রাজা
রাজা


মুখভার করে ট্রেনের সিটে বসে আছে রক্তিমা। ফার্ষ্ট রাউন্ডেই হেরে গেলো পিয়ানো! এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। মিসেস বেরার ছেলে সেমি ফাইনাল রাউন্ডে পৌঁছে গেছে। ওনার হাসি হাসি মুখটা মনে পড়লেই ভেতরে ভেতরে যেন একটু একটু করে ক্ষয়ে যাচ্ছে রক্তিমা। ওর ছেলে ফার্ষ্ট রাউন্ড কোয়ালিফাই করতে পারেনি বলে যেন কত দুঃখ পেয়েছেন উনে। রক্তিমাকে ছোট করার জন্য ইচ্ছা করেই সহানুভূতি জানাতে এসেছিল। অসহ্য লাগছে রক্তিমার। মাথার দুপাশের রগ দপদপ করছে যন্ত্রণায়।
অথচ দেখো পিয়ানোর মনে হারের কোন লজ্জাই নেই। যাওয়ার পথে ট্রেনে কেনা পাজল গেমটা নিয়ে দিব্যি রঙ মেলাতে ব্যস্ত। ছেলেকে দাবা খেলা শেখানোর জন্য কম পরিশ্রম করে রক্তিমা! সপ্তাহে দুদিন ছেলেকে বারুইপুর থেকে টানতে টানতে সল্টলেক নিয়ে যাওয়া আবার নিয়ে আসা কম ঝামেলার! তবু ছেলেটাকে দাবায় তুখোড় করে তোলার জন্য সেই কষ্টও আজ চারবছর ধরে হাসি মুখে করছে রক্তিমা। বারুইপুরের ঐ বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার কথা বাসবকে কতবার বলেছে। কিন্তু সেকথা কানেই তোলেনি বাসব। ছেলের ভবিষ্যতটা সুন্দর করার দায়িত্ব একমাত্র যেন তার। নাহ্ এই ছেলের দ্বারা কিছুই হবেনা।
-ওমা খিদে পেয়েছে।
সেই সকালে খেয়েছে, খিদে পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবু
পিয়ানোর কথায় কান দেয় না রক্তিমা। খাওয়া, ঘুম, খেলা সবকিছু ঠিকঠাক আছে; শুধু কাজের কাজ করার বেলাতেই অমনোযোগী। আজ থেকে আর জীবনের চব্বিশ ঘন্টা ঐ ছেলের পিছনে দিয়ে নিজের জীবনটাকে শেষ করবে না। কোন প্রত্যাশা রাখবে না ছেলের ওপর। তাহলে আর কষ্টও পেতে হবে না।
অন্যদিন ট্রেন থেকে নেমে পিয়ানোর হাতটা শক্ত করে ধরে থাকে রক্তিমা। আজ ভীষণরকম আনমনা সে। কখন যে হাতের মুঠোটা আলগা হয়ে গেছে বুঝতেও পারেনি।
হঠাৎ চারদিকে সবার চিৎকারে সম্বিত ফেরে রক্তিমার। ডাউন লাইন দিয়ে তখন একটা একটা এক্সপ্রেস ট্রেন পিয়ানো কোথায় গেল! মুহূর্তে কেঁপে ওঠে ওর বুকটা।
ট্রেনটা চলে যেতেই দুধারের প্লাটফর্মের লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়ে লাইনে। অন্ধ বুড়ি মানুষটা লাইন পাড় হচ্ছিল, ট্রেনটা যে আসছে বুঝতেই পারেনি। পিয়ানো প্লাটফর্ম থেকে লাফিয়ে নেমে লাইন থেকে কোনরকমে সরিয়ে নেয় বুড়িমাকে। নিজের যে কতবড়ো বিপদ হতে পারে একবারও সে কথা ভাবেনি।
ঘটনার আকস্মিকতা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি রক্তিমা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্লাটফর্মে। সবাই ধন্য ধন্য করছে পিয়ানোর।
নিজের হেরো ছেলেটা আজ যেন রাজার মতো মনে হচ্ছে রক্তিমার। জীবনের দাবা বোর্ডে সবাইকে হারিয়ে দিয়ে যেন একা দাঁড়িয়ে আছেন রাজা।