ে, ঠিকঠাক বলতে না পারাটাই তাদের গর্বের বিষয় বলে প্রতিভাত হয়। অথচ দেখুন, বিশ্বের সবথেকে মধুর ভাষার স্বীকৃতি কেবল বাংলাই পেয়েছে।
বিদ্যাসাগরঃ হ্যাঁ, তার জন্য তোমারই রচনা মূলত কৃতিত্ব দাবী করতে পারে। দেশের জাতীয় সংগীত 'জন গণ মন অধিনায়ক' র জন্যই তো এ বিরল সম্মান পেয়েছে বাংলা ভাষা। তোমার সৃষ্টির প্রশংসা তো সারা বিশ্বজুড়েই হয়ে থাকে।
রবি ঠাকুরঃ আপনার সৃষ্টি, কর্মকাণ্ড, বিদ্যানুরাগ, পাণ্ডিত্য এবং জনদরদী মননের দর্শন আমি সারাজীবন স্মরণে রেখেছি। আপনার জ্ঞান ও জনগণের মধ্যে তাকে পৌঁছে দেবার ঐকান্তিক প্রয়াস আমায় উৎসাহিত করেছে, আমি উদ্বুদ্ধ হয়েছি আপনার থেকেই। আপনি আমার মতই অসংখ্য বাঙালীর সার্থক পথপ্রদর্শক, গদ্যসাহিত্যের
প্রথম ও সার্থক স্রষ্টা। তবে আরও একটা বিষয় আছে বাংলা ভাষার খ্যাতি ও গৌরবের জন্য। তা' হলো - বাংলাই একমাত্র ভাষা যাকে রক্ষা করতে, ভালোবেসে শহীদ হয়েছে লক্ষ লক্ষ বাঙালী। আপামর দেশবাসীর ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ও বলিদানে একটা আস্ত দেশই তৈরী হয়েছে এই ভাষাকে ভালোবেসে।
বিদ্যাসাগরঃ নিজেদের সেই ঐতিহ্যকেই ভুলতে বসেছে আজকের বাঙালীরা। নিজেদের ভাষা শুধু না, নিজেদের ইতিহাসও ভুলতে বসেছে। কখনও তোমার সৃষ্টি, কখনও রাজা রাম মোহন রায়ের কৃতিত্ব আমার নামে জড়িয়ে যাচ্ছে। তোমাদের দুজনই বাংলা নবজাগরণের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র। বাঙালী আজ সেই নবজাগরণকেও ভুলেছে, আর আমাদের কার্যকলাপও।
রবি ঠাকুরঃ সত্যি কথাটা বলতে একটুও ইচ্ছে করছে না তবু বলছি - শতবর্ষ হয়ে গেলেই বোধ হয় সবাই ভুলে যায় মানুষকে, তার সৃষ্টিকে। কিন্তু বাংলা ভাষা যতদিন আছে, আপনাকে ভুলতে পারবে না বাঙালী - শিক্ষার শুরুই যে আপনার হাত ধরে। যেটুকু অবহেলা আজ দেখা গেছে তাদের মনে, হয়তো তাও একদিন নিশ্চয়ই কেটে যাবে। হয়তো আবার কোন নবজাগরণ বাঙালীর স্মৃতিভ্রংশকে রুখে দিয়ে নিজের ভাষার প্রতি আবার ভালোবাসা, শ্রদ্ধাকে জাগিয়ে তুলবে।
বিদ্যাসাগরঃ বড় ইচ্ছে হয় তোমার এই কথাগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে দেখতে। আমি জানি রবি - 'মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ'। আমিও সারাজীবন অনেক কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছি, বলা ভালো করতে বাধ্য হয়েছি। সারা বাংলার রাজ রাজারা যখন একজোট হয়ে বিরোধিতা করেছে, তখনও আমি নিরাশ বা আশাহত হইনি - বাংলার ভালো, দেশের, দশের ভালো, আমার অসহায় মা বোনেদের ভালোর জন্য আমি লড়াই করেছি প্রতি নিয়ত। আজও আমি নিরাশ হই না, তোমার মতই আমিও আশাবাদী - একদিন নিশ্চয়ই আবার বাংলা ভাষা তার ক্রমক্ষয়িত গৌরব আবার উদ্ধার করবে।
রবি ঠাকুরঃ সেই আশা আমারও পণ্ডিত মশাই। আপনার জন্মলাভের দ্বিশতবার্ষিকীতে পৃথিবীতে আপনার আমার মতই অনেক বাংলা ভাষা প্রেমী বাঙালী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আমাদের উত্তরাধিকার রক্ষার। আসুন, আজ আপনার শুভাশিস ঝরে পড়ুক সেই সব ভাষাসৈনিকদের ওপর। আপনি আশীর্বাদ করলে তা কখনই বিফলে যাবে না।
বিদ্যাসাগরঃ তুমি একথা বলছো? বেশ, তবে আমি শুভাশিস, শুভেচ্ছা জানাই তাদের। সকলের কল্যাণ হোক।