এভাবেও মা হওয়া যায়
এভাবেও মা হওয়া যায়
অফিস থেকে বেরোতে অনেকটাই লেট করে ফেলেছে দীপা। অ্যাপ ক্যাববুক করে সে। অফিসের সামনের অভিজাত এলাকা ছেড়ে পরপর কয়েকটি ছোট ছোট চায়ের দোকান। তা পেরিয়েই বড় রাস্তার সামনে এসে দাঁড়ায় দীপা। "আজ অনেকটাই রাত করে ফেলেছি, বুবলিটা যে কী করছে? সরলাও তো আসেনি।" নিজের মনে মনেই বিড়বিড় করে ওঠে সে। ফোন করে বুবলিকে। ওপার থেকে মিষ্টি আদর মাখা কন্ঠস্বর ভেসে আসে।
"হ্যালো মা"
"হ্যা সোনা মা বড্ড দেরী হয়ে গেছে আজ। মামমাম্ কাজে ব্যস্ত ছিল আজ বাবু। ভয় পাবে না একদম। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরছি। ঘর ভিতর থেকে ভালো করে লক..."
"হ্যা মামমাম্ আমি জানি।"
ফোন কেটে আলতো হাসে দীপা। মেয়ের গলা পেয়ে খানিক নিশ্চিন্ত হয় আর কি! বুবলিটা কত কম বয়সে ম্যাচিওর হয়ে গেছে। আসলে বাবা ছাড়া, ব্যস্ত মায়ের সন্তানদের যা হয়।
নামী বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরতা অভিদীপ্তা বসু সরকার ওরফে দীপা। কাজের অনেক দায়িত্ব ঘরে ও বাইরে। ঘর বলতে সে আর তার নয় বছরের কন্যা বুবলি। দীপা একজন সিঙ্গেল মাদার। বারো-বছরের বিবাহিত সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্না।
ক্যাবচালককে ফোন করে দীপা। ফোনের ওপার থেকে কন্ঠস্বর ভেসে আসে "ম্যাম আপনার লোকেশানে এসে গেছি প্রায়, একটু দাঁড়ান।" প্রায় দু- মিনিটের মধ্যে সামনে এসে পড়ে সাদা রংয়ের গাড়িটি। গাড়ির নম্বর মিলিয়ে হাত দেখায় দীপা, তারপর গাড়িতে উঠে পড়ে সে। গাড়ির চালকের সাথে ওটিপি শেয়ার করার পর ব্যাকসিটে পিঠ এলিয়ে দেয় দীপা, গাড়িতে হাল্কা করে এসি চালানো, ক্লান্ত দীপা হাল্কা নিমজ্জিত চোখে গাড়ির কাঁচ দিয়ে বাইরে দেখতে থাকে। শহরের রাজপথ ভেদ করে ছুটে চলে গাড়ি। দুপাশের রাস্তার ধারে সারি সারি বিল্ডিং আর আলোর রোশনাই। অতীতের স্মৃতিতে ডুবে যায় দীপা।
অনেক ছোটবেলায় দীপার মা পালিয়ে যান তাঁর প্রেমিকের সাথে। সেইসময় খুব নাকি হুলস্থূল কান্ড হয়। দীপার ঠাকুমা তাদের বাড়িতে আসেন আর বলেন "গেলিই যখন পাপ টাকে নিয়ে যেতিস সঙ্গে করে" এসব কথার মানে কিছুই তখন বোঝেনি ওইটুকু শিশু। বাবা ছোট্ট দীপাকে সামলানোর জন্য এবং নিজের প্রয়োজন মেটাতে আবার বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ঘরে আসেন মণিমা। অল্পবয়সী তরূণী, সুন্দরী, শিক্ষিতা কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দীপার ওপর শুরু হয় তাঁর মানসিক অত্যাচার। নিজের মেয়ে বলে দীপাকে কোন দিনই মানতে পারেননি তিনি। নতুন মায়ের কাছে ভালোবাসা পাবার জন্য আকুল হয় ছোট্ট দীপা। কিন্তু কোন লাভ হয় না। দীপার বাবাও নতুন বৌকে কিছুই বলে উঠতে পারেননি। বিত্তশালী বাবার একমাত্র মেয়ে দীপা। তাকে দেখভাল করার জন্য খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। বুড়িমাসির প্রথম দিন বাড়িতে আসার কথা এখনো মনে পড়ে দীপার। বেশ বয়স্কা একজন সাদামাটা মহিলা, পিছুটানহীন। মাথায় কাঁচাপাকা চুল, পড়নে হাল্কা রঙয়ের শাড়ি। দীপাকে দেখামাত্রই কাছে টেনে নেন মিষ্টি হেসে। দীপার মণিমা যেন জ্বলে যান "নেকামো যত্তসব" বলে বুড়িমাসিকে সম্বোধন করে বলেন "শোন এই ধিঙ্গি মেয়ের সব দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে বুঝেছ?" "অমন করে বলছেন কেন বৌদি? এতটুকু মেয়ে..." বলে আরও কিছু বলতে যান বুড়িমাসি। দীপার সৎমা বলে ওঠেন "এই থামো থামো! যা বলেছি, সেইমতো করো তুমি" এই বলে মুখ ভেংচে সেখান থেকে চলে যান তিনি। তারপর থেকে বুড়িমাসির সাথে কীভাবে যেন একাত্ম হয়ে ওঠে দীপা। দীপার রোজনামচার সাথী হয়ে ওঠেন বুড়িমাসি। তাকে স্নান করানো, খাওয়ানো, স্কুলে দিয়ে আসা, নিয়ে আসা, গল্প বলে ঘুম পাড়ানো থেকে শুরু করে সব কিছুই বুড়িমাসি সামলাতে থাকেন। মা-হারা দীপা ও সন্তানহীনা বুড়িমাসি একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। তারপর আসে সেই অভিশপ্ত রাত...
"ম্যাম, গাড়িটা কি লেফ্টে ঘোরাব?" ক্যাবচালক জিজ্ঞেস করেন দীপাকে। "হুম" শান্ত প্রতিক্রিয়া জানায় দীপা। এরপর গাড়ি এসে দাঁড়ায় দীপাদের বহুতল আবাসনের সামনে। ক্যাব থেকে নেমে পড়ে সে। নেমেই জোরে পা চালায়। মেয়েটা যে ঘরে একদম একা। যদিও একা থাকতে সে অভ্যস্থ্। কিন্তু আজ বড্ড রাত হয়ে গেছে দীপার। বুবলি হয়তো ঘুমিয়েও গেছে। লিফ্টে উঠতে উঠতে দুশ্চিন্তা করতে থাকে সে। লিফ্ট থামে চার তলায়। দীপা নেমে পড়ে। সাথে থাকা চাবি দিয়ে লক খোলে সে।
আজকাল হঠাৎ ই অনেক বড়ো হয়ে গেছে বুবলি। মামমাম- এর আওয়াজ পেলেই সে আর দৌঁড়ে আসে না আগেরমতো। মেয়ের মনের অভিমান নাকি রাগ বুঝতে পারে না দীপা। সত্যি বলতে বোঝার সময়ও তার নেই। মেয়ের ঘরে ঢোকে সে, বুবলি ঘরে বসে পড়ছিল। পড়াশোনার প্রতি আজকাল বেশ মনোযোগী হয়েছে মেয়ে। গত সপ্তাহের প্যারেন্ট-টিচার মিটিং এ আর কোন কম্পলেন তো আসেনি মেয়ের নামে। আসলে বড় হচ্ছে তো...
"মা" ডেকে ওঠে মেয়ে।
"হ্যাঁ সোনা"
"ওখানে দাঁড়িয়ে কী ভাবছ?"
"কিছু না সোনা। ভাবছি আমার লক্ষী পাখিটা কত বড় হয়ে গেছে। এই নাও তোমার চকোলেট। তবে এখন খাবেনা কিন্তু, কাল খাবে।" এটাই হল দেরী করে আসার একমাত্র সওদা মেয়ের সাথে। আজকাল বুবলিটা আর জেদ বায়নাও করেনা বিশেষ, মায়ের কাছে সময় ও চায় না আগের মতো। আব্দার করেনা গল্প শোনানোর, একা থাকাতেই সে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। মেয়ের পরিবর্তন তাকে বেশ চিন্তায় ফেলে এইবার। কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও মেয়ের ব্যবহার হঠাৎ বদলে যাওয়া এবার তাকে বেশ ভাবায়। আজকাল তো কত কী হয়। বুবলির সাথেও তেমন কিছু হচ্ছে না তো, ঠিক যেমন তার সাথেও ছোটবেলায় হয়েছিল। আঁতকে ওঠে দীপা।
রাতে খেতে বসে মেয়েকে নানাভাবে জ্ঞিজ্ঞেস করে দীপা তার সাথে কোন কিছু ঘটেছে কিনা? তাকে কেউ স্পর্শ করে কিনা? বুবলিকে ছোট থেকেই অনেক কিছু প্রশিক্ষণ দিয়ে রেখেছে দীপা। তাকে একা বড় হতে হচ্ছে কিনা! জানতে তো হবেই। বুবলি ঘাড় নেড়ে তাকে জানায় "কিছুতো হয়নি মা।" খাওয়া শেষে মেয়ে শুতে চলে গেলে দীপাও সব কাজ গুছিয়ে রেখে, বুবলিকে আদর করে নিজের ঘরে শুতে চলে আসে। ঘরের রাতবাতির মৃদু আলোতে বিছানাতে গা এলিয়ে দেয় দীপা।
শহরের নাম করা ব্যবসায়ী শ্রীমান সমরেশ বসু সরকার, তার ব্যবসায়ের অংশীদার বন্ধু শ্রী দীনেশ মুখোপাধ্যায়। বাল্যকালের বন্ধু দীনেশের অবাধ যাতায়াত সমুর বাড়িতে। বাবার সাথে বন্ধুত্বের সূত্রে দীপার ও খুব কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন তিনি। পিতৃসম দীনু কাকু ও খুব স্নেহ করতেন তাকে। যখন-ই তাদের বাড়িতে আসতেন অনেক উপহার আনতেন দীপার জন্য। দীপার ও তার আদরের কাকুর কাছে বায়নার শেষ ছিল না। সৎমা আসার পর দীনু কাকুর বাড়িতে আসা অনেক বেড়ে যায়। বাবাকে ব্যবসার কাজে প্রায়শই বাইরে থাকতে হত আর কলকাতার অফিস সামলাতেন কাকু। বাবার অনুপস্থিতে বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল তাঁর। এক রাতে দীনু কাকু তাদের বাড়িতে আসেন। মণিমা, বুড়িমাসিকে দীপার ঘর থেকে ডেকে একটা কাজ দিয়ে বাইরে পাঠান, দীপার বাবাও তখন ব্যবসার কাজে বাইরে। দীনু কাকু দীপার ঘরে আসেন, ছোট্ট নিস্পাপ শিশু টিকে ঘুম থেকে টেনে তোলেন তারপর আদরের নামে তার উপর চলে অত্যাচার। উফঃ কি অসহ্য যন্ত্রনা! "কাকু ছাড়ো ব্যথা করছে" ককিয়ে ওঠে সে। কিন্ত কিছুতেই কোন লাভ হয় না। দীনেশের শক্ত হাতে নিস্পেষিত হয় দীপার ফুলের মতো কচি শরীরটা। দীপার মণিমা সামনে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য উপভোগ করতে থাকেন, এক পাশবিক হাসি খেলে যায় তাঁর মুখে।
হঠাৎ দীনেশের ঘাড়ের কাছে এক কোপ। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই, কোপ পড়ে হাতে। হকচকিয়ে ওঠেন মণিমা। ব্যথায় ককিয়ে ওঠেন দীনেশ। পিছনে দাঁড়িয়ে দীপার বুড়িমাসি। তাঁর তখন রণচন্ডী রূপ। দীনেশ ও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন, দীনেশ ও মণিমা দুজনে মিলে বুড়িমাসিকে চেপে ধড়েন। চলে মারধোর, অত্যাচার। দীপাকে ছেড়ে বুড়িমাসিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন তাঁরা। বুড়িমাসি দীপাকে চেঁচিয়ে বলেন "মামণি তুমি পাশের ঘরে গিয়ে দ্বোর দাও।" দীপাও তখন খানিক ধাতস্থ হয়ে উঠেছে। অসম্ভব সাহসের উপর ভর করে সে পাশের ঘরে দৌঁড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। তারপর কি হয়েছিল দীপার আর কিছুই মনে নেই।
পরের দিন অনেক বেলায় জ্ঞান ফেরে দীপার। খাটের পাশে তখন বাবা, দীনুকাকু, মণিমা ও ডাক্তার কাকু। জ্ঞান ফিরেই বুড়িমাসিকে খোঁজে সে। দীনু কাকুকে সামনে দেখেই আঁতকে ওঠে দীপা। বাবাকে সব বলার চেষ্টা করে সে কিন্ত সমরেশ বাবু তাঁর কোন কথাতে কান না দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে। এরপর মণিমা ও দীনু কাকু তাকে ভয় দেখায় বাবাকে কিছু জানালে তাঁকে মেরে ফেলা হবে প্রাণে। দীপাকে ও তার বাবাকে জানানো হয় সেদিন রাতেই বুড়িমাসি নাকি অনেক টাকা পয়সা নিয়ে দীপাকে ফেলে পালিয়ে যান। শিশু দীপা কিছুই বলে উঠতে পারেনি তার বাবাকে। বুঝেও উঠতে পারেনি সে যে বুড়িমাসির কি হল। এরপর কিছুদিন দীনেশের ও তাদের বাড়িতে আসা বন্ধ হয়। দীপা ঘরে বসে একা একা বুড়িমাসির কথা ভাবত ও চোখের জল ফেলত। ধীরে ধীরে অবসাদে চলে যায় সে। মনে মনে ভাবত একদিন বুড়িমাসিকে ঠিক খুজে বের করবে। কারণ বুড়িমাসি তাকে ফেলে পালিয়ে যাননি, পালিয়ে যেতে তিনি পারেন না। শিশু মনে বুঝে উঠতে পারেনা যে বুড়িমাসির সাথে কি হতে পারে...
