Sonali Basu

Inspirational

2  

Sonali Basu

Inspirational

রমার প্রাপ্তি

রমার প্রাপ্তি

7 mins
757


বাস থেকে নেমে রমা প্রতিদিনের মতো একবার বাজারে ঢুকলো, কিছু তরিতরকারি কিনে বাড়ি ঢুকবে। মা ফোনে বলে দিয়েছিল বাজার শেষ। এক হাসপাতালের নার্সের কাজ করে ও। শিফট ডিউটি বলে একটু সুবিধা। দোকানগুলো প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে তাও ও যে দোকানে বেশীরভাগ কেনাকাটা করে সেটা তখনো খোলা। ও দোকানের দিকে এগিয়ে যেতে গিয়েই দেখতে পেলো দোকানে বরুণ দাঁড়িয়ে। ওকে দেখতে পেয়েই এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো পা। তা কতদিন নাকি বছর পর ওকে দেখলো রমা? তা প্রায় বছর এগারো তো হবেই।

চোখের ওপর ভেসে উঠলো এগারো বছর আগের সেইসব রঙিন ঝলমলে সব দিন। একই পাড়া থেকে সকাল দশটা বাজলেই রমা আশা ব্রততী শিখা মণিকা এক ঝাঁক উচ্ছল কিশোরী প্রতিদিন এক সাথে পা মিলিয়ে সারদা বিদ্যাপীঠের পথে হাঁটা দিতো। সে বছর সব ক্লাস টেনে উঠেছে। রাস্তায় আরও অনেকে এসে ভিড়তো সেই দলে। মেয়েদের স্কুলের কাছাকাছি ছেলেদের স্কুল না হলেও দু একজন অতিউৎসাহী ছাত্র গেটের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে মেয়েদের দেখতো। এর অবশ্য কারণও ছিল। এই মেয়েদের দঙ্গলে তাদের দু একজনের প্রেমিকাও থাকতো। তারা প্রেমিকাদের দেখতে পেলে আকার ঈঙ্গিতে বা চোখের ইশারায় কিছু জানাতো আর বাকি বান্ধবীরা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস বা এসব নিয়ে হাসাহাসি করতো। রমার অবশ্য এসব ব্যাপারে মন ছিল না। ও পড়াশোনাটাই খুব ভালো বুঝতো আর ওটাই মন দিয়ে করার চেষ্টা করতো। বয়েসের স্বাভাবিক ধর্মে মন না দিয়ে শুধু পড়াকে আঁকড়ে ধরার একটা কারণ ছিল বৈকি। তা হল ওদের সংসারের পরিস্থিতি। বাবা সেরকম চাকরি করতো না, মুদির দোকানে খাতা লেখার কাজ। বাড়িতে ওরা চার ভাই বোন মা বাবা, যার মানে খাওয়ার মুখ অনেক কটা তার ওপর ছোট ভাই প্রায় অসুস্থ থাকে। রমা জানতো মাধ্যমিক পাশ দিয়ে ওকেও যে কোন উপায়ে সংসারের হাল ধরতে হবে। ও তাই কোনদিকেই দৃষ্টি দিতো না। যথা সময়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসলো ও আর ফলাফল বেরোলে দেখা গেলো ও মোটামুটি নম্বর নিয়ে পাশ করেছে।

কিন্তু ওকে যে কেউ খেয়াল করে তা ও জানতো না। ওদের পাড়ার মণিকার কাকু সরকারি হাসপাতালের কমপাউণ্ডার ছিলেন। রমা কাকুকে বলে রেখেছিল ওনাদের হাসপাতালে মাধ্যমিক পাশ মেয়েদের নার্সিং ট্রেনিং শুরু হলে ওকে জানাতে, ও চেষ্টা করবে ট্রেনিং নিতে। কাকু ওদের পরিস্থিতি জানতেন তাই কথা দিয়েছিলেন যতটা সম্ভব সাহায্য করবেন। মাধ্যমিকের ফল বেরোলে ওর সব বন্ধুরাই এগারো ক্লাসে ভর্তি হল। রমাও কিন্তু বসে থাকলো না, ও দু তিনটে টিউশনি যোগাড় করে নিলো পড়া আর হাত খরচের টাকা তুলতে। কারণ ও জানতো বাবা আর পারবে না ওর পড়া টানতে তার ওপর ওর বাকি ভাইবোনদের পড়াশোনা বাকি। কিন্তু পড়া চালিয়ে গেলেও ও মাঝেমাঝেই মণিকাদের বাড়ি যেতো কাকুর কাছে।

একদিন কাকু এসে জানালেন শুরু হয়েছে হাসপাতালে নার্সিং ট্রেনিং, সেই বিষয়ে ফর্ম দিচ্ছে। কাকু ওর জন্য একটা ফর্মও নিয়ে এলেন। তারপর কাকু বললেন “এটার সাথে তো আরও কিছু কাগজ লাগবে যা তোমায় সরকারি অফিসে ঘুরেঘুরে যোগাড় করে নিতে হবে”

রমা বলল “কিন্তু কাকু আমি তো সব জায়গা চিনি না, মানে কোনদিন তো সেভাবে বাড়ি থেকে বেরোইনি”

কাকু এক মুহূর্ত কিছু ভাবলেন তারপর আওয়াজ তুলে ডাকলেন “বরুণ… বরুণ”

“ভেতর থেকে উত্তর এলো, আসছি বাবা”

খানিক পরে বরুণ এসে হাজির। কাকু বললেন “এই শোন, আমি ঠিকানা লিখে দিচ্ছি তুই ওকে নিয়ে গিয়ে কাগজগুলো যোগাড় করতে সাহায্য করবি”

বরুণ উত্তর দিলো “ঠিক আছে বাবা”

বরুণকে এর আগে শুধু দেখেছে রমা, জানে ও মণিকার খুড়তুতো দাদা কিন্তু ওর বেশি কিছু না। এবার এই কাগজ যোগাড় করতে গিয়ে বেশ ভালোভাবেই আলাপ হল। সব গুছিয়ে হাসপাতালে জমাও করে এলো বরুণকে সাথে নিয়ে। এবার ক্লাস শুরু হবে। এরকম একদিন হঠাৎ বরুণ রমাকে বলল “একটা কথা বলবো, রাগ করবে না তো?”

রমা হাসি মুখেই বলল “না না রাগ করবো কেন?”

“এবার তো তোমার ক্লাস শুরু হবে তাছাড়া আমার সাহায্য করার কাজও শেষ তাহলে এবার থেকে নিশ্চই আমাদের আর দেখাসাক্ষাৎ হওয়ার কোন চান্স নেই”

রমা খানিকক্ষণ বরুণের দিকে তাকিয়ে রইলো, বুঝতে চেষ্টা করলো ওর চোখে দেখা হবে না ভেবে দুঃখের ছায়া ভাসছে কি না। ওর গভীর চোখের তারায় শুধু ওরই প্রতিবিম্ব। তারপর বলল “দেখা হতেই পারে যদি তোমার ইচ্ছে থাকে কারণ আমার তো বিশেষ সময় হবে না তোমার বাড়ি যাওয়ার। তাছাড়া কি কৈফিয়ত দেবো যাওয়ার কারণ হিসেবে”

বরুণের মুখে হাসি ফুটে উঠলো “তুমি রাগ করবে নাতো এখানে দেখা করতে এলে?”

“না তবে তোমার কোন কাজ বাদ দিয়ে এসো না তাহলে খারাপ লাগবে”

“না না সেসব শেষ করেই আসবো”

এরপর ক্লাস আর ট্রেনিংএর মাঝে ওদের দেখাসাক্ষাৎ হতে থাকলো। তখন দুজনে হয় কোন কফিশপে বসে কফি খায় আর গল্পগুজব করে নয়তো পার্কে বসে বাদাম খায় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ঝালমুড়ি খায় বা ফুচকা খেতে খেতে গল্প করে। আস্তে আস্তে রমা ওকে মন দিয়ে ফেলল। কিন্তু বরুণের মনে কি আছে তা ও তখনো জানে না। একদিন বরুণ নিজেই বলল “রমা তোমায় আমি ভালোবাসি। তুমি জানো না তবে যবে থেকে তুমি মণিকার সাথে যাতায়াত কর স্কুলের পথে তখন থেকেই আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি তবে আজ সাহস করে জানালাম”

রমা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল “আমিও তোমায় ভালোবাসি কিন্তু বরুণ তুমি কলেজ স্টুডেন্ট আর আমি স্কুলের। এখনো যেমন বিয়ের বয়েস হয়নি তেমনই কেউ নিজের পায়েও দাড়াইনি। আমাদের পরিবার এরকম নড়বড়ে সম্পর্ক মেনে নিতেও পারে আবার নাও পারে। অতএব সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে”

বরুণ উত্তর দিলো “আমি তোমাকে আমার মনের কথাটা জানালাম। আসলে আমার জানার উদ্দেশ্য ছিল তুমিও আমাকে পছন্দ করো কি না। তা জেনে আমার মনে যে টেনশন ছিল কেটে গেছে। তোমার কথাগুলো আমিও জানি রমা, ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেওছি। আর আমারও মনে হয় তুমি যা বলছো সেটা একদম ঠিক। আমাকে অন্তত একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে তোমার বাবার সাথে কথা বলার আগে”

এদের এই ভালোবাসার পর্বের মাঝে রমার ট্রেনিং শেষ হয়ে গেলো। ও এক প্রাইভেট নার্সিংহোমে কাজে ঢুকলো। কাজের ব্যস্ততা বাড়তে ওর আর বরুণের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ কমে গেলো তাছাড়া বরুণের কলেজের পাট শেষ হতে ও চাকরির পরীক্ষা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। রমা শুধু চাকরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল তা নয়। পরের বোন রুমার হঠাৎ ভালো সম্বন্ধ চলে আসাতে বাবা মা কেউ দেরী করতে রাজি হল না কারণ বেপাড়ার কোন বখাটে ছেলে ওকে বেশ কিছুদিন ধরে বিরক্ত করছিলো । বিয়ের খরচের ধকল বইতে হল রমাকে। তারপর ছোট ভাইকে নিয়ে কিছুদিন যমে মানুষে টানাটানি হল কিন্তু শেষ অব্দি তাকে ধরে রাখা গেলো না। ভাইটা চলে যাওয়াতে বাবা সেই শোক সামলাতে না পেরে পরলোকের পথে হাঁটা দিলো। এত সব ঘটনার ঘটার সময় বরুণ যতটা সম্ভব ওর সাথ দিয়েছে কিন্তু ওদের সম্পর্কটা আর লুকোছাপা ছিল না দুই পরিবারের মধ্যে। রমার মা বুকে বল পেয়েছিল এই ভেবে যে বড় মেয়ের হাত ধরার জন্য কেউ আছে কিন্তু বরুণের পরিবার ব্যাপারটা মেনে নিলো না। মণিকার কাকিমা মানে বরুণের মা বাড়ি বয়ে এসে অপমান করে গেলেন। ততদিনে বরুণ পোস্ট অফিসে চাকরি পেয়েছে, তার জন্য কত ভালো সম্বন্ধ আসছে। এরকম মেয়ের সাথে বরুণের মা বিয়ে দিতে রাজি নন। রমাদের বাড়িটা তো নিজেদের ছিল না ভাড়াবাড়িতে থাকতো এই ঘটনার পর ওরা রাতারাতি অন্য জায়গায় উঠে গেলো। রমাও অন্য বেসরকারি হাসপাতালে ভালো কাজের সন্ধান পেয়ে আগেরটা ছেড়ে দিলো। এরপর আর কোনদিন বরুণের সাথে দেখা হয়নি।     

আজ আবার এতদিন পর। কি করবে রমা? সব্জি কিনতে এগিয়ে যাবে নাকি এখান থেকেই ফিরে যাবে, অন্যদিন নিয়ে নেবে বলে। খানিক দাঁড়িয়ে কি মনে হওয়াতে ও এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো দোকানদারের সামনে, মুখে বলল “দাদা আমাকে দু কেজি আলু দেবেন, আর ওই ফুলকপিটা। আড়াইশো গ্রাম কুমড়ো, বেগুন ওই পালংএর আঁটি পাঁচশো গ্রাম মুলো আর হ্যাঁ একশো গ্রাম লঙ্কা” চোখে বরুণের দিকে না চাইলেও ও বুঝতে পারছিলো বরুণ ওর মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। ওর বলা শেষ হতে বরুণ বলে উঠলো “কেমন আছো রমা?”

রমা খুব শান্ত স্বরেই উত্তর দিলো “ভালো, তুমি?”

“চলে যাচ্ছে… তা তুমি কি এই সময় বাজার করো নাকি?”

“যেদিন যেমন সুযোগ হয় ডিউটি ফেরত”

“তুমি তো পুরনো নার্সিংহোমে কাজ করো না?”

“না নতুন একটা প্রাইভেট হাসপাতালে করি”

“দিদি আপনার বাহাত্তর টাকা হল” দোকানদার সব থলিতে ভরে দিয়ে বলল। টাকাটা দিয়ে থলি নিয়ে রমা বলল “তোমার সংসার কেমন চলছে?”

“একার সংসার, চলে যাচ্ছে”

“একার সংসার কেন? তোমার বাবা মা? বৌ কি বাপের বাড়ি গেছে?” হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলো রমা।

“বাবা মা তাদের নিজেদের বাড়িতেই আছে, ছোট ভাই আর তার বৌ তাদের দেখাশোনা করে। আমি বিয়ে করিনি, এক রুমের একটা ভাড়াবাড়িতে থাকি, স্বপাকে খাই আর ডিউটি করি”

“বিয়ে করনি কেন, তোমার মা তো তোমার জন্য ভালো পাত্রী খুঁজচ্ছিলেন…”

“তা খুঁজচ্ছিল কিন্তু আমি তো তার আগেই একজনকে জীবনসঙ্গী করবো কথা দিয়েছিলাম। সে’ই আমার ওপর ভরসা রাখতে না পেরে দূরে সরে গেলো। আমি অবশ্য তার অপেক্ষাতেই আছি এবং থাকবো। যদি ভবিষ্যতে সে আমার ওপর অভিমান ভুলে ফিরে আসে”

রমার মুখ থেকে একটাই কথা বেরিয়ে এলো “বরুণ……”

“কেন গেলে রমা, মা তোমাদের খারাপ কথা শুনিয়েছিল, পরে শুনেছি। তার জন্য আমি লজ্জিত কিন্তু তুমি তো এসে সব জানাতে পারতে”

“হয়তো পারতাম কিন্তু তোমার মায়ের সেই কথাগুলো আমাকে অভিমানে ভরে দিয়েছিল, আমি কোন পথ দেখতে পাইনি। আমি সত্যি দুঃখিত”

“আবার পারো না এসে আমার সংসারের আর আমার জীবনের হাল ধরতে? আমি যে পালছেড়া নাবিক হয়ে গেছি”

“সত্যি বলছো?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ”

পরের মাসেই ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেলো রমা বরুণের। ওর হাত থেকে সিঁথেই সিঁদুর পড়তে পড়তে রমা মনে মনে বলল তোমার ভালোবাসাই আমার সেরা প্রাপ্তি!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational