Sheli Bhattacherjee

Drama

5.0  

Sheli Bhattacherjee

Drama

নেশা মুক্তি

নেশা মুক্তি

5 mins
2.3K


সকাল সকাল মিলনসংঘের মাঠে বেশ ভালো সংখ্যক লোকের ভিড় হয়েছে। দূর থেকে দেখে কপালের মাঝ বরাবর বেশ কয়েকটা সমান্তরাল রেখার দাগ ফুটে উঠল বিভাস দাসের। নিজের মনে নিজেই কতকটা আৎকে উঠলেন তিনি। তবে কি টেসে গেল নাকি? উফফ, মহা যন্ত্রণা বটে! খুব কাছে গিয়ে যে কাউকে জিজ্ঞেস করবে, তার উপায় নেই। লোকের মাথায় আজকাল বিদ্যেবুদ্ধি কম বেশি যাই থাকুক না কেন টিভিতে সব খতরনাক সিরিয়ালগুলো দেখে সন্দেহের বীজ গেঁথে রয়েছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। দু পা সামনে এগিয়ে যে কাউকে জিজ্ঞেস করবে তার উপায় নেই। আর সত্যি সত্যিই যদি হারুর কিছু হয়ে যায়, তবে কি থানা পুলিশ হবে? কাল রাতে আদৌ তাদের একসাথে কি দেখেছিল কেউ মাঠে? সব চিন্তায় মাথাটা কেমন গুবলেট হতে থাকে বিভাসের।


এমন সময় বান্টি ওর মায়ের হাত ধরে স্কুল যাচ্ছিল, আর বলছিল " মা জানোতো, হারুকাকু খুব ভালো মানুষ। কি সরল হাসি দিয়ে আমাদের সব জোকস বলতো। আর বিভিন্ন ক্যারিকেচার করেও দেখাত। মাঝেমধ্যে পশুপাখির ডাক ডাকত, আবার কখনো টম সাজত, জেরি সাজত, আবার কখনো কারমিট দ্য ফ্রগের মতো চার হাত পা দিয়ে বসে লাফিয়ে লাফিয়ে হাসাত আমাদের। দেখো আজ সেই সবুজ পাঞ্জাবিটাই পরে আছে হারুকাকু। আর বলত তোরা কখনো কারো হাতের পাপেট চরিত্র হবি না। পাপেট চরিত্র কি মা?'


বান্টির কথাগুলো কানে যেতেই বিভাসের আর কোনো সন্দেহ রইল না। নির্ঘাত হারুর কিছু হয়েছে। মাঠের পূবদিকে বান্টিদের বাড়ি। সেখান থেকে মাঠ পেরিয়ে শটকার্ট ঘাসবিহীন মাটির সরু পথ বেয়ে ওরা বড় রাস্তায় এসে উঠেছে। আর সেসময়ই সম্ভবত ওই জটলার কারণটা বান্টির চোখে পড়েছে। তাই দেখেই কি বান্টি হারুর কথা বলছিল? নাকি দুঃখও করছিল? তার মানে কি সত্যি হারু আর ...!


'ও বিভাস কাকা, বিভাস কাকা ...'

পাড়ার ক্লাবের ছেলে তনয়ের গলা পৌঁছায় বিভাসের কানে। সে তাকে বারান্দায় দেখে ডাক পারছে। আর সাড়া না দিয়ে উপায় নেই। আবার সাড়া দিলে যে কি হতে পারে, তাও বিভাসের জানা নেই। তাও নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল বিভাস 

"কিরে তনয়, ডাকছিস কেন বাবা?"

বিভাসের মতো খিটকেল বদ মেজাজি লোকের মুখে বাবা বাছা শোনার অভ্যাস কোনোকালেই পাড়ার ছেলেদের ছিল না। তাই একটু অবাক হয়েই ঢোক গিলে ওরা বলল 'হারুকাকুতো পুরো কুপোকাত হয়ে পড়ে রয়েছে?'

"অ্যা ... সেকি রে? কোথায়?" বিভাসের উত্তর তার অভিনয় দক্ষতা আপ্রাণ প্রমাণ কর‍তে চাইছে যে ঘটিনাটির সাথে তার দূর দূরেও কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি এইমাত্র তনয়ের মুখে এই ব্যাপারটা শুনে অবহিত হলেন মাত্র।

"হারুদা বাড়িতে যে নেই, তুমি আগে জানতে না।" তনয়ের পাশ থেকে বিশু সন্দেহজনক সুরে বলে উঠল।

"কাল শরীরটা ঠিক ছিল নারে, তাই একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম। তোর বৌদির মা অসুস্থ বলে বাপের বাড়ি গিয়েছিল। বাড়ির পেছনের দিকের দরজাটা ভেজিয়ে রেখেছিলাম হারু আসবে বলে। ওর তো আবার বাড়ি ফেরার সময়ের কোনো ঠিক ঠিকানা থাকে না। সারাটা দিন টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। নিজের মর্জির রাজা সে। কিছু বলতে গেলেই তো অবুঝ তর্ক জুড়ে দেয়।"

বিভাসের বলা কথাগুলো সবারই জানা। হারুকাকু যে গার্ডেনের অফিসে সরকারি চাকরি পাওয়ার পর এক রেবা নামক মেয়ের প্রেমে পড়ে পাগল হয়ে গিয়েছিল, তাও পাড়ার সবাই মোটামুটি জানে। কোনো কারণে সেই রেবা তার জীবনে না আসায় সে অল্প বয়সে অনেক মেয়েকেই দেখে অবচেতনে রেবা বলে ডাকত। কিন্তু কাউকে উত্যক্ত করত না। কিছু সময় পর নিজেই নিজের ভুল বুঝে সরে যেতো। হয়তো নিপাট সরল মনের মানুষ বলেই, একজনকে ভুলে গিয়ে আরেকটা প্রেমের জটিল হিসাবে আর নিজের জীবনে ঢুকাতে পারে নি। সময়ের সাথে সাথে হারুকাকুর মাথার গোলমাল বেড়েছে। শেষ কমাস হল চাকরিতেও ঠিকঠাক যায় না। তাও সরকারি চাকরি বলে রক্ষে, মাইনেটা মাসের শেষে চলে আসে। তাতে তার দাদা, বিভাস দাসের লাভ হয়েছে বিস্তর। বলতে গেলে সারাটা জীবন সে ভাইয়ের টাকায় বসে বসে পা দুলিয়ে খেয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে টুকটাক জমির দালালি করেছে। আর তাতে করেই এইট পাস বিভাসের সম্বন্ধে পাড়ায় বা বেপাড়ায় তেমন সুনাম নেই। সবাই কম বেশি জানত হারু যেমন সত্যবাদী, আর সাধাসিধা, তার দাদা বিভাস ঠিক তেমনই মিথ্যেবাদী আর ধাপ্পাবাজ। বিভাস ঘরে প্রায়ই মদ্যপান করত ভাইয়ের টাকায়। শোনা গেছে, বাকি ফূর্তিতেও নাকি রুচি আছে তার। কিন্তু হারুকাকা তো তেমন নয়। তাহলে সে আজ এভাবে মাঠে পাতা বেঞ্চটার উপর এতোগুলো মদের বোতল নিয়ে কিকরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর সবার কাছেই অজানা ও বিষ্ময়কর।


"হ্যাঁ রে বিশু, তনয় বললি না তো হারু কোথায়?"

অভিনয় জারি রাখে বিভাস। 

"ওইতো মাঠের বেঞ্চের উপর।" জানায় বিশু।

কথাটা শোনা মাত্র মরাকান্না কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে যায় বিভাস। তারপর সামনে গিয়ে দেখে বেঞ্চের উপর চিৎপটাং হয়ে শুয়ে রয়েছে হারু। তার দুহাতে ভিন্ন ভিন্ন মদের বোতল। কিছু খালি বোতল আবার আশপাশে গড়িয়ে পড়ে রয়েছে। ঠিক যেমনটা বিভাস গতকাল রাতে এসে দেখে গিয়েছিল। সে নিজেই তো হারুর সাথে কয়েকটা বোতল বয়ে এনে দিয়েছিল।


মনে মনে ভাবল বিভাস, ওর বুদ্ধিটা কাজে লেগেছে। হারুকে কদিন ধরেই বোঝাচ্ছিল ও, যে ভালো করে নেশা করলে রেবাকে ও কাছে পেতে পারে। তবে সে নেশার কথা কাউকে বলা যাবেনা। নির্জনে ধ্যানের মতো করে করতে হবে। এইভাবে হারুকে বেশ কয়েকদিনের চেষ্টায় বেশ ভালো নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল বিভাস। উদ্দেশ্য ছিল হারুকে নেশাখোর প্রমাণ করে, পৈতৃক বাড়িটা পুরোপুরি নিজের নামে করে নেওয়া। ভাইয়ের টাকায় স্ত্রী কন্যাসহ সংসার চললেও, বাড়িটা পুরো লিখিয়ে নিলে হারুকে কিছু না জানিয়েই প্রোমোটারকে দিয়ে মোটা টাকা পাওয়া যাবে। সাথে একটা ফ্ল্যাট। পাড়ার কিছু অতি সৎ মানুষ হারুকে স্নেহ করে বলে, তারা হারুর কিছু হলে এগিয়ে আসত। কিন্তু সেসব ল্যাটাও থাকবে না আর। কারো কিছু বলার মুখ থাকবে না এবার। ভাবতে ভাবতে প্রসন্ন মনে হারুকে ধরে কাঁদতে লাগল বিভাস। আর সবাইকে বলল "একটু জল এনে দাও তোমরা। ছেলেটাকে সরল সিধা পেয়ে কতজনই যে কত বদবুদ্ধি দিয়েছে এতোদিন। আমি সব সামলে রাখতাম। আর আজ কিনা সেই হারু মাতাল হয়ে গেল।" 


সবাই মিলে চোখেমুখে জল দেওয়ায় হুশ ফিরল হারুর। আর তাতেই একটু একটু করে ভিড় পাতলা হতে শুরু করল। বিভাসের মেয়ে রুমি ততক্ষণে গানের ক্লাস সেরে মাঠে এসে গিয়েছিল। বিভাস আর রুমির কাঁধে ভর দিয়ে তখন বাড়ির দিকে যাত্রা করে হারু। আর বলতে থাকে "জানিস দাদা, কাল সত্যি রেবা এসেছিল। আমার তখন চোখ মেলে ঠিকঠাক চাওয়ার অবস্থা ছিল না। তবু আবছায়া দেখলাম ওকে নীল সালোয়ারে। আমায় বলল 'তুমি আর নেশা কোরো না, আমি তাতে কষ্ট পাবো।'

আমি আর এসব ছাইপাঁশ খাবো না রে। রেবা মানা করেছে আমায়।" বলে মাথা দুদিকে নেড়ে নিজের কাজের নিজেই প্রতিবাদ করতে থাকল হারু।

বিভাস কতকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে চেয়ে রয়েছে তখন হারুর দিকে। আর রুমি মনে মনে বলছে, ভগবান আমায় ক্ষমা করো। বাবার অপরাধ কমাতে আমায় গতকাল রাত্রে কাকুর সামনে রেবা হতে হয়েছিল। নইলে যে কাকুর সরল মনের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তার উপর অন্যায় করছিল বাবা। কাকুর মনে সুপ্ত থাকা প্রেমের নেশাকে আরেকটা নেশা দিয়ে অতলে ডুবিয়ে দিচ্ছিল। আমি যে গত কয়েকদিন ধরে সবই টের পেতাম পাশের ঘর থেকে। কাকুকে কুপথে নামানোর জন্য বাবার নিকৃষ্ট প্রয়াসগুলোকে যে আর মেনে নিতে পারছিলাম না। মেনে নিতে পারছিলাম না একটা সরল মানুষের উপর হওয়া এতো বড় অন্যায়কে। অজান্তে পুতুলের মতো সে ব্যবহৃত হচ্ছিল তার নিজের লোকের কাছেই। সে যে শুধু আমার কাকু নয়, আমাদের সবার অন্নদাতা। 


(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama