Sanghamitra Roychowdhury

Drama

2.8  

Sanghamitra Roychowdhury

Drama

নীল খামে নীল চিঠি

নীল খামে নীল চিঠি

11 mins
1.7K


আমার প্রিয় 'সু',


অনেককাল বাদে কাগজ কলম নিয়ে বসলাম। নাহ্, আজকাল আর চিঠিপত্র লেখা হয় না, চলটাই উঠে গেছে। তাছাড়া লিখবোই বা কাকে? তবে আজ যে তোমায় আমি চিঠিটা লিখছি তা কিন্তু একেবারেই অকারণে বা নিছকই অবসরের সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে নয়। গূঢ় উদ্দেশ্য অবশ্যই আছে একটা। তবে সে আপাতত যাকগে, ওকথা নাহয় পরেই হবে। অনুরোধ রইলো চিঠিখানির শেষ ছত্র অবধি পড়ার।

তারপর, তোমার খবর কি? কেমন করছো আজকাল সংসারধর্ম পালন? তবে মোটেই তোমার কোনো খবর জানি নে, একথাটা কিন্তু একবারও ভেবো না 'সু'। আমি না চাইতেই তোমার খবরগুলো ঠিক কানে চলে আসেই, দিদিভাইয়ের ফোনের মাধ্যমে। শুনেছি, সব শুনেছি, ইচ্ছে না থাকলেও, কষ্ট হলেও। এই সেদিনে নিউইয়র্কে বড়মেয়ের বাড়ি থেকে ঘুরে এলে। তার ক'দিন পরেই আবার মেলবোর্নে ছোটমেয়ের বাড়ি থেকে। বেশ আছো কর্তা-গিন্নিতে! কৃতি মেয়েদের কল্যাণে পৃথিবীর এমুড়ো থেকে ওমুড়ো উড়ে বেড়াচ্ছো। আচ্ছা, 'সু' তোমার কি এখনো উচ্চতায় ভয় হয়? নাকি সয়ে গেছে?

উচ্চতার কথায় হঠাৎ মনে পড়লো। 'সু', তোমার মনে আছে, একবার রাসের মেলায় দু'জনে সেই জায়েন্ট হুইল... ইলেক্ট্রিক নাগরদোলায় চেপেছিলাম? ঠিক যখন আমি ভীষণ অস্বস্তিতে চেঁচাবো কিনা ভাবছি, ঠিক তক্ষুনি তুমি ঐ বাজখাঁই গলায় চেঁচাতে শুরু করলে, "থামাও, থামাও, আমি নেমে যাবো, থামাও..."! আরো দু-এক পাক খেয়ে যখন থামলো নাগরদোলা, তখন দু'জনেরই অবস্থা সঙ্গীন। পেটের ভেতরে মেলা থেকে খাওয়া সবকিছু তখন ঊর্ধ্বমুখী। অনেক চেষ্টাতেও সামলানো গেলো না, ঢেলে ফেললাম দু'জনেই। কে কার মাথায় জল দেয় তখন! পরে দিদিভাই শুনে বলেছিলো, "তোরা দুটোই পাতে দেবার অযোগ্য, জন্মেও শুনিনি বাবা, চাকরি করা ধেড়ে ধেড়ে ছেলেমেয়েদের এমন হয়! কী করে যে সংসার করবি তোরা?" ঠিকই তাই, আমার সাথে তোমার এমন গুছিয়ে সংসার করাটা হোতো না, আমি তো এখনো তেমনই অগোছালো, খানিক হয়তো বাউন্ডুলেও।

আজকাল বুঝি জানো, বয়সটা বেড়েছে। একা মানুষ, নিজেকেই সব করতে হয়। এইতো দেখো না, আজকাল ওষুধ ছাড়া ঘুমই আসে না। পাড়ার দোকানে ওষুধটা আজ পাই নি, অনেকটা হাঁটতে হোলো ওষুধটা নেবার জন্য। একমাসের পুরো স্টকই নিয়ে নিলাম তাই। অতটা হেঁটে শরীরটা আজ আর দিচ্ছে না গো, তার ওপর জানোই তো জব্বলপুরের গরম!

