প্রেম
প্রেম
দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়েলড ইজ কারেন্টলি আনঅ্যাভেলেবল, প্লিজ কল আফটার সাম টাইম...
দাঁতে দাঁত চেপে জোর করে ফোনটা কেটে দেয় রিমা। এই নিয়ে আজকে পঞ্চান্ন বার। সেই যে পরশু রাতে কথা হলো, তারপর সকালে টুক করে একটা টেক্সট... গোয়িং আউট অফ স্টেশন, কামিং সুন উইথ সারপ্রাইজেস!!
তারপর থেকে ফোন নট রিচ্যাবল! আরে,চাঁদে তো আর যাস নি, যে সেখানে নেটওয়ার্ক নেই!!
আর ,কোথায় গেলি, কেনই বা গেলি, কবেই বা ফিরবি... এসব একবারও রিমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলো না আর্য!
তার ওপর চব্বিশ ঘন্টা আউট অফ রিচ!
জাস্ট নেওয়া যায়না আর!
ব্যাগের ভিতর ফোনটা ঠেলে ফেলে রাস্তায় পা দেয় রিমা।
ইডিয়ট টার জন্য একটা গিফ্ট কিনতে হবে।
আর বলতে হবে...
আর্যটা সত্যিই একটা উল্লুক। সব কিছু সহজ করে না বললে বোঝেনা। দেখতেও ভ্যাবলারাম, আর মনটাও ভ্যাবলারাম।
আর্যর মুখটা মনে আসতেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো রিমার গাল দুটো।
সেই ছোট্ট বেলা থেকে ওদের বন্ধুত্ব।
রিমার মনে পড়ে, মা যখন মাথায় ঝুটি বেঁধে দিয়ে স্কুলের ভিতর ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে আসতো, খুব কান্না পেতো রিমার। কাঁদতে পারতো না, মা বলতো, "কাঁদলে সবাই তোকে বোকা ভাববে, ভাববে তুই হারিয়ে গেছিস"!
রিমা মোটেও বোকা নয়, সে গড়গড় করে ওয়ান থেকে হান্ড্রেড স্পেলিং করতে পারে, ড্রইং করতে পারে, একা একা ভাত খেতেও পারে।
তাই দু চোখে জল ভরে এলেও সে কাঁদতো না।
ক্লাসের ভিতর আর্য তার পাশে বসতো, কি সুন্দর কালার পেন্সিল আনত আর্য!
রিমা টিফিন বক্স থেকে স্প্যাগেটি দিত আর্যকে। আর আর্য দিত পাস্তা।
ক্লাস এইটে যখন, স্কুলের সরস্বতী পুজোয় রিমা শাড়ি পরে গিয়েছিল, প্লে গ্রাউন্ডের এক পাশে রিমাকে ডেকে আর্য বলেছিলো, "তোকে না, আজ কি সুন্দর বউ বউ লাগছে!"
লজ্জায় রিমা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল।
আর্য রিমার পিঠে আঙ্গুল রেখেছিল! এর আগে কতবার আর্য ছুঁয়েছে রিমাকে, কিন্তু এই ছোঁওয়া যেন অন্য ছোঁওয়া, অন্য রোমাঞ্চ!
প্রত্যেক বছর সরস্বতী পুজোয় সব বন্ধুরা মিলে ঘুরতে যায়। আর্য রিমা কখনো কারোর পাশ ছাড়ে না। বন্ধুরা মজা করে, খ্যাপায়। তবু কেউ কাউকে মনের কথা বলেনা, শুধু লজ্জায় লাল হয়ে যায় রিমার ফর্সা গাল দুটো।
এবছর, ওরা দুজনেই কলেজে। না, একই কলেজে নয়। রিমার ইংলিশ আর আর্যর ম্যাথ।
এখন আর রোজ রোজ দ্যেখা হয়না।
দুজন দুজনের দিনযাপনে ভীষণ ব্যস্ত।
তবে ফোনে কথা হয়।
একটা চোরা ভয় আজকাল প্রায়ই রিমার মনে কাজ করে, আর্য অন্য কারোর সঙ্গে....!!
না, না, সেরকম হলে রিমা জানতে পারতো নিশ্চয়ই।আফটার অল রিমা তো আগে ওর বন্ধু, সেরকম হলে আর্য নিজে থেকেই জানাতো রিমাকে।
****************
ওয়াটার প্রুফ রিস্ট ওয়াচটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে রিমার। আর্যকে মানাবেও দারুন। এবার একটা কার্ড নিতে হবে। বড় কার্ড।
পিছনে কেউ ডাকছে না!
রিমা ঘাড় ঘোড়ায়। "আরে, নীলাদ্রি! কতদিন পর, ওমা কেয়া! তুই নীলাদ্রির সঙ্গে! হ্যারে, তোদের টম এন্ড জেরি কবে মিটলো! ওয়াও হোয়াট আ সারপ্রাইজ!"
নীলাদ্রি, কেয়া ,রিমা, আর্য ,এরা সবাই সেই নার্সারির টিম। স্কুল পাশ করে যে যার এদিক ওদিক ছিটকে গেছে।
একটা সময় তো নীলাদ্রি আর কেয়ার সাপে নেউলে সম্পর্ক ছিল।
ক্লাসে মনিটর ছিল নীলাদ্রি। কেয়াকে প্রায়ই মার খাওয়াতো। কেয়ার লম্বা বিনুনি টেনে দিতো, কতবার কেয়ার টিফিন চুরি করে খেয়েছে নীলাদ্রি!
একবার তো অ্যানুয়াল স্পোর্টসে দুজনের লাঠালাঠি পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল। গো অ্যাজ ইউ লাইকে কেয়া সেজেছিল বুড়ি, আর নীলাদ্রি ভিখিরি। কেয়া নাকি নীলাদ্রির লাঠিটা নিয়ে নিয়েছিল। এই নিয়ে মাঠে সবার সামনে সে কি চুলোচুলি দুজনের!
আর সেই কেয়া নীলাদ্রি দুজনে আজ একসঙ্গে শপিংয়ে বেরিয়েছে। বাহ!দারুন দারুন।
ঝগড়াঝাটিই বোধহয় আসল প্রেমকে চিনিয়ে দেয়!
কেয়া রিমার দিকে এগিয়ে আসে, " গিফ্ট কিনছিস, নতুন বয়ফ্রেন্ড!"
রিমা বলতে যাচ্ছিল, "নতুন আবার কে! আমি তো আর্যকেই...!"
তার আগেই নীলাদ্রি বললো, "হ্যা সেই, আর্যও যখন অন্য একজনকে নিয়ে ঘুরছে, তুইই বা একা থাকবি কেন?"
আর্য অন্য একজনের সাথে ঘুরছে!
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা রিমা, কি বলছে এরা এসব!
কেয়া বোধহয় রিমার মনের ভাব বুঝতে পেরেছে, "তুই জানতিস না? আমিও দেখেছি রে, একটা লম্বা ফর্সা মেয়ে, বোধহয় ওদের কলেজেই পড়ে। কালও তো মলে দেখলাম দুজনকে।"
চোখের জল প্রাণপণ লুকিয়ে রিমা বলে, "আমি জানি, আমি চিনি মেয়েটাকে। হ্যা, আর্য বলেছে তো আমায়। তোরাও না যা তা। স্কুলে একসাথে ঘুরতাম বলে কি আমরা লাভার্স ছিলাম! আরে ওটা কি প্রেম করার বয়স ছিল! চল বাই, আমার বয়ফ্রেন্ড ওয়েট করছে!"
*************
দড়াম করে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো রিমা। এই জন্যই ফোনটা নট রিচ এবল!
আউট অফ সাইট একেবারে আউট অফ মাইন্ড করে দিলো!
কিন্তু আর্য তো একবার বলতে পারতো রিমাকে, বন্ধুত্বের খাতিরেই!
কেন, রিমা বলেনি, যখন, ক্লাস নাইনে পি এস এমের ক্লাসে রিমার ঘোর লাগতো, পি এস এমের হাসি, কথা বলা, তাকানো, রিমাকে পাগল করে দিত, রিমা বলেনি আর্যকে সে কথা!
আর্যই তো তখন ইনফর্মেশনটা দিয়েছিল, "হি ইজ ম্যারেড, তিন বছরের বেবিও আছে, তোর চান্স নেই। কেটে আয়!"
সবাই সমান ।সবাই সমান।
কেমন দেখতে সেই মেয়েকে, যে আর্য রিমাকেই ভুলে গেল?
খুব রাগ হচ্ছে রিমার। নিজের ওপর,আর্যর ওপর। ডেস্কের ভিতর ঢাই করা নোটসের খাতা। কয়েকটা আর্যর হাতের লেখা। রিমা বের করে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলে।
ড্রয়ারের ভিতর গ্রিটিং কার্ড, নিউ ইয়ার, বার্থডে ... রিমা ছুঁড়ে ফেলে মেঝের ওপর।
ড্রেসিং টেবিলের ওপর ফটো অ্যালবাম। ভিতরে স্কুল ফাইনালের গ্রূপ ফটো। পাশাপাশি আর্য রিমা। রিমা লাল স্কেচ দিয়ে লাভ সাইন এঁকেছিলেন। ছবিটা বের করে ছিঁড়তে যাবে, মোবাইলটা বাজলো, স্ক্রিনে আর্য। না ধরাই ভালো। কিন্তু মন চাইছে, ধরি।
-" বাড়িতে আছিস?"
রিমা ঢক করে কান্না গিলে নেয়, "বল...
-" আই অ্যাম ইন লাভ রুমি, একটু হেল্প করবি আমায়?"
চোখের জল বাগ মানছে না, "খুব ভালো। কিন্তু আমি আজীবন জগৎ সংসারে শুধু হেল্প করে চলতে পারবো না।"
-"ওভাবে বলছিস কেন? আসলে ও আমার খুব ভালো বন্ধু, যদি প্রপোজ করলে আর বন্ধুত্ব না রাখে! তুই যদি একটু...."
-"আমাকে কিউপিড সাজতে বলছিস তো? পারবো না, জাস্ট পারবো না। আমার অন্য কাজ আছে!"
-"কি এমন মহৎ কাজ আছে রে তোর? বয়ফ্রেন্ড জুটিয়েছিস নাকি?"
-"কেন? না জানিয়ে একা তুইই গার্লফ্রেন্ড জোটাতে পারিস? রাখছি। আর শোন, ডোন্ট ডিস্টার্ব মি এনি মোর!"
পটাং করে লাইনটা কেটে দেয় রিমা। চোখের জল ধরে রাখতে পারছেনা আর।কাঁদছে। অঝোরে।
ঘরের ভিতর বড্ড গুমোট।ফাগুনের এই শুরুতেও বড্ড ঘামছে রিমা। একটু বাতাস চাই। খোলা বাতাস।
****************
ছাদে উঠলে শহরের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। চারিদিক অন্ধকার, তার মাঝে রঙিন তারা হয়ে শহরটা জ্বলছে যেন। আজ যে শহরে উৎসব, প্রেমের উৎসব। রাস্তার সবাই জোড়া জোড়া। একমাত্র রিমাই নিঃসঙ্গ!
বারবার স্ক্রিনে চোখ চলে যায়, আঙ্গুল নিশপিশ করে, ডায়াল করেও কেটে দিতে হয় আর্যর নম্বর..."কেন তুই বুঝলিনা আমায়?
সব ভুলে গেলি!
সেই যে মনিদিদির বিয়েতে আমি নিতকনে ছিলাম আর তুই দৌড়ে এসে আমার হাত ধরে বলেছিলি, নিতবর চাইনা, আমিই তোর বর! ভুলে গেলি আর্য!
ছোটবেলায় কতবার আমরা বর-বউ খেলেছি, তোর জন্য রান্নাবাটি করেছি, সব ভুলে গেলি?
একবারও তোর মনে পড়লোনা আমার কথা?
ঠিক আছে, তুই ভালো থাক!"
কালো আকাশের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে রিমা। একটা সময় চোখ বোঝে, ঘোর আসে....
ছাদের আলোটা জ্বললো। "কিরে এখানে বসে বসে ঘুমোচ্ছিস? আন্টি যে বললো,তুই ঘরে.... তা তোর বয়ফ্রেন্ড কই?"
আর্যকে আড়াল করে রিমা চোখ মোছে, "কেন তোর গার্লফ্রেন্ডকে কি আন্টি বাড়িতে অলরেডি আলাউ করে নিয়েছে নাকি?"
আর্য হাত ওল্টায়, "আবার কি! কবে থেকে..."
বুকটায় কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে রিমার।
আর্য কি বুঝতে পারছেনা, রিমার কষ্ট হচ্ছে!
নাকি ইচ্ছে করে...
রিমা উঠে দাঁড়ায়, "তা তুই এখন এখানে...."
-" তা কি করবো, তোকে বললাম হেল্প করতে, তুই পা ভারী করে ফেললি, তা আমার আর তুই ছাড়া গতি কই!"
-"সেই, হেল্পের সময়ই আমি বন্ধু," রিমা সোজাসুজি তাকায়, "এই ওয়েট, তুই ওকে এখানে নিয়ে এসেছিস?"
-''হ্যা, তোর ঘরে বসে আছে!"
-"মানে টা কি?",বলেই রিমা দৌড়োলো ঘরে।
পিছনে আর্য।
"কোথায় তোর ডার্লিং?"
আর্য পিছন থেকে রিমার কাঁধ ধরে নিয়ে আসে আয়নার সামনে, "ওই দেখ, তোর মত সুন্দর নয় জানিস,তবে একটা পরিষ্কার মন আছে, আমার কাছে ও-ই মিস ইউনিভার্স।সারাদিন ঝগড়া করে দিনের শেষে ভাব করে নেয়।
তোর মত কুচুটে নয়, আর আমায় চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে, কারোর কথায় নেচে বেড়ায় না। নীলাদ্রি যাকে দেখেছিল, সে আমার মাসতুতো বোন রে গাধী!!
এবার বল,আমার হয়ে ওকে বলবি তো আমার মনের কথা?"
লাজুক চোখে রিমা বলে, "কেন বলবো? আমার বয়ফ্রেড যদি পারমিশন না দেয়?"
আর্য কপট চোখে, "আজকাল বয়ফ্রেন্ডের কেনা বাঁদী হয়ে গেছিস? জিজ্ঞেস না করে করিস না কিছু? বেশ, তবে তাই হোক..."
বলেই হাটু মুড়ে আর্য রিমার সামনে,
"আমি শুধু তোকে চাই।
সারাদিন ঝগড়াঝাটি
বর বউএর খেলনা বাটি
একটা খোলা আকাশ রেখে
সারারাত হুটোপুটি।
তোর সঙ্গে যেমন ছিলাম
উদোম ছেলেবেলায়
সাদা চুলেও হাতটা ধরে
বসিস বারান্দায়।
কড়া লিকার চায়ের কাপে
মোটা ফ্রেমের কাজল
ভ্যালেন্টাইন সেদিনও হোস
বকিস আবোল তাবোল!!"
নিজের বুক থেকে রিমার চিবুক তুলে ধরে রিমা, "এতটা হিংসুটে তুই? কে না কে ভুজুং ভাজুং দিলো, আর তুই সাদা মনে বিশ্বাস করে নিলি? আমায় একবার জিজ্ঞেসও করলিনা?"
রিমা আর্যর চোখে চোখ রাখে, "তা তুই যদি চাঁদে চলে যাস, তো আমি কিকরে নেটওয়ার্ক পাই! তবে যেখানেই যাও, আমি ছাড়া তোর কপালে কেউ নেই, আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম, আছি, থাকবোও। অন্য কেউ এর মাঝখানে এলে আমি কিন্তু ..."
আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আর্যর ঠোঁট চেপে ধরে রিমার ঠোঁটদুটো।
শহরে আজ হাজার আলোর রোশনাই।
আজ যে তাদের প্রেমের দিন!!!
বন্ধুত্বের সম্পূর্ণতার দিন!!!
ভালোবাসার দিন!!!