পতিতা
পতিতা
"শোন্ মিনা আমাদের ভালোবাসতে নেই। সংসার, ভালোবাসা, সন্তান এসব আমাদের জন্য না। তাই যা হয়ে গেছে ভুলবশতঃ সেটাকে সুধরে নে। আর কালই আমার সঙ্গে গিয়ে ওটাকে নষ্ট করে আসবি।"
"না, না এটা আমি কিছুতেই করতে পারব না দিদি। হতে পারি আমি পতিতা, কিন্তু তাই বলে একটা জীবন পৃথিবীর আলো দেখবার আগেই তাকে আমি অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারব না। ওকে আমি এই পৃথিবীর আলো দেখাবোই।তার জন্য আমাকে যা করতে হয় করব।"
"তুই বুঝতে পারছিস না মিনা। শবরী মাসী তোকে ছাড়বে না। এতদিন ওর ব্যবসার ক্ষতি ও কিছুতেই মেনে নেবে না এত সহজে। তুই ওর সোনার ডিম পাড়া হাঁস।"
"দিদি আমি ওকে জন্ম দেবার পর চারগুণ উশুল করে দেব শবরী মাসী কে। দিন রাত খাটবো। কিন্তু এ অধর্ম আমি কিছু তেই করতে পারব না। একটা নিষ্পাপ শিশুর আমি এভাবে হত্যা করতে পারব না।"
মিনা কোলকাতার এই পতিতা পল্লীতে এসেছিল সেই কোন্ ছোটবেলায়। বাবা, মা মারা যাবার পর কাকা বেড়াতে নিয়ে যাবার নাম করে এখানে এনে বিশ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছিল ওকে। তখন সবে রজস্বলা হয়েছে ও। যৌবনে পদার্পণ করার আগেই ওর যৌবন বিক্রি হয়ে গিয়েছিল রূপের এই বাজারে, পতিতা পল্লীর এই সংকীর্ণ গলিতে। একটা মেয়ে তার নিজের শরীরকে পুরোপুরি চেনার আগেই, তার শরীর অন্য কেউ চিনে নিয়েছিল। ছোট্ট শরীর এত ধকল নিতে পারত না সবসময়। কিন্তু শবরী মাসীর মতো পাষন্ড হৃদয় মহিলা তা শুনতে চাইবে তবে তো। নতুন কম বয়সের শরীরের চাহিদা যে দশ গুণ বেশি এই পতিতা পল্লীতে। হাতে কড়কড়ে নোট গোনার নেশায় মাসী তখন মত্ত। তার খেয়াল থাকবে কি করে মিনার শরীরের দিকে।
সেদিন সকাল থেকে মিনা শুয়ে ছিল।কেমন যেন গোটা শরীরে ব্যথা। পেটে আর নিম্নাঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণা।শবরী মাসী এসে বলে গেল, "যত বিশ্রাম নেবার নিয়ে নে এখন। রাতে কিন্তু আমি কোনো অজুহাত শুনব না।"
মিনা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শবরী মাসী দরজাটা টেনে দিয়ে চলে গেল। মিনা চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। ছোটবেলায় মা যেমন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো, সেই স্পর্শ অনুভব করলো ও হঠাৎই।
"এ কি রে তোর গা তো হেব্বি গরম মাইরি। কাল কজনকে তোর ঘরে ঢুকিয়েছিল ওই মেয়েমানুষ? নোটের গন্ধ পেলে ওই মেয়েমানুষ আর কিচ্ছুটি বুঝবে না মাইরি। এক্কেবারে জহ্লাদ মেয়েমানুষ। দাঁড়া তোর জন্যে একটা ওষুধের ব্যবস্থা করি।" বলেই বাইরে বেরিয়ে গেল সে। মিনা আধবোজা চোখে আচ্ছন্নের মতো শুয়ে ছিল।
কিছুক্ষণ পরই আবার ফিরে এসেছিল সে ওষুধ নিয়ে।
"নে ওঠ। কিচ্ছুটি মুখে দিয়েছিস সকাল থেকে? নাকি খালিপেটে ই শুয়ে পড়েছিস। নে দুটো বিস্কুট খেয়ে ওষুধটা খা। নাহলে ওই নিষ্ঠুর মেয়েমানুষ সন্ধ্যে বেলায় ছাড়বে না তোকে।তোর কাছ থেকে রোজ কড়কড়ে নোটের স্বাদ পেয়েছে যে।"
মিনা কোনো কথা না বলে আস্তে আস্তে উঠে বিস্কুট খেয়ে ওষুধটা খেয়ে নিয়ে আবার শুয়ে পড়লো। ওর এখন কথা বলতেও ইচ্ছা করছে না। সন্ধ্যে বেলা মিনা চমকে উঠে বসলো শবরী মাসীর ডাকে। "কই লো বড়লোকের বেটি। তোর জিরোনো হলো? আর কত বিশ্রাম নিবি লো। এবার ধান্দা পানিতে মন দিতে হবে তো ।"
মিনার শরীর তখনো সায় দিচ্ছিলো না। কিন্তু না বললেও তো মাসী শুনবে না। হঠাৎই মাসীর পেছন থেকে কেউ যেন বলে উঠলো। "আজ ওকে ছেড়ে দাও মাসী।কচি শরীর অতো ধকল সামলাতে পারছে না। শেষে মরে গেলে তখন তোমার একুল ওকুল দুকুল ই যাবে গো।সোনার ডিম পাড়া হাঁস কে একটু যত্নআত্তি করতে হয় গো মাসী।" কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে সে সামনে এসে দাঁড়ালো। মিনা দেখলো বছর পঁচিশের একটি মেয়ে। বেশ শক্ত সমর্থ চেহারা। আর মুখ খানা কি মায়াভরা। মিনার ওর মায়ের মুখখানা মনে পড়ে গেলো। তখন তো ভালো করে দেখেনি ও। কিন্তু গলাটা শুনে মনে হচ্ছে এই ওকে তখন ওষুধ দিয়েছে। মেয়েটা ওর সামনে এগিয়ে এসে ওকে জানতে চাইলো ওষুধ খেয়ে ও কেমন আছে এখন। তারপর শবরী মাসী কে উদ্দেশ্য করে বললো,"আজ ওর বদলে আমি উশুল করে দেবো গো তোমাকে। একেবারে ডবল উশুল।" কথাগুলো বলে মিনার দিকে তাকিয়ে বললো, "বসে না থেকে এই অসুস্থ শরীরে শুয়ে পড় দেখি।আর হ্যাঁ কাল থেকে কিন্তু আবার সামলাবি সব নিজের।"
কৃতজ্ঞতায় মিনার দুচোখ জলে ভরে গেল। সেই থেকেই মিনা করবী কে দিদি বলেই ডাকে। তখন তো ও নতুন একেবারে এই লাইনে। এই করবী ই ওকে এই দেহ ব্যবসার সব নিয়ম শিখিয়েছে। এখানে টিকে থাকতে হলে কেমন জবাব দিতে হয় শিখিয়েছে। শবরী মাসীর মতো মহিলার সঙ্গে কিভাবে টিকে থাকতে হয় শিখিয়েছে। তারপর তো সুখে দুঃখে আরও কতো গুলো বছর পার হয়ে গেছে। অবশ্য এই পতিতা পল্লীতে সুখের আশা করাটাই ভুল। তাও ও যখন করবীর সঙ্গে নিজের ছোটবেলার কোনো স্মৃতি ভাগ করতো, বা করবী ওর সঙ্গে।সেই মুহূর্তে ওদের জীবনে ক্ষণিক সুখের স্মৃতি আসতো বৈকি। মানুষ নিজের শরীরের চাহিদা মেটাতে আসে এই পতিতা পল্লীতে। মনের সঙ্গে তাদের দূর-দূরান্তে র কোনো সম্পর্ক নেই। আর করবী দিদি ওকেও বারবার এটাই বোঝাতে চেয়েছে শুরু থেকেই যে, মন কাউকে কখনও দিবি না এখানে। লোকে এখানে শরীর নিতে আসে, মন না। তুই তোর মন দিলে, তারা সেই মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে। তারপর তোর সেই মনকে ওরা ভেঙ্গে চুরমার করে চলে যাবে।কষ্ট তখন তোর হবে।
কিন্তু পারলো কই মিনা শেষ পর্যন্ত নিজের মনটাকে নিজের কাছে রাখতে। জয়ন্ত রায় যেদিন প্রথম এসেছিল ওর কাছে, একবার দেখেই কেন জানেনা ওর মনে
একটা ভালোলাগার অনুভূতি এসেছিল মানুষটার প্রতি। আর ভালো তো ও সেই মুহূর্তে ই বেসে ফেলেছিল মানুষটাকে, যখন ওর ঘরে ঢুকে মানুষটা ওকে বলেছিলো, একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। শরীর ছোঁয়া র আগেই মানুষটা ওর মন ছুঁয়ে নিয়েছিল। তারপর থেকে প্রতি রাতেই মানুষটা আসতো। না, এসেই চলে যেত না সে। সারা রাত থাকতো। তার জন্য শবরী মাসী তার থেকে বাকি খদ্দেরের টাকা ও উশুল করে নিতো। কতো গল্প, কতো কথা জানতে চাইত সে। নিজের কথাও বলতো মিনাকে। তার বউ নাকি তাকে ছেড়ে তার বন্ধুর সঙ্গে গিয়ে সংসার পেতেছে। সত্যি কি আজব এই দুনিয়া। কতো মেয়ে স্বামী সংসার সব পেয়েও তা অবলীলায় ছেড়ে চলে যায়। অথচ মিনার মতো কতো শত মেয়েরা একটা সংসারের আশায় সারা জীবন অপেক্ষা করে থাকে। মিনার মতো মেয়েরা তো নিজেদের ইচ্ছায় এখানে আসেনি। পরিস্থিতির চাপে তারা বিক্রি হয়েছে এখানে।
কদিন ধরে মিনার শরীরটা ঠিক লাগছিল না। কেমন যেন অলসতা সারা শরীরে। মাথাটাও ঘুরছে কখনও কখনও। দুপুরে করবীদিকে ও বললো নিজের শরীরের কথা। করবীদি বললো, "আর কি হচ্ছে ভালো করে বল। তোর ভাবগতিক আমার ভালো ঠেকছে না মিনা। কিছু বাঁধিয়ে বসিসনি তো আবার। এ মাসে হয়েছে তোর?"
মিনা ভেবে দেখলো সত্যিই তো ওর দু মাস হলো হয়নি ওসব। তবে কি সত্যিই অন্য কিছু নাকি। একটা ঠান্ডা স্রোত ওর শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এলো। শবরী মাসী জানতে পারলে তো মেরে ফেলবে তাকে।করবী দির হাতটা চেপে ধরলো ও ভয়েতে। করবী ওকে বললো, কাল দুজনে একবার বেরিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আসবে। শবরী মাসী কে অন্য কিছু বলে বেরোবে। দু'জনে পরদিন গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে। টেস্টের রিপোর্ট ও পজিটিভ। আরও অনেক পরীক্ষা করতে দিয়েছিল ডাক্তারবাবু। কিন্তু অত সময় কোথায় ওদের হাতে। যেটা জানবার দরকার ছিলো সেটুকু জেনে গেছে ওরা। সন্ধ্যে বেলা দুজনে ফিরে এলো। ঢুকতেই শবরী মাসীর হাজার প্রশ্ন। কোনো রকমে দুজনে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে পালিয়ে বাঁচলো। কিন্তু শবরী মাসীর অভিজ্ঞ চোখকে এড়িয়ে যাওয়া কি অতই সহজ নাকি। তার প্রমাণ ওরা কিছুক্ষণের মধ্যেই পেয়ে গেলো। শবরী মাসী ঘরে ঢুকেই জানতে চাইলো, "কি গোল পাকাচ্ছিস লো তোরা দুজন। তোদের ভাবগতিক আমার ঠিক সুবিধের লাগছে না।"
শবরী মাসী কে দেখে দুজনেই চুপ করে গেল ওরা।
মিনা বলেছিলো শবরী মাসীকে সব। ওর বলার মধ্যে এমন কিছু ছিলো যাতে শবরী মাসী ওকে না বলতে পারেনি। আসলে শবরী মাসী নিজের অতীতে ফিরে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। সেই বার শবরীকে কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। জোর করে ওর গর্ভপাত করিয়ে দিয়েছিল ওরা, এইকথা বলে যে পতিতাদের এসব স্বপ্ন দেখা বারণ। একটা নিষ্পাপ প্রাণ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ শবরী এই পাপ করবে না। আর তাই সে মিনাকে কিছু না বলেই বেরিয়ে গিয়েছিল ওই ঘর থেকে। যতটা খারাপ ওরা ভেবেছিল শবরী মাসী কে, ততটাও খারাপ না বোধহয় মাসী। আসলে প্রত্যেক মানুষের মনের অন্তঃকরণে আর একটা মন থাকে। আর সেই মনটা খুব ভালো ভাবে জানে অতীতের করা ভুলকে কিভাবে শুধরে নিতে হয়। শবরী হয়তো বা সেটাই করতে চেয়েছিল। নইলে মিনার এই ভুলকে, তার মতো নির্দয়ী মানুষ কিছুতেই স্বীকার করে নিতে পারতো না।
মাঝে কেটে গেছে অনেক গুলো বছর----
"তিতির আর একটু খেয়ে নে মা। সারাদিন তো নিজের খেয়াল রাখিস না।"
"মা হসপিটালে আমার জন্য সবাই অপেক্ষা করে আছে। দুটো অপারেশন আছে। আর তুমি এখানে আমাকে খাবার খেতে বলছো।"
তিতির রায় আজ শহরের নামকরা গাইনোকলজিস্ট। কম বয়সে নিজের একটা সুন্দর পরিচিতি তৈরি করে নিতে পেরেছে সে নিজের অসাধারণ কর্ম দক্ষতার মধ্যে দিয়ে। শহরের অভিজাত এলাকায় তার ফ্ল্যাট। মাকে সঙ্গে নিয়ে থাকে। শবরী মাসী আর করবী মাসীকেও সে বলেছিল আসতে ওদের সঙ্গে এই ফ্ল্যাটে, কিন্তু তারা আসেনি।আর তাই তিতির ওর মা মিনাকে নিয়ে চলে এসেছিল এই ফ্ল্যাটে। কিন্তু প্রত্যেক সপ্তাহে অন্তত একবার সে নিয়ম করে যায় তার ওই দুই মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। কারণ মায়েদের কোনো জাত হয় না, কোনো নাম হয় না, কোনো ধর্ম হয় না। তিতির একটু ও লজ্জিত হয় না ওর পরিচয় নিয়ে। কজন মা পারে এমন সাহস দেখিয়ে, তাদের সর্বস্ব দিয়ে, এই পরিস্থিতিতে, এই পরিবেশে নিজেদের সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে। তার তিনজন মা এই সাহস দেখিয়েছে তো। তিতির একটু বড়ো হতেই, নিজেদের রোজগারের সমস্ত টুকু দিয়ে তাকে অন্য জায়গায় রেখে সুস্থ, সুন্দর পরিবেশে মানুষ করে, একটা সুন্দর জীবন উপহার দিয়েছে তারা তিতির কে। অবশ্য জয়ন্ত রায় মানে তিতিরের বাবাও ওর পিতৃ পরিচয়কে অস্বীকার করেনি। নিজের নাম দিয়েছে সে তিতিরকে। অনেক বলেছিল মিনাকে তার সঙ্গে গিয়ে থাকতে তিতিরকে সঙ্গে করে নিয়ে। কিন্তু মিনা চায়নি। কারণ সে জানে সমাজ তাকে অত সহজে মেনে নিতে পারবে না। শুধু শুধু আর একটা মানুষের জীবনে অশান্তি ডেকে আনতে চায়নি সে। তার আসল চাওয়া তো শুধু ছিলো তিতিরকে নিয়ে। সেই চাহিদা যখন ওই মানুষটা পূর্ণ করেছে,আর তার কিছু চাইবার নেই। জয়ন্ত রায় তিতিরের সব দায়িত্ব পালন করেছে। আর পালন করেছে তার তিন মা। যারা না থাকলে আজ তিতির গাইনোকলজিস্ট তিতির রায় হতে পারতো না কিছুতেই। মাতৃত্বের চেয়ে বড়ো যে আর কিছুই হয় না তার প্রমাণ তার তিন মা। যারা সমাজের চোখে পতিতা হলেও, তিতিরের চোখে শুধুই মা। আর মায়ের কোনো আলাদা পরিচয় লাগে না। তার মাতৃত্বই তার সবচেয়ে বড় পরিচয়।