Abanti Pal

Romance Fantasy Inspirational

4  

Abanti Pal

Romance Fantasy Inspirational

নব বসন্ত

নব বসন্ত

9 mins
879



'ডোরিয়ান! ডোরিয়ান তুমি কোথায়?' ইভার আকুল আর্তি প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো হাসপাতালের বিশাল ঘরটায়, কিন্তু কোনো প্রত্যুত্তর এলো না।


আরশি লাগানো দেওয়াল জোড়া জানলাটার সামনে ধীর লয়ে এগিয়ে গেল ইভা। বাইরে গেরুয়া আকাশ ক্রমে ধূসর হচ্ছে, কিছুক্ষণ পরেই উঠবে ধূলোঝড় আর তারপর আকাশ ভরে আসবে অজস্র তারা। সারা আকাশ জুড়ে এখন আল্ট্রা-হিউম্যানদের ব্যস্ততা। কিন্তু যতদূর চোখ যায়, এদের মধ্যে কোত্থাও নেই ডোরিয়ান। তবে কি ওর দুরারোগ্য অসুস্থতার খবর পেয়ে ওর পরমপ্রিয় ডোরিয়ান ওর বিমুখ হলো? ছেড়ে চলে গেল এই কারাগার-সম হাসপাতালে, একলা নিজের অপ্রতিরোধ্য ভবিতব্যের সম্মুখীন হতে! দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইভা।


পৃথিবী থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরে, এক অন্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অবস্থিত গ্রহ ওরিয়ন-৫৬৩৭। এই গ্রহের বাসিন্দাদের উৎপত্তি কিন্তু আমাদের পৃথিবী থেকেই। সেইবার যখন গ্রহাণু-সংঘর্ষের কারণে পৃথিবীর এক বৃহদাংশ নষ্ট হয়ে গেল, মানবজাতি প্রায় বিলুপ্তির মুখে, তখনই অবশিষ্ট মানুষেরা - তখন যাদের বলা হতো সুপার-হিউম্যানস, পাকাপাকিভাবে পাড়ি দেয় অন্য বাসস্থানের উদ্দ্যেশে। বসবাস শুরু করে ওরিয়নে। কিন্তু এই গ্রহকে স্থায়ী ঠিকানা বানানোর জন্য অনেক কসরত করতে হয়। এরাই ক্রমে বিবর্তিত হয় আল্ট্রা-হিউম্যানস-এ।


ওরিয়নের আবহাওয়া সম্পূর্ণ বাসোপযুক্ত নয়। সেখানে অতিমাত্রায় রয়েছে হিলিয়াম। অক্সিজেনের থেকে বেশিমাত্রায় রয়েছে ওজোন। মাটিতে আয়রন, লেড প্রভৃতি ধাতব উপাদান বেশী, তাই রুক্ষ উর্বর মরুভূমি সর্বত্র। ওরিয়নের নিজস্ব কোনো উপগ্রহ নেই। পৃথিবীর তুলনায় দেখতে গেলে, এই গ্রহে দিন হয় ১৮ ঘণ্টায়, সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ৪৫৩ দিনে। তাপমাত্রা একেবারে অনুকূল নয়। সবসময় স্থায়ী শীত। কিন্তু বসোবাসের জন্য এই গ্রহের বায়ুমণ্ডল অন্যান্যদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশী গ্রহণযোগ্য। তাই এখানেই আপাতত স্থায়ী বসতি গড়েছে মানুষ। কিন্তু এখানে স্থিতিলাভ করে বাঁচতে গেলে, প্রত্যেককে জন্মলগ্ন থেকে থাকতে হয় একটা বিশেষ তৈরি বাবল-এর মধ্যে। সেই স্বচ্ছ বুদ্বুদ তার ফিল্মের মাধ্যমে বাইরের আবহাওয়া থেকে বাতাস শুষে নিয়ে, সেইটা মানুষের শ্বাস নেওয়ার উপযুক্ত করে তোলে। তৈরি করে একটা অভ্যন্তরীণ বায়ুমণ্ডল যার মধ্যে কোনো বিশেষ স্পেস-স্যুট ছাড়াই বাঁচতে পারে মানুষটি। এক একটা বাবলকে বলা হয় পড। এই পড ছাড়া ওরিয়নে বেঁচে থাকা দুঃসাধ্যকর। পড জটিলভাবে যুক্ত থাকে মস্তিষ্কের সাথে। একবার এই বাবলে প্রবেশ করলে, কিছু নির্দিষ্ট 'পড নিয়ন্ত্রক কেন্দ্র' আর হাসপাতাল ছাড়া সেই বাবল থেকে বেরোনো যায়না। আংশিকভাবে খোলা গেলেও, কোনো পড থেকে কেউ পুরোপুরি মুক্ত হতে পারে না। পড আয়তনে বাড়ানো কমানো, তার অভ্যন্তরীণ আবহাওয়ার অদলবদল ঘটানো বা বিশুদ্ধকরণ করার উপায়ও এইসব নির্দিষ্ট কেন্দ্রেই সম্ভব।


ইভা ওরিয়নে বসবাস করা এমনই একজন আল্ট্রা-হিউম্যান। দুর্ভাগ্যবশত, একটা গবেষণা চলাকালীন, ওর পড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এইক্ষেত্রে, ইভার পড অক্সিজেন মাত্রা বজায় রাখার ক্ষমতা হারাতে শুরু করেছে ক্রমশ। ওরিয়নে এখনো সেই উন্নত প্রযুক্তি আসেনি যেটার সাহায্যে সম্পূর্ণ পড বদলানো যায়। অগত্যা, ডাক্তারেরা জানিয়ে রেখেছেন ইভার অনিবার্য পরিণতির কথা। এও বলেছেন যে নিজে থেকে যেদিন পড অক্সিজেন বানাতে সক্ষম হয়, সেইদিন এই রোগের নিরাময় সম্ভব। সেই দিন এখনও ওরিয়নে আসেনি।


ঘটনাস্থলে যখন ব্লাস্ট হয়, তখন ওর সহ-গবেষক ডোরিয়ানকে বাঁচাতে গিয়েই ইভার এই পরিণতি হয়। আর এই মুহুর্তেই কি না ডোরিয়ান ওকে কিছু না জানিয়ে চলে গেল! একের পর এক ওদের দুজনের আনন্দঘন মুহূর্তগুলো ভেসে উঠতে লাগলো ইভার চোখের সামনে। 


শুনেছিল প্রথমবার যখন ও নিজের মায়ের বাবল থেকে বেরিয়ে নিজস্ব পড পেয়েছিল, তখন সেই হাসপাতালেই গর্ভস্থ হয়েছিল ডোরিয়ানও। একই অঞ্চলে থাকতো ওরা, একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করে বেড়ে উঠেছিল, একই কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত হয়েছিল দুজনেই। 


ইভার সমস্ত গল্প, খেলা, দুরন্তপনার জায়গা ছিল ডোরিয়ানের ঘর। একদম ছোটবেলায়, দুজনে পডের সাহায্যে উড়ে বেড়াত আকাশে। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার অদম্য কৌতূহল নিবারণ না করতে পারার হেতুতে, কতই না বিপদসঙ্কুল জায়গায় পৌঁছে অভাবনীয় সব অভিজ্ঞতা হয়েছিল ওদের। একটু বড় হতে, জাগ্রত হয়েছিল বিপজ্জনক অথচ অভিনব পন্থায় বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট করার নেশা। স্বপ্ন বুনেছে ওরিয়নকে আরো বাসযোগ্য করে তোলার।


পড-মুক্ত ওরিয়ন ছিল ইভার স্বপ্ন। নিজের ঠাকুরদাদার মুখে শুনেছে, তাঁরা যে পৃথিবী ছেড়ে এসেছিলেন, সেখানে 'জল' গ্রহের সিংহভাগ দখল করে রাখতো। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের অভাব ছিল না। তাছাড়া, একধরনের বিশেষ প্রাণশক্তি, যাদেরকে 'গাছ' বলা হতো, তারা অক্সিজেন তৈরি করতে সমর্থ ছিল। নীলে সবুজে, নানান রঙের সমাহারে সেই গ্রহ ছিল রঙিন, শ্যামলা, সদা হাস্যজ্জ্বল। মানুষ মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াতো! আহা, এমন একদিন কি আসবে না ওরিয়নে, যেদিন কৃত্রিমভাবে জল তৈরি করার প্রয়োজন ফুরাবে? অন্যান্য বহু বৈজ্ঞানিকদের মতন ইভা আর ডোরিয়ানও সচেষ্ট ছিল উদ্ভিদের মতন কিছু তৈরি করতে। কিন্তু উন্নত আল্ট্রা-হিউম্যান হয়েও, আজ পর্যন্ত তারা এই সাফল্য পায়নি।


শয়নে-স্বপনে-জাগরণে নিজেদের পরিকল্পনা কার্যকরী করতে গিয়ে, কোনো এক সময়ে ডোরিয়ান আর ইভা অজান্তেই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। খুব ছোটবেলা থেকেই ওরা অবিচ্ছেদ্য ছিল, বুঝি আলাদা পড তবু একই মন। আলাদাভাবে কোনো অনুভূতি ইভা কোনোদিনও বুঝতে পারেনি, জানতো ডোরিয়ান ওরই সম্প্রসারিত অঙ্গ বিশেষ! ওকে ছাড়া যে শেষের দিনগুলো একা বাঁচতে হবে, এটা ছিল ইভার কল্পনার ঊর্ধে। 


তবুও, ধুকুপুকু করতে থাকা গভীর অন্তরে, ইভা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে ডোরিয়ানকে। মন বলে, যায়নি, কোথাও যায়নি সে। আছে আশেপাশেই, ফিরে আসবে নিশ্চয়ই। ইভা অপেক্ষা করতে থাকে হাসপাতালে ওর জন্য বরাদ্দ বিশাল ঘরটায়, যার তিনদিকের কাঁচের দেওয়ালের বাইরে রোজ একটু একটু করে ফিকে হয়ে আসে ওরিয়নের সূর্য। নিজের বিলম্বিত প্রতিচ্ছায়াকে দেখে কান্না উঠে আসে অকারণ। বড়ো পরিত্যক্ত মনে হয় আজকাল নিজেকে। যেমন খুব তাড়াতাড়ি পরিত্যক্ত হবে ওরিয়নও। হারিয়ে যাবে নিজের কক্ষপথে, যেদিন নিভে যাবে ওদের সৌরজগতের সূর্য। সেইদিন যে আর বেশী দেরী নেই, সেটা সম্প্রতি টের পেয়েছে গ্রহবাসিরা। ওরিয়ন পরিত্যক্ত হয়ে গেলে, ইভার স্বপ্নও তাৎপর্যবিহীন হয়ে যাবে। 


নিভন্তমুখী সূর্যের কারণেই আজকাল খুব শীতের আবহ চলছে। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া চোরাবালির মতন ডুবিয়ে দিতে চাইছে গ্রহবাসিদের, ওড়ার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে বেশ কিছুদিন যাবৎ। চারদিকে ব্যস্ততা বাড়ছে। গ্রহকে অথবা নিজেদেরকে বাঁচানোর চূড়ান্ত চিন্তাভাবনা চলছে চারদিক। আল্ট্রা-হিউম্যানেরা সম্ভবত বিকল্প ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে এতদিনে। শুধু ইভার রয়েছে অবশ্যম্ভাবী পরিসমাপ্তির অপেক্ষা। এমতবস্থায় ডোরিয়ানেরও ব্যস্ত থাকা স্বাভবিক, নিজের অবোধ মনকে প্রবোধ দেয় সে। ডুবন্ত জাহাজকে বাঁচানোর চেষ্টা করার থেকে তো চলন্ত জাহাজকে আগলে রাখার চেষ্টাই শ্রেয়। তবুও, এই অনন্ত শীতে চিরঘুমে যাওয়ার আগে যদি একবার, একবার দেখতে পেত নিজের প্রিয়তমকে... নিস্তব্ধ হাহাকার ওঠে অবুঝ মন মাঝে।


এমনই বিষন্ন একদিন হঠাৎ ঝনঝন করে কেঁপে ওঠে ইভার হাসপাতাল ঘরটা। দীর্ঘ অন্ধকার কাটিয়ে রৌদ্রকিরণ প্রবেশ করার মতনই খুলে যায় ওর ঘরের দরজা, দোরগোড়ায় দেখতে পায় ডোরিয়ানকে।


'তুমি এসেছ?' বাঁধভাঙ্গা আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছুটে যায় ইভা ওর প্রণয়ীর কাছে।


'আসতে তো আমাকে হতই প্রিয়া! আসব বলেই তো যেতে হয়েছিল '


'মানে?' বিভ্রান্তিতে পড়ে ইভা। হঠাৎ ভয় হয়, ডোরিয়ান নিজেকে না বাঁচিয়ে ওর সাথে নিজেকে নিঃশেষ করার সিদ্ধান্ত নেয়নি তো? বুক কেঁপে ওঠে, তবুও অপেক্ষা করে সবটুকু শোনার জন্য।


ডোরিয়ান নিজের পড থেকে একটা অদ্ভুত জিনিস বের করে। বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে দেখে ইভা এই অসম্ভব ব্যাপার। পড সম্পূর্ণভাবে দুর্ভেদ্য হয়। তবে এই অসাধ্য সাধন কিভাবে করলো মানুষটা? এর প্রক্রিয়ায় তো মনে হলো না ডোরিয়ানের কোনো ক্ষতি হলো। আর জিনিসটাই বা কি? বেগুনি রঙের একটা লম্বা নরম জিনিস, তার থেকেও নরম সবজে-হলদে রঙের দুটো সদ্য প্রস্ফুটিত পাখনার মতন জিনিস।


' এটা কি?' অবাক হয় ইভা।


বিনা বাক্যব্যয়ে ডোরিয়ান জিনিসটাকে ইভার পডের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেয়। আহ! অপার শান্তি, মনোমুগ্ধতা অশেষ প্লাবনধারার মতন ছুঁয়ে যায় ইভাকে। মন্ত্রমুগ্ধের মতন জিনিসটা হাতে নেয় ইভা। বহুদিন পর মনে হলো প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়ে পুনরুজ্জীবিত বোধ করলো।


'আমরা পেরেছি ইভা! আমাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি শেষ পর্যন্ত। কালজয়ী আবিষ্কার করেছি আমরা। শেষ পর্যন্ত 'গাছ' - এর মতন এই পদার্থটি বানাতে সক্ষম হয়েছি। ভাবতে পারছ এর পরিণাম কি হতে চলেছে?'


' সত্যি বলছো ডোরিয়ান?' উত্তেজনায় কেঁপে উঠে আঙ্গুল দিয়ে আলতো করে স্পর্শ করে ইভা ওই সবুজাভ জিনিসটা। 'এই সেই অমূল্য জিনিস?'


তারপরই একটু থমকে গিয়ে বলে


'কিন্তু সেদিন তো গবেষণাগারে বিস্ফোরণের পর আমাদের সব স্যাম্পল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তারপরেও কিভাবে সম্ভব হলো কাজটা সম্পন্ন করা?'


'বলতে পারো, কিছুটা ভুল করেই হয়েছে এই ভালো। সেদিন ডাক্তারের রায় শোনার পর আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছিলাম যে আমাদের পরিকল্পনা এবারে বাস্তবায়িত করতেই হবে। আজ ওরিয়নের যা অবস্থা, সেখানে এরকম আবিষ্কার হয়তো ভিত্তিহীন, কিন্তু... যাক, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। সেদিন তোমার চোখে চোখ রাখার বাতুলতা আমার ছিল না। ক্রমশ স্পন্দনহীন হয়ে আসতে থাকা তোমাকে দেখে উন্মাদ হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। তাই মুখোমুখি হয়ে তোমাকে আরো দুর্বল করে দিতে চাইনি ইভা। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গিয়েছিলাম গবেষণাগারে, কাজে লেগে পড়তে। দুই দিন দুই রাত্রি ধরে অবশিষ্ট থাকা মুষ্টিমেয় স্যাম্পল নিয়ে ফের লেগে পড়েছিলাম কাজে আমার নিজস্ব গবেষণাগারে। তৃতীয় দিন খেয়াল হলো, একটা অসম্ভব মূল্যবান রাসায়নিক পদার্থ নেই আমার কাছে। এই দুর্লভ জিনিস ছাড়া আর এগোনো সম্ভব নয়। হন্যে হয়ে ছুটে গিয়েছিলাম দুর্ঘটনাস্থলে, আগের গবেষণাগারে। গিয়ে কি দেখলাম জানো? বসন্ত এসেছিলো আমাদের ল্যাবরেটরিতে! বিস্ফোরণের অতিরিক্ত তাপমাত্রায় আমাদের কর্মস্থলের একপাশে ফাটল ধরেছে। আর ঠিক তার মধ্যে এক কোণায়, মাথা তুলে উঠেছে একটা চারাগাছ! তোমায় বলে বোঝানোর প্রয়োজন নেই যে কতটা আপ্লুত হয়েছিলাম আমি!' এতটা বলে থামল ডোরিয়ান।


'কি বলছ? গাছ সৃষ্ট হয়েছে খোদ ওরিয়নে? গ্রহের নিজস্ব খোলামেলা পরিবেশে? তার মানে তো আমাদের পড মুক্ত হওয়ার দিন এসে গেছে'


'হ্যাঁ, কৃত্রিমভাবে নয় প্রাকৃতিকভাবেই। কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছ কি চূড়ান্ত তাপমাত্রায় এর সৃষ্টি হয়েছিল। আমি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে আবার চেষ্টা করে সক্ষম হয়েছি এদের তৈরি করার। কিন্তু সত্যিকারের পরিস্থিতে এদের তৈরি করে সাধারণ ওরিয়নবাসীদের কাছে সহজলভ্য করা একদমই সহজসাধ্য নয়। বিশেষত, যখন এরা স্বল্পায়ুর'


' ঠিক কতটা? ' জিজ্ঞাসা করে ইভা।


'আমার হিসেব অনুসারে ওরিয়নের একমাস। তারপরেই নিজে থেকে নষ্ট হয়ে যাবে এরা'


কিছুক্ষন চুপ করে থাকে দুজনেই। এর পরিণাম ওরা জানে। দীর্ঘমেয়াদি নয়, অস্থায়ী নমুনা তৈরি হয়েছে মাত্র। তারপর ঘোর ভাঙার মতন ডোরিয়ান বলে' কিন্তু আমাদের জন্য এটাই যথেষ্ট!'


'কি রকম? আর তো বেশিদিন নেই ওরিয়নের। আর এখন এই ক্ষণস্থায়ী উদ্ভিদের নমুনা দিয়ে কি লাভ?' ইতস্তত বলে ইভা। 'তুমি আর সময় নষ্ট করো না এর জন্যে, স্থায়ী ঠিকানার উদ্যেশ্যে বেরিয়ে পড়ো'


ডোরিয়ান এগিয়ে আসে ওর কাছে। চোখ দুটো গভীর, নীরবতার মধ্যেও বলতে চায় হাজারো কথা। নিজের উচ্ছ্বাস ভাষায় কোনোদিনও প্রকাশ করতে পারেনি, কিন্তু নিজের চাহনি দিয়েই অনুভূতির বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে ভাসিয়ে দিতে পারে ইভাকে অবলীলায়। আজ সেই চোখদুটো এক আনন্দের আলোয় জ্বলছে। ইভা আন্দাজ করতে পারে, ডোরিয়ানের এই শেষমুহূর্তের কাজের পেছনে কোনো সদ্ভাবনা আছে, সে নিছক জেদের বশে স্বপ্নপূরণের পেছনে দৌড়ায় না।


ঊষ্ণ আলিঙ্গনে প্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরে ডোরিয়ান, ওদের পড স্পর্শ করে একে ওপরকে।


'তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না ইভা, তাইতো বলতে এসেছি'


'অযৌক্তিক কথাবার্তা বলো না ডোরিয়ান। তুমি তো জানো, আমার এই পড আমাকে এই হাসপাতালের গণ্ডির বাইরে টিকতে দেবে না একমুহুর্তও। আমি তো দূরের কোনো যাত্রা করতেই পারবো না, সে যত উন্নতমানের মহাকাশযানই হোক না কেন। এই অবস্থায় বেরোনো মানে স্পেস সুট ছাড়া মহাশূন্যে বেরোনোর সমান!'


তবুও মিটিমিটি হাসে সামনের মানুষটা। কেন যে এত রহস্যময় মনে হয় ওকে মাঝেমাঝে, ভেবে কূল পায়না ইভা। খুব আস্তে আস্তে ডোরিয়ান অবশেষে বলে

'তোমার কি মনে হয়, উপায় না বের করেই আমি তোমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি? শুধু ল্যাবরেটরিতে বদ্ধ ছিলাম না এতগুলো দিন'


'তাহলে?' বড়ো বড়ো চোখ করে তাকায় ইভা।


'এক চমৎকার গ্রহ খুঁজে পেয়েছি আমরা। সেখানে একবার পৌঁছতে পারলে, আমরা ওরিয়নের থেকে উন্নত পরিবেশ পাবো' উৎফুল্ল শোনায় ডোরিয়ানকে।


'এ তো দারুন ব্যাপার'


'হ্যাঁ। আর সেখানে গেলে আমরা দুজনে একসাথে যাবো, নাহলে কেউই নয়'


'এটা হয় না। আমাকে আমার গ্রহেই শেষ কয়েকটা দিন থাকতে দাও, শান্তিতে থাকি যে তুমি সফলভাবে নতুন বসতিস্থানে পৌঁছে নতুন জীবন শুরু করেছ। তোমার মধ্যে দিয়েই বাঁচবো আমি, আর তোমার সৃষ্ট এই গাছটার মধ্যে দিয়ে আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত খুঁজে নেবো তার স্রষ্টাকে'


'তার প্রয়োজন হবে না' হাসে ডোরিয়ান। 'তুমি সত্যিই এখনো বুঝতে পারনি, কেনো আমি এই উপহার নিয়ে তোমার কাছে এলাম? এই গাছ তোমাকে রক্ষা করবে যাত্রার সময়টুকু। এটা একধরনের উন্নত উদ্ভিদ, যে শুধু অক্সিজেন তৈরি করে তাই নয়, এর উপস্থিতি মানুষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারে পড ছাড়া। কিন্তু যেহেতু আমরা এই মুহূর্তে অনেক গাছেদের দিয়ে গ্রহের বায়ুমণ্ডল পরিবর্তন করতে পারছি না, তাই সেইটুকু উপাদানই তোমার কাছে এনে দিলাম যতটা আমাদের প্রয়োজন। এই উদ্ভিদ তোমার সাথে থাকলে, মহাকাশে যাত্রা করতে পারবে তুমি অনায়াসেই'


হাজারো আলো জ্বলে ওঠে ইভার চোখে। জানত, ও তো মনের গহীন অন্তরে ঠিক জানত, ওর ভালোবাসার মানুষটা ওকে ছেড়ে দেবে না কখনোই, হারতে দেবে না কাউকেই। এই ধূসর শীতাতুর মরুভূমির মতন রুক্ষ গ্রহে একা হারিয়ে যেতে দেবে না ওকে কিছুতেই।


*********************************


মহাকাশযান থেকে একটা নতুন গ্রহে নামলো একদল ওরিয়নবাসি আল্ট্রা-হিউম্যানস। সবার শেষে, ইভা নামলো ডোরিয়ানের হাত ধরে। এ যে এক অভূতপূর্ব জগৎ! চারিদিকে বিস্তৃত সবুজ অরণ্যে চোখ জুড়িয়ে যায়। পর্বতশৃঙ্গ থেকে চোখে পড়ে, নীল অনন্ত সমুদ্র। এখানে আকাশ গেরুয়া নয়, গাঢ় নীল। এখানে ভূমি শুষ্ক রুক্ষ ঊর্বর নয়, নরম। ইভার পডের উদ্ভিদটি মনে হলো, এই গ্রহেরই ক্ষুদ্র অংশ। 


খুব ধীরে, কিছুটা সংকোচের সাথে ইভা নিজের পড খুলে বেরিয়ে এলো। বাধা দিতে গিয়েও, থেমে গেল ডোরিয়ান। নিজেও বেরোলো নিজের পড থেকে। এই তো তাদের