নতুন ভোর
নতুন ভোর
টিং টাং টিং টাং টুং....
-"কীরে অ্যালার্ম ঘড়িটা তো কখন থেকে বেজেই চলেছে, এবার ওঠ! ওঠ মা ওঠ!" মায়ের ডাকে চোখ খোলে বিন্দি। "কটা বাজে মা?" ঘুম চোখে আড় ভাঁঙতে ভাঁঙতে জিজ্ঞেস করে সে। মা জানান ভোর ৫ টা বেজে গেছে। তার নাকি কী মেল করার আছে অফিসে। কাল রাতেই তো বলে শুয়েছিল। অ্যালার্ম ও দিয়ে শুয়েছিল বিন্দি। "ওহ! সত্যি অনেক দেরী হয়ে গেছে। থ্যাঙ্কন্স মা, আমার লক্ষী সোনা মা" এই বলে মাকে জড়িয়ে ধরে বিন্দি। "ওরে ছাড় ছাড়! ওঠ এবার, এত বড় মেয়ের আদিখ্যেতা" বলে আহ্লাদ করে মেয়েকে সরিয়ে দেন মা। ঘুম থেকে উঠে মুখে চোখে জল দিয়ে কাজে বসে বিন্দি। বরাবরই কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস বিন্দিদের বাড়ির সকলেরই। বাবা বাজারে যান সকাল সকাল প্রাতঃরাশের পরেই। তার মা ও সকালে জলখাবার বানিয়ে স্নান সেরে পুজোতে বসেন। এসবের অনেক আগেই সকাল সকাল বিন্দিকে বেরিয়ে পড়তে হয় অফিসের জন্য। মর্নিং শিফ্ট থাকে তার। অফিসের গাড়ী তাকে তুলে নিয়ে যায় সামনের বড়ো রাস্তা থেকে। বিন্দি একটি স্বনামধন্য রেডিও স্টেশনের সঞ্চালিকা। সকাল বেলাতেই থাকে তার শো। সকাল সকাল সক্বলকে সুপ্রভাত জানিয়ে শুরু হয় তার সকালের অনুষ্ঠান "এক কাপ চা বিন্দির সাথে"। সেখানে শ্রোতাদের মন ভালো করা নানা রকম গল্প শোনায় বিন্দি। শো- এর ফাঁকে ফাঁকে চলে মিষ্টি মধুর সব গান। আর গানের ফাঁকে চলে বিরতি। রেডিও সঞ্চালিকা পেশাকে বেশ উপভোগ করে বিন্দি। পুরো নাম বিন্দি বোস। মানুষের মন ভালো করাই তার কাজ। সকালবেলা মানুষকে ভালো ভালো গল্প শোনানো এবং গান শুনিয়ে মন ভালো করার মতো কাজকে জীবিকা হিসাবে বাছার জন্য নিজের উপর বেশ গর্ব বোধ করে বিন্দি।
কিন্ত বেশ কয়েক মাস হল শহরে এক নতুন ভাইরাস এসেছে। মানুষ মরছে অবিরাম। ডাক্তারদের ও ঘোল খাইয়ে ছেড়েছে মারণ এই ভাইরাস। সংক্রমণের আকারে তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে। শহর, গ্ৰাম, গোটা দেশ, এমনকি গোটা পৃথিবীব্যাপী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই বিধ্বংসী ভাইরাস। মানুষ নাকি একে অপরের সংস্পর্শে আসতে পারবে না, মানতে হবে দূরত্ববিধির সব নিয়ম, মুখে পড়তে হবে মাস্ক। হাত ধুতে হবে বারবার। এগুলোই নাকি এই ভাইরাসকে এড়িয়ে চলার একমাত্র উপায়। সরকারি আদেশে বন্ধ হয় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস, সিনেমা হল, শপিং মল, এবং সব রকম বিনোদনের স্থান, করা যাবে না কোনরকম জমায়েত। বিন্দিদের অফিসও বন্ধ হয়ে গেছে। ঘরে বসেই এখন শো পরিচালনা করতে হচ্ছে বিন্দিকে। তাই নিজের একটি ঘরেই শো চালানোর সব ব্যবস্থা করিয়ে নিয়েছে বিন্দি। প্রথমে তার অফিসের বস বলেছিলেন আপাতুতো শো বন্ধ রাখতে কিন্ত এমনটা চায়না বিন্দি। বসকে অনেক অনুরোধ করার পর নিজের বাড়িতেই শো চালিয়ে যেতে চায় বিন্দি। হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী সে নয়। সরকারি আদেশে লকডাউন হয়ে গেছে সব জায়গাতে, মানুষ ঘরে বসে আজ, কত মানুষ কাজ হারিয়েছে, কত শিশু খাওয়ার দুধটুকু ও পাচ্ছে না। অন্ধকার নেমে এসেছে গোটা পৃথিবীতে। এমন দিনে মানুষকে গল্প শুনিয়ে একটুও আনন্দ সে যদি দিতে পারে, সেটাই তার কাছে বিরাট পাওনা।
নিজের ঘরে ল্যাপটপে কাজ নিয়ে বসে বিন্দি। সকাল ৭.৩০ টা বাজলেই শুরু হবে তার শো। এমন সময়ে মা হুড়মুড়িয়ে আসেন তার ঘরে "এই বিন্দি শিগগি্র দেখে যা কি হয়েছে! দারুণ খবর। উফ! আমার তো বিশ্বাসই
হচ্ছে না"।
"উফ মা! কাজের খুব চাপ এখন। সকালের শো-টার জন্য স্ক্রিপ্টটাতে আরও একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি। কী হয়েছে তাড়াতাড়ি বলো।"
"ওরে আয় আয়, ঐ ঘরে আয়, দেখে যায় কি দেখাচ্ছে টিভিতে" বলে মা তাড়াহুড়ো করে চলে যান বসার ঘরে।
মা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর বিন্দি ধীর পায়ে উঠে নিজেদের বসার ঘরে যায়। বাবা, মা টিভি দেখছেন বসে আর চা খাচ্ছেন। বাবা বিন্দিকে দেখেই বলে ওঠেন "বিন্দি মা আয়"। বিন্দি খবরে শোনে শহরে আসা নতুন ভাইরাস নাকি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে বিশেষজ্ঞদের অক্লান্ত পরিশ্রমে। বাতাসে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অনেকদিন ধরেই তাঁরা নাকি খবরটি প্রকাশ করছিলেন না, নিশ্চিত হতে পারেননি তাই। সম্পূর্ণ নিশ্চিত হবার পর প্রচারের আলোতে আসে এই তথ্য। শোনা মাত্র বাবা মাকে জড়িয়ে ধরে বিন্দি। আনন্দের হাসি খেলে যায় তাদের সকলের মুখে।
বিন্দির অফিসের বস তাকে ফোন করেন "হ্যালো বিন্দি! শুনেছ তো খবর টা নিশ্চই?"
"হ্যাঁ স্যার শুনলাম।" মি: মিত্র বললেন "শোনো তাহলে এক কাজ করো, আজকের মর্নিং শো টা বাড়ি থেকেই কম্প্লিট করে চলে এসো অফিসে। আমি অন্য স্টাফ দের ও ডেকেছি বুঝলে? দুদিনের মধ্যেই আমরা অফিস শুরু করে দেব। আবার কর্মজীবনে ফিরতে হবে সকলকে। আর শোনো আমি গাড়ী পাঠিয়ে দেব। চলে এসো সময়মতো।"
"হ্যাঁ স্যার আমি শুনলাম খবরে। চলে আসব অন টাইম"। ফোন কাটে বিন্দি।
আজ বহুদিন পর আবার অফিস যাচ্ছে বিন্দি। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে তার। রাস্তায় আজ মানুষের ছড়াছড়ি। বেশ খুশি মানুষজন। অফিসের গাড়ী তাকে নিয়ে এগিয়ে চলে অফিসের দিকে। আজ আর মুখে মাস্ক পড়েনি বিন্দি। সেই পুরানো পরিবেশ। কোনো কিছুই জানো বদলায়নি। বাসগুলোতে ঠাসা লোকের ভিড়, রাস্তার পাশের ছোট, বড় সব দোকান খোলা। অটো, রিক্সা সব যানবাহন স্বাভাবিক রাস্তাতে, চারপাশে শুধুই মানুষের কোলাহল। এরপর অফিসে পৌছায় বিন্দি। তিনতলায় এসে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। সঙ্গে সঙ্গে বেজে ওঠে হাততালি। তার সকল সহকর্মী এবং বস মি: মিত্র উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান তাকে। এরপর সহেলী এবং চৈতী ছুটে আসে বিন্দির কাছে, পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে তারা।
দুপুরে মিটিং শেষে বেজে ওঠে বিন্দির ফোন। ওপার থেকে গলার আওয়াজ ভেসে আসে সুব্রতর। সুব্রত-র সাথে ৫ বছরের প্রেমের সম্পর্ক বিন্দির। বাগদান হয়ে গেছে তাদের। শুধু পৃথিবীর অসুস্থতার কারণে বিয়েটা এখনো করা হয়নি।
"কী আর.জে ম্যাডাম! কী খবর আপনার? সকাল থেকে তো একটাও ফোন নেই। আজকে এত খুশির দিন। আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল যে রেষ্টুরেন্টে, চ সেখানেই দেখা করি আজ দুপুরে" এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে যায় সুব্রত। বিন্দি বোঝে তার সুব্রত খুব খুশি আজ। সেও উত্তর করে "ফোনটা তো তুই ও করে নিতে পারতিস রে। সকালে তো মেসেজ করেছিলাম অফিস যাব, আচ্ছা আমি আসছি। রাখ ফোন।"
দুপুরে লাঞ্চ সেরে সারাদিন একসাথে সময় কাটায় তারা। এরপর শপিং মল থেকে প্রচুর শপিং করে বিন্দিকে তার বাড়ীতে ছেড়ে দিয়ে বাড়ী ফিরে যায় সুব্রত।
বাড়িতে ঢোকামাত্রই কারা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে বিন্দির উপর। হকচকিয়ে ওঠে সে। সবাই একসাথে বলে ওঠে "সারপ্রাইজ"। আরে, পাগলগুলো আর কেউ নয়, তারই বাল্যকালের বন্ধু, বান্ধবীরা। কতোদিন দেখাই হয়নি কারোর সাথে। চলতে থাকে আড্ডা, হুল্লোর। পৃথিবীতে মারণ ভাইরাস কেন এসেছিল, আবার কখনো অন্য কোন রূপে ফিরবে? নাকি সত্যিই পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে? নানা আলোচোনা হতে থাকে বন্ধুদের মধ্যে। এরপর সারা সন্ধ্যে অনেক মজা করার পর বিন্দির মায়ের হাতের খাবার খেয়ে একে একে বাড়ী ফিরে যায় তার বন্ধুরা।
রাতের বেলা শুতে যাওয়ার আগে বাবা মাকে শুভরাত্রি বলতে যায় বিন্দি। আজ ভীষণ খুশি সে। বাবা তাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলেন, "খুব ভালো থাকিস রে মা! জানি তুই একেবারেই একা থাকতে পারিস না। বিয়েটা করেই ফেল এবার। তাহলে আমি আর তোর মা যেখানে আছি, শান্তিতে থাকব।" বিন্দি মনে মনে ভাবতে থাকে "এসব কী বলছে বাবা?"
"ক্রীং ক্রীং" বিন্দির কানে ভেসে আসছে মোবাইল ফোনটার আওয়াজ। ফোন হাতরাতে হাতরাতে কানে তোলে বিন্দি। ফোনের ওপারে সুব্রতর গলা- "গুড মর্নিং ম্যাডাম! কখন থেকে ফোন করছি। অনেকবার বেজে বেজে ফোনটা কেটে যায়। কীরে শরীর ঠিক আছে তোর?" খুবই চিন্তিত শোনায় তার গলা। বিন্দির মুখের কথা আটকে যায়। যেন বোবায় ধরেছে তাকে। প্রচন্ড ঘামতে থাকে সে। কেটে দেয় হাতে ধরে থাকা ফোন। কোনমতে বিছানা থেকে উঠে এসে টেবিলের উপরে রাখা গ্লাসের সবটুকু জল খেয়ে ফেলে সে।
একটু ধাতস্ত হয়ে এগিয়ে আসে দেওয়ালে টাঙানো একজোড়া ছবির দিকে। পৃথিবীতে আসা এই মারণ ভাইরাসের দাপটে গত হয়েছেন তার মা, বাবা কয়েকমাস আগেই। মৃত্যুর পরে মা, বাবার দেহ দুটিকে দেখতেও পায়নি বিন্দি। তাঁদের শেষযাত্রায় সামিল হতে পারেনি সে। সাদা প্লাস্টিকে মুড়ে কিছু আপাদমস্তক ঢাকা লোকজন নিয়ে যায় বিন্দির বাবা মায়ের দেহ। এছাড়া তার সহকর্মী বন্ধু সহেলীও তো মারা যায় বেশ কিছুদিন আগেই।
আর কিছু ভাবতে পারেনা বিন্দি। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মা বাবার ছবির সামনেই। বাবা, মায়ের মৃত্যুর পর থেকে সুব্রতই ভোরে ফোন করে ঘুম ভাঙায় বিন্দির। অ্যালার্ম ঘড়ির আওয়াজে তার যে ঘুম ভাঙ্গে না। আগে ঘুম ভাঙানোর এই দায়িত্ব ছিল বিন্দির মায়ের।
মা বলতেন ভোরবেলার স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। সত্যিই কী পৃথিবী ছেড়ে কোনদিন বিদায় নেবে বিধ্বংসী এই ভাইরাস? মনে মনে ভাবতে ভাবতে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকায় সে। ঘড়ির কাঁটায় ঠিক তখন ভোর ৫ টা।
