পূজার ডালি
পূজার ডালি
‘আমাকে একটু তোমার পূজার ডালি থেকে দুটো বাতাসা দেবে গো?' ঝকঝকে শ্বেতপাথরের মন্দিরের থাম ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা শীর্ণকায় একটা হাত এগিয়ে এলো বছর আটের এক বালিকার| চোখে তার বহুদিনের ক্লান্তি, তবু তার চাহনিতে এক নিবিড় প্রশান্তি|
'এই যা এখান থেকে, দেখছিস পূজো দিতে যাচ্ছি, কেউ এমন পথ আটকায়?' ঝাঁজিয়ে উঠলেন ঝকমকে শাড়ী-গহনা পরিহিতা প্রমিলা দেবী| 'কেন যে মন্দির প্রাঙ্গনে ঢুকতে দেয় এদের!'
'আহ্ পিসিমা, কি হচ্ছে কি, যাও এগোও তো তুমি, আমি আসছি...' ওনাকে মন্দিরে প্রবেশ করতে তাড়া দেন ওনার বছর কুড়ির ভাগ্নি, তিতাস| পিসিমার বাড়িতে প্রায় ছয় বছর পর এসেছে সে। ওনার অনুরধেই একসাথে মন্দিরে পূজো দিতে আসা। পিসিমা এগিয়ে যেতেই, মেয়েটার কাছে গেল তিতাস।
'এই মেয়ে, এদিকে আয় আমার সাথে...' মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে, সামনের মিষ্টির দোকানে যায় সে, এক প্যাকেট মিষ্টি কিনে তার হাতে ধরিয়ে জিজ্ঞাসা করে
'নাম কি তোর?'
'মিঠি' আসে উত্তর।
'বাড়ি কোথায়? বাপ মা কোথায়? এই ভরদুপুরে মন্দিরে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছিস?' শাসনের সুর তিতাসের|
'ও দিদিভাই, আমি ভিক্ষে করলাম কোথায়? পূজার ডালি থেকে বাতাসা চাইলাম শুধু। তোমরা যেই ভগবানকে পূজো দাও, তাঁকে তো আমিও পূজো দিতে চাইলাম| আমার কাছে তো পয়সা নেই, তাই.. পূজো দিতে চাওয়া কি ভিক্ষে?
'মানে?' বলে কি মেয়েটা, অবাক তিতাস। 'তু্ই পূজো দিতে চাইলি মানে? নিজের খাওয়ার জন্য চাইলি না?'
খিলখিল করে হেসে ওঠে মিঠি|
‘না গো না, আজ আমার পরিবার হয়েছে, তাই মন্দিরে এলাম ভগবানকে আমার সর্বশ্রেষ্ঠ উপহারটা পাওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাতে।’
‘মানে? ঠিক বুঝলাম না রে.. ভাই হয়, বোন হয়, আরো অনেক কিছুই হয়, একেবারে গোটা পরিবার হয় কি করে? আমরা তো পরিবারে থেকেই বড় হই’ বললো তিতাস।
‘আমারও এক বাপ-মা-হীন পরিবার আছে আমার বোনেদের নিয়ে, তবে এ এক অন্যরকম পরিবার পেলাম আমি আজ। দেখবে?’ জিজ্ঞাসা করল মিঠি।
ওর চাহনি আর গলার স্বরে এমন কিছু ছিল, যা তিতাসের কৌতুহল উদ্রেক করলো। ব্যাপারটা হালকা আন্দাজ করতে পারলেও, ও পিছু নিলো মেয়েটার। নিশ্চই কোন অনাথ আশ্রমে বেড়ে উঠছিল মেয়েটা, কোনো সহৃদয় পরিবার ওকে দত্তক নিয়ে আপন করল আজ।
তবে মিঠি যা দেখালো, সেটা অপ্রত্যাশিত ছিল তিতাসের কাছে। মন্দিরের সামনে সুবিশাল মাঠের এক প্রান্তে একটা বড়ো সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। অনেকগুলো দুই থেকে চোদ্দ বছরের বাচ্চা সেখানে খলবল করে খেলা করছে। কারুর হয়তো ধূলিমলিন জামা, কারুর জুতো নেই, কারুর চুল যত্নহীনতায় রুক্ষ। তবে ওদের নিষ্পাপ হাসিতে আর সুমধুর কলধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে অপরাহ্নের অলস দুপুর। বোঝাই যায়, এরা আশেপাশের এলাকায় থাকে। কোনো বিশেষ কারণে একত্রিত হয়েছে এখানে।
সামিয়ানার নীচে, মস্ত চশমা এঁটে, খাতা কলম হাতে এক বয়স্ক ভদ্রলোক আর এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের সাথে গভীর আলোচনায় নিমগ্ন।
ওনাদের কথা ভেসে এলো তিতাসের কানে।
‘আমরা এই সকল বাচ্চাদের নাম নথিভুক্ত করে নিলাম’ বললেন ভদ্রলোক।
‘খুব ভালো ধীরেনবাবু, কাল থেকেই তাহলে শুরু হয়ে যাক এদের পড়াশোনা’ বললেন রামকিঙ্কর পুরোহিত।
‘আমরা আজই মন্দিরের দক্ষিণ হলঘরটা একবার ঘুরে দেখতে চাই’ বললেন ভদ্রমহিলা।
‘নিশ্চই দেখাব সুহাসিনী দেবী। আপনারা দেখে বুঝে নেবেন কতটা জায়গা আছে। সব বাচ্চাদের একই ঘরে না বসাতে পারলে, আমরা পুবদিকের ছোট হলঘরটার ব্যবস্থা করে দেব। এই বাচ্চাদেরকে যে আপনারা পড়াতে রাজী হয়েছেন, ভবিষ্যৎ সমাজকে গড়ে তুলতে চাইছেন, এর জন্য যথাযথ সাহায্য আমরা করবো’
‘তাই তো বলি, আপনাদের মন্দিরের এত সুনাম কি আর এমনি’ মৃদু হাসলেন সুহাসিনী দেবী। ‘আপনাদের মতন বড় মনের মানুষেরা আছেন বলেই না মন্দিরটা এত পবিত্র, সুশৃঙ্খল আর উন্নতিশীল হওয়ার খ্যাতি অর্জন করেছে!’
‘আমরা সকল পুরোহিতরা মিলে একত্রিত এই পুরো ব্যাপারে’ বললেন রামকিঙ্কর পুরোহিত। ‘আশেপাশের বস্তির প্রচুর ছেলেমেয়েরা এমনিই ঘুরে বেড়ায় মন্দিরে, বেশিরভাগই আসে ভিক্ষার আশায়। কিন্তু ভিক্ষা করে তো সারাজীবন চলতে দেওয়া যায়না, তাও আবার আমরা থাকতে। তাই আমরা গত মাসেই উদ্যোগ নিলাম যে যারা একটু বড়ো, এই ধরুন আট থেকে বারো বছরের মধ্যে, তাদেরকে মন্দিরের কাজ শেখাবো। একটা পরিবারের ছায়া দেব। এখন তো অনেক বাচ্চাই নিয়মিত আসছে। কেউ ঝুড়ি বানাচ্ছে, কেউ মাটির পুতুল, তো কেউ সেলাইয়ের কাজ শিখছে। কিন্তু এদের যত্নআত্তি আর পড়াশোনা করাও যে কত জরুরি, তা আমরা প্রতিনিয়ত অনুভব করতে লাগলাম। এদের শিক্ষিত করলে শুধু এরা নিজেরাই নয়, এদের পরিবারও অনেক বিপদ-সংকটের সাথে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে, আর সুস্থভাবে বাঁচতে পারবে।’
‘আপনি যে ওদের সাথে সাথে আমাদের পরিবারের ছাতাটাও এতটা সুবৃহৎ করে তুললেন, এটা সত্যিই এক মহৎ মানুষের মন ছাড়া অভাবনীয়। আমরাও তো বৃদ্ধাশ্রমে বিচ্ছিন্ন। সবাই হেসেখেলে একত্রে থাকলেও, সকলের মনের গহীন কোনে এক মর্মভেদী ব্যাথা অনুভব করি। আমরা কি হেরে গেলাম তবে জীবনে? সব করেও কি আসল জীবনের উদ্দেশ্যে ব্যর্থ হলাম? অনেকেরই প্রশ্ন। কিন্তু এই যে নতুন উদ্যোগে আপনি আমাদের কথা ভেবে আমাদেরকেও জড়ালেন, এই বাচ্চাদেরকে পড়ানো, হস্তশিল্প শেখানোর দায়িত্ব দিলেন, ওদের যত্ন নেওয়ার ভার দিলেন, এতে আমরা আবার মন খুলে নিঃশ্বাস নেওয়ার একটা পরিস্থিতি পেলাম, বাঁচার নতুন আশা পেলাম’ একনাগাড়ে এতটা বলে একটু হাপিয়ে পড়লেন ধীরেনবাবু।
‘ঠিকই তো, মনে হচ্ছে ঈশ্বর দ্বিতীয়বার মুখ তুলে তাকিয়ে আমাদের হাতে এক নতুন প্রজন্ম তুলে দিয়েছেন, ভালোবাসায় ভরিয়ে ওদের যথার্থ মানুষ করে তোলার’ এবার বললেন সুহাসিনী দেবী। ‘এদের মধ্যে তো আবার কয়েকজন অনাথ শিশুও আছে? আমরা আস্তে আস্তে আমাদের পরিবারের ছায়াটা আরো বিস্তীর্ণ করবো, আমাদের পরিবারের শাখা প্রশাখায়, এই এলাকার সমস্ত হতদরিদ্র বাচ্চাদেরকে এই প্রকল্পের মধ্যে নিয়ে আসবো। বৃদ্ধাশ্রমের যতজনের পক্ষে সম্ভব, সকলে মিলে গড়ে তুলব আমাদের রাজসংসার, আমাদের সুখনীড়। আর সেটার সূত্রপাত করলেন আপনারা, এই মন্দিরের পুরোহিতেরা। আপনাদের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ!’
‘এরকম ভাবে কেন ভাবছেন’ হাসলেন এবার রামকিঙ্কর পুরোহিত। ‘আমরা সকলে মিলেই তো পরিবার, এর মধ্যে কোনো সদস্য না থাকলেই যে পরিবার অসম্পূর্ণ।’
প্রশান্তির হাসি এদের সকলের মুখে। শিহরিত হয়ে উঠলো তিতাস ওনাদের কথাপোকথন শুনে। চতুর্দিকের এতো হাহাকার, পাপ, অন্ধকারের মধ্যেও এতো ভালোবাসা? এই তো মানবহৃদয়, এই তো সামাজিকতাবোধ… হারিয়ে যায়নি এখনো কলিযুগের কালিমায়!
হঠাৎ ওর জামায় টান পড়তে সম্বিৎ ফিরলো তিতাসের।
‘কেমন লাগলো আমার নতুন পরিবার?’ মিটিমিটি হাসছে মিঠি।
‘সবথেকে শ্রেষ্ঠ,বহুমূল্য সম্পদ। খুব যত্নে আগলে রাখিস এই পরিবারের সকলকে।‘
কি বুঝলো মিঠি, সেই জানে। অবাক হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল তিতাসের দিকে। তারপর জিজ্ঞাসা করলো
‘আচ্ছা, আমার তো এবার নিজের মস্ত পরিবার হয়ে গেছে, এবার থেকে তাহলে আমিও তোমাদের মতন ডালি সাজিয়ে পূজো দিতে পারব বল? আমি কিন্তু নিজের হাতে সাজিয়ে নেব সেই ডালি, দোকানের কেনা নয়। কি কি দিয়ে সাজাবো বলতো?’
'মনুষত্ব্যবোধ দিয়ে। মানুষের মতন মানুষ হয়ে উঠিস, নিজের জীবনের যথার্থ সদ্ব্যবহার করিস মিঠি। আর তোর এই দুর্মূল্য পরিবারের সকলকে বড় হয়েও যেন কোনদিন ভুলিস না! জানবি, এঁদের সম্মান করা মানেই ভগবানকে পুজো করা। সেটাই হবে তোর নিবেদন করা সর্বশ্রেষ্ঠ পূজার ডালি।'
আকাশ দিয়ে উড়ে গেল এক ঝাঁক পাখী, বুঝিবা তাদের নিশ্চিন্ত, নিরবিচ্ছিন্ন নীড়ের ছায়ায়|