Sonali Basu

Inspirational

3  

Sonali Basu

Inspirational

প্রাণ প্রতিষ্ঠা

প্রাণ প্রতিষ্ঠা

6 mins
863


“ও বাবা, তুমি দত্ত দাদুদের ঠাকুর দালানে যাচ্ছ?”

দরজার দিকে এগোতে এগোতে হারাণ বলল “হ্যাঁ রে, মায়ের চেহারা গড়ে তুলতে হবে না। আর তো ক মাস পরেই দুর্গা পুজো। মায়ের মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে। তখন দেখবি মা কেমন হাসি মুখে তোর দিকে তাকিয়ে আছে”

“সত্যি বলছো?” লীলার গলায় অবিশ্বাস। “হ্যাঁ রে মা, সত্যি”

আশ্বস্ত হয়ে ছোট্ট মেয়ে এবার আব্দার জোড়ে “আমিও যাবো দেখতে কেমন করে তুমি মাকে বানাও”

ছোট্ট মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে সান্তনা দিতে দিতে বলে “এখন গিয়ে লাভ নেই সবে খড়ের ওপর এক মাটির প্রলেপ পড়েছে। এরপর এটা শুকোবে আবার মাটির প্রলেপ দিতে হবে যেখানে ফেটে যাবে”

“রঙ কবে হবে?”

“দেরী আছে”

“তাহলে তখন নিয়ে যাবে তো?”

“হ্যাঁ এখন বাড়িতে থাক”

বাড়িতে থেকে যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও লীলা থেকে গেলো। বাবা তো বলেছে পরে নিয়ে যাবে কিন্তু ওর তো আজই যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। ও পায়ে পায়ে রান্নাঘরের দিকে চলল। ওর মা জোছনা রান্না করছে। ওকে দরজা থেকে উকি দিতে দেখে হেসে বলল “কি রে কিছু খাবি?”

“না” উত্তর শুনে মা এবার মন দিয়ে ওর মুখের ভাব দেখলো তারপর বলল “তবে কি বাইরে খেলতে যেতে পারিসনি বলে মুখ ভার করেছিস নাকি?”

“না” এবারও না শুনে মা বলল “আর কোন কারণ আছে বুঝি?”

“হ্যাঁ বাবাকে বললাম সাথে নিয়ে যাও, আমি ঠাকুর গড়া দেখবো কিন্তু বাবা নিয়ে গেলো না”

“কি বলল নিয়ে যাবে না?”

“না বলল পরে নিয়ে যাবে”

“এই তো বলেছে যখন তাহলে তো রাগের কিছু নেই, ঠিক নিয়ে যাবে”

“তাহলে কিছু খেতে দাও”

“কি খাবি?”

“নাড়ু”

“আমার হাত জোড়া সোনা, তুই নিয়ে নে আর নাহলে মামীকে বল দিয়ে দেবে”

“আচ্ছা” লীলা দৌড়ে চলে গেলো পাশের ঘরে মামীর খোঁজে। মামী গোপা তখন দাদাকে স্নান করিয়ে জামা পড়িয়ে দিচ্ছে। ওকে প্রায় ছুটে ঘরে ঢুকতে দেখে মামী বলল “কি রে ছুটছিস কেন?”

“নাড়ু খাবো”

“দিচ্ছি দাঁড়া, আগে এটাকে জামা পড়িয়ে নিই। তুই কখন স্নান করবি, আজ রবিবার বলে কি ওটা করবি না ঠিক করেছিস?”

“না করবো, মা করিয়ে দেবে” দাদা মন্টু ওদের কথার মাঝে বলে উঠলো “মা আমাকেও নাড়ু দেবে”

গোপা বলল “দুজনকেই দেবো কিন্তু আগে স্থির হয়ে দাঁড়াও। এভাবে লাফালাফি করলে তো জামা পড়াতে দেরী হবে আর এদিকে দেরী হলে নাড়ু দিতেও দেরী হবে”

এ কথা শুনে মন্টু সাথেসাথেই স্থির দাঁড়িয়ে পড়লো। জামাকাপড় পড়ার পর চুল আঁচড়ানো হয়ে গেলে গোপা আঁচলে হাত মুছলো তারপর তাকের ওপর থেকে কৌটো পেড়ে ওদের দুই ভাই বোনকেই দুটো করে নাড়ু দিলো। নাড়ু পেয়েই লীলা ঘর থেকে ছুটে বেরোল, পেছন পেছন মন্টু। ওরা দুজনেই উঠোনে এসে দাঁড়াতে পাশের বাড়ির ছাদ থেকে তিথি ডাকলো “কি রে লীলা কি খাচ্ছিস?”

লীলা মুখ তুলে তিথিকে দেখে বলল “নাড়ু গো দিদি”

“আমাকে খাওয়ালি না তো?”

“দাঁড়াও তোমার জন্য নিয়ে আসছি” বলেই লীলা দৌড়ে ঘরে ঢুকে মামীর কাছে চেয়ে আবার নাড়ু নিলো তারপর গেট পেরিয়ে ওদের বাড়িতে গিয়ে ঢুকলো। তিথি ছাদ থেকে উঠোনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল “ওপরে উঠে আয়, আমি সিঁড়ির কাছে দাঁড়াচ্ছি”

খানিক পরে লীলা ধীরে ধীরে ওপরে উঠে এলো। তারপর তিথির হাতে নাড়ু দিয়ে বলল “এগুলো তোমার”

“থ্যাংক ইয়্যু” তিথি নাড়ু খেতে খেতে বলল “তুই স্নান করিসনি কেন?”

“মা রান্না করছে, হয়ে গেলে স্নান করিয়ে দেবে”

“ও আর মন্টু কি করছে?”

“ও এই স্নান করে বেরোলো তাই মামী আসতে দিলো না”

ওরা ছাদে ঘুরছে আর গল্প করছে এমন সময় দেখা গেলো লীলার বাবা আর বাপী দুজনে একই সাথে ফিরছে। ছাদ থেকে ওদের দুজনকে আসতে দেখে লীলা বলল “তিথিদিদি আমি এখন বাড়ি যাই। বাবা ফিরছে বাপীও”

ওদের পেছন পেছন লীলাও বাড়ি ঢুকলো। ওর মা বলল “কিরে তুই স্নান করবি না?”

“তুমি করিয়ে দাও”

“ঠিক একটু বস আমি রাহুলকে খেতে দিয়ে নিই”

লীলা বলল “না বাপী আজ আমাদের সাথে খাবে” তারপর বাবার দিকে ঘুরে বলল “বাবা তুমিও স্নান করে নাও”

রাহুল উত্তর দিলো “না মা, আপনি আগে লীলাকে স্নান করিয়ে নিয়ে আসুন আমরা সব এক সাথেই খাবো”

জোছনা লীলাকে নিয়ে চলে গেলে রাহুল হারানকে বলে “বাবা আপনারা না থাকলে লীলাকে কি ভাবে যে সামলাতাম বড় করতাম ভাবতেও পারি না। যেভাবে ওর মা পাখী চলে গেলো অকালে…”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হারান বলল “সবই তোমাদের দুজনের সেই সাথে আমাদের দুর্ভাগ্য নাহলে এতো কম বয়েসে ও পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যায়! লীলার যখন জন্ম হল তখন আমার পাখী মায়ের কি আনন্দ। বলেছিল বাবা জানো আজ আমি খুব খুশি। ঠাকুরের কাছে পুতুলের মতো মেয়ে চেয়েছিলাম তাই পেয়েছি। অথচ সেই মেয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ও চলে গেলো”

রাহুল বলল “সত্যি বাবা সেদিন অত সকালে যদি বাজারের পথে বেরিয়ে না যেতাম তাহলে হয়তো পাখীকে আগুনের গ্রাস থেকে বাঁচাতে পারতাম। শীতের সকাল পাড়া প্রতিবেশীরাও সেরকম কেউ বাড়ির বাইরে ছিল না যে ওকে বাঁচাতে পারবে। শরীর থেকে উলের পোশাক খুলতেই পারেনি। বুঝতেই তো পারেনি কখন উনোন থেকে শাড়িতে আগুন ধরে গেছে। শেষ মুহূর্তে হাসপাতাল নিয়ে গেলেও ডাক্তার কিছু করতে পারলো না”

আরও কিছু আলোচনা হওয়ার আগেই লীলা লাফাতে লাফাতে ঘরে ঢুকলো তারপরই কলকল করে উঠলো “ও বাবা ও বাপী তাড়াতাড়ি স্নান করো খিদে পেয়ে গেলো তো”

দুজনেই “এই যাই মা” বলেই কুয়োতলার উদ্দেশ্যে চলে গেলো। দুপুরের খাওয়া সেরে লীলা ওর বাপীর গলা ধরে আব্দার জুড়ে বসলো “ও বাপী, বাবাকে বলো না আমি ঠাকুর গড়া দেখবো”

রাহুল মেয়েকে আদর করে বলল “তা সেটা তো তুমি বাবাকে নিজেই বলতে পারো”

“বলেছিলাম, কিন্তু বাবা নিয়ে যাচ্ছে না”

“ঠিক আছে আমি বলে দেবো”

লীলা রাহুলের গালে হামি খেয়ে বলল “তুমি খুব ভালো বাপী”


পরেরদিন বাবার হাত ধরে লীলা গেলো দত্তদের ঠাকুর মন্দিরে। মন দিয়ে দেখলো কি ভাবে খড়ের কাঠামোর ওপর মা দুর্গা সহ বাকি ঠাকুর গড়ে উঠছে। দুপুরে বাবার সাথে ফিরে এসে স্নান করলো ভাত খেলো। এরপর থেকে প্রতিদিনই ও ঠাকুর গড়া দেখতে যায়। মন্টু বলে “কি রে বুনু তুই তো সারাক্ষণ মন্দিরেই থেকে যাচ্ছিস, আমার সাথে তো খেলিসই না”

লীলা উত্তর দেয় “আমি একটা জিনিস শিখছি রে”

“কি” আগ্রহ দেখায় মন্টু।

“পরে বলবো” লীলা চলে যায়।


দেখতে দেখতে মহালয়া পেরিয়ে গেলো, ঠাকুর তৈরিও শেষ। আজ লীলা আর যায়নি মন্দিরে দাদুর সাথে বরং একটা কাজ করছে মন দিয়ে পেছনের বাগানে বসে। একবার মন্টু এসে দেখে গেছে ও কি করে তারপর ওর দিদাও দেখে গেছে, লীলা মাটি দিয়ে কি করছে যেন। আজ ও আপন মনে কাজ করছে কাউকে বিরক্ত না করে তাই কেউ আর কিছু বলেনি। দুপুরে প্রতিদিনের মতো রাহুল এলো কাজের থেকে মেয়েকে একবার দেখে যাওয়ার জন্য। কিন্তু লীলা তো ঘরে নেই। মন্টুকে কাছে পেয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে তার ছোট্ট মেয়ে বাগানে বসে কি যেন করছে। রাহুল চলে আসে পেছনে। এসে দেখে লীলা মাটি দিয়ে একটা মহিলা মূর্তি বানিয়েছে, গড়ন ঠিকমতো না হলেও বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। রাহুল মেয়ের পাশে গিয়ে মাটিতে বসে পড়ে বলে “এটা কি বানাচ্ছো মা?”

“মামণিকে। মামণি যে আমায় ছেড়ে চলে গেছে” একটু চুপ করে থেকে তারপর আবার বলে “বাবা বলে দুর্গা মায়ের মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হলে মা জ্যান্ত হয়ে যাবে। তখন দুর্গা ঠাকুর আমাদের সব কিছু দেখতে শুনতে পারবে। তাহলে এই মূর্তিতে কি ভাবে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবো যাতে মামণি ফিরে আসে”

মেয়ের মুখে এই কথা শুনে রাহুল আর কোন উত্তর দিতে পারে না প্রশ্নও করতে পারে না, শুধু পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকা শ্বশুরমশাই শ্বাশুড়িমাকে দেখে। হারান জামাইকে সরিয়ে নিজে লীলার পাশে বসে তারপর বলে “লীলা মা এই মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা একমাত্র মা দুর্গাই পারে। তুমি তার কাছে সেই আশীর্বাদ চেয়ে নিয়ো”

রাতে লীলা ঘুমিয়ে গেলে হারান বলে “বাবা এবার তোমার হাতে সব কিছু। তুমিই পারো লীলার আশা পূরণ করতে”

“কিন্তু বাবা আমি যে পাখীকে ভুলতে পারবো না”

“সেটা আমরা কেউই পারবো না কিন্তু লীলার কথাটাও তো তোমাকে ভাবতে হবে”

রাহুল চুপ করে থাকে।


দশমীর বিকালে বিসর্জন দেখে পাখী ফিরে এসে বলে “বাবা জানো মা দুর্গা যাওয়ার সময় আমায় আশীর্বাদ দিয়ে গেছে। আমার মামণির প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে আর খুব তাড়াতাড়ি”

হারান হাসিকান্না মাখানো মুখে লীলার দিকে চেয়ে থাকে।

  


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational