পরচর্চা
পরচর্চা
চুকলিবাজি করা, কিংবা উস্কানি দেওয়ার বিদ্যে সকলের রপ্ত থাকেনা। কেউ কেউ অবশ্য এই বিশেষ বিদ্যেটি নিয়েই জন্মায়। জন্মগত বিদ্যে বটে, তবে ঈশ্বরপ্রদত্ত বলা যায় কি? কারণ ঈশ্বর তো কেবল জীবজগতের মঙ্গলের উদ্দেশ্যেই নানান গুণ দিয়ে পাঠান জন্মের সময়। তবে অন্যের শুধুমাত্র ক্ষতিই করা যাবে যা দিয়ে তেমন বদগুণ ঈশ্বরপ্রদত্ত কিনা এর উত্তর সাবিত্রীর জানা নেই। তবে এই চুকলিবাজির জ্বালায় অস্থির সাবিত্রী। ওর প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়।
সাবিত্রীর বিয়ে হয়েছে আট বছর হয়ে গেছে। বাচ্চাকাচ্চা হলো না এখনো। ফিসফাস চলছে। শাশুড়ি দিনরাত কপাল চাপড়াচ্ছে। শ্বশুর মুখ গোমড়া করে আছে। সাবিত্রীর বর সত্যেনও চুপচাপ থাকে, তার মনে যে কি চলছে তা সাবিত্রী তেমন আঁচ করতে পারে না। তবে সাবিত্রীর সঙ্গে ওর শ্বশুরবাড়ীর কেমন যেন একটা আড়োআড়ো ছাড়োছাড়ো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সাবিত্রী অপরাধীর মতো মরমে মরে থাকে। নির্বাক পুতুলের মতো। মুখে অবশ্য কেউ কিছু বলে না, তবে ঠারেঠোরে ঠেস দিয়ে কথা বলতে ছাড়ে না। এই ঠেসের যে কি ভয়ঙ্কর মাহাত্ম্য, তার মর্ম কেবল ভুক্তভোগী মাত্রেই জানে।
প্রতিবেশীদের মতো পরম বন্ধু হয় না, আবার প্রতিবেশীদের মতো চরম শত্রুও হয় না। উস্কানি দিয়ে দিয়ে ঝগড়া লাগিয়ে দিতে ওস্তাদ। পাশের বাড়ির বীণা মাসিমা, সাবিত্রীর শাশুড়ির গলায় গলায় বন্ধু, বহুকালের বন্ধুত্ব। সেই সুবাদে সাবিত্রীদের বাড়িতে সর্বক্ষণই যাওয়া আসা আছে। পাড়ার ছেলেপুলেরা বীণা মাসিমার নাম দিয়েছে মোবাইল নিউজ চ্যানেল। ভুল কিছু নাম দেয়নি। সারা পাড়ার লোকের হাঁড়ির খবর ওনার নখদর্পণে। এবাড়ির কথা ওবাড়িতে, ওবাড়ির কথা সেবাড়িতে দিনরাত চালাচালি করাই ওনার কাজ। অদ্ভুত মহিলা!
বীণা মাসিমা সেদিন এলো সন্ধ্যেবেলা। ঢুকে গেলো সোজা সাবিত্রীর শাশুড়ির ঘরে। "শুনেছো, ননীর নাতি হয়েছে!" পান চিবোতে চিবোতে বলে। সাবিত্রীর শাশুড়ি রিমোট টিপে টিভিটা বন্ধ করে দিলো।সিরিয়াল দেখছিলো সাবিত্রীর শাশুড়ি, "ওমা, তাই নাকি? কবে হলো গো?" "এইতো, কালই তো হলো, নার্সিংহোমে। সিজার করে হয়েছে গো," তারপর বীণা মাসিমা ঠোঁট উল্টে বললো, "অবশ্য সিজার তো এখন জলভাত। বাচ্চা হলেই সিজার। সিজার না হলে, নার্সিংহোমের বিলটা মোটাসোটা হবে কী করে? আজকাল সবই তো ব্যবসা।" "যাক, তা বউ ভালো আছে তো?" বীণা মাসিমা একগাল হেসে বললো, "হ্যাঁ, মা বাচ্চা দুজনেই ভালো আছে।" কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ফোঁস করে একখানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বীণা মাসিমা সুর করে বললো, "তোমারই কপাল মন্দ। নইলে অ্যাদ্দিনে তো তুমিও নাতি নাতনির মুখ দেখতে। ঠিক কিনা বলো?" সাবিত্রীর শাশুড়ি চুপ করে রইলো। কথাটায় সম্মতির বা অসম্মতির কোনো ভাবই দেখালো না। মুখখানাও ভাবলেশহীন। বীণা মাসিমা উশখুশ করছে আরো কিছু বলবার জন্য।
সেদিকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে সাবিত্রীর শাশুড়ি বললো, "আর ওসব বলে কি হবে? হলে হবে, না হলে না হবে!" বীণা মাসিমা যেন একটু হতাশ হলো। কিন্তু হাল ছাড়লো না, " তাই বলে এইভাবে হাল ছেড়ে দেওয়াটাও তো কোনো কাজের কথা নয়, নাকি বলো না? তা, বৌমা কি বলে?" গুটিগুটি এবার কথা অন্যপথে এগুচ্ছে, সাবধানী সাবিত্রীর শাশুড়ি, "বৌমা আবার কি বলবে? তারও তো ইচ্ছে হয় মা হবার। কোন মেয়ে মা হতে চায় না বলো তো?" বীণা মাসিমার কপালে ভাঁজ, একটু যেন অন্য সুর। তাও গম্ভীরমুখে বললো, "আর তোমার ছেলে, সে কী বলে?" বুঝেশুনে কথাটা আলতো করে ছোঁড়ে, ওজনটা বুঝতে চাইছে। সাবিত্রী সবই শুনছে বারান্দায় বসে উল বুনতে বুনতে। "আমার ছেলে বরাবরই চুপচাপ, মুখে কিছু বলে না। কিন্তু, আমি বুঝতে পারি, সন্তান কে না চায়?" সাবিত্রীর শাশুড়ির দায়সারা উত্তরে হতাশ বীণা মাসিমা। উঠে পড়লো। এবারে শেষ ও মোক্ষম অস্ত্র, "দ্যাখো কী হয়? এখন তো আর তাবিজ কবচের যুগ নেই। ডাক্তারই ভরসা। যা ভালো বোঝো করো। আমি আর কী বলবো? যাই গো, একবার রাজুদের বাড়িতে যাবো। ওরা পুরী গিয়েছিলো, প্রসাদ দেবে বলে ওর মা ফোন করেছিলো। আসি গো এখন!" বীণা মাসিমার করুণ প্রস্থান। খেলটা তেমন জমলোই না। রাজুদের বাড়িতে যদি সেই খেদ খানিকটা মেটে। আপনমনে হেসে ফেললো সাবিত্রী।
বীণা মাসিমা চলে যেতেই সাবিত্রী শাশুড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। সাবিত্রীকে দেখে শাশুড়ি নিজেই মুখ খুললো, "চুকলিবাজদের কখনো বিশ্বাস করতে নেই। সব্বাই জানে, তবুও ভুল করে। আরে বাবা, এই সহজ হিসেবটা অ্যাদ্দিন মাথায় ঢোকেনি কেন, তাই জানি না। যে লোক এর কথাটা ওর কাছে চালাচালি করছে , সে লোক তো অবশ্যই আমার ঘরের কথাও অন্যের কাছে চালান করবে। অবশ্যই করবে।" সাবিত্রী তো
এতোক্ষণ ধরে আড়াল থেকে সবই শুনেছে। এবারে সাবিত্রী অনুযোগের সুরে বললো, "মা, তুমি ওনাকে সত্যি কথাটা বললে না কেন?" সাবিত্রীর শাশুড়ি একগাল হেসে বললো, "শিখে নাও বৌমা, যতই বাঁজা সেজে থাকুক কিছু মানুষের থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে হয়। নইলে, আখেরে ক্ষতিই হয়।" সাবিত্রীর এখন সবে তিন মাস চলছে। এখনই কানে গেলে বীণা মাসিমা গোটা পাড়ায় রাষ্ট্র করে বেড়াবে এমন খবর। সঙ্গে নানান রং চড়াবে। এসব পরচর্চার বিষয় আর ভাল্লাগে না সাবিত্রীর শাশুড়ির। মনে মনে একটু লজ্জাও হয়, এই বীণা মাসিমার উস্কানির কাছে নতিস্বীকার করে কম দুঃখ করেছে, "আমার ছেলের বৌটা বাঁজা," বলে বলে। তখন কী আর জানতো যে সমস্যাটা নিজের ছেলের? মুখ ফস্কে এসব কথা বেরিয়ে পড়লে রক্ষে নেই। বীণা মাসিমার দৌলতে দুনিয়া জানবে। তার থেকে মুখে তালাচাবি থাক। যখন সময় আসবে তখন তো সবাই নিজের চোখেই দেখবে। পরচর্চার সুযোগ কিছুতেই দেবে না সাবিত্রীর শাশুড়ি।
সাবিত্রী মুখ টিপে হেসে গুনে গুনে ঘর বন্ধ করলো, কী সুন্দর হয়েছে ছোট্ট মোজাজোড়া!