One Trip (পর্ব -দুই)
One Trip (পর্ব -দুই)
সীমা শান্তার কাঁধে হাত রেখে বললো "আমাকে ভুল বুঝিস না শান্তা, আমি এতো কিছু জানতাম না রে।"
" আমি কিছু ভাবিনি রে, লড়াই শেষে আমরা এখন সুখী, ভাই ভালো চাকরি করে। আমিও করছি, আর কারো উপর কোনো অভিমান নেই রে। যে আত্মীয়রা দরকারের সময় ছেড়েছিল হাত অদ্ভুত ভাবে জানিস সুসময় ফিরে এসেছে। "
সীমা এবারে একটা ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বললো "হ্যাঁ রে আগে কষ্ট করেছিস, এখন সুখের মুখ দেখেছিস। আর আমি মিথ্যা আলেয়া সুখের পেছনে ছুটে মরলাম কেবলমাত্র।"
শান্তা ওর দিকে তাকিয়ে বললো "কি হয়েছে সীমা বল আমায়.."
সীমা হেসে নিয়ে বললো "সে হবেক্ষণ, এতোদিন পরে একসাথে ঘুরতে বেড়িয়েছি এখন আনন্দ করবো না বুঝি। দাঁড়া... " বলে একটা ব্যাগ খুলে একটা খাবারের বাক্স খুলে বললো "দেখ তো খেয়ে কেমন হয়েছে? "
" কি রে এটা?"
" খেয়ে বল.." বলে সব বান্ধবীদের দিয়ে ট্রেনের কয়েকজনের হাতেও দিলো।
" অসাধারণ খেতে রে... কি দিয়ে বানিয়েছিস মিষ্টিটা জিজ্ঞেস করে অর্চনা।
" আন্দাজ কর.."
কেউ বলল ছানা, কেউ বলল ক্ষীর, কেউ বললো কাজু... সবাইকে অবাক করে দিয়ে সীমা বললো "তোরা সবাই ভুল, এটা আটা দিয়ে তৈরী। "
কপালে সবাই চোখ এমন করে তুললো বোঝা গেল কেউ বিশ্বাস করেনি। তারপর শান্তা আরেকটা বাক্স খুলে সবাইকে কুচো নিমকি দিতে দিতে বললো "এটাও নাকি ওর হাতের তৈরী। "
এতো সুন্দর মচমচে নিমকি ওরা ভাবতেই পারেনি বাড়িতে করা সম্ভব।
স্বপ্না ব্যাগ খুলে বললো "দেখ বাপু কিছু বানাতে পারিনি আমি, মালদহের বিখ্যাত কানসার্ট আর রসকদম্ব এনেছি কিনে।"
শান্তা বাচ্চাদের মতো বললো " রসকদম এনেছিস, দে দে আমায়, দেখ আমি দুটো খাবো কিন্তু। "
" সে খাস অনেক এনেছি।"
এবারে একে একে সবাই ঝাঁপি খুলে বসলো।
অর্চনা বললো " দেখ আমি কি এনেছি।" বলে একটা ছোট দুধের ক্যান দেখিয়ে বললো "এর মধ্যে আমাদের গঙ্গারামপুরের ক্ষীর দই। "
"বাঃ রে জম্পেশ রে.."
" না তো কি? আমি কাল বাপের বাড়িতে এসে কত সাবধানে রেখেছি তোরা জানিস। অবশ্য ওদের জন্যও এনেছিলাম, তবুও বাচ্চা-কাচ্চার বাড়ি।"
সীমা পীঠ চাপড়ে বললো "জিও মেরে জান।"
শান্তা এবারে দুটো বড় টিফিনবাক্স সীমার হাতে দিয়ে বললো "বল তো এতে কি আছে?"
সীমা গন্ধ শুঁকতে যেতেই শান্তা বাঁধা দিয়ে বললো "সেটা হবেনা, আন্দাজ করো।"
সীমা বললো "পায়েস.."
শান্তা রহস্যের মতো মুখ করে বললো "কিছুটা কাছাকাছি, তবে এটা আমাদের রায়গঞ্জের বিখ্যাত ছানার পায়েস। "
রুমা খুশী হয়ে বললো "তাই!! তোর জন্য অনেক গুলো চুমু..."
আজ সবাই যেন কিশোরী বয়সে ফিরে গিয়েছে।
রুমা এবারে ওর ঝাঁপি খুলে বললো " আমি বাপু মিষ্টি কিছু আনিনি, আমাদের বাড়ির পাশে একজন ভালো গাটিয়া আর ঝুরি বানায়। সেটা কিনে এনেছি।"
শান্তা বললো "তা বেশ করেছিস। মিষ্টির মাঝে তোর ঝুরি, গাটিয়া খেয়ে মুখ খুলবে। "
সীমা পেটে হাত দিয়ে বললো "যাই বল বাপু আমার বড্ড খিদে পেয়ে গিয়েছে। "
" সে তো বুঝতে পারলাম, মালার জন্য অপেক্ষা করলে ভালো হতো না।"
রুমা উজ্জ্বল মুখে শান্তার দিকে তাকিয়ে বললো "মালাও আসবে রে?"
" রাজি করিয়েছি অনেক কষ্টে, আসলে ওকে খাগড়া ঘাট থেকে উঠতে হবে। সেখানকার পরিবেশটা একদম ভালো না। ও যদি ওর দেবরকে রাজি করে আসতে পারে তো আসবে বলেছে।"
সীমা শান্তার কথাগুলো শুনে বলে " ওকে রাজি করাতে পারলি সেটাই অনেক। মেয়েটার সত্যিই বাইরে আসা প্রয়োজন। একটু প্রকৃতির মাঝে এলে যদি মেয়েটা...."
রুমা সীমার কথা শুনে বললো "কেন রে, কি হয়েছে মালার?"
অর্চনা রুমার দিকে তাকিয়ে বললো "তুই কিছু জানিস না?"
" না রে..."
অর্চনা আর সীমা পরস্পরের দৃষ্টি বিনিময় করে নিলো।
স্বপ্না ওদের চুপ থাকতে দেখে মুখ খুললো এই বিষয় প্রথম " মালার কলেজের শেষ পরীক্ষা দেবার আগেই ওর পছন্দের ছেলের সাথে বাড়ির লোকেরা বিয়ে দিয়ে দেয়। ঠিক বিয়ে দিয়ে দেয় বললে ভুল। ও বিয়ে করে নিতে চায়, ওদের তো আজকের প্রেম ছিল না। প্রায় ছয় বছরের প্রেম, তখন অবশ্য ওর স্বামীরা পাশের কোয়ার্টারে থাকতো। মালার বাবা অবশ্য উঁচু পদে ছিল, অবশ্য প্রেম তো আর বলে কয়ে হয়না। হঠাৎ করে ছেলেটার বাবা মারা যায়, ছেলের বড় দাদা চাকরিটা পায়। প্রথমে সব ঠিক থাকলেও বিয়ের পরে থেকে ছোট দুই ভাই আর একমাত্র বোনকে আর সহ্য করতে পারে না। ওদের মা পেনসনের টাকাটুকু সম্বল করে তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে শ্বশুরবাড়ির ভিটে রঘুনাথগঞ্জে চলে আসে। তখন থেকে নাকি ছেলেটা আর্মিতে যাওয়ার চেষ্টা করতে শুরু করে। অনেক চেষ্টায় আর্মিতে চাকরিও পেয়ে যায়। চাকরি পাওয়ার পরে বাড়ি ঘর চলনসই করার পরে বিয়ের জন্য রায়গঞ্জে আসে৷ ততদিনে মালারা বেশ বড় একটা বাড়ি করে নিয়েছে। মালার বাবা এই বিয়েতে একদমই রাজি ছিলেন না। মালা বড় আদরে মানুষ, আর ছেলের বাড়তে কিছুই নেই বিলাসিতার দূর সাধারণ জিনিসপত্রও নেই, খালি কোনো মতে জীবন চালানো।
তার উপর ছেলে আর্মিতে চাকরি করে, মেয়ের ভবিষ্যৎ পদ্মপাতায় জলের মতো। কিন্তু মালার জেদের কারণে বাধ্য হয়ে বিয়ে দেন উনি। ততদিনে মালার বর ছোট ভাইটাকেও একটা ছোট দোকান খুলে দিয়েছে। ননদটারও বিয়ে ঠিক করাই ছিল ওরই একজন সহকর্মীর সাথে।বিয়ের বছর খানেকের মধ্যেই ছোট বোনের বিয়ে দিয়ে দেয়। বাড়িতে থাকার মধ্যে মালা,ওর দেবর আর শ্বাশুড়ি। বেশ কিছু বছর ওর ভালোই কেটেছিল, শ্বাশুড়িও বৌমা বড় ভালোবাসতো বলে শুনেছি। কিন্তু মেয়েটার কপালে সুখ বেশিদিন থাকলো না। বিয়ের ছয় বছরের মাথায় স্বামীকে হারালো অভাগী। ততদিনে দুই মেয়ের মা হয়ে গিয়েছে সে। দেবরেরও বিয়ে হয়ে গিয়েছে ওরই ননদের ননদের সাথে। দেবরের একটা ছেলেও হয়েছে। ধীরে ধীরে বাড়ির পরিবেশ কেমন বদলে যেতে লাগলো। অপয়া কথাটা অহরহ শুনতে হতো। " বলে একটু চুপ করলো।
" তুই এতোকিছু কি করে জানলি?"
" একবার বাপের বাড়িতে আসছিলাম শ্বশুরবাড়ি থেকে, আমার তখন সবে বিয়ে হয়েছে আর আমিও আসছিলাম। বাসে ওর সাথে দেখা, ওর সাদা থান দেখে আমি তো প্রায় কেঁদে ফেলেছিলাম, তখনই সব কিছু খুলে বলে। সে প্রায় হয়ে গেল নাই নাই করে বারো বছর। "
" তারপর কি হলো?"
" জানিরা আর তেমন কিছু ওর বিষয়ে।"
" আর কিছুই জানিস না?"
এবারে শান্তা শান্ত করে বললো "ওর মেয়ে দুটোর একজন এখন ওকালতি পড়ছে আর অপর জন বাবার মতো আর্মিতে গিয়েছে। মেয়েদুটো বড় মেধাবী ওদের লেখাপড়ার খরচ তেমন লাগেনি। "
" তুই কেমন করে জানলি?"
" ও জানবে না তো কে জানবে?"
গল্প করতে করতে ওদের স্টেশন কখন খাগড়া ঘাটে এসে পৌঁছেছে তা ওরা কেউ লক্ষ্য করেনি।
" মালা তুই এসেছিস?" বলে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে রুমা।
" হ্যাঁ রে আসলাম..."
" কে পৌঁছে দিয়ে গেল রে?"
" বড় মেয়ে এসেছে মাসখানেকের জন্য বাড়িতে, ওই পৌঁছে দিয়ে গেল ওর বাইকে।"
" মেয়েকে ছেড়ে আসলি তবুও.. "
শান্তার দিকে তাকিয়ে মালা বলে "ওর শান্তা মাসি বলেছে ও সেটা না শোনা করে?"
" বারে তোদের মধ্যে যোগাযোগ আছে বুঝি।"
" যোগাযোগ মানে সবটা..."
" থাক না মালা ওসব কথা, কি দরকার? "
" কেন থাকবে রে? কেউ যখন আমার পাশে ছিল না তুই কিভাবে আমার এক কথায় আর্মি স্কুলে বিনা খরচে ওদের লেখাপড়া থাকার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলি। সেসময় তুই ওমন করে পাশে না দাঁড়ালে।"
" দেখ মালা আমি কিছুই করিনি, এটা তোদের প্রাপ্য ছিল, আমি কেবলমাত্র ছোটাছুটি করে ব্যবস্থাটা করে দিয়েছি মাত্র।"
" কম ছোটাছুটি? দিল্লি পর্যন্ত গিয়েছিস আমার জন্য কয়েকবার। তারপর.. "
" ছাড় ওসব, তবুও তো আমি প্রথমে খবর পায়নি, অবশ্য পেলেও কিছু করতে পারতাম জানিনা। তখন আমি অবশ্য বেকার ছিলাম। ভাগ্যিস চাকরিটা সেই বছরই পেয়ে গিয়েছিলাম, তাই তোকে সাহায্য করতে পেরেছিলাম। আর বড়োকে তো প্রথম থেকে সাহায্য করতে পারিনি বল, ওকে তুই মনে হয় ক্লাস ফাইভে ভর্তি করেছিলি?"
" হ্যাঁ , ও ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত গ্রামের প্রাথমিকে পড়েছিল।আর্মি স্কুলে বলেছিল ফাইভ থেকে পড়ালে ওরা ভর্তি নেবে,তাই রাজি হয়ে যাই। তবে ছোটকে ছোট থেকে দিতে পেরেছিলাম, ওকে তো ওর বাবা দেড় বছর বয়স পর্যন্ত দেখেছিল।"
" ছাড় ওসব ভাবিস না। ওরা তো তোর মাথা উঁচু করেছে। আর দেখ একজন কেমন NDA exam qualify করে এখন আর্মি অফিসার। "
" হ্যাঁ রে ঠিকই বলেছিস, ছোটটাও এবার ওকালতি পড়ার জন্য বর্ধমান কলেজে ভর্তি হলো। বড় বলেছে সব বোনের সব খরচ ওর।"
এতোক্ষণ মালার দুঃখে সবার মন কেমন মলিন হয়ে গিয়েছিল। এখন মালার এই হাসিমাখা উজ্জ্বল মুখখানা সবার মনকে যেন স্বস্তি দিলো নিজের অজান্তেই।
সীমা এতোক্ষণ চুপ করেছিল। এবারে ও কিশোরীর মতো মালা পাশে বসে বললো "মেয়ে এখন আর্মি অফিসার আর তুই কিনা শুধু মুখে বলছিস, মিষ্টি খাওয়া.. "
" এখুনি....!"
" হ্যাঁ এক্ষুনি.."
" চোখ বুজে হা কর.. "
সীমা হা করতেই একটা গোটা মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত ছানাবড়া গুঁজে দেয় সীমার মুখে।
" আরে সত্যি এনেছিস? আমি তো ঠাট্টা করছিলাম।"
" আমি না বড় কাল গিয়ে বহরমপুর থেকে কিনে এনেছে ওর মাসিদের জন্য। আরও কিসব আছে এই ব্যগটায়। আমার চেয়ে ওরই বেশি উৎসাহ। "
" তা মেয়েকে ছেড়ে আসতে খারাপ লাগছিল নিশ্চয়।"
" তা মিথ্যা বলব না, তবে পরের মাস থেকে মেয়ের কাছে চলে যাচ্ছি আমি আর ওর ঠাকুমা দুইজনেই। এই কয়দিন ও রায়গঞ্জ কালিয়াগঞ্জ আর মুর্শিদাবাদে আমাদের যত আত্মীয় রয়েছে ওদের সাথে দেখা করতে যাবে। চাকরি পাওয়ার পরে এতোদিন তো ট্রেনিং এর পরে কত শঙ্কা প্রবণ স্থানে পোস্টিং এ ছিল তারপর ছোটর মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক, এবার সবে ছোট বর্ধমানে গেল ওকালতি পড়তে। সবে একটা ভালো জায়গায় পোস্টিং পেয়েছে, এখন আমাদের নিয়ে যেতে চায়৷ আগে যে ঠাকুমার ও চক্ষুশূল ছিল, এখন চোখে হারায়।"
" তুই খুব ভাগ্যবতী রে মালা, তোকে বড্ড হিংসা করছে।"
সীমার মুখে হাত দিয়ে মালা বলে "নারে যাই কর আমার ভাগ্যকে হিংসা করিস না, তবে এটা বলি আমার মেয়ের মতো যেন তোর সন্তানরা হয়।"
এই কথাটা শুনেই সবাইকে অবাক করে সীমা মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে ফেলে...
চলবে..