সেই রাতের পর থেকে মণিমার চোখে যেন আরও বিষ হয়ে উঠতে থাকে দীপা। তাঁরই প্ররোচনায় দীপাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেন সমরেশ বাবু। তারপর সেখানেই চলতে থাকে তার পড়াশোনা । ছুটিতে যখন বন্ধুদের বাড়ির লোক খোঁজ খবর নিতেন , মেয়েকে দেখতে আসতেন হোস্টেলে, দীপার বাড়ির থেকে কেউ আসতেন না, এমনকি দীপার বাবা হোস্টেলের ইন-চার্জ কে ফোন করে মেয়ের খবর টুকুও নিতেন না। শুধু মাসের শেষে টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হত তার জন্য। বাবার প্রতিও ঘৃণায় মন বিষিয়ে উঠত দীপার। নতুন পরিবেশেও মন থেকে মুছে যাননি বুড়িমাসি কখনো। মনমরা হয়ে দিন কাটত তার। হোস্টেলে যখন অন্য বন্ধুরা খেলত, আনন্দ করত, একা সময় কাটত দীপার। এভাবেই পেরিয়ে যায় আরও দশটা বছর, শুরু হয় তার কলেজ জীবন। নিজের বাড়িতে আর কখনোই স্থান হয় না দীপার। কলেজের হোস্টেলে থাকতে শুরু করে সে। বরাবরই হোস্টেলে থাকা দীপা ছিল কঠোর পরিশ্রমী, সংযমী ও সুশৃঙ্খল। যাই হোক সেই কঠোর নিয়মের জাল ভেদ করে ভুটো ওরফে সুবীর আসে সুন্দরী দীপার জীবনে। কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধুত্ব এবং তা থেকে প্রেম শুরু হয় তাদের। দীপার একাকীত্বের জীবনে ভুটোই তার সঙ্গী হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে তার একমাত্র অবলম্বন। অতীত জীবনের সব জেনেও দীপাকে আপন করে নেয় সে। কথা দেয় সম্ভব হলে তার বুড়িমাসিকে ঠিক খুঁজে বের করবে যদি তিনি বেঁচে থাকেন।
এরপর স্নাতকোত্তর স্তর পেরিয়ে সুবীরের সাথে বিয়ে হয় দীপার। বিয়ের পর কিছুবছর বেশ আনন্দেই কেটেছিল তাদের। নতুন ঘর, নতুন সংসার, তার আদরের ভুটোর ভালোবাসা। ছোট্টবেলা থেকে কখনো ভালোবাসা পায়নি সে। সুবীরের মায়ের থেকে সে মায়ের মতো ভালোবাসা পেতে থাকে। আপন মায়ের মতনই দীপাকে খাইয়ে দিতেন নিজের হাতে। ঠিক যেন তার বুড়িমাসি। দীপা ভাবে তার জীবনের সব অপূর্ণতা পূর্ণ হবে এইবার। এইভাবেই কাটতে থাকে সময়। বুড়িমাসিকেও হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে দীপা। দেওয়া হয় কাগজে বিজ্ঞাপণ। নিজের এক পুলিশ বন্ধুকেও সে সব ঘটনা জানায়। শুরু হয় তোলপার। শুরু হয় কেস। জয়ী হয় দীপা। নিজের বাবার সেই বন্ধু দীনেশকে শাস্তি দিতে পেরেছিল দীপা। দীনেশ ও মণিমার জেল হয় সেদিনের দীপার উপর করা অত্যাচারের দায়। কিন্ত তাঁরা স্বীকার করেননি বুড়িমাসির সাথে কী হয়েছিল । তাঁরা একই কথা বলতে থাকেন বুড়িমাসি পালিয়েছিলেন সেই রাতে, তারপর আর কেউ তাঁকে কোনদিন দেখেনি। বুড়িমাসির কেউ ছিল না এই দুনিয়াতে তাই তাঁর খোঁজ করার মতো কোথাও কেউ ছিল না একমাত্র দীপা ছাড়া। যাই হোক, মণিমা ও দীনেশের শাস্তি হবার পর দীপার বাবা মেয়ের কাছে এসেই থাকতেন। ব্যবসায় ভরাডুবি হয় তাঁর।
এরপর দীপা চাকরীও পায় একটি প্রাইভেট সংস্থায়। কিছুদিন পর দীপার পেটে আসে তার মেয়ে বুবলি। দীপার বাবা মারা যান হঠাৎ করে। বুবলির জন্মের তিন বছরের মাথায় মারা যান তার ঠাকুমা। কিছু দিন পর দীপার স্বামীর মধ্যে আসে অদ্ভুত পরিবর্তন। রোজ রাত করে বাড়ি ফেরা, এবং দীপার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করতে থাকে সে। দীপার আদরের ভুটো বদলে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। দীপাকে একদম সহ্যই করতে পারত না, ফিরেও তাকাতো না আর তার দিকে। মেয়ের জন্য কোনো খরচ ও দিত না। দীপা এইসময় একটি বহুজাতিক সংস্থায় মোটা বেতনের চাকরী পায়। মেয়ের সব খরচ সে নিজেই চালাতে থাকে। মনে আশা ছিল সুবীর একদিন ভালো হয়ে ফিরে আসবে তার কাছে। কিন্ত সুবীরের অসভ্যতা মাত্রা ছাড়ায়। কেটে যায় আরো তিন বছর। ধৈর্য রাখে দীপা, ভরসা রাখে নিজের ভালোবাসায়। সুবীরের ও বদল হতে থাকে, দীপার কাছে ক্ষমা চায় সে। ভালোবাসার জয় ভেবে খুশি হয় দীপা। সুবীরকে অনেক টাকাও দেয় সে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য।
কিছুদিনের মধ্যেই ভুল ভাঙ্গে দীপার। সুবীরের ফোন হাতে পড়ে তার। চোখে পড়ে কামিনীর মেসেজ। নিষিদ্ধ প্রেমের খেলায় মেতে ছিল সুবীর। কামিনী ছিল বিধবা মেয়ে, তার জন্য সুবীর খরচ করতে থাকে দীপার কষ্টের উপার্জন করা টাকা। একরাশ ঘৃণা দলা পাকিয়ে ওঠে দীপার মনে। ঘর ছেড়ে সেই রাতেই বেরিয়ে পড়ে সে নিজের ছোট্ট মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। সুবীর তখন ঘুমে মগ্ন। এরই ঠিক বছরখানেক আগে দীপা নিজের একটি ছোট্ট ফ্ল্যাট কিনে রাখে দক্ষিণ কলকাতায়। সেই রাতে ট্যাক্সি নিয়ে সেখানেই ওঠে দীপা ও বুবলি। বাচ্চার কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস, ঔষুধ আর জামা কাপড় ছাড়া আর কিছুই সেদিন নেয়নি সে। পরে সুবীর অনেক ক্ষমা চায় তার কাছে। অনেক টানাপোড়েনের পর দীপা সুবীরকে ফিরিয়ে দেয়। ডিভোর্স কেস ফাইল হয় কিন্ত সুবীর ডিভোর্স দিতে না চাওয়ায় কিছুটা বেগ পেতে হয়েছিল। অবশেষে অনেক সময় লাগলেও তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তারপর থেকে দীপা মেয়েকে একা হাতেই মানুষ করছে। নিজের মতো মেয়ের জীবন টাও ছারখার হতে দিতে চায়না সে। কিন্ত জীবিকার তাগিদে তাকে ঘুরতে হয় বাইরে। বুবলিটাও অনেক বঞ্চিত হচ্ছে মায়ের স্নেহ থেকে। কিন্ত অপারগ দীপা।
ভাবতে ভাবতে ঘুম নেমে আসে দীপার অশ্রুসিক্ত দু- চোখে। কাউকে আর কোনদিন ভালোবাসবে না সে। নতুন করে নিজের জীবনে কাউকে আসতে দিতে চায়না দীপা। মেয়েটার ভবিষ্যৎ সে অনিশ্চিত করতে পারবে না মা হয়ে ঠিক যেমন টা তার সাথে হয়েছিল।
পরদিন সকালে রান্নাঘরের কাজ সামলে বুবলিকে খাইয়ে স্কুলের গাড়িতে তুলে দেয় সে। দরজায় বেল বাজে।
"কিরে সরলা তুই এলি আজ? তোর ছেলে কেমন আছে এখন?"
"ছেলে এখন ভালো আছে গো দিদি। জ্বরটা কমেছে। ওর বাপকে ঘরে রেখে এসেছি।"
"আজ তো না এলেই পারতিস রে, আমি হাফ ডে নিয়েছি। কাল-ই অফিসে বলে এসেছিলাম। তোর বাচ্চাটার যখন জ্বর..."
তাকে থামিয়ে দিয়ে সরলা বলে "না গো দিদি তুমি আমার বাচ্চাটার কথা এত ভাবো। তুমি সেদিন অতো গুলো টাকা দিলে তা দিয়েই তো ছেলেটার চিকিৎসা করাচ্ছি। তুমিই তো আমায় দেখো দিদি" হেসে বলে সে।
"থাক তোমাকে আর পাকামো করতে হবে না।" টেবিলের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে দীপা বলে "ওখানে কিছু ফল এনে রেখেছি, যাওয়ার সময় নিয়ে যাবি তোর ছেলের জন্য।"
"আচ্ছা" বলে নিজের কাজে রান্নাঘরে ঢোকে সরলা।
স্নান সেরে অফিসে বেরোনোর জন্য তৈরী হয় দীপা। এরপর খেতে বসে টেবিলে। সরলা তাকে জানায়
"দিদি জানোতো বুবলি না স্কুল থেকে এসে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে আজকাল। মাঝে মাঝে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। বাইরে থেকে আওয়াজ পাই আমি। কিন্ত ডাকলে বিরক্ত হয়।"
বেশ চিন্তিত হয় দীপা সরলার কথাগুলো শুনে। সরলা বুঝতে পেরে বলে "না গো দিদি, এ বয়সের মেয়ে তো.. ছেলেমানুষ। আমার রাজাটাও ঘুমের ঘোরে হেসে ওঠে মাঝেমাঝে।"
"ঠিক আছে তুই যা, আমি দেখছি" বলে ওঠে দীপা। কয়েক মাস ধরেই বুবলিটার বদল সে লক্ষ্য করছে।
"নাঃ আর রিস্ক নেওয়া যাবে না, বুবলির স্কুলের হেড মিসেসের সাথে কথা বলব এবার। কোনো ছেলে টেলের পাল্লায় পড়ল না তো সে... না না একি ভাবছি আমি? এতটুকু মেয়ে বুবলি... তবে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে সে, এখনকার বাচ্চারা যা স্মার্ট, তার উপর বুবলির হাতে রয়েছে দামী ফোন। নিরুপায় হয়েই তো ফোন দিতে হয়েছে মেয়েটাকে..."
"দিদি ও দিদি, বেরোবে না? দেরী হচ্ছে তো তোমার। কী ভাবছ?" কাঁধে আলতো ঝাঁকুনি দিয়ে বলে ওঠে সরলা। "হুঁম! শোন বুবলির দিকে একটু নজর রাখিস তো, বুঝলি? তুই যখন ওকে স্কুল থেকে এনে খাইয়ে বাড়ি যাবি, তখন..." মুখের কথা কেঁড়ে সরলা তাকে জানায় বুবলি নাকি আজকাল বাড়িতে ফিরেই সরলাকে চলে যেতে বলে। ও নাকি নিজেই খাবার নিয়ে খেয়ে নেবে। বেশ কিছু মাস ধরেই চলছে বুবলির এই ব্যবহার। তাকে আগে কিছু কেন জানায়নি বলে সরলাকে বেশ খানিকটা বকাঝকা করে দীপা।
এরপর অফিসে গিয়েও কাজে মন বসাতে পারে না দীপা। সেদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে বুবলির সাথে অনেকটা সময় কাটায় সে। কথায় কথায় বুবলির থেকে অনেক কথাই জানতে চায় দীপা কিন্ত বুবলি কিছুই বলে না তাকে। পরের সপ্তাহে বুবলির স্কুলের হেড ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করে দীপা। সব কথা জানায় তাকে। হেড ম্যাডাম বুবলির ক্লাস টিচারকে ডেকে পাঠিয়ে সব জানান তার মায়ের উদ্বেগের কথা। কিন্ত স্কুল থেকে সে জানতে পারে অভিসিক্তা পড়াশোনা ভালোই করছে, বন্ধুবান্ধবীর সংখ্যা তার খুবই কম। সন্তানের প্রতি কড়া নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন হেড মিসেস। বাড়ি ফিরে আসে দীপা।
দুদিন পরে দুপুর বেলা অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আসে দীপা, শরীরটা একটু খারাপ ছিল ওইদিন তার। ফ্ল্যাটের একটা চাবি থাকে তার কাছে, আর ডুপ্লিকেট একটা থাকে ঘরে, বুবলির কাছে। প্রতিদিন স্কুল থেকে সে ফিরলে তাকে খেতে দিয়ে সরলা চলে গেলে ভিতর থেকে দরজা লক্ করে দেয় বুবলি।
ঘরে ঢোকে দীপা। সোজা বুবলির ঘরে আসে, কোথাও নেই বাচ্চাটা ঘরের মধ্যে। হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ায় দীপা। মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে আবাসনের নীচে চলে আসে সে। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে সে বুবলিকে কোথাও দেখেছে কিনা। "ম্যাম বিটিয়া রোয উস্ রাস্তকী তারাফ জাতি হ্যায় অয়র আধে ঘন্টে পার লউট তি হ্যায়।" দারোয়ান উত্তর দিকের সরু রাস্তার দিকে হাত দিয়ে দেখায়। দীপাদের অভিজাত আবাসনের অদূরে উত্তরদিক দিয়ে একটা সরু রাস্তা চলে গেছে ঢাল বেয়ে আর তার দুপাশে কয়েক ঘর গরীব লোকের বাস। তারা এই দীপাদের আবাসনের মতো জায়গায় কাজের সন্ধানে আসে। সেদিকে পাগলের মতো ছুটে যায় দীপা। খোঁজ করতে থাকে মেয়ের। এমন সময় একটি মহিলার সঙ্গে বুবলিকে তাদের আবাসনের দিকে আসতে দেখে দীপা। মহিলার পরণে নোংরা নোংরা একটি শাড়ি, মাথা ভরা উস্কোখুস্কো পাঁকাচুল, চেহারায় দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। দীপাকে খেয়ালই করেনি বুবলি। দুজন গল্পে মত্ত হয়ে ছিল। "বুবলি, বুবলি এদিকে এস" বলে তার কাছে ছুটে যায় দীপা। মহিলাকে উপর থেকে নীচ একবার কৌতুহলের চোখে মেপে নিয়ে দীপা বুবলিকে বলে "ওর হাত ছাড়ো আর আমার কাছে এসো! কী হল ছাড়ো, ছাড়ো বলছি" এই বলে মেয়েকে নিজের দিকে টেনে নেয় দীপা। "মা এটা তো আম্মু, আমাকে অনেক ভালোবাসে। প্রতিদিন স্কুল থেকে আসার পর সরলা দিদি যে খাবার গরম করে রেখে যায়, আমি সেটা টিফিন বক্সে নিয়ে আম্মুর কাছে চলে আসি। তারপর আমরা একসাথে..." "থামো তুমি" বলে বুবলিকে ধমক দেয় দীপা। মেয়ে কেন আর আগের মতো মায়ের কাছে আসে না, কেন সে অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে, বুঝতে বাকী থাকে না দীপার। এই তাহলে আসল রহস্য। আজকাল কত কি হয়, ভুলিয়ে ভালিয়ে পাঁচার করে দেয় বুবলির বয়সী মেয়েদের। আঁতকে ওঠে মায়ের মন। রেগে সেই মহিলাকে জানায় "ছোট মেয়েদের পাঁচার করো তোমরা? লজ্জা করে না? আমার কিন্তু পুলিশের সাথে চেনা আছে। আমার মেয়ের আশেপাশে তোমায় যেন আর না দেখি।"
"আপনি আমায় গালত ভাবছেন মাইজী। বুবু বেটা হামারি বিটিয়া আছে। ওর ক্ষুতি কুনো দিন করবক্ লাই।" বলে কাঁদতে থাকেন আম্মু। দীপা মুখ ফিরিয়ে বুবলিকে টেনে নিয়ে সামনে পা বাড়ায়। যেতে যেতে ঘাড় ঘুড়িয়ে আম্মুকে অসহায়ের মতো দেখতে থাকে বুবলি। আবাসনে ফিরে দারোয়ানকে দীপা জানায় বুবলিকে যেন আবাসন থেকে বেরোতে না দেওয়া হয় দীপার অনুপস্থিতে। দারোয়ান সম্মতি জানায়।
পরদিন সরলা এলে তাকে সব ঘটনা জানায় দীপা এবং তাকে বিকেল ৫ টা অবধি এখন থেকে বুবলির সাথে থাকতে বলে সে। বিনিময়ে সরলার বেতন বৃদ্ধি। এইভাবে বুবলির থেকে ওই মহিলাকে দূরে সরানোর সব ব্যবস্থা করে ফেলে দীপা। সে নিজেও স্থির করে কদিন অফিস ছুটি নিয়ে বুবলির সাথে সময় কাটাবে। ঘুরতে যাবে, খেলা করবে, একসাথে ছবি আঁকবে, মেয়ের মন থেকে মুছে দিতে হবে তার আম্মুকে।
সবকিছু করার পরও বুবলির মন থেকে তার আম্মুকে সরাতে পারে না দীপা। ধীরে ধীরে অবসাদে চলে যেতে থাকে বুবলি। সে পড়তে চায় না, স্কুলে যেতে চায় না, নিজের ঘরের বারান্দা দিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে বুবলি সারাদিন। আজকাল আর মায়ের ধারের কাছে আসতে চায় না মেয়ে। অমন বাধ্য, লক্ষী, শান্ত মেয়ে কেমন জেদী, অবাধ্য হয়ে উঠতে থাকে। দীপা ভাবে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবে সে মেয়ের জন্য। কিন্ত তাতেও কোন লাভ হয় না। সে বুবলির চোখেও তার ছোটবেলার মতোই মাতৃ বিচ্ছেদের যন্ত্রণা ও অবসাদ দেখতে পায়। দীপার বুক ফেটে যায় মেয়ের দুঃখে। কবে যে মেয়েটা তার মায়ের কাছ থেকে এতদূরে চলে গেছে, ব্যস্ত জীবন আর কাজের ফাঁকে এক সংগ্ৰামী মা কখনো তা বুঝতেই পারেনি যে ভিতরে ভিতরে কতটা একা হয়ে পড়ছিল বুবলি।
ছুটিতে থাকাকালীন অবস্থায় একদিন সন্ধ্যেবেলা নিজের ঘরে বসে ল্যাপটপে মেল চেক করছিল দীপা। এমন সময় পাশের ঘর থেকে বুবলির খিলখিলিয়ে হাসির আওয়াজ পায় সে। ছুটে গিয়ে দেখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে ইশারা করছে বুবলি। চারতলার বারান্দা দিয়ে নীচে দেখে দীপা। রাস্তার আলোয় দেখে সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন বুবলির আম্মু। প্রচন্ড রেগে গিয়ে দীপা ফোন করে নীচের আবাসনের দারোয়ানকে। আর তাঁকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিতে বলে। আরও জানায় কোনদিন ও এই মহিলাকে আবাসনের আশেপাশে যেন ঘেসতে দেওয়া না হয়। মহিলাকে দারোয়ান সেখান থেকে চলে যেতে বলে। তিনি হাপুসহুপুস নয়নে কাঁদতে থাকেন আর চিৎকার করে বলতে থাকেন "হাম কাভি মা নেহি বান পায়ে, হামে হামারি বুবু বিটিয়া সে আলাগ মাত কারো মাইজী, মাত কারো" তাঁর করুণ স্বর এরপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে বাতাসে। নিশ্চিন্ত হয় দীপা।
বুবলি এরপর ধীরে ধীরে আরও অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকে। শরীর খারাপ হতে থাকে তার। বুবলির বেঁচে থাকার জন্য আম্মু অপরিহার্য হয়ে ওঠেন। নিজের মাকে দূরে সরিয়ে দিতে থাকে বুবলি। মেয়ের এত কান্না সহ্য করতে পারেনা দীপা। ভাবে যদি বুবলির আম্মুকে একবার নিয়ে আসা যায় ভবি ভোলানোর জন্য আর কি! কিন্তু আম্মুকে অনেক খুঁজেও আর পায় না দীপা। তাঁর আসল নামটাই তো জানা হয়নি। বুবলিকে সঙ্গে করে নিয়ে একদিন দীপা যায় তার আম্মুর ঘরে, যে ঘরে বুবলির আম্মু যেতেন এতদিন তাকে নিয়ে। কিন্তু সেই ঘর বন্ধ ছিল, ঘরের ভিতর কেউ ছিল না। পরপর কদিন খোঁজ করেও আম্মুকে পাওয়া যায় না। বুবলি অবসাদগ্ৰস্ত হয়ে পড়ে আরও। দীপাও নিজের ভুল কিছুটা বুঝতে পারে।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা দীপা অফিস থেকে ফেরার সময় দেখে তাদের আবাসনের নীচে পুলিশ দাঁড়িয়ে সাথে দারোয়ান ও আবাসনের কিছু ছেলে। দারোয়ান দীপাকে দেখে ছুটে আসে ও যা বলে তা শুনে দীপার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। দারোয়ান যা বলে তার সার সংক্ষেপ হল-
বিকেলে সরলার সাথে দোকানে যায় বুবলি, সরলা দোকানে জিনিস কিনতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেইসময় নাকি সেখানে উপস্থিত হন বুবলির আম্মু। আম্মুকে দেখে বুবলি ছুট্টে যেতে যায় তাঁর কাছে, আম্মুও ছুটে আসছিলেন রাস্তার ওপার থেকে। সেই সময় বড় রাস্তা দিয়ে ধেয়ে আসে একটি গাড়ি। আম্মু সেইসময় দৌঁড়ে এসে গাড়ির সামনে থেকে সরিয়ে দেন তাঁর আদরের বুবু বেটিকে। ছিটকে পড়ে বুবলি জ্ঞান হারায় এবং গাড়ির চাকায় পিষে সেখানেই মারা যান আম্মু। বুবলিকে পরে সেখান থেকে কোলে করে তাদের চারতলার ফ্ল্যাটে নিয়ে যায় সরলা এবং স্থানীয় কিছু ছেলে। ঘটনার হটকারিতায় দীপাকে ফোন করার সুযোগ পায়নি দারোয়ান। কিন্তু সে নাকি তাকে কল করতেই যাচ্ছিল।
সব শুনে দীপার হাত পা কাঁপতে থাকে সে দৌঁড় দেয় লিফ্টের দিকে। মেয়ের কাছে যায় দীপা। ডাক্তার মিত্র পাশে বসে তার। ডাক্তার দীপাকে দেখে উঠে এসে জানান মেয়ে ভালো আছে তার। শক পেয়েছে, কাটতে একটু সময় লাগবে। বিশেষ কোন চোট পায়নি বুবলি, এখন ঘুমানো তার জন্য ভালো। এরপর সরলা তাকে জানায় জ্ঞান ফেরার পর বুবলি নাকি খুব কান্নাকাটি করছিল। তাকে জানানো হয় তার আম্মু ভালো আছেন, হাসপাতালে আছেন, ফিরতে সময় লাগবে।
আজ রাতে বুবলির সঙ্গেই শোবে দীপা। বুবলির ঘরের জানলা দিয়ে বাইরে তাকায় সে। বুবলি তখনও ঘুমিয়ে আছে। ধীর পায়ে এসে বারান্দাটার কাছে দাঁড়ায় দীপা। বারান্দার গ্ৰিল দিয়ে সোজা নীচে তাকিয়ে সে দেখতে পায় একটি সারমেয় ও তার শাবকেরা কি সুন্দর খেলা করছে। আজ দীপার ভীষণ মনে পড়ছে বুড়িমাসির কথা। বুড়িমাসিও একদিন তাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের কথা ভাবেননি, হয়তো তাঁকেও এমন ভাবেই প্রাণ দিতে হয়েছিল। দীপার বুড়িমাসি ও বুবলির আম্মু কোথায় যেন মিলেমিশে এক হয়ে যান। বুবলির জীবনেও কী তার মায়ের মতো কষ্টটা থেকেই যাবে সারাজীবন? বুবলি ও কী তার মায়ের মতো আফসোস নিয়েই...
"মা!" পিছন থেকে ডেকে ওঠে বুবলি। খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে সে। "জানো মা আম্মুর সাথে আমার প্রথম এই বারান্দাটার সামনেই দেখা হয়। রোজ যেন এখানে কি কাজে আসত আম্মু। একটু আগেও এসেছিল আমার সাথে কথা বলল কত। এখন থেকে সে নাকি আমার কাছে রোজ আসবে আর কেউ তাকে বাঁধা ও দিতে পারবে না।" দীপা বোঝে স্বপ্ন দেখেছে বুবলি। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। কষ্টটা দলা পাকিয়ে জমে থাকে বুকের কাছে। এতদিনে মাতৃত্বের অর্থ বুঝে গিয়েছিল দীপা। নিজের মা না হয়েও দুই মায়ের অবদান গেঁথে যায় তাদের মা ও মেয়ের জীবনে।
সমাপ্ত