আরে হ্যাঁ, হাঁটার কথায় মনে পড়ে গেলো, সেই সেবার তুমি ধর্মতলায় সেই পাক্কা সাহেবী বুলি আওড়ানো অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বুড়োর কাছ থেকে জেনিথ ক্যামেরাটা কিনলে। তখন তো খালি গ্রামবাংলার ছবি তোলার নেশায় প্রায় প্রতি শনিবার গ্রামে ছুটছো। সঙ্গে ল্যাংবোট আমিও আছি। একটা বাসে চেপে বসলাম একদিন এসপ্ল্যানেড থেকে। কী কান্ড! আমাদের খুচরো বাসে ওঠার আগেই খেয়েদেয়ে শেষ। এদিকে কন্ডাক্টরও কিছুতেই একশো টাকার নোট ভাঙিয়ে দেবে না, তার ওপর গুছিয়ে গন্তব্যের স্টপেজ বলতে পারছো না। কে জানে, কোত্থেকে শুনেছিলে, ভালো নাকি গ্রামবাংলার ভিউ পাওয়া যাবে এ বাসে চেপে কোনো একজায়গায় গেলে। কিন্তু মাথা টাথা বিস্তর চুলকেও কিছুতেই মনে করতে পারলে না স্টপেজের নাম। কন্ডাক্টর চিড়িয়াখানার প্রাণী দেখার মতো কৌতুকে আর সন্দেহে মেলা দৃষ্টিতে সামনে টিকিটের জন্য হাত বাড়িয়ে। পকেটে খুচরো বলতে একটাই পাঁচ টাকার নোট। কন্ডাক্টরের হাতে ধরিয়ে বললে, "এই পয়সায় দু'জনের যতদূর যাওয়া যায় গিয়ে নামিয়ে দিও।" কন্ডাক্টরও বিজ্ঞের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে টাকাটা পকেটে পুরে ফেললো, স্টপেজের নাম নেই, তাই টিকিট দেওয়ারও দায় তার নেই।

শহর পিছনে ফেলে বাস ছুটছে, দূরে দূরে গ্রামের আভাস, রাস্তা থেকে ধানি জমি ছাড়িয়ে অনেকদূরে। কন্ডাক্টর ঘন্টি বাজিয়ে বাস থামিয়ে নামিয়ে দিলো ঐ জনশূন্যপুরে। যেই বাসটা গোঁ গোঁ শব্দে ছাড়লো তুমি অমনি বাসের পিছনে ছুটলে, "হেই, রোকো, রোকো..." না দাঁড়িয়ে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে বাস চলে গেলো। আমি কিছু বলার আগেই তুমি বলে উঠলে, "মনে পড়েছে, স্টপেজ আমতলা।" সাইকেল আরোহী একজনকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলে, "আমতলা কতদূর দাদা?" সে বললে, "এই তো, সামনেই, এই পাকা সড়ক ধরে সিধে।" অর্থাৎ যেদিকে বাসটা গেছে সেদিকেই, হাঁটা শুরু। বোধহয় আধা ঘন্টাখানেক হেঁটে ফেলেছি, তখনও আমতলা কেন, কোনো তলাই আসে নি।

তারপর দেখি বছর বিশেকের তরুণ এক সাইকেল ভ্যানে একটা বাচ্চা গরু চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একজন হেঁটো ধুতি পরা পুরুষ আর ঘোমটা টানা মহিলাও ছিলো পা ঝুলিয়ে বসে। আমাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। নতুন চটির ঘষায় তখন আমার পায়ের ছাল-চামড়া উঠে রক্তারক্তির জোগাড়। দেখে শেষমেশ ভ্যানওয়ালার আন্তরিক আহ্বানে চেপেই বসলে আমাকে নিয়ে ভ্যানে, পা ঝুলিয়ে। তারপর আমতলা পর্যন্ত গোটাটা রাস্তা হাসতে হাসতে পেটব্যথা। মাঝে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে একটা বাসও চলে গেলো আমতলার দিকে। তাতে আমাদের হাসি আরও বেড়ে গেলো দেখে কেন কে জানে আমাদের সহযাত্রীরাও হাসতে শুরু করলো। বাছুর বাবাজী হাম্বারবে বিরক্তি প্রকাশ করলো শুধু। ওহ্, আমার পেটের মধ্যে হাসিটা এখনো কোকাকোলার মতো বুজবুজ করছে গো।

এই দেখো, লিখতে লিখতে নিজের কথাই তো সাতকাহন লিখে ফেললাম গো, সরি, সরি। আরে তোমার সেই কথাটা মনে আছে? সেই একাদশীর দিনে আমরা নন্দন থেকে "ঘরে বাইরে" দেখে বেরোলাম, আর শুরু হোলো তুমুল বৃষ্টি। সে আর থামেই না, এদিকে রাত বাড়ছে। তখন তুমি বললে,

"চল কিকি, রাত হয়ে যাচ্ছে, ট্যাক্সি ধরে শিয়ালদা পর্যন্ত চলে যাই," আমিও বললাম, "ঠিক আছে!"


ট্যাক্সি ধরার জন্য নন্দন চত্বর থেকে বেরোতেই হাওয়ায় আমার মহেন্দ্র দত্ত থেকে কেনা নতুন ফোল্ডিং ছাতা গেলো উল্টে। উল্টোনো ছাতা ঠিক করতে করতেই দু-জনেই চুপচুপে ভিজে। ততক্ষণে ছাতার শিকে তোমার হাত কেটেছে আর আমি ব্যাগ হাতড়াচ্ছি, একটা ব্যান্ড-এড ছিলো যে ব্যাগে। এদিকে ততক্ষণে মহেন্দ্র দত্তকে একটা বাছাই মুখখারাপি সম্বোধন করে তুমি ছাতাটা ফুটপাতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছো। আমি ফ্যাক করে হেসে ফেলায় তোমার সে কী রাগ, "এই শোন, না পোষালে তুই আর কোনোদিন আমার সাথে কোথাও যাবি না, বুঝলি?" বুঝলাম, সেই বোঝাই চলছে।

এ বাবা, দেখো আবার ভুলে গেছি, আজ তো দু-জনের কথার জাবর কাটতেই এ চিঠি। তারপর সেদিনে ট্যাক্সির জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে খালি ট্যাক্সি তো আর কপালে জুটলো না, তবে কপালক্রমে একটা প্রায় খালি ২৩০ বাস জুটে গেলো। এ একপক্ষে ভালোই হোলো, সোজা বেলঘরিয়া চলে যাওয়া যাবে ভেবে আমি লাফিয়ে উঠে পড়লাম বাসে, পিছনে তুমিও। ছোকরা কন্ডাক্টর ফিচেল হেসে ভারী আপ্যায়ন করে দু'জনকেই সিটের ব্যবস্থা করে দিলো, মুখোমুখি। বাসে হাতেগোনা যাত্রীসংখ্যা। বৃষ্টিভেজা শহর কোলকাতার বুক চিরে জল ছিটিয়ে, পথচারী ভিজিয়ে, অন্য রুটের মিনিবাসের খালাসীর গালাগালি খেতে খেতে আমাদের বাহন ২৩০ বাসটি মধ্যমগতিতে এগোচ্ছে খানিকটা, আবার গোঁত্তা খেয়ে থামছে। তখনও কোলকাতার অনেক রাস্তায় ওয়ান-ওয়ের রমরমা হয় নি। বাসে চড়লে বেশ রাস্তার ধারের দোকানের সাইনবোর্ডের নাম - রাস্তার ঠিকুজি কোষ্ঠী এসব বেমালুম মুখস্থ করে নেওয়া যেতো। মনে আছে? ওহ্, অনেক বছর কোলকাতায় যাওয়া হয় নি।

