Souryadeep Roy Chowdhury

Classics

2.0  

Souryadeep Roy Chowdhury

Classics

রক্তের মূল্য( Price of blood)

রক্তের মূল্য( Price of blood)

8 mins
801



আয়নার সামনে বসে নিজেকে মনের মতো করে সাজিয়ে নিচ্ছে স্নেহা । আজ অনেকদিন পর আবার দেখা হবে সুমিতের সাথে । বেশিদিন হয়নি , এই পাঁচ-ছয় মাস হবে তাদের আলাপ , আর তার থেকেই প্রেম । অন্য সবার মতো একসাথে ঘুরতে যাওয়া , পার্কে বসে গল্প করা এসব করার ইচ্ছা থাকলেও সেসব আর করা হয়ে ওঠে না ওদের । সুমিত কিন্তু ঠিকই সময় দিতে চায় । কিন্তু সমস্যাটি সম্পূর্ণ স্নেহার দিক থেকে ।


আসলে মা মারা যাওয়ার পর প্রায় এক বছরের মধ্যেই বাবা তার অফিসের সেক্রেটারিকে বিয়ে করে বাড়িতে আনে । সেই থেকেই বাবার সাথে তুমুল অশান্তি করে বাড়ি ছেড়ে দূরে এক শহরে চলে আসে সে । অবশ্যই তার ভাইকেও সেখানে একা ফেলে আসতে সাহস পায়নি স্নেহা । বাবা খুব অশান্তি করেছিল । কারণ যে দুর্ঘটনায় মা কে হারিয়েছে সে , সেই একই অভিশপ্ত যাত্রা কেরে নিয়েছে তার ভাইয়ের চলার ক্ষমতা । আজ ২ বছর হল , সে বিছানায় শয্যাশায়ী । শুধু এটি নয় , সুস্থ সবল তার ভাইটি বাকশক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলে সেই ঘটনার পর থেকে । তাই বাবা আর নতুন আসা মায়ের সাথে ওকে রেখে আসার সাহস সে পায়নি । আসলে ওই ভাই ছিল ওর সবচেয়ে কাছের । মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে জন্মথেকেই যেন নিজে হাতে বড় করে তুলেছে সায়নকে । সায়নের তো দিদি বলতে প্রাণ । তাই যদি সে আগের মতো থাকত তাহলে হয়তো দিদির পাশে দাঁড়াতে পারত এই অসময়ে । হালিশহরে একটা বাড়িভাড়া করে থেকে ওরা দুজন। বাড়িতেই টিউশন পড়িয়েই দিন চলে যায় ওদের তার উপর মায়ের জমানো বেশকিছু টাকা-পয়সা আছে তার উপর প্রতিমাসে মামা নিয়মকরে একটা ভালো অঙ্কের টাকা পাঠিয়ে দেয় । আসলে ভাইকে এভাবে রেখে বাইরে যেতে মন মানে না স্নেহার । ছোটো থেকেই খুব আদরে বড় হয়েছে ভাইটি । তাই একটুতেই অভিমানী হয়ে যায় ।


সুমিতের ব্যাপারটা এখনো সায়নকে বলেনি । স্নেহা ভেবেছে একটা সারপ্রাইজ দেবে। যদি সবকিছু ঠিকঠাক চলে তাহলে একদিন সুমিতই তো সায়নের জামাইবাবু হবে । আজ অনেকদিন পর সাজতে বসেছে স্নেহা । সারাদিনের এতো কাজের চাপ – ভাইয়ের দেখাশুনা এসবের মধ্যে কেমন যেন হারিয়ে গেছে সে । তাই আজ আয়নার সামনে বসে নিজেকে যেন এক নতুন রূপে উপলব্ধি করল স্নেহা । সে আজ পড়েছে মায়ের সেই প্রিয় হলুদরঙের জামদানী শাড়িটা , সঙ্গে তার কমনীয় ঠোঁটে দিয়েছে হাল্কা লাল লিপস্টিক । কানে ঝুলছে একটা দারুণ সুন্দর ঝুমকো , কালো চুলের গহন অরণ্যে যেন লুকিয়ে আছে এক মাতাল করা সৌরভ । আজ নিজেকে আয়নায় দেখে নিজের প্রেমে পড়ে গেল স্নেহা । এসব সাজ খুব পছন্দ সুমিতের । এসব ভাবতে ভাবতে আচমকা কলিংবেলের আওয়াজে চমকে ওঠে স্নেহা। দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে সে । দেখে একগুচ্ছ গোলাপ হাতে সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুমিত ।


একটা মিষ্টি হাসি হেসে হালকা আলিঙ্গন করে দুজনে । সুমিত সোজা গিয়ে বসে সোফায় । টেবিলের জার থেকে জল ঢেলে গ্লাসটা এগিয়ে দেয় স্নেহা । হালকা হাসি টেনে স্নেহা বলল – তুমি পাসের ঘরে ভাইয়ের সাথে গিয়ে গল্প করো আমি একটু শরবত করে আনছি । এই গরম থেকে এলে । সুমিত খুব আনন্দের সহকারে তার ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে এগিয়ে গেল সায়নের ঘরের দিকে । আসলে সায়নের ব্যাপারটা ও পুরোটাই জানে । ও বলেছে বিয়ের পর সায়নও আমাদের সাথেই থাকবে । এটা না হলে হয়তো সুমিত-স্নেহার সম্পর্ক এতদূর আসতই না । সে যেই আসুক না কেন সায়নকে ছেড়ে দেওয়া কোনোদিন সম্ভব না স্নেহার পক্ষে । স্নেহা চলে যায় রান্নাঘরের দিকে ।


শরবতের গ্লাস হাতে স্নেহা যখন টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ায় তখন দেখে , সায়ন কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠেছে , চারিদিকে হাত নাড়ছে । পাশে রাখা বইগুলো ফেলে দিয়েছে । বিছানার চাদর লণ্ডভণ্ড । বালিশ পড়ে আছে মাটিতে । স্নেহাকে দেখেই সুমিত তৎক্ষণাৎ কানথেকে ফোনটা রেখে বলে – দেখো সায়ন কেমন যেন করছে । হয়তো আমাকে পছন্দ হয়নি ওর । স্নেহা তখনই সঙ্গে সঙ্গে ট্রে-সমেত গ্লাসদুটো টেবিলে রেখে দৌড়ে যেতে লাগল ভাইয়ের দিকে । কিন্তু তার আগেই সুমিত ওর ভাইয়ের পাশে বসে ভাইয়ের মাথায় হাত বোলানোর চেষ্টা করছে । এটা দেখে স্নেহার মনে একটা আলাদা অনুভূতির সঞ্চার হয় , কিন্তু ভাইকে এমন করতে দেখে ওর আজ সত্যি অবাক লাগছে । কেমন যেন খাঁচায় বাঁধা পাখির মতো ডানা ঝাপটাচ্ছে । সুমিত যত ওকে সামলে আদর করার চেষ্টা করছে ও ততো যেন ওকে ঠেলে দূরে ফেলে দিতে চাইছে । সুমিত বলল - ও আমাকে একদম সহ্য করতে পারছে না , আমি চলি আজ , পড়ে একদিন আসব । স্নেহা কেমন যেন ইতস্তত বোধ করে বলে – এমা না না , চল আমরা তাহলে পাশে আমার ঘরে গিয়ে বসি । আসলে এতদিন পর অবশেষে সুমিতকে এত কাছে পেয়ে ওকে বিদায় জানাতেও মন চাইছে না স্নেহার । তাই স্নেহা ভাইয়ের কাছে গিয়ে ভাইকে একটু সামলানোর চেষ্টা করে । কিন্তু ভাইয়ের কাছে যেতেই ভাই কোনো পরিস্থিতিতে দিদিকে ছাড়তে চাইছে না । কি যেন একটা বলতে চাইছে , কিন্তু পারছে না । আসলে ও তো ছোটো থেকে আর বাকরুদ্ধ নয় , সদ্য হারিয়েছে নিজের কথা বলার ক্ষমতা । হটাৎ স্নেহা একটা খাতা পেন দিতে যাবে যাতে সায়ন লিখে বোঝাতে পারে , ঠিক তখনই

সুমিত ডাক দেয় – স্নেহা একটু এদিকে আসবে ?

স্নেহা ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে এগিয়ে যায় সুমিতের দিকে । দুজনে শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে চলে যায় পাশের ঘরে । ঘরটা আকারে ছোটো হলেও বেশ সুন্দর সাজানো গোছানো । একটা পরিপাটি স্নিগ্ধ শান্তির ছাপ ফুটে ওঠে চারিপাশে । টেবিলে সুসজ্জিত একটা ফুলদানি , দেওয়ালের চারিপাশে ছড়িয়ে আছে স্নেহার নিজে হাতে তৈরি করা রকমারি অরিগামি । বিছানায় বসে এইসবই পর্যবেক্ষণ করছে সুমিত আর গল্প করছে স্নেহার সাথে । গল্পের মোহে দুজনেই যখন মত্ত তখন আস্তে করে স্নেহার কপালে হেলে পরা চুল সরিয়ে ওর কোমল ঠোঁটের ভাঁজে নিজের ঠোঁটের ছোঁয়া দিতে যাবে এমন সময় হঠাৎ কিসের যেন একটা আওয়াজ আসে পাশের ঘর থেকে। দুজনে ছুটে গিয়ে দেখে পাশে কাঁচের ফুলদানিটার ভাঙা টুকরোগুলোর পাশে সায়ন পড়ে আছে মাটিতে। সুমিত- স্নেহা দুজনে মিলে সায়নকে তুলে বিছানায় শোয়ায় । সুমিত তখন বলে – আজ আর এখানে থাকাটা ঠিক হবে না । স্নেহা তখন ভাইয়ের মাথার কাছে ভাইয়ের হাতটা ধরে বসে আছে । ইচ্ছা না হলেও আজকের মতো সুমিতকে বিদায় জানাতে বাধ্য হয় সে । দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেয় সুমিতকে । তারপর ঘরে ফিরে এসে দেখে , ভাই আবার স্বাভাবিকভাবে শুয়ে আছে । ভাইকে দেখে মনের মধ্যে আচমকা যেন একটা রাগের উদ্বেগ হয়ে ওঠে স্নেহার । সে রাগান্বিত কণ্ঠে ভাইকে বলে – আমার সারা জীবনটা তো পুরো জ্বালিয়ে দিলি , আজ এতদিন পর সামান্য একটু সুখের মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম সেটিও তুই এভাবে ধূলিসাৎ করে দিলি বল । তোর জন্য আমার ঐ সুন্দর চাকরিটা ছেড়ে বাড়ি বসে টিউশন পড়াতে হচ্ছে । কতো স্বপ্ন ছিল আমার জীবনে ,সবকিছু তো ছেড়ে দিয়েছি একে একে । এত তো বড় হয়েছিস । একটু তো বুঝবি নাকি আমার জীবনে কি কোনো সুখের স্বাদ পেতে দিবি না তুই ? সুমিতের সাথে একটু কথা বলছিলাম সেটাও পোষালো না তোর ? ঝড়ের মতো এসব বলে কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের বিছানায় গিয়ে নিজেকে ছুঁড়ে দেয় স্নেহা । বালিশে মুখ চেপে রেখে অঝোরে কাঁদতে থাকে । খুব কষ্ট হচ্ছে আজ ওর , রাগের মাথায় ভাইকে কি না কি বলে ফেলল ও । আসলে অনেক কষ্ট মুখ বুজে মেনে নিয়েছে ও । অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে ওকে । সুমিতকে আঁকড়ে আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছিল ও । ভাই ওকে মেনে নিতে পারছে না এতে হঠাৎ করে কেমন যেন আবেগপ্রবণ হয়ে গেছিল স্নেহা । আচমকা টেবিলে একটা ফোনের মেসেজের আওয়াজে হুঁশ ফেরে স্নেহার । ফোনটা হাতে নিয়ে অবাক হয় ,এতো সুমিতের ফোন । তখন দৌড়াদৌড়িতে ভুল করে ফেলে গেছে হয়ত। পরে ফিরিয়ে দেবে এইভেবে ফোনটা রেখে দিতে যাবে এমন সময় রুদ্রর মেসেজটার দিকে চোখ যায় স্নেহার । তাতে লেখা আছে --- “ ভাই কেমন লাগল এই মালটা ? আমি বলেছিলাম কিন্তু একটু ঘরোয়া গোছের হলেও তোর আগের গুলোকে ছাপিয়ে যাবে । আমরা কবে স্বাদ পাবো ? J J ” । মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরে স্নেহার । এ কি দেখল সে ! নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না ও । ওদের সম্পর্কের প্রথম দিন থেকেই এই রুদ্রকে একদম ভালো লাগত না স্নেহার । ও মানা করায় সুমিত বলেছিল , রুদ্রর সাথে নাকি আর কথা বলে না সুমিত । সুমিতের মুখের কথাকেই বিশ্বাস করেনিয়েছিল স্নেহা । কিন্তু এসব তো ওর কল্পনারও বাইরে । আচ্ছা ভাই কি এমন কিছু সন্দেহ করেছিল ? তাই জন্য ওইরকম আচরণ করল ? কেমন যেন পাগল পাগল লাগছে স্নেহার মাথা কিছু কাজ করছে না । ছুটে ভাইয়ের ঘরে গিয়ে যা দেখল তাতে ওখানেই যেন তৎক্ষণাৎ এক পাথরমূর্তিতে পরিণত হয়ে গেল স্নেহা । বিছানায় শুয়ে আছে ভাই , ডান-হাতে ধরা আছে ফলকাটার ধারালো ছুরিটা , আর বাঁ-হাতের শিরা থেকে ঝরছে রক্তধারা । সবকিছু যেন অন্ধকার লাগছে স্নেহার কাছে । কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না । তারপর দৌড়ে পাশের ঘরে গিয়ে নিজের ফোনটা নেয় । ফোন করার সাথে সাথে আসে অ্যাম্বুলেন্স । আসলে ওদের বাড়ি থেকে ১০ মিনিটের দূরত্বে থাকা নার্সিংহোমেই জানিয়েছিল সে ।


গাড়িতে রক্তাক্ত ভাই , একজন ডাক্তারের সাথে একা বসে স্নেহা । চোখ থেকে কোনো জল না ঝরলেও , ভিতরে বইছে প্লাবন । আসলে দুঃখ সহ্য করে করে অনেকটা শক্ত স্নেহা । বাড়ি থেকে আসার আগে ভাইয়ের পাশে রাখা ডায়েরীটা নিয়ে এসেছিল স্নেহা । ওখানে শুধু লেখা আছে , - “ দিদি ঐ লোকটা ফোনে একজনের সাথে তোকে নিয়ে খুব নোংরা নোংরা কথা বলছিল । ও ভালো না দিদি । ওর সাথে মিশিস না । কিন্তু আজ আমি জানতে পারলাম আমিই তোর জন্য কতো বড় বোঝা । মায়ের সাথে তখনই চলে গেলে পারতাম , তাহলে তোকে আর এত কষ্ট পেতে হত না । আমি চললাম দিদি ।” স্নেহা এখন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সায়নের দিকে । মনে মনে হয়তো বলছে , -- ভাই প্লিস একবারের জন্য তাকিয়ে হেসে ওঠ । একটিবারের জন্য । তোকে ছাড়া তো কেউ নেই আর এইদুনিয়ায় ।

গ্রীষ্মের দুপুরের শূন্যতার মধ্য দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন যেন এটাই বলতে বলতে এগিয়ে চলল - “ মানুষের মুখ থেকে একবার যে কথা বেরিয়ে যায়, তা শতধারালো তরবারির চেয়েও বেশি আঘাত হানে ।মাত্র দুমিনিটের জন্য রাগ সংবরণ করতে পারলে,অনেক সম্পর্কের পুনরুজ্জীবন হয়ে যায় ।"


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics