Sanghamitra Roychowdhury

Romance Tragedy Classics

4  

Sanghamitra Roychowdhury

Romance Tragedy Classics

প্রেম অপ্রেম

প্রেম অপ্রেম

5 mins
290



ভালোবেসে পরিবারের অমতে বিয়ে করেছিলো অবন্তী আর ময়ুখ। প্রথম ছ-সাতটা মাস ছোট্ট এক কামরার ফ্ল্যাটে একটু কষ্ট করেই থাকতে হয়েছিলো। কিন্তু তারপর ময়ুখ অনেক বড়ো সরকারি চাকরি পেলো। আর অবন্তীকে নিয়ে ভালো পাড়ার ভালো

একটা ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠলো। ওরা সুন্দর ফ্ল্যাটে নতুন সংসার ঢেলে যত্ন নিয়ে সাজালো, অবন্তী আর ময়ুখ দু'জনে মিলে। সংসারে সুখ উপচে পড়ছে তখন। প্রথম প্রথম ভালোই চলছিলো। হঠাৎ করেই অবন্তী লক্ষ্য করে ময়ুখের মধ্যে যেন বেশ একটা পরিবর্তন এসেছে।




আগে মানে বিয়ের পরে প্রথম প্রথম ময়ুখ মাঝে মাঝেই অবন্তীকে নিয়ে ঘুরতে বেড়াতে যেতো। কখনো সিনেমা বা থিয়েটার, কখনো রেস্তোরাঁ বা শপিঙে নিয়ে যেতো। ভালোবাসতো উদ্দাম। দু'জন দু'জনের আশ্রয় পরিপূরক হয়ে উঠেছিলো। তবে দীর্ঘস্থায়ী হলো না অবন্তী ময়ুখের সাংসারিক অথবা দাম্পত্য সুখ। কিন্তু কেন এমন? অবন্তী ভেবে ভেবে কোনো কূলকিনারা পায় না। মনমরা হয়ে মুষড়ে থাকে অবন্তী।




ময়ুখ নিয়মমাফিক অফিসে যায়। একসময় ফিরেও আসে। আর সারাদিন একলা থেকে থেকে অবন্তী মুখিয়ে থাকে কখন ময়ুখ ফিরবে। তারপর দু'টো মনখোলা সুখ দুঃখের কথা বলা-কওয়া করবে দু'জনে। তা না অফিস থেকে ফিরে ফ্ল্যাটে আসার পর কিরকম খিটমিটে একটা মেজাজ নিয়ে থাকে আজকাল ময়ুখ। অবন্তীর সাথে অহেতুক খারাপ ব্যবহার করে, তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে, কখনো আবার অকারণেই।




ময়ুখের এই হঠাৎ পরিবর্তনে অবন্তীর খুব কষ্ট হয়। গলা বুজে, দমবন্ধ হয়ে বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চায় দলা পাকানো অভিমানী কান্না। বাড়ির কথা, বাবা-মায়ের কথা সর্বক্ষণ মনে পড়তে থাকে। ভাবে কোথায় ভুল হলো? কিসের গলদ? কিন্তু কিছু ধরতেই পারে না অবন্তী।




ময়ুখের ব্যবহার দেখে দেখে, সহ্য করে করে অবন্তীও আজকাল মাঝে মধ্যেই মেজাজ হারিয়ে ফেলছে। নয়তো স্বভাবগতভাবে অবন্তী ভারী ধীর স্থির, শান্ত নম্র ভদ্র, মিশুকে। কিন্তু অবন্তীর ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙছে আজকাল প্রায়ই। এইতো সেদিনের কথা, ময়ুখের ফোনে একটা মেসেজ এসেছে। অবন্তীও সামনেই ছিলো। অবন্তী হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিতে যেতেই ময়ুখ এসে একেবারে ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে নিলো। আর একগাদা ছোট-বড় কথা শুনিয়ে দিলো অবন্তীকে। সামান্য ব্যাপার। তাছাড়া

স্বামীর ফোন স্ত্রী হাতে নেওয়াটা তো বিরাট অন্যায়ের কিছুও নয়, তবুও। ময়ুখের ব্যবহারে ভীষণ আহত হলো অবন্তী। মনটা ভেঙে চুরচুর হয়ে গুঁড়িয়ে গেলো অবন্তীর। অবন্তী কান্না লুকোতে তাড়াতাড়ি ওদের শোবার ঘর লাগোয়া ব্যালকনিতে গিয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আজকাল প্রায়ই হয় এমন, অবন্তী ময়ুখের বছর দুয়েকের পুরোনো সংসারের তালটা যেন কেটে গেছে। অবন্তী খুব কষ্ট পায় মনে মনে। কাউকে কিচ্ছু বলতেও পারে না।




অবন্তী আর ময়ুখ দু'জনে মিলে অনেকগুলো বেলফুল আর গোলাপচারা লাগিয়েছিলো ওদের ব্যালকনির টবে, আগের বছরে, ফ্ল্যাটে আসার পর পরই। অনেকদিন পার হয়ে গেছে, গাছগুলো ঝাঁপিয়ে বেড়েছে, কিন্তু তাও সেই গাছগুলোতে ফুল হয়নি। এমনকি কখনো এক আধটা যে কু্ঁড়ি আসবে, তাও আসেনি। গাছগুলো অবন্তীর বড়ো আপন। যেন অবন্তীর সুখ দুঃখ বোঝে সব। 




এতবড় ফ্ল্যাটটায় সারাদিন একলা থাকতে থাকতে দম বন্ধ লাগে অবন্তীর। এখনো অবন্তী ময়ুখ দুই থেকে তিন হতে পারেনি। তাই দিনের বেশিরভাগ সময়ে অবন্তী ঘরের জড়বস্তুগুলোর সাথে, ওদের ব্যালকনিতে টবের এই গাছগুলোর সাথে টুকটুক করে কত কী যে গল্প করে। তার সুখ দুঃখের গল্প।

বাবা-মায়ের গল্প। ছেলেবেলার সুখ ঠাসা দরাজ দিনের গল্প, এমনকি ময়ুখের সাথে প্রেম পর্ব আর ভালো বাসাবাসির গল্পও করে ওদের সাথে। এই মারাত্মক একাকিত্ব অবন্তীর জীবনটাকে গ্রাস করে নিয়েছে। ময়ুখ আজকাল ফ্ল্যাটে ফিরেই সামান্য চা জলখাবার খেয়েই বসে ল্যাপটপটা সামনে খুলে নিয়ে। কোনোদিন আবার ফোনটা নিয়ে। অবন্তী কেমন যেন অপাঙক্তেয় হয়ে পড়েছে ময়ুখের জীবনে। অবন্তী অপরাধী অপরাধী মুখ করে ওদের বিছানার একপাশে চুপটি করে শুয়ে থাকে বটে, তবে ঘুম আসে না অবন্তীর। অপেক্ষা করে থাকে, কিন্তু ময়ুখ আর আগের মতো বিছানায় এসে "সোনা বৌ" বলে অবন্তীকে জড়িয়েও ধরেনা। দিন কেটে যাচ্ছে এভাবেই, অবন্তীকে দুমড়ে মুচড়ে পিষে দিয়ে।




আজকাল তো অবন্তী আর ময়ুখের মধ্যে কোনো কথাবার্তাও হয়না। ১৪ই ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস। ভ্যালেন্টাইন্স ডে। অবন্তী খুব যত্ন করে ময়ুখের প্রিয় চকোলেট কেক আর ক্ষীরের পাটিসাপটা ‍ বানিয়ে সারাটা দিন অপেক্ষা করেছে, ময়ুখ অফিস থেকে ফিরে ফ্ল্যাটে আসেনি। রাত বারোটা বেজে গেলো। বসার ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ইলেকট্রনিক ঘড়িতে তারিখটা বদলে গিয়ে ১৫ হয়ে গেলো। ভ্যালেন্টাইন্স ডে পার হয়ে গেলো।

পরেরদিন সকালে ময়ুখ ফ্ল্যাটে ফিরেছে। চোখেমুখে রাত জাগার স্পষ্ট ছাপ নিয়ে। অবন্তী একবারও কিছু জিজ্ঞেস করেনি। জানতে চায়নি সারারাত ময়ুখ কোথায় ছিলো, অথবা রাতে ফ্ল্যাটে আসেনি কেন।




এরপর অবন্তী কথাবার্তা একেবারেই বন্ধ করে দিলো। কাজের লোকজনের সাথেও কথা বলতো না। নিজের অযত্ন, অনিয়ম শুরু করেছিলো। দুঃসহ একাকিত্ব আর দিনের পর দিন ময়ুখের চূড়ান্ত অবহেলায় জর্জরিত অবন্তী নিজেকে গৃহবন্দী করে ফেলেছিলো। শোবার ঘরে আর ঢুকতো না অবন্তী। গেস্ট রুমের দরজা জানালা বন্ধ করে অন্ধকার ঘরে থাকছিলো, তাও টনক নড়েনি ময়ুখের। নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে ময়ুখ অবন্তীকে ভয়ঙ্কর অবহেলা করছিলো, তা কেউ জানতেই পারেনি। কারণ অবন্তী ময়ুখের এইসব কীর্তিকলাপ জানায়ইনি কাউকে কখনো। শুধু নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে দিনের পর দিন।



আসলে ময়ুখ আর অবন্তীর মাঝে একজন তৃতীয়

অস্তিত্ব এসে প্রবেশ করেছিলো। ময়ুখের কলিগ, ডিভোর্সি, মারকাটারি সুন্দরী, এবং একদা ময়ুখদের পাড়ার প্রতিবেশী মেয়ে রীতি। এক অফিসে চাকরির সুবাদে আবার যোগাযোগ। তা থেকে বন্ধুত্ব, এবং তার চেয়েও বেশী কিছু হয়ে উঠতে সময় লাগেনি।

ময়ুখ বিবাহিত, অবন্তীকে ভালোবেসে বাড়ির অমতে বিয়ে করেছে। পরিপাটি সুখের সংসার ওদের। অবন্তী নিজের প্রাণের থেকেও বেশী ভালোবাসে ময়ুখকে। এতোসব কিছুর পরেও ময়ুখ আর রীতি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। উদ্দাম সম্পর্কে অবৈধ প্রেমে কিছু মাস পার হতে না হতেই ময়ুখের সাথে সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে রীতি। অফিসে সদ্য জয়েন করা ওদের এক নতুন আনম্যারেড কলিগের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে রীতি। ধাক্কাটা খেয়ে ময়ুখের যখন সম্বিত ফিরলো, তখন অনেক অনেক দেরী হয়ে গেছে।




ময়ুখ ফিরে এলো অবন্তীর কাছে। তবে অবন্তী এখন আর একটা শব্দও উচ্চারণ করে না মুখে। অবন্তী কথা হারিয়ে ফেলেছে চিরতরে। কথা বলানোর বৃথা চেষ্টা করে ময়ুখ প্রাণপণ, তবে তাতে কোনো লাভ হয়নি। সবসময় ঘরে অন্ধকারে থাকতে থাকতে অবন্তী চোখে আলোও সহ্য করতে পারে না। চোখ বুজেই থাকে। একলা থাকলে চোখের কোল বেয়ে জল গড়ায়। ময়ুখের উপস্থিতিতে তাও নয়। জড়পদার্থের মতো চোখ বুজে পড়ে থাকে অবন্তী। চেহারাটা যেন মিশে গেছে বিছানায়। খেতো না ঠিকমতো। ময়ুখ কখনো খেয়াল পর্যন্ত করেনি।




ময়ুখ এখন প্রায় বেশিরভাগ দিনই ছুটি নিয়ে ফ্ল্যাটে থাকে। শুধু কাজের লোকের ওপরে ভরসা রাখতে পারে না। অনেক বড় বড় ডাক্তার দেখায় অবন্তীকে। মোটামুটি সব ডাক্তারেরই কমবেশী একই মতামত। অবন্তী এখন যে কণ্ডিশনে রয়েছে তাতে এর থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবুও ভরসা রাখতে হবে। অবন্তীর বাবা-মা, ময়ুখের বাবা-মা, ওদের দু'বাড়ীর সব আত্মীয়-স্বজন সবাই আজকাল আসা যাওয়া করছে। আর ময়ুখ তো পুড়ে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে অন্তর্দহনে। ডাক্তারেরা জানিয়ে দিয়েছেন, যত্ন আর ভালোবাসাতেই অবন্তী যদি আবার সুস্থ স্বাভাবিক হয়। এবং ভালোবাসা যত্ন আর দাম্পত্যের দাবী মেনে দেওয়া অবন্তীর প্রাপ্য সময়ই হলো এই মুহূর্তে অবন্তীর একমাত্র ঔষধ। আজকাল ময়ুখ অবন্তীকে খুব যত্ন করে। খুব ভালোবাসে। অফিসের সময়টুকু বাদ দিয়ে সারাক্ষণই অবন্তীর কাছে। অবশ্য অবন্তীর কিন্তু সেটা বোঝার ক্ষমতাটাই নেই আর। ক'দিন হলো সম্পূর্ণ চেতনা হারিয়ে ফেলেছে অবন্তী। কোমায় আছে এখন। ময়ুখের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের ফলে আঘাতের অভিঘাতে অবন্তী আজ সব মায়ার বন্ধন কাটিয়ে চিরতরে চলে যাবার মুহূর্ত গুণছে। আর ময়ুখ ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাইতেও পারে না, কৃতকর্মের জন্য লজ্জায়। ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে যদি এবার সত্যিই কোনো মিরাকেল হয়... তার অপেক্ষায় রাত জাগে ময়ুখ হাসপাতালের করিডোরে অথবা অবন্তীর বেডের পাশে বসে, নির্নিমেষ।




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance