সময়ের মূল্য
সময়ের মূল্য


কোলকাতায় বেলেঘাটা এলাকার একটা দোতালা বাড়িতে আমাদের ছোট্ট সংসার । আমার নাম ইন্দ্রাণী সেন। কথাটা যে সময়ের তখন আমি একটা মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানিতে সিনিয়র ম্যানেজার ছিলাম । আমার স্বামী অলকেশ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্মী । আর আমাদের একমাত্র বাঁচার সম্বল ,আমাদের ছেলে অভিরাজ সবে কলেজে উঠেছে । ফার্স্ট ইয়ার কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র । আমাদের এলাকায় সেন বাড়ি বললেই সবাই একডাকে চেনে । আসলে ওর বাবা , মানে আমার শ্বশুরমশাই অবনীন্দ্র সেন ছিলেন এই এলাকার খুব নামকরা উকিল । দুই ছেলে অলকেশ আর সমরেশ এর জন্য এই বাড়ি বানান উনি। স্বপ্ন ছিল দুই ছেলেকে নিয়ে বেশ সুখেই কাটাবেন । কিন্তু সে সুখ বেশিদিন টেকেনি । ৫৬ বছর বয়সে ওনার মৃত্যুর পর শুরু হয় দুইভাইয়ের মধ্যে তুমুল অশান্তি । দীর্ঘ ২.৫ বছরের কোর্ট-কেসের পর ঝামেলা মেটে জমি ভাগাভাগির মধ্যে দিয়ে । আমাদের ভাগে আসে ওনার কিছু জমানো টাকা আর এই দোতালা বাড়িটা । আমাদের তিনজনের জন্য এই বাড়িটা খুবই প্রকাণ্ড হয়ে দাঁড়াতে থাকে । আসলে আমরা দুজনেই সকালে অফিসে চলে যাই আর রাত্রে ফিরি । ছেলেটাও সারাদিন কলেজ, টিউশন করে বেশিরভাগ সময়ই বাড়ির বাইরে থাকে। তাই আমরা ঠিক করি নিচসেইমতো কাগজে বিজ্ঞাপন দেই । এক সপ্তাহে অনেক লোকই যোগাযোগ করে । আসলে আমরা ছোটো একটা পরিবারকেই ভাড়া দেব - এটাই ছিল প্ল্যান ।অনেক খোঁজার পর একটি পরিবারকে অবশেষে ঠিক করি । নতুন নতুন বিয়ে করেছে । সাত্যকি রায় মুম্বাইতে একটা ব্যবসা করে আর আরশি রায় একজন চিত্রশিল্পী । ওর অনেক ছবি নাকি পুরষ্কার পেয়েছে, শিল্পীমহলে বেশ সুনাম আছে ওর । আসলে ওর জন্যই এখানে ঘরভাড়া নিতে হয়েছে। ওরা বলেই দিয়েছিল মুম্বাইতে অতো বড়ো ব্যবসা সামলে সাত্যকি হয়তো মাঝেমধ্যে আসতে পারবে না । বেশিরভাগ সময়টা এখানে একাই থাকবে আরশি ।
৫০০০ টাকা অগ্রিম জমা দিয়ে ২০১২ এর এপ্রিল মাসের ১ তারিখেই ওরাবেশ মিশুকে স্বভাবের মেয়ে আরশি। আসলে সদ্য সদ্য বিয়ে হওয়ায় গৃহবধূর ছাপগুলো এখনো পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠেনি ওর মধ্যে, অনেকটা যেন সদ্য যুবতি কন্যা আর নতুন বউয়ের ঠিক মাঝামাঝির একটা মেলবন্ধন বলা যেতে পারে । বেশ টানাটানা চোখ , কোমর পর্যন্ত ঘন কালো চুল , ফর্সা গায়ের রং , তার উপর অপূর্ব এক শারীরিক গঠন । স্বর্গের অপ্সরা যেন নেমে এসেছে আমাদের আঙিনায় । প্রথম কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের সাথে বেশ ভালো মিশে যায় মেয়েটা । আসলে আমাদের সাথে তো প্রায় দেখা হতোই না । আসলে আমার ছেলেও টুকটাক ছবি আঁকত আগে। এখন পড়াশুনার চাপে সব বন্ধ । হয়তো আমার ছেলে অভির সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে ওর সেইজন্যই। সব ভালোই চলতে থাকে । কিন্তু আচমকা ঐ মাসের ২৮ তারিখেই শনিবারে আরশি আমায় ডেকে যা জানায় তাতে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে । ও জানায় এই মাসের ৩০ তারিখেই ও ঘর ছেড়ে দেবে । অগ্রিমের যে টাকাটা ওরা দিয়েছিল সেটাও ও ফেরত চায় না । আমি তখন সবে অফিস থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে ওর ঘরে আসি । ঘড়িতে তখন ৬:৩০ । সেদিনের সমস্ত কথা শেষ করে যখন উঠি তখন ঠিক ৯:৫০ বাজে। আমার সারা শরীর তখন যেন শীতল বরফের মতো লাগছিল । পা-দুটো যেন মেঝেতে কেউ পেরেক দিয়ে আটকে রেখেছে এমন মনে হচ্ছিল । অনেক ভেবে নিজেকে সামলে সোজা গেলাম আমাদের বাথরুমে । বালতি ভর্তি ঠাণ্ডা জল গায়ে দিয়ে নিজেকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম । সেদিন তারপর যে কি হয়েছিল সেসব আর ঠিক মনেও নেই । সেদিন আমার আর আরশির সাথে যে কি কথা হয়েছিল তা আমি কাউকে আজ পর্যন্ত বলার সাহস পাইনি । আজ অনেক সাহস সঞ্চয় করে লিখতে বসেছি সেইরাতের কথা ।
সেদিন দুপুরে আরশি আমায় ফোন করে জানায় যে সে এই মাসেই ঘর খালি করে দিতে চায়। আমি তখন ওকে কারণ জিজ্ঞাসা করায় ও আমায় সন্ধ্যেবেলায় আসতে অনুরোধ করে । ওর ঘরে পৌঁছে আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করায় ও একে একে বলতে শুরু করে । একটাই শর্তে – আমাকে আগে ওর পুরো কথা শুনতে হবে ।
আরশি বলে - “এই বাড়িতে আসার কয়েকদিনের মধ্যেই আমার সাথে অভির একটা বেশ সুন্দর বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয় । সবার চোখে এটা সাধারণ মনে হলেও আমার কেমন একটা খটকা লাগে । আসলে ঐ যে বলে না ... দূরে কোনো ছেলে যদি কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে তাহলে একটা মেয়ে সেটা বুঝতে পারে । আর আমার মনে হয় আমাকে দেখতে খুব একটা খারাপও নয় । দুপুরে কলেজ ছুটির পরেই অভি আসতে থাকে আমার ঘরে ছবি আঁকার জন্য । কিন্তু ওর চোখের দৃষ্টি প্রায়ই আটকে যেত আমার শরীরের দিকে । বুকের ভাঁজ থেকে শুরু করে পেটের নাভি, সবকিছুই যেন ওর চোখের তুলি দিয়ে রাঙিয়ে তুলতে চাইত ।”
আমি রেগে গিয়ে বলে উঠি – “এসব কি যা তা বলছ তুমি ।ঐটুকু একটা বাচ্চা ছেলে।”
আরশি আমায় থামিয়ে বলে – “ দিদি রাগ করবেন না । আমি কিন্তু আপনাকে বলেছিলাম আগে আমার সব কথা শেষ করতে দিতে হবে । তারপর আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন । ”
আমি কোনোমতে রাগ সংবরণ করে জানাই – “আচ্ছা বলো।”
আরশি আবার শুরু করে – “আপনাদের মনে আছে একটি সপ্তাহে আপনারা দুজনেই অফিসের কাজে বাইরে ছিলেন ।আপনার নিশ্চয় মনে থাকবে, সেদিন দুপুরে অভির আমার ঘরে খাওয়ার কথা ছিল । আপনি জানেন সেদিন অভি কি বলেছিল আমায় ? ও আমার সারা শরীরজুড়ে চুমু খাওয়ার প্রস্তাব জানায় । আমার সাথে যৌন মিলনের কথা বলে ।”
আমি চেয়ার ছেড়ে তখনই উঠে দাঁড়িয়ে বলি – “ অভি আমাদের এত ভদ্র এত শান্ত । এই সকল কথা এই বয়সে সে কোথা থেকে জানলো । আমারই ভুল হয়েছিল একা একটা মেয়েকে এভাবে ঘর ভাড়া দেওয়াটা । নিজের শরীরের চাহিদা মেটাতে শেষমেশ একটা বাচ্চাছেলেকে ? ছিঃ ”
আরশি আমার কাছে এসে বলে – “ দিদি অভি আমার ভাইয়ের মতো আপনি কি করে ভাবলেন ওর সাথে আমি এরকম কিছু করব । আর অভি কিন্তু এখন আর বাচ্চা নেই - এটা বোঝার চেষ্টা করুন । এই বয়সের একটা ছেলের নারীশরীরের প্রতি আসক্তি থাকবেই । এটা তো স্বাভাবিক । ”
আমার কাঁধে হাত রেখে আমার পাশে বসে ও বলে – “সেদিন আমাদের মধ্যে কিছুই হয়নি । আমি অভিকে ডেকে ওর মাথায় হাত রেখে বলি তোর আমাকে দেখে যে অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে তা কেবল কামনার আসক্তি , কামনার বশে কোনো সিন্ধান্ত নেওয়া কিন্তু ঠিক না ভাই । যৌন মিলন ভালোবাসার এক গভীর পর্যায় । সম্পর্ক অনেক গভীর হলে, সম্পর্কে বিশ্বাস জন্মালে তবেই এর কথা ভাব , তার আগে না । শরীরের স্পর্শ ছাড়াই দুটি আত্মা যখন মিলে মিশে একাকার হয়ে যাবে , যখন তোর প্রিয় মানুষটির মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাবি আর তোর মধ্যে সে নিজেকে খুঁজে পাবে , তখনই জানবি একমাত্র সেইক্ষণেই তোরা চিরন্তন মেলবন্ধনের সঙ্গী হয়ে উঠবি। তখন কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে অভি । বলে – আরশিদি আমায় ক্ষমা করে দাও। সারাদিনে একলা থাকতে থাকতে এই পর্ণ ভিডিওই আমার মাথায় তাণ্ডব নৃত্য করে চলে সর্বক্ষণ । আমার সামনে ঘুরে বেড়ানো সমস্ত মেয়ে ঐ রূপে ভেসে ওঠে মনের মধ্যে। তাই প্রথমদিন থেকে তোমার প্রতি ঐ দৃষ্টিতে মজে গেছিলাম আমি । আমায় ক্ষমা করো দিদি । আমি আর কোনোদিন তোমার সামনে আসব না । তুমি কাউকে প্লিস বলবে না , প্রমিস করো ।
ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি - না রে কাউকে বলব না ।
অভি আরও বলে – কিন্তু আমি কি করব ? অবসর সময় পেলেই ওইসব মাথায় খেলা করতে থাকে ।
তারপর ওকে বোঝাই - কেন দেখবি ওইসব । এখন জীবনের গোড়াপত্তনের সময় রে অভি । এই সময়টা তুই নিজেকে যেভাবে গুছিয়ে নিবি, তোর জীবন সেইদিকেই এগোবে । আর প্রেম , ভালোবাসা , সেক্স ...এগুলো সবার প্রয়োজন । আর ঠিক সময় হলে নিশ্চয় পাবি এগুলো । তার জন্য দরকার অপেক্ষা করার,নিজেকে এগুলো গ্রহণের জন্য প্রস্তুত করে তোলার ।এসব জীবনের একটা অঙ্গ রে । সম্পূর্ণ জীবন না । ”
আমি চুপ করে আরশির কথাগুলো শুনে যেতে লাগলাম ।
আরশি আবার বলে - “আমার মনে হলো আপনার এই কথাগুলো জানা প্রয়োজন । দেখুন দিদি আমার পক্ষ থেকে যতটুকু বোঝানোর আমি বলেছি। এরপর আপনাদের দায়িত্ব । ছেলেটাকে একটু সময় দিন । ওর বন্ধু হয়ে উঠুন ।এত কাজ ,টাকা পয়সা কি হবে যদি ছেলেটাই বিপথে চলে যায় । অভি এখনও অনেক নিষ্পাপ রয়েছে । ওর জায়গায় অন্য কোনো দানবীয় প্রবৃত্তির কেউ হলে আমার অতগুলো কথা কেউ চুপ করে বসে শুনত না । আর আমার সম্মান , সতীত্বের বিসর্জন হতে দুঘণ্টাও লাগত না । কলেজ পড়াশুনা বাদে জীবনের বাকিটা সময়ে নিজের পরিবারকে খোঁজে একজন ছাত্র । সেখানে ওর কাকা-কাকিমা,দাদু-দিদা এদের তো খুঁজে পাবে না - আজকের এই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে । তাই শেষ সম্বল বাবা-মা কেও যদি সে না পায় , তাহলে জীবনে মুক্তির স্বাদ খুজতে কিন্তু সেই নেশার ধোঁয়ায় আর নারীর শরীরে ঝাঁপ দিতে বাধ্য হবে অভি ।”
পরদিন আরশি চলে গেছিল । অলকেশ কারণ জানতে চায়নি । অভি সেদিনের ঘটনা নিয়ে কোনো কথা বলেনি । আমিও ওকে জিজ্ঞাসা করিনি । সেদিনের পর থেকে নিচের ঘরে আর ভাড়া দিইনি আমরা । ওখানে আমি একটা ছোটো টিউশন সেন্টার খুলেছি । আমি ওখানেই পড়াই । আর বাকি সময়টা রাখা থাকে অভিকের জন্য । সেদিনের ঐ শিক্ষাটাকে যতটা সম্ভব কাজে লাগাতে চেয়েছি আমি । কলেজ টপার হয়েছে আমার ছেলে, সাথে হায়দ্রাবাদে নামী কোম্পানিতে চাকরি । আজকের এই খুশির সময় আমাদের চার বছর আগের সেই ভাড়াটিয়াকে খুব মিস করছি । আজও মনে হয় ও কোনো মানুষ ছিল না । আমাদের সংসারের দিকে ধেয়ে আসা আগামীদিনের তীব্র ঝড়ের এক ছবি দেখিয়ে দিয়েছিল তা নয় , সেই দুর্বিপাকের থেকে উদ্ধারের পথের সন্ধানও দিয়েছিল ।