পাকাবুড়ি
পাকাবুড়ি


" রংতুলির গান " গেয়ে শুভাশীষ সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো । সুর দিয়েছিলো নিজেই কিন্তু লেখাটা ছিলো ফেসবুকে পাওয়া ।
হঠাৎ সেদিন কবিতার একটা পেজ দেখতে দেখতে একটা দারুণ কবিতা দেখে চোখ আটকে যায় তার ।প্রথম কটা লাইন এরকম :
" নীলরঙা খামে ভরা আকাশের মাঝে ,
লিখে যায় কুঁচো মেঘ আদরের ভাঁজে ।
আমি রংতুলি নিয়ে আঁকি দিনকাল ,
শিউলির আবেশে বাঁধি মায়াজাল ।
শোনো বলি শোনো শরতের গল্প ,
রংতুলি সাজালো ছোট্ট ছোট্ট গল্প । "
পুরো কবিতা পড়ে মনটা ভালো হয়ে গেলো শুভাশীষের । কবিতাটা লিখেছেন মধুরিমা সেন বলে একজন । অফিসের কাজের চাপ লহমায় ছেড়ে যায় যখন সে শাটলে বসে এই কবিতাটা পড়ে ।
রাতে একটু সিন্থেসাইজার নিয়ে বসার অভ্যাস আছে শুভাশীষের । আজ খাবারটা কীরকম তাড়াহুড়ো করে খেলো । মা বললেন , " কি রে বাবু এত তাড়াহুড়ো করছিস কেন ? ধীরে না খেলে হজম হবে না । "
" এই তো কেমন আস্তে চিবোচ্ছি । " বলেই শুভাশীষ হাতের তাল দিতে দিতে মাথা নাড়াতে লাগলো ।
" তুই পাগল হয়ে যাবি বাবু , দিনরাত এই কবিতা , গান নিয়ে থাকা ভালো কিন্তু খাবারের সময় শান্তি করে খা । কি বলি বলো তো তোমার ছেলেকে ? " বললেন মা ।
বাবা বললেন , " আজ আবার কোন সুর পেলি ? "
শুভাশীষ বললো , " আরে আজ ফেসবুকে একটা এতো সুন্দর কবিতা পড়লাম একটা পেজে , মনে ঘুরছে তখন থেকেই । মধুরিমা বলে একজন লিখেছেন , ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালাম । "
" কীরকম দেখতে রে বাবু ? " মা বললেন ।
" ওফ মা ! একেই চাপে আছি অচেনা একজনের কবিতা নিয়ে সুর ঘুরছে মাথায় , তারপরে তাকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি তার মধ্যে ... তুমি না ... "
শোওয়ার আগে বসলো লেখাটা নিয়ে । বহু চেষ্টার পর একটা সুরের বাঁধনে আনতে পারলো । শুতে শুতে ২টো বেজে গেলো । পরের দিনই একবার চেক করে নিলো রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট হয়েছে কিনা । না হয়নি ।
সামনের শনিবার কয়েকজন বন্ধুরা একসঙ্গে হলে পরে শুভাশীষ এই গানটার উপর মিউজিক ভিডিও করার প্রস্তাব করে । সবাই সুরের মূর্ছনায় অভিভূত হয়ে রাজি হয়ে যায় । একমাস পর ভিডিওটা ইউটিউবে রিলিজ করলো ওরা । সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করলো ওরা ভিডিওটা । লিরিকসে মধুরিমা সেন আর সুরে শুভাশীষ কর । ওরা ভিডিওর শুরুতে বলে দিয়েছিলো , " লিরিসিস্টের সাথে আমরা দেখা করতে ইচ্ছুক , এই ভিডিও দেখে তিনি দেখা করতে চাইলে ডেসক্রিপশনে দেওয়া নম্বরে যোগাযোগ করুন । "
ভিডিওটা ভায়রাল হতে দুদিন সময় লেগেছিলো । এর আগেও শুভাশীষ কয়েকটা গান রেকর্ড করেছিলো কিন্তু তা জনপ্রিয়তা পায়নি । সেগুলো লিখেছিলো সে নিজে অথবা চিন্ময় বলে এক বন্ধু । তবে এবারের গানটা প্রচুর জনপ্রিয় হলো । এক সপ্তাহেও কিন্তু লেখিকার থেকে রেসপন্স এলো না ।
ঠিক দুসপ্তাহ পরে সকালবেলা অফিস যাওয়ার পথে এলো ফোনটা ।
সবেমাত্র ইউটিউব চ্যানেলটা খুলে ভিউয়ার্স আর লাইকস দেখছিলো ভিডিওটায় । প্রায় ১০০০ লাইক আর ৫০ হাজার ভিউ । মন্দ নয় । আত্মতুষ্টিতে থাকতে কদিন মধুরিমা সেনের কথা ভুলে গিয়েছিলো । হঠাৎ অচেনা নম্বরে ফোন এলো । ট্রুকলারে নাম দেখে সতর্ক হয়ে উঠলো । নাম মধুরিমা সেন ।
" হ্যালো , শুভাশীষ বলছেন ? "
" হ্যাঁ নমস্কার , আমি যদি খুব ভুল না করি আপনি মধুরিমা বলছেন । "
" হ্যাঁ , আপনার গান আমি শুনেছি । "
" কেমন লাগলো ? বাই দ্য ওয়ে লিখেছেন কিন্তু অসাধারণ । "
" নিজের লেখা কবিতার এত সুন্দর রূপ আমি আর পাবো কিনা সন্দেহ । কি দারুণ গেয়েছেন ! "
" এই লেখাটা কি পসিবল হতো লেখাটা না থাকলে ? "
" ওই আরকি । কিন্তু আমার একটা অভিযোগ আছে সেটা আপনাকে দেখা হলেই জানাবো । "
" কপিরাইট কেস ঠুকবেন নাকি ? ডিসক্লেমার দিয়েছিলাম তো ! "
" হ্যাঁ বড়সড় কেস । এই থানাতেই বসে কোন ধারায় কেস দেবো সেই কারণে । "
" অ্যাঁ ? "
" আরে মশাই আসুনই না । ভয় কেন এতো ? কেস ঠোকার হলে আমি আপনাকে থুড়ি ফোন করে মিষ্ট বাক্যালাপ করতাম ? "
ওরা ঠিক করলো দুদিন পর ইকোপার্কে দেখা করবে সেভেন ওয়ান্ডার্সের গেটে । কথামতো শুভাশীষ পাঁচটা নাগাদ অফিসে বলে বেরিয়ে পৌঁছে গেলো স্থানে ।
প্রোফাইল ফটো দেখে রাখায় চিনতে অসুবিধা হলো না মধুরিমার । শুভাশীষের পিছন থেকে হঠাৎ তার নাম ভেসে আসায় সে ঘুরে তাকাতেই মধুরিমাকে দেখলো ।
প্রোফাইল ফটোতে চেহারা ঠিকঠাক বোঝেনি । আজ সামনাসামনি দেখে বিভোর হয়ে গেলো । কিন্তু মুহূর্তখানেক স্থির হয়ে গেলো তার কাঁধের ঠিক ওপরে গভীর কাটাচিহ্ন দেখে । লহমায় শুভাশীষের মনে পড়ে গেলো ছোটোবেলার কথা ।
শুভাশীষ গ্রামের ছেলে । আদিবাড়ি বাঁকুড়ার এক গ্রামে । করবাড়ির দুর্গাপুজোয় প্রচুর হৈচৈ হতো । খুব মনে পড়ে দিনগুলো । পাশেই ছিলো সেন বাড়ি । দুই বাড়ির মধ্যে হৃদ্যতা ছিলো প্রচুর ।
ঠিক দশবছর বয়স শুভাশীষের , সেবারের পুজোর কথা মনে পড়ে গেলো । ঠাকুরদালানে চক্ষুদান হচ্ছে । সেনবাড়ির ছোটোমেয়ের সাথে তার খুব ভাব ছিলো । লুকোচুরি খেলছিলো । হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়লো মেয়ে । সামনে কাঁটাঝোপে হঠাৎ কাঁধের কাছে গভীরভাবে কেটে গেলো । সে কি কান্না ! সেনগিন্নী হাউ হাউ করে কাঁদছেন , মেয়েকে কোলে করে প্রমোদ ডাক্তারের কাছে ছুটলেন । অ্যান্টিটিটেনাস ইঞ্জেকশন আর ব্যান্ডেজ করে ফিরলো ।
সেইরাতে হাল্কা জ্বরে পড়লো আর তার পাশে বসেছিলো সারারাত শুভাশীষ ।
এর ঠিক দুবছর পর জমি নিয়ে শোরগোলে ভিটে ছেড়ে কোলকাতায় ঘর ভাড়া নিয়ে চলে এলো । কিছু বছর পর সোদপুরে জমি নিয়ে বাড়ি করলো । যাওয়াটা এত দ্রুতই হয়েছিলো গ্রামের কাউকে সেরকম বলার সুযোগ হয়নি । শুভাশীষের বাবা শহরের প্রচুরের লোকের পরিচিত বলে বাড়ি পেতে অসুবিধে হয়নি ।
মধুরিমা শুভাশীষের চমক কাটাতে টুস্কি বাজালো ।
" কি হলো ? "
" ওই গভীর ক্ষতটা কীসের ? "
" এখনও বোঝা যায়নি ? "
" না মানে সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে । "
" গুলোনোরই কথা । ফেসবুক কমই খুলি , তাই রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্টে সময় লাগলো । কিন্তু মুখের মধ্যে কিছুই ছাপ ছিলো না ছেলেবেলার ? "
" প্রোফাইল ফটোয় বুঝিনি । "
" মধুরিমা নামটা তুমি জানতে না ? "
" না মানে জানার কথা ছিলো কি ? আপনি কি বলছেন ... "
" এখনও আপনি ? হুতোম দাদা পাকাবুড়িকে মনে পড়ে না । মানছি , আসল নাম জানতেই না কারণ মা ডাকতেন শ্যামা বলে , বন্ধুরা সোনা বলে কিন্তু মুখ দেখেও বোঝা যায় না ? "
" পাকাবুড়ি ... মানে তুই এত বড় হয়ে ... "
" ওফ বুড়োদের মতো কথা বলো না তো । তুমি যেন খোকা আছো ? "
" হুমম । কি তাড়াতাড়ি সময় চলে যায় , তাই না ? "
" তুমি কিচ্ছু না বলে তখন চলে এলে । তোমরা ছেলেরা এসব মনে রাখো না । আমি কিন্তু তোমার কথা ভুলতে পারিনি । "
" এই তবে অভিযোগ । এই কান মুললাম । ক্ষমা কর মা । "
" ওরকমভাবে হবে না , আমরা এবছর গ্রামে যাবো একসঙ্গে । আমার বাবা ওখানেই আছেন এখনও । উকিলের সাহায্যে উনি করবাড়ি বেহাত হতে দেননি । জমি নিয়ে যারা শোরগোল করছিলো তাদের সবাইয়ের সাজা হয়েছে । বাবা মনেপ্রাণে চান তোমরা ফিরে এসো । "
সেদিনই শুভাশীষ বাড়ি নিয়ে আসে মধুরিমাকে । বাবা মা তাকে চিনতে পেরে বুকে জড়িয়ে ধরে ।
মধুরিমা নাকি এইবছর বিটেক পাশ করেছে , গেট দিয়েছে , এম.টেক পড়বে সম্ভবত । শুভাশীষ আড়াই বছর হলো চাকরি করছে । ওরা পুজোয় বাঁকুড়ায় নিজের গ্রামে ফেরার তোড়জোড় শুরু করলো ।
আজ ষষ্ঠী । নিজের বাড়ির চাবি সেনবাবুর কাছেই রাখা ছিলো । চাবি নিয়ে কম্পমান হাতে ঘরের দরজা খুললেন করবাবু । ওদিকে শুভাশীষ বাড়ির সামনের অশত্থ গাছের দিকে কাউকে না বলে এগিয়ে গেলো । অনেক ছোটোবেলার স্মৃতি আছে ওখানে ।
ওর পিছনে পিছনে মধুরিনাও গেলো । গাছের সামবে এসে কোটরে হাত ঢুকিয়ে একটা ছবি আঁকা কাগজ বের করলো । পাকাবুড়ি ছুটছে আর লাঠি নিয়ে তাড়া করছে তার হুতোম দাদা । সে এঁকেছিলো । মধুরিমা বলে উঠলো , " লুকোচুরি খেলবে হুতোম দাদা ? "
" উবু দশ কুড়ি ত্রিশ চল্লিশ ... " বলে ওরা কে লুকোবে স্থির করতে লাগলো । অ ইরেই ছেলেবেলায় ডুবে গেলো ওরা । চড়া পরা নদীর পাশ দিয়ে দৌড়তে গিয়ে পা মুচকে বসে পড়লো মধুরিমা । শুভাশীষ আরও জোরে এসে ওকে তুলে ধরলো ।
মধুরিমা বললো , " আবার হারিয়ে দিলে তো হুতোম দাদা ! "
শুভাশীষ বললো , " তুই সারাজীবন যে এমনিভাবেই জিতিয়ে দিলি আমায় । " এরপরের ব্যাপারটার জন্য মধুরিমা প্রস্তুত ছিলো না । শুভাশীষ আলতো করে কপালে তার চুম্বন এঁকে দিয়ে বললো , " আমার পাকাবুড়ি । "