Sucharita Das

Inspirational Others

4  

Sucharita Das

Inspirational Others

প্রতিবাদে থেকো

প্রতিবাদে থেকো

6 mins
400


"রানী কোথায় গেলি মা। একটু সাজগোজ কর।আর কিছুক্ষণ পরেই তো ওরা এসে যাবে।" বড় ঠামির চিৎকারে রানী মানে আমাদের রাজেন্দ্রাণী ছাদ থেকে নেমে এলো।


রাজেন্দ্রাণী এ বাড়ির একমাত্র মেয়ে। এই নিয়ে তাকে প্রায় দশজন ছেলেপক্ষ দেখতে এলো। কিন্তু প্রতিবারই পাত্রপক্ষ রানীর প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে একেবারে "ব্যাক টু দি প্যাভিলিয়ন" হয়ে যায়। আসলে রানী এরকমই। ছোট বেলায় সে দেখেছে তার ছোটপিসির শুধুমাত্র রূপের চমক ছিলো না বলে ,একের পর এক পাত্রপক্ষ তার পিসিকে বিয়ের বাজারে নাকচ করে দিয়েছে। সর্বগুণসম্পন্না ছোট পিসি দিনের পর দিন পাত্রপক্ষের সামনে সঙের মতো সেজে বসতো। পাত্রপক্ষ দেখতে আসার দিন সকালে, ঠাকুমার নির্দেশে পিসিকে বেসন,হলুদ, মুলতানি মাটি, চন্দন কত কিছুরই যে প্রলেপ দেওয়া হতো ফর্সা , সুন্দর দেখানোর উদ্দেশ্যে তার ঠিক নেই।রানী তো সবসময় পিসির সঙ্গে সঙ্গে থাকতো। তাই কখনও কখনও ছোট্ট রানীও ওই প্রলেপ লাগাবে বলতো। তখন পিসি রানীকে আদর করে বলতো,"এমন রানীর মতো রূপ নিয়ে জন্মেছিস তুই।তোর এসবের যেন কখনও প্রয়োজন না হয়। তুই তো আমার রাজেন্দ্রাণী।" পিসি ই তার এই নামটা দিয়েছিল আদর করে। রানীর আজও মনে আছে, পিসিকে দেখতে এসে পাত্রপক্ষ কখনও হাঁটতে বলতো, আবার কখনও গান করতে বলতো, আবার কখনও বা চুল কতটা খুলে দেখাতে বলতো। কখনও বা মুখের ওপর বলে দিতো পিসির সৌন্দর্যের খামতি নিয়ে। যেন বাজার থেকে আলু, পটল কিনছে দেখে দেখে যাচাই করে, তারপর ভালো জিনিসটা কিনবে। এসব অবশ্য অনেক দিন আগের কথা। তখন তো রানী ছোট্ট। কিন্তু এসব কথা ই তার স্পষ্ট মনে আছে। ছোট পিসির সঙ্গে সঙ্গে সে থাকতো যে সবসময়। তারপর যখন বিয়ের বাজারে ছোটপিসিকে নাকচ করে দিতো পাত্রপক্ষ , ছোটপিসি কান্নায় ভেঙে পড়তো। যেন কতো বড়ো অপরাধী পিসি ,তাকে পছন্দ হয়নি ওদের সেজন্য। ছোট্ট রানী তখন পিসিকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে না বুঝেই বলতো, "তুমি কেঁদো না পিসি। তোমাকে কে কষ্ট দিয়েছে বলো, আমি তাকে মারবো।" দিনের পর দিন পাত্রপক্ষের সামনে অবহেলিত হবার অপমান আত্মাভিমানী পিসি মন থেকে মেনে নিতে না পেরে একদিন তাই নিজেকেই শেষ করে দিয়েছিল সব অপমানের অবসান ঘটিয়ে। বাড়ির সবাই সেদিন কান্নায় ভেঙে পড়লেও ছোট্ট রানী তার পিসির আসল কষ্টের কারণ কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছিল। আসলে মুখে আমরা যতই বলি একটা মেয়ের গুণ ই তার আসল পরিচয়, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আমাদের সমাজে এখনও পাত্রপক্ষ সবার আগে ঝাঁ চকচকে রূপের দিকেই আকৃষ্ট হয়। রূপ নয় গুণ বড়ো, এসব শুধু কথার কথা। কটা পাত্র পাত্রীর বিজ্ঞাপনে এটা লেখা থাকে যে , সুন্দরী নয় গুণী মেয়ে চাই। বেশীরভাগেরই তো চাহিদা হলো সুন্দরী,শিক্ষিতা,গৌরবর্ণা ,গৃহকর্মনিপুণা। এখন আবার তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কর্মরতা হলেও আপত্তি নেই। আর কি বাকি রইল সেটাই তো বোধগম্য হচ্ছে না।


 সে যাই হোক ,রাজেন্দ্রাণীর জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিল তার আদরের পিসির উপর হওয়া প্রত্যেকটা অন্যায়ের উচিত জবাব দেওয়া।যে রূপের খোঁচা দিয়ে পিসিকে পাত্রপক্ষ প্রত্যাখ্যান করতো দিনের পর দিন, সেই রূপ কেই হাতিয়ার করে রাজেন্দ্রাণী শিক্ষা দেবে পাত্রপক্ষ দের, বলা ভালো সমাজের সেই সমস্ত মানুষদের ,যারা এখনও মেয়েদের পন্য সামগ্রীর মতো ক্রয় করতে আসে, বিয়ের বাজারে। প্রতিজ্ঞা করেছিল সে নিজের কাছেই, তার পিসিকে অকালে হারানোর কষ্ট সে সমাজকে ফিরিয়ে দেবে দ্বিগুণ ভাবে।আর তাই তার সেদিনের পিসিকে দেওয়া সেই কথা আজ রানী ওরফে রাজেন্দ্রাণী খুব ভালো করেই রাখছে।




"রূপে গুণে অনন্যা আপনাদের রানী। এ মেয়েকে পছন্দ না হলে আর কাকে পছন্দ হবে? কি যেন নাম বলেছিলেন, রাজেন্দ্রাণী।সত্যিই রাজেন্দ্রাণী আপনাদের মেয়ে। অবশ্য আমাদের ছেলেও হেলাফেলা করার ছেলে না। সুদর্শন, সরকারি চাকরি করে, আর কি চাই?" রানীর বাড়ির লোক তখন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।তারা তো ভালো করেই জানে এরপর কি ঘটতে চলেছে তাদের সাথে।আর তাই পাত্রপক্ষে যখন বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করার কথা বলেছিলো। ঘরের মধ্যে তখনই তো বোমাটা ফাটিয়েছিলো রানী, "শুধু মাত্র আপনাদের পছন্দ হলেই তো আর বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে না।আপনাদের ছেলেকেও একদিন আনুন আমাদের বাড়িতে। আমি আগে দেখি , আপনাদের ছেলের ব্র্যান্ডটা এই বিয়ের বাজারে। সেই ব্র্যান্ড আমার পছন্দ হয় কিনা সেটা আগে যাচাই করে দেখি, তারপর তো বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হবে। সবসময় আপনারা পাত্রপক্ষ রা নিজেদের মতামত জানিয়ে চলে যাবেন, তা কি করে হয়?আর তাছাড়া সুদর্শন আর সরকারি চাকরি করলেই যে আপনাদের ছেলে বিয়ের জন্য একেবারে যোগ্য পাত্র, এরকম কেন ভাবছেন বলুন তো। মানুষ হিসাবে আপনার ছেলের কতটা যোগ্যতা আছে, সেটাও তো আমাকে দেখতে হবে।" রানীর এহেন মন্তব্যে পাত্রপক্ষ থতমত খেয়ে গেল। তারা তখন রানীদের বাড়ি থেকে তাদের আপ্যায়নের জন্য যে জলখাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল,,সেটার সদ্গতি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু রানীর কথায় তাদের মুখের খাবার না গলা দিয়ে নামাতে পারছে আর না মুখে ঢোকাতে পারছে এরকম অবস্থার সম্মুখীন। কোনোরকমে গলাধঃকরণ করে তারা পালিয়ে বাঁচে। বাবা এ মেয়ে তো তাদের বাড়িতে গিয়ে তাদের চরকি নাচ নাচিয়ে ছাড়বে। তার থেকে দরকার নেই বাবা সুন্দরী মেয়ের।সে যাত্রা তারা পালিয়ে বেঁচেছিল। আর রানী ? আবার পিসির অপমানের প্রতিশোধ নিতে পেরে যুদ্ধ জয়ের ভঙ্গীতে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছিল। এই হলো আমাদের রানী। 



পাত্রপক্ষ দেখতে আসা আর তাদের কথার প্রত্যুত্তরে রানীর তাদের নাকাল করা, এসব দেখেশুনে রানীর বাড়ির লোকজনের বর্তমান অবস্থা বেশ শোচনীয়। রানী শুনেছে একদিন ওর মা বাবা কে বলছিলো, "এরকম চলতে থাকলে মেয়ে তোমার সারাজীবন আইবুড়ো হয়ে ঘরে বসে থাকবে। এই ডানাকাটা পরীর মতো রূপ নিয়েও কিছু হবে না। ওই যে কথায় আছে না,"অতি বড়ো ঘরণীর না জোটে ঘর,আর অতি বড়ো রূপসীর না জোটে বর"। তোমার মেয়ের ক্ষেত্রেও সেটাই হতে চলেছে। রানী তখন দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছে,"তাহলে বিয়ে করবো না মা, অতো ভাবছো কেন তুমি। বিয়েটাই একটা মেয়ের জীবনের সব নাকি। আমি চাকরি করে তোমাদের সঙ্গেই থাকবো।" মেয়ের উপর কপট রাগে রানীর মা গজগজ করতে করতে বলে তখন, "সারাজীবন আমরা তোর কাছে থাকবো না রানী,তখন কি হবে তোর? জীবনে বেঁচে থাকার জন্য একটা অবলম্বনের দরকার হয় রানী। কেন বুঝতে পারছিস না তুই। অতীতের একটা ঘটনার জন্য তোর জীবন এভাবে নষ্ট করিস না রানী। অতীতের খারাপ স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে হয়।"কিন্তু এতো বোঝাবার পরও রানী নির্বিকার। একটা মেয়ে তার সৌন্দর্য্য হীনতার কারণে ছোট হয়ে, নিজের আত্মগ্লানিতে শেষপর্যন্ত আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিল, এটা রানী কি করে ভুলতে পারে?



এরপর পাত্রপক্ষ যখন দেখতে এসে ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল,"রান্নাবান্না, ঘরের কাজকর্ম করতে পারো তো মা?" রাজেন্দ্রাণীর চটজলদি উত্তর," তাহলে তো দেখছি আপনারা ছেলের জন্য বউ না, কাজের লোক আর রান্নার লোক খুঁজতে বেড়িয়েছেন।" পাত্রপক্ষের মধ্যে ছেলের মাসী আমতা আমতা করে বলেছিল,"কেন মা ঘরের বউ রাও তো রান্নাবান্না ,ঘরের কাজ করে।" রানীরও সপ্রতিভ উত্তর," সেটা জানতে চাইবার কি আছে। সাধারণ ঘরের মেয়েরা সবাই অল্পবিস্তর কাজ, রান্নাবান্না ছোট থেকেই জানে। আর একটা কথা, আমাকে বিয়ে করতে গেলে আপনাদের ছেলেকেও ঘরের কাজ, রান্নাবান্নায় ততটাই পটু হতে হবে,যতটা আমি"। সে যাত্রাতেও মেয়ের এরকম মুখে মুখে কথায় পাত্রপক্ষ পালিয়ে বেঁচেছিল। আসলে রানীর মনে ছোট থেকেই বিয়ে নিয়ে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার পিসিকে দেখে, সে অভিজ্ঞতা রানীকে প্রবল বিয়ে বিরোধী করে তুলেছিল। বিয়ে যদি এভাবে রূপের বিচারের ওপর ভিত্তি করে হয়, পুরো ব্যাপারটাতেই মেয়েদের সবকিছুতে দক্ষ হতে হবে, এরকম মনোভাব নিয়ে হয়, তাহলে দরকার নেই রানীর এই সামাজিক বন্ধনের। এর থেকে তো সে একাই ভালো। 



অতীতের কিছু বেদনার স্মৃতি আমাদের মনে খারাপ প্রভাব ফেলে একথা সত্যি। কিন্তু সেই স্মৃতি থেকে আমরা অনেক কিছু শিক্ষা নিতে পারি। রাজেন্দ্রাণী অবশ্য শেষপর্যন্ত বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল, আর সেই সংসারে সে রাজেন্দ্রাণীর মতই সংসার করছে বর্তমানে। রূপে নয়, গুণেই হোক তোমার প্রকৃত পরিচয় মেয়ে, এরকম পরিবারেই রাজেন্দ্রাণীর বিয়ে হয়েছে। সমাজের বিরুদ্ধে রাজেন্দ্রাণীর এই প্রতিবাদ আপনারা কতটা সমর্থন করেন, জানাতে ভুলবেন না কিন্তু।

        



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational