ফেরা
ফেরা


প্রথমে খানিকক্ষণ টিপটিপ করে, তারপরেই ঝমঝমিয়ে নেমে এলো বৃষ্টি। আকাশ কালো মেঘে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে, শুধু মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকানিতে চারিদিক উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। তাল নারকেল গাছের মাঝে হাওয়া বইছে শনশন। তালে তালে মাথা নাড়াচ্ছে তারাও।
"খোকা, খোকা, যাসনে; ওই দ্যাখো, কি ডাকাত ছেলে রে বাবা! কিরকম বাজ পড়ছে, এর মধ্যে লাফাতে লাফাতে কোথায় চললি রে, ও খোকা?"
"এই তো মা, আসছি এক্ষুণি।"
মা'র চিৎকার গেরাহ্যি না করে বিলু এক দৌড়ে নেমে পড়লো রাস্তায়। মিত্তিরদের বাড়ির ভাঙা পাঁচিল টপকে ওপারে আমবাগানে ঢুকে পড়ার আগে দ্রুত একঝলক ওদের দোতলার দিকে তাকালো সে। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একমাথা কোঁকড়া চুল টেনে দু'বিনুনি করা প্রিয় মুখটা একটা কিছু বললো চেঁচিয়ে। তার দিকে হাতটা একবার নেড়েই বিলু ফলসাবনের মধ্যে দিয়ে শর্টকাট করে একেবারে কইপুকুরের চানঘাটে এসে হাঁফাতে লাগলো। বুকটা একটু টনটনও করছে কী!
গোটা দীঘিটায় তখন পাগলের মতো দাপাদাপি জুড়েছে বৃষ্টিফোঁটারা। ঝাপসা হয়ে গেছে ওপার। দৃশ্য শ্রাব্য সবকিছুই যেন আবছা। সেইসব আবছায়া ভেদ করে ভেসে এলো কিছু কথা, কিছু অস্পষ্ট শব্দ, কিছু অনুভব।
"বাবা, বাবা..."
"শুনছো, ওগো..?"
বিলু বলতে চাইলো,"আঃ, পিছুডাক দিওনা তো!" বিরক্তিকর কথামালাকে ছাপিয়ে উঠলো একটা কষ্ট। হাঁফটা কি বাড়ছে? ঝপ করে একটা আওয়াজ শুনে সামনে তাকিয়ে দেখে, পুকুরপাড়ের বাঁকা তালগাছ থেকে একটা বড় কালো হেঁড়ে তাল পড়লো জলে, পড়েই তলিয়ে গেলো নীচে। এখনি ভেসে উঠবে আবার। ভেসে ওঠার আগেই জলের নীচে ওটাকে ধরতে পারলে তবেই না সে চ্যাম্পিয়ন সাঁতারু। সে জানে, মিত্তিরদের দোতলার জানালাটা এখনো খোলাই আছে, দু'বিনুনি দাঁড়িয়েই থাকবে ওখানে, যতক্ষণ না সে ফিরছে। তালটা হাতে নিয়েই ফিরতে হবে। বুকের ব্যাথাটা বোধহয় বাড়ছে। সে যাই হোক, ডাইভটা দিয়েই দিলো বিলু।
সাথে সাথেই কেউ যেন নব ঘুরিয়ে বৃষ্টির আওয়াজটা মৃদু করে দিলো। একটা টানা শোঁ শোঁ শব্দ শুধু। নীরবতার ঘেরাটোপে নিমগ্ন হতে থাকলো সে। বুকের ব্যাথাটাও যেন কমে গেল! আহ্, অপার শান্তি!
ডাঃ রায় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, " আয়্যাম সরি, দত্তসাহেব ইজ নো মোর।"
কান্নার রোল উঠলো বিলাস দত্তের বাড়িতে, যাকে বিলু নামে ডাকার মতো কেউ নেই আর । খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন শেষের ক'দিন।