STORYMIRROR

SHUBHAMOY MONDAL

Drama Horror Tragedy

3  

SHUBHAMOY MONDAL

Drama Horror Tragedy

নিশির ডাক

নিশির ডাক

5 mins
234


আমি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে, বসে আছি এখন ওড়িশার দাড়িংবাড়িতে। নির্জন বনের ভিতরে, একটা আধ-পোড়ো বাড়ির দোতলার ঘরে, আরাম কেদারায় শুয়ে সকালের রোদ গায়ে মাখছি। 


আমার সামনের বিছানা, আমি কাল রাতে শেষ যেখানে শুয়ে ঘুমিয়েছিলাম, সেটা এখন একটা ধবধবে সাদা চাদরে টানটান করে ঢাকা। তার কোথাও একটু দাগও লেগে নেই কোনো।


ঠিক সামনের দেওয়ালে, কাল রাতেও ঝুলছিল - কপালে এত্তবড় লাল টিপ পড়া, খুব মিষ্টি দেখতে, একটা কিশোরী খ্রীষ্টান বালিকার হাস্যোজ্জ্বল মুখাবয়ব। সেখানে দেখি জায়গা করে নিয়েছে এখন - আমারই নিজের এক করুণ প্রতিকৃতি! তার গলায় আবার সদ্য চড়ানো হয়েছে - একটা রজনীগন্ধার মালাও!


বিয়ে থা তো আর করিনি, তাই রজনীগন্ধার মালা পড়লে নিজেকে কেমন লাগে, সেটা আগে দেখা হয়নি আমার। আজ দেখলাম নিজেকে একেবারেই বেমানান লাগছে।


সারা জীবন কেবল টোঁ টোঁ করে দেশজুড়ে ঘুড়ে বেড়িয়েছি - অতিপ্রাকৃত ঘটনা আর বস্তুর সন্ধানে - বলা ভালো ভূতের গল্প লেখার আগে, তার রসদ খুঁজে বেড়িয়েছি, আর কি?


অবশ্য সেই কারণে এবার এই দাড়িংবাড়িতে আসিনি। এসেছিলাম এক পুরানো বন্ধুর ডাকে তাদের এই ওড়িশার কাশ্মীরকে দেখতে। 


এদিকে শীতটা যাই যাই করেও পুরোটা যাচ্ছে না। আর ফলস্বরূপ, আদেখলা বিশ্ব-ভবঘুরে আমাদের বাঙালী পর্যটকদের ভিড়ও কমছে না। আসে পাশে, থাকারও তাই জায়গা পাচ্ছিলাম না কোনো হোটেলে। 


আমার বন্ধুটির ঠিক এই সময়েই এক অতি নিকট আত্মীয় বিয়োগ হয়েছে। তাই তাকে ডাকাডাকি না করে বরং একটু এড়িয়ে যাবারই চেষ্টা করছিলাম। 

কিন্তু বিধি বাম, তাই থাকার জায়গা না পেয়ে, অগত্যা তাকেই ফোন করতে বাধ্য হলাম। একটাই শর্ত ছিল যে, তার বাড়িতে এই দুঃসময়ে কিছুতেই গিয়ে উঠবো না। তার চেয়ে বরং জায়গা না পেলে, এবারটা নাহয় কলকাতাতেই ফিরে যাবো।


তো আমার সেই বন্ধুর যোগাযোগেই, এই অনেক দিনের পুরানো বাড়িটা পেয়ে গেলাম - নাম মাত্র ভাড়ায় দুদিন থাকার জন্য। জায়গাটা অবশ্য দাড়িংবাড়ি থেকে অনেকটা দূরে, নুয়াপল্লি বলে একটা ছোটো গ্রামের পাশে। 


একটা সবুজে ঘেরা পাহাড়ের চুড়ায়, জন মানব পরিত্যক্ত, খুব সুন্দর পরিবেশে দাঁড়িয়ে বাড়িটা। হাইওয়ে থেকে নেমে কাঁচা রাস্তা ধরে, বনের মধ্যে যেতে হল প্রায় এক কিলোমিটার। এ আমার একেবারে পছন্দের পরিবেশ! তাই বিনা বাক্য ব্যয়ে, এখানে থাকার সুযোগটা আমি একপ্রকার লুফেই নিলাম। 


বাড়িটা অনেক পুরানো - পরাধীন ভারতে একদা কোনো এক প্রকৃতিপ্রেমী ইংরেজ পুংগবের প্রিয় বাসস্থান ছিলো এটা। দেশ স্বাধীন হলে তাঁরা দেশে চলে যান - বাড়িটা নিকটবর্তী গীর্জার পাদ্রীকে দান করে দিয়ে।


এই এলাকায় খ্রীষ্টান জনসংখ্যা হিন্দুদের চেয়ে কম না, বরং কোথাও কোথাও বেশী। তা সেই পাদ্রী সাহেব ঐ বাড়িতে থাকতেন, তাঁর এক শিশু কন্যাকে নিয়ে।


পাদ্রী সাহেব নিজে অকৃতদার ছিলেন। শিশুটিকে পরিত্যক্ত অবস্থায়, তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন একদিন - তাঁর ঐ গীর্জারই পিছনের চাতালে। 

তারপর থেকে, তিনিই পরম মমতায় আর যত্নে, বড় করে তোলেন শিশুটিকে। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, তিনি তার নাম রেখেছিলেন মার্গারেট। আর সেও পাদ্রী সাহেবের আদর্শে উদার, ধর্মপ্রাণ ও সকল মানুষের মঙ্গলাকাঙ্খী এক নান রূপে বড় হয়ে উঠছিলো।


এলাকার সমস্ত জনকল্যাণমূলক কাজে - রুগ্ন, অসুস্থের সেবায়, দরিদ্র মানুষের উপার্জন ও জীবিকার উৎস তৈরীর কাজে, পাদ্রী সাহেবের মূল শক্তি হয়ে উঠেছিল সে। আসে পাশের এলাকার সমস্ত লোক তাকে চিনতো, স্নেহ করতো, ভালোবাসতো, আদরও করতো। 


কিন্তু হঠাৎ একদিন, কিছু ধর্মান্ধ উন্মাদের দল সেখানে হাজির হলো। তারা অভিযোগ নিয়ে এলো - ঐ পাদ্রী সাহেব অন্যধর্মের মানুষদের জোড় করে ধর্মান্তরিত করে খ্রীষ্টান বানাচ্ছেন।


একথা সত্য ছিল যে, সাধারণ মানুষকে পাদ্রী সাহেব যীশুর জীবনের নানা ঘটনার কাহিনী ও উপদেশের কথা বলতেন। তাঁর উদার মানসিকতা আর জগতের সমস্ত মানুষের কল্যাণের জন্য, তাঁর নিরন্তর প্রচেষ্টার কথা গল্প করে শোনাতেন। নিজে থেকে কেউ খ্রীষ্টান হতে চাইলে তাদের ধর্মান্তরণও করতেন - এও সত্য।


কিন্তু তিনি কখনও কারোর ওপর জোড় খাটাতেন না। তাঁর কাছে যীশুর নানা অলৌকিক কাহিনী শুনতে গীর্জায় রোজ হিন্দু, মুসলিম পরিবারের ছেলে মেয়েরাও হাজির হতো। আর্তের সাহায্যে গিয়েও কোনোদিন তিনি ধর্মের কথা তোলেন নি কোথাও। মানুষের পাশে দাঁড়াবার আগে, তার ধর্মের খবর নেননি তিনি কখনও। 


তবু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে, একদিন প্রকাশ্য দিনের বেলায়, তাঁর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিলো তারা! সেদিন পাদ্রী সাহেব ঘটনাক্রমে তখন একজনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় গিয়েছিলেন। বাড়িতে ছিলো শুধু কিশোরী মার্গারেট। 


পাদ্রী সাহেবের প্রার্থনাকক্ষে বসে, সে তখন বাইবেল খুলে, নিউ টেস্টামেন্টের ক্যানোনিকাল গসপেল-এ বর্ণিত, প্রভু যীশুর নির্মম পরিণতির কাহিনী পড়ছিল। পড়তে পড়তে আবেগ তাড়িত হয়ে, প্রভুর প্রতি সমবেদনায়, ব্যথায় বিভোর হয়ে অশ্রুজলে ভাসছিলো সে। 


বাইরের লোকজনের আওয়াজ, অগ্নিসংযোগ - এসব কিছুই বোধ হয় তাই তার কানে ঢোকে নি। হয়তো সে বেঘোরেই মারা গিয়েছিলো! খবর পেয়ে যখন পাদ্রীসাহেব ছুটে এলেন বাড়িতে, ততক্ষণে সব শেষ।


তারপর, তিনি এই বাড়িতে আর কখনও আসেন নি। তখন থেকে এই বাড়িটা পরিত্যক্ত হয়েই রয়ে গিয়েছিলো। পরে কোনো এক ট্যুরিস্ট কোম্পানীর নজরে আসে বাড়িটা।


বাড়িটার লোকেশান আর সামনের এমন মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে, তারা বাড়িটা ঐ গীর্জা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এক প্রকার জলের দরেই কিনে নেয়।


বাড়িটার সাড়াই ও সাফ সুতড়ো করার সময়, তারা দেখে - দোতলার ঘরের দেওয়ালে ফ্রেমবন্দী, একটা সুন্দর কিশোরীর ছবি! যদিও সেটা মোটেই বেমানান লাগছিলো না, তবুও তারা ঘরের কাজ শুরুর আগে, ছবিটা দেওয়াল থেকে নামিয়ে নিতে চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু পারে নি।


যতবারই ছবিটা সড়ানোর চেষ্টা করেছে কেউ - ছিটকে পড়ে গেছে সে মেঝেয়। ছবিটাকে এই দেওয়াল থেকে একচুলও নড়ানো পর্যন্ত যায়নি ! অগত্যা, আর বাড়াবাড়ি না করে, ছবিটাকে ঐ দেওয়ালে ঐভাবে রেখেই, বাড়িটার পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়।


তারপর থেকে, গেস্টহাউস হিসাবে বাড়িটা ভাড়া দিয়ে, তারা বেশ ভালোই রোজগার করছে। কিন্তু দোতলার ঐ ঘরটা - তারা কোনোদিনই কাউকে থাকার জন্য ভাড়া দেয়নি!


আমার জন্য যখন বন্ধু ফোন করেছিলো, তখন ওদের যে বুকিং এজেন্ট, সে বলেই দিয়েছিলো - ঐ ঘরটা কাউকে তারা ভাড়া দেয়না এবং তার কারণটাও জানিয়ে দিয়েছিলো।


তারা আবার আমার ঐ ট্যাক্স কনসালটেন্ট বন্ধুর মক্কেল - মানে আমার বন্ধুই ওদের ট্যাক্সের সমস্ত ঝামেলা পত্তর দেখে আরকি। তার ওপর আমারও থাকার জন্য এইরকমই কোনো জায়গাই বেশি পছন্দ - এটা শোনার পরই, তারা এই প্রথমবারের জন্য রাজী হয়েছিলো - কাউকে ঘরটা ভাড়া দিতে।

ঘরটায় আসবাবপত্র কিছুই ছিলো না। আমি এখানে পৌঁছাবার পর, তারা একটা খাট, একটা টী টেবল আর এই আরাম কেদারাটা এই ঘরটায় ঢুকিয়ে দিয়ে গেলো।


রাতে খাওয়া দাওয়ার পর, খাটে একা শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম - সভ্য মানুষ কি করে এত নিষ্ঠুর হয়? এমন ফুলের মত একটা নিষ্পাপ শিশুকে কেউ হত্যা করতে পারে?


জ্যোৎস্নায় ভরে গিয়েছিল গোটা ঘরটা। আমি দেওয়ালে মার্গারেটের ছবিটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে, মনে মনে ভাবছিলাম - ঠিক কি ঘটে থাকতে পারে সেদিন?


ঘুম আসছিলো না, মনে হলো - কাহিনীটা লিখেই রাখি আমার ডায়েরীতে। লিখছি, লিখতে লিখতে অবশেষে এলাম সেদিনের ঘটনার বর্ণনায় - ছোট্ট মার্গারেট বাইবেল খুলে, যীশুর মর্মান্তিক ক্রুশবিদ্ধ হবার কাহিনী পড়ছে, আর ওদিকে তার বাড়িতে আগুন লাগাচ্ছে সেই লোকগুলো!


বর্ণনাটার এই জায়গায় এসে, মার্গারেটের শেষ পরিণতি নিয়ে যাই লিখি, দেখি - কালি পড়ে না কলম থেকে! অথচ অন্য পাতায় বা অন্য আর যা কিছু লিখি - তার বেলা দেখি, দিব্যি স্পষ্ট কালি ঝড়ছে! শুধু সেদিনের ঐ কাহিনীটা - যেমন শুনেছিলাম আর কি, তেমন করে কিছুতেই লিখে উঠতে পারছিনা! 


।চলবে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama