পুরষ্কার
পুরষ্কার


"অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার" এর চিঠিটা হাতে নিয়ে খানিক্ষণ চুপ করে বসে রইল মধুমিতা বসু। মাঝরাতেই ফোন এসেছিল, প্রতিষ্ঠিত লেখক আরিফ আহমেদ- এর... অভিনন্দন- বার্তা নিয়ে।সকাল থেকে টেলিভিশন, রেডিও, খবর কাগজের লোকেরা তাকে বিশ্রাম নিতে দেয়নি। গভীর রাত পর্যন্ত তো পড়াশোনা, লেখালেখি, টাইপ করার কাজ নিয়েই কেটে যায়… সময়ের বড় অভাব।
এই পুরস্কার, এই স্বীকৃতি তাকে সুযোগ দিল ফিরে দেখার…
কবে যেন শুরু হয়েছিল এই লেখালেখি… কীভাবে এসেছিল সেই অনুপ্রেরণা...
পুরস্কৃত উপন্যাস 'হারায়ে খুঁজি'র কথাই ঘুরে ঘুরে আসছে তার মনে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন খাতা- ডাইরিতে এলোমেলো ভাবে টুকরো টুকরো লেখা, কাটাকুটি… কীভাবে সাজিয়ে তুলবে তারও কোনও পরিষ্কার ধারণা ছিল না। ঘটনার গতি প্রকৃতি যে কোনদিকে যাবে, ঠিক বুঝেই উঠতে পারছিল না, মধুমিতা।
যখনই সময় পেয়েছে উপন্যাসটা নিয়েই বসেছে সে। মাঝে মাঝে এক আধটা ছোট গল্প, কবিতা বা রম্যরচনা লিখতে হয়েছে যদিও… পত্র পত্রিকার ফরমায়েশ মত। সেই উপন্যাসই যে পুরস্কৃত হবে, তাকে সম্মান এনে দেবে… ঘূণাক্ষরেও মনে আসেনি মধুমিতার।
রূঢ় বাস্তবের ওপরে কল্পনার রঙ বুলিয়ে এঁকে গেছে সে, একের পরে এক ছবি। যাদের চেনে না, তাদের নিয়ে লিখতে গেলে যে কল্পনাশক্তির প্রয়োজন তা ছিল না মিতার। তার রচনার পাত্র পাত্রী তারাই, যাদের সে কাছের থেকে দেখেছে।হাতের কলমটা নামিয়ে রেখে জানলা দিয়ে বাইরের আকাশটাকে দেখতে থাকল মিতা। ঘন কালো মেঘের গায়ে এক সার সাদা বক ডানা মেলে দিয়েছে। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল তার। ছোটবেলায় কী যেন বলত তারা বক দেখলে...
বকমামা বকমামা টিপ দিয়ে যাও,
নারকেল গাছে কড়ি আছে গুনে নিয়ে যাও।
তার পরেই নখের ওপরে ছোট ছোট সাদা সাদা ফুটকি নজরে আসত।
মনে পড়ল প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটানো ছোটবেলার দিনগুলোর কথা। বাড়ীর চারপাশের খোলা মাঠ, পুকুর, গাছপালা... সব থেকে আগে সামনে এসে দাঁড়ালেন ঠাম্মি, মিতার প্রকৃতি- প্রেমের হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁরই কাছে।
মা ছিলেন মুর্তিমতী যমদূতী… বাধা- নিষেধের পাহাড়। ঠাম্মি সময় মত মা'র তালে তাল মেলাতেন… নালিশ আর আশকারা সাথেই সাথেই চলত। ঠাম্মির সঙ্গে ছিল যত ঝগড়া তত ভাব, তাঁর শাসনে- আদরে- প্রশ্রয়ে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা...
মিতার সব দুরন্তপনার পরম সহায় ছিলেন, তার বাবা। যতক্ষণ বাবা বাড়ি থাকেন, তাদের গুজগুজ ফুসফুস চলতেই থাকে। কত রাত অবধি জেগে যে তারা পড়াশোনা, আলোচনা করে তা মিতার মা, রতি জানতেও পারে না, জানতে চায়ও না। অনেক সকালে উঠতে হয় তাকে। এইসব আদিখ্যেতার সময় নেই। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরে মড়ার মত ঘুমোয় রতি। একটু দেরীতে ঘুম ভাঙলেই শাশুড়ি মায়ের হাঁড়িমুখ দর্শন। কতদিন... স্বামী চিত্ত তাকে ডেকে তুলে দিয়ে আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে।
স্কুল থেকে ফিরে তর সয়না মিতার। খাওয়া দাওয়ার বালাই নেই, কোনও রকমে স্কুলের পোশাক ছেড়েই খেলতে দৌড়য় সে। বাড়িতে তো দাদা- ভাইয়ের সঙ্গ থাকেই, বাইরেও তার বন্ধু সব ছেলে। ওর মত দুরন্তপনা কোনও মেয়ের পক্ষে যে সম্ভব তা চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারে না।
নারীত্ব পাওয়ায়, ঠাম্মির বাধা- নিষেধের বেড়ি পড়ল মধুমিতার পায়ে... শাপে বর হলো বাইরের দস্যুবৃত্তি বন্ধ হওয়ায়।
সর্বগুণসম্পন্না মায়ের প্রভাবে নিজের অজান্তেই কখন যেন সে নান্দনিক শিল্পের প্রতি আকর্ষিত হয়ে পড়ল তা সে নিজেও বুঝে উঠতে পারল না। স্কুলে, তাকে বাদ দিয়ে কোনও অনুষ্ঠানের কথা কেউ ভাবতেই পারে না। নাচ, গান, আলপনা… সবেতেই সে এক নম্বর। বাড়িতে পড়াশোনার আবহাওয়া তাকে বইয়ের দুনিয়ার প্রতিও আকর্ষিত করে তুলল। জন্মদিনের কোনও ঘটা পটাই কোনদিন হয় না বাড়িতে কিন্তু পিসাই, ঠাদ্দু আর বাবা রকমারি বই উপহার দিয়ে তার জীবনকে রঙিন করে তুলেছিলেন। ঠাদ্দু, মা আর বাবার বইয়ের প্রতি অসীম আকর্ষণ হিমির সামনে খুলে দিল এক অজানা দুনিয়ার দরজা। ঠাম্মি বেশী পড়াশোনা না জানলেও মুখে মুখে ছড়া আর প্রবচনের বন্যা বইয়ে দিতেন। কী সুন্দর হাতের লেখা তাঁর। স্কুলের পরে মা মাঝে মাঝেই বই এর দোকানে নিয়ে গিয়ে বই কিনে দেন। কোনও উপলক্ষের দরকারই হয় না।
বই পড়া, ছবি আঁকার সঙ্গে সঙ্গে লেখার দিকেও একটু ঝুঁকল মিতা। শুরু হয়েছিল স্কুলের বাংলা ক্লাসে। রচনা লিখেছিল 'ছুটি'। দিদি, সেই লেখা ক্লাসে পড়ে শুনিয়েছিলেন সকলকে। স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপাও হয়েছিল।
প্রতিদিনের জীবনযাত্রার ওপরে রঙ বুলিয়ে মধুমিতা লিখে ফেলল কয়েকটা ছোট গল্প।
কখন যে দাদা দেখে ফেলেছে তার সেই লুকিয়ে রাখা লেখার খাতা, আর পড়েও নিয়েছে। মিতা জানতেও পারে না।
'এই নাও মিতা...'
একমনে বসে স্কুলের কাজ করছিল মিতা... চমকে উঠল। কখন যেন দাদা আর তার বন্ধু আরিফ আহমেদ ঘরে ঢুকেছে, সে টেরও পায়নি।
আলিদার বাড়ানো হাতে মাসিক পত্রিকা 'বাংলা'।
'তোমার লেখা বেরিয়েছে?' হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মিতার মুখ।
'তোমার লেখা আমার খুব ভাল লাগে আলিদা।'
'পড়ে দেখ্।'
উলটে পালটে দেখে, আরিফ আহমেদের নাম কোথাও পায় না মিতা কিন্তু নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখে প্রথমে অবাক হলেও ছদ্মকোপে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে, দাদার ওপরে।
'তুই! তুই আমার খাতা চুরি করে পড়েছিস?'
'যা যা, বেশী লাফাস না তো। তোর যেন ভাল লাগেনি নিজের লেখা ছাপার অক্ষরে দেখে। আলিকে ধন্যবাদ দে। ওইই সব ব্যবস্থা করেছে...'
'লেখা ছাড়িস না মিতা। তোর কলম বেশ জোরাল।'
আলিদার স্বীকৃতিতে উদ্ভাসিত হয়, মিতার মুখ... তার হাসিতে জ্বলে ওঠে হাজার ওয়াটের বাল্ব।