এই যাহ্, সরি, সরি। তারপর তোমার মনে আছে? সেই কন্ডাক্টর ছোকরা আর মাঝবয়সী খালাসী দু'জনেই ঘুরেফিরে আমাদের দিকে বারবার তাকাচ্ছে দেখে তুমি আর পারলে না। তোমার পাশের সিটটা খালি পড়েছিলো এতক্ষণ, এবার পরের স্টপেজে বাস থামতেই তুমি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে আমাকে তোমার পাশের খালি সিটটায় বসিয়ে দিয়ে আমার হাতটা শক্ত মুঠিতে চেপে ধরে রেখে দিলে। তবু দেখলাম ওরা দু'জনেই দিব্যি আমাদের দিকে তাকাচ্ছে, মাঝেমধ্যে ফিসফাস করছে, আর হাসছে। ভারী অস্বস্তি তখন আমারও, যতই দেখতে না চাই, সেই বারবারই চোখ আটকাচ্ছে ওদের বত্রিশ পাটি দন্তব্যাদনে। এবার চোখটা ঘোরাতে গিয়ে মনে হোলো বাসে আরো কেউকেউ ঠোঁট টিপে হাসছে আমাদের দিকে তাকিয়ে। শ্যামবাজার ছাড়াবো ছাড়াবো সময়ে যখন তুমি খুব আস্তে আস্তে বললে, "নেমে যাবি?" ঠিক তখনই চড়বড়িয়ে আবার তেড়ে বৃষ্টি নামলো। সুতরাং, ও সিদ্ধান্তে ইতি টানতেই হোলো। ততক্ষণে আমি গুনে ফেলেছি, আমাদের নিয়ে বাসে তখন ষোলোজন। অগত্যা বসে রয়েছি আমরা তখন, টালা ছাড়ালো, সিঁথির মোড় ছাড়ালো। আইএসআই-এর সামনে পৌঁছতে বৃষ্টি তখন ইলশেগুঁড়ি। বাসে তখনও আমরা মিলিয়ে এগারোজন। ডানলপ মোড়ে এসে একসাথে ছ'জন নেমে যেতেই কন্ডাক্টর এসে আমাদের উল্টোদিকের খালি সিটে বসলো। আমরা তখন নিজেদের মুঠি আরো শক্ত করেছি। ভাবছি, আর তো মাত্র ক'টা স্টপেজ! মায়ের অষ্টধাতুর গোপালের মুখটা আমার চোখের সামনে দিয়ে যেন সড়াৎ করে হড়কে গেলো।

কন্ডাক্টরটাও একটু ইতস্তত করে তখনই বললো, "দাদা, আপনার জামাটা দেখুন একবার!" মুখে তার বিগলিত হাসি, তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম আমি। আর তুমি সেই আবার বলেই ফেললে, "তোর দিদি-জামাইবাবুটা কিপটের জাসু একদম। নিজের বোনকে পুজোয় এরকম কাঁচা রঙের শাড়ি কেউ দেয়?" আমার রাণীরঙা জামদানী শাড়ীর কাঁচা রঙ তখন তোমার বম্বে ডাইং-এর অফ হোয়াইট শার্টের এখানে ওখানে। ট্যাক্সির জন্য দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতেই কাণ্ডটা ঘটেছিলো তার মানে। খুব পছন্দের ছিলো তোমার শার্টটা, মনে আছে? আমার প্রথম মাইনেয় কেনা। মনে হচ্ছে যেন এই সেদিন, চোখের সামনে হাজারো মুহূর্তের শয়ে শয়ে স্লাইডশো, মনে পড়ে তোমার? নাকি এসব মনে করিয়ে বৃথা কষ্ট দিচ্ছি তোমায়? জানি নে তা।

এরপর তুমি মুর্শিদাবাদে ট্রান্সফার হলে, নতুন চাকরি, বয়স কম, তোমার মামাবাবুর সুপারিশ তেমন কাজে এলো না, যেতে হোলো তোমায়। আর আমি তখনো সেই ধ্যাদ্ধেরে গ্রামের ব্রাঞ্চে পড়ে আছি, ক্যানিং থেকে সাইকেল ভ্যানে ঘন্টাখানেক দূরে। দু'জনের দূরত্ব আমার বাবা-মাকে ভাবালো। বাড়ীর লোক ধরেই নিয়েছিলো অনুষ্ঠান হওয়াটাই কেবল বাকী। তাই আগ বাড়িয়ে তোমাদের বাড়ীতে সটান একেবারে বিয়ের দিন ঠিক করতে ছুটলো। বিয়েটা হলে সেই গ্রাউন্ডে আমি ট্রান্সফারের দরখাস্তও করতে পারবো, তোমার পোস্টিং প্লেস অনুযায়ী। তাই ওদের আর তর সইলো না, দিদিভাইও খুব উত্তেজিত ছিলো। ক্লাসমেট ভগ্নিপতি হবে বলে কথা! তোমাকে বোধহয় সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলো। আমারও মনটা তখন টগবগ করে ফুটছিলো।

আমি ছাদে একা দাঁড়িয়েছিলাম, কপালে ছিলো তোমার দেওয়া সেই কালো সোয়েডের চল্লিশ টিপের পাতার দ্বিতীয় টিপটা। ক'দিন আগে মুর্শিদাবাদ থেকে আসার সময় ট্রেন থেকে কিনে বুকপকেটে করে নিয়ে এসেছিলে। আর প্রথম টিপটা নিজের হাতেই পরিয়ে দিয়ে বলেছিলে, "বাহ্, বেশ দেখাচ্ছে তো!" সারা শরীরের রক্ত তখন আমার মুখে জমা হয়েছিলো বলেছিলে, মনে আছে? অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার হাতটা টিপ ছুঁলো কপালে। তোমার সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো, কিন্তু উপায় ছিলো না, ফোনের অভাবে। তোমাদের বাড়ীতে বোধহয় তখন পাঁজিপুঁথি দেখা চলছিলো, নাহলে বাবা-মা-দিদিভাইরা ফিরতে এতো দেরী করছে কেন? এইতো পাশের পাড়ায় তোমাদের বাড়ী!

ওরা ফিরলো, কেমন যেন ক্লান্ত পায়ে আর থমথমে মুখে। সেদিনই অনেক কিছু জানলাম, শুনলাম অনেক কিছু। জানলাম তোমরা কুলীন ব্রাহ্মণ আর আমরা শুদ্র, মৃৎকার পাল, তুমি নাকি তোমার মায়ের পা ছুঁয়ে কথা দিয়েছো যে তুমি তোমার মায়ের পছন্দের মেয়েকেই বিয়ে করবে। তোমার মায়ের ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সাথে বিয়ে দেবার জন্য নাকি সব লাখোপতি বাবারা তাদের ডানাকাটা হুরপরী মেয়েদের নিয়ে হত্যে দিয়ে পড়ে আছে। আমার বাবার মতো হাড়হাভাতে, মেয়েদের রোজগার হাত পেতে নেওয়া বামনের চাঁদে হাত দেওয়ার শখ হয় কি করে?

ওসব কথার কিছু আমার কানে ঢুকছিলো, কিছুটা না। দিদিভাই বলেছিলো একবার, "চল কুকু, একবার সুদীপ্তর কাছে মুর্শিদাবাদে যাই।" খুব কঠিন গলায় আমি বলেছিলাম, "না, একেবারেই না", সেই প্রথম মনে হয়েছিলো, "খুব ভুল করে ফেলেছি, তোমার সাথে মেলামেশার আগে হিসেবী হওয়া উচিৎ ছিলো।" আত্মসম্মান বড্ড ঘা খেয়েছিলো, তবে সাড়ে তেইশ বছরের শরীরের খাঁচার ভেতরে  মনটা একলাফে ছেচল্লিশের হয়েছিলো। অনেক শক্তপোক্ত জোরালো। সেজন্য অবশ্যই তোমার ও তোমাদের বাড়ীর লোকজনদের একটা বড়সড় ধন্যবাদ পাওনা আছে আমার কাছ থেকে। তবুও কী আশ্চর্য্য! তখনো প্রার্থণা ছিলো, আমার হতাশ্বাসের হুতাশন যেন কখনো আমার 'সু'কে স্পর্শ না করে। এর বেশী কিছু ভাবার শক্তিও তখন আমার আর ছিলোও না।

এরপরের ক'দিন অনেক ছোটাছুটি, ধরাধরি করে আমি জব্বলপুরের পোস্টিংটা জোগাড় করলাম, চাকরিটা আমাকে করতেই হবে। আর আমি চেনা পরিচিত গণ্ডীটা থেকে দূরে পালাতে চাইছিলাম। চার দশক আগে প্রেম বিয়ে অব্দি না গড়ালে অনেক জ্বালা ছিলো, বিশেষতঃ আমাদের মতো নিম্নবিত্ত পাড়ায়, হাড়হাভাতে পরিবারে। আর একটা কারণ তোমার মুখোমুখি হলে দুর্বল হয়ে পড়তেও চাই নি। বাবা - দিদিভাই - জামাইবাবু অনেক বুঝিয়েছিলো, কিন্তু মা খুব ঠান্ডা গলায় বলেছিলো, "ওকে তোমরা একটু সামলাতে দাও, দূরে যাক, মনটা ফিরুক।" মায়ের চোখে স্পষ্ট বিষাদের ছায়া। মা যে তোমাকেও বড্ড স্নেহ করতো, তাওতো তুমি জানতে। তাই মা বোধহয় তোমার ফেরার অপেক্ষায় ছিলো ঐ মাসখানেক। তারপরের লড়াইটা আমাকে একা লড়েই জিততে দিয়েছিলো।

তারপর মাসখানেকের মাথায় একাই চেপে বসলাম


শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেসের থ্রি-টায়ার স্লিপার কামরায়। কারুর কোনো কথা শুনি নি, একা পথচলার অভ্যেসটায় পটু হওয়ার পরীক্ষা শুরু হয়েছে তখন।

পরদিন দুপুর রোদ মাথায় দু-পাশের ধূধূ রুক্ষ প্রান্তর হেলায় দু-পাশে আরো দূরে ঠেলে ট্রেন ছুটছে যখন চাকায় ঝমঝম আওয়াজ তুলে, তখন জানো, আমার মনে হোলো তোমার কথা, "বল তো, ট্রেন ছুটতে ছুটতে কি বলে?" বোকাদৃষ্টি মেলে হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে তুমি বললে, "তুই একটা হাঁ করা মেয়ে, ট্রেন বলে -- ডাক্তারবাবু কত টাকা, ডাক্তারবাবু কত টাকা," চোখটা আমার গরম হয়ে উঠেছে। সহযাত্রীদের চোখের জিজ্ঞাসা এড়াতে চোখে সানগ্লাসটা পরে নিলাম।

অনেকক্ষণ লিখছি তো বহুকাল বাদে, গলাটা একেবারে শুকিয়ে উঠেছে তেষ্টায়। দাঁড়াও একঢোঁক জলে গলাটা ভিজিয়ে নিই।

এখানকার জল আমার এতবছরেও ভালো লাগে না, আজ তো আরো বিস্বাদ লাগলো, পুরোনো আবেগে হয়তো। আচ্ছা, কোথায় যেন থেমেছিলাম, ও, ঠিক আছে, দেখে নিয়েছি। ট্রেন ছুটছে সামনে তখন, আর আমার মন সবেগে পিছনপানে। হঠাৎই মনে হোলো জব্বলপুরে কি কোকিল ডাকে? কোকিলের ডাক শুনেই তো দিদিভাই সদ্যোজাত আমার নাম দিলো "কুকু", খুকুর বোন "কুকু"। কুকু নামটাই চালু হয়ে গেলো। তারপর কৈশোরের শেষবেলায় এক রোদমরা বিকেলে পাড়ার লাইব্রেরীর বারান্দায় দাঁড়িয়ে তুমি বললে, "আজ থেকে তোর নাম কিকি, কুকু'টা বড্ড বাজে শোনায়, কেমন যেন খুব খারাপ খারাপ!" ব্যাস্, সেই আমি হয়ে গেলাম কিকি, তোমার কিকি।

এরপর শিবপুরের হোস্টেল থেকে যখন দিদিভাই আসতে পারতো না, তখন তোমার হাত দিয়ে ক্লিপ বা কখনো সখনো চকলেট কিম্বা নেলপালিশ পাঠাতো। আর সঙ্গের গল্পের বইটা যে হাতখরচ বাঁচিয়ে তুমি এনেছো, সেটা আমি দিব্যি বুঝতাম।

এরপর একবার কাকতালীয় ভাবে তুমি আমার জন্য এনেছিলে মির্চা এলিয়েদের "লা ন্যুই বেঙ্গলি"র অনুবাদ, আর আমি টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে তোমার জন্য কিনেছিলাম মৈত্রেয়ী দেবীর "ন হন্যতে" । লেন দেনটা একই দিনে হয়েছিলো, মনে পড়ছে? "ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে...."!

তারপর পাশ করে দিদি যাদবপুরে এম-টেক করতে ঢুকলো। তুমি আর জামাইবাবু.... দু'জনেই ভালো ভালো সরকারি চাকরি পেলে। পরে যখন দিদি যাদবপুরেই পড়াচ্ছে, দিদির তখন বিয়ে হোলো। তুমি থাকাতে বাবা-মা বুঝলোই না বিয়েবাড়ীর হাজারো ঝক্কি ঝামেলা। সব সামলালে তুমি। আমি তোমাদের মতো অত ভালো ছিলাম না পড়াশোনায়, তবু পরীক্ষা-টরীক্ষা দিয়ে আমার যোগ্যতা অনুযায়ী বাইশ বছর পূর্ণ করেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের চাকরিটা পেয়ে গেলাম। ভাগ্যিস পেয়েছিলাম! নাহলে যতই তুমি আমার নাম পাল্টে 'কিকি' করো না কেন, এই যে আবার 'কুকু' হয়ে যাবার সময় কার কাছে হাত পাততে পারতাম বলো তো?

আরেকটু জল খেয়ে নিই দাঁড়াও, জলটা এতো বিস্বাদ, একবারে বেশী খেতে পারছি না।

অনেক হোলো আগডুম বাগডুম এলোপাথাড়ি কথাবার্তা, চর্বিত চর্বণ। তোমাকে আর অধৈর্য্য করাবো না, তাছাড়া রাতও হয়েছে, আর আমারও ঘুম পাচ্ছে ক্লান্তিতে। খুব মন দিয়ে শোনো, না না, পড়ো।

আচ্ছা, সু, নীল কি এখনও তোমার প্রিয় রঙ? তুমি তো আমাকে নীল শাড়ীই পরতে বলতে সবসময়। আর সমুদ্রনীল শাড়ীটা তো সেবার 'মঞ্জুষা' থেকে নিজে হাতে করেই কিনে এনেছিলে আমার একুশে পা দেওয়া জন্মদিনে। নীলরঙে নাকি তোমার চোখের আরাম হোতো। এখনও কি হয় গো, নীলে তোমার আরাম?

চল্লিশ ছুঁইছুঁই যে ছেলেটি তোমার কাছে এই নীল খামের চিঠি পৌঁছে দেবে তাকে তুমি চিনবে না।

বিদেশেই ছিলো ওও অনেক বছর, গবেষণার কাজে। আমিই ওকে তোমার ঠিকানা আর হাল হকিকত বুঝিয়ে দিয়েছি অনেক আগেই। ওকে এও বুঝিয়ে দিয়েছি, এ চিঠি যাতে কেবলমাত্র তোমার হাতেই পড়ে, তার অন্যথা কোনোমতেই না হয়। এ কারণেই এ চিঠি ডাকে না দিয়ে হাতে হাতে পাঠানো। তবে খামের ওপরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা তোমার নাম ঠিকানা দেখে তুমি নিশ্চয়ই আমার হাতের লেখাটা চিনতে পেরেছো এতক্ষণে। চিঠিটা সত্যিই অনেক লম্বা হয়ে গেলো গো।

চিঠি শেষ হয়েছে। ও হ্যাঁ, আর একটা কথা, চিঠি পড়া হলে একবার যাচিয়ে নিও, যে তোমার কাছে চিঠিটা পৌঁছে দিলো তার নাম সত্যকাম কিনা? স্বেচ্ছাধীনা জবালাতনয় সত্যকাম, কোনো দুর্বল মূহুর্তের মানুষ-মানুষী খেলায় জন্ম। পারলে দেখো, ওর ঠিক ঘাড়ের নীচের দিকের বাঁ-পাশে বিশালাকার এক টকটকে লাল জড়ুল আছে, ঠিক তোমারই মতো।

এবার সত্যিই আমার কথা ফুরোলো।

‌ভালো থেকো। আমি এবার ঘুমের দেশে চলি।


প্রীত্যন্তে,

তোমার কিকি



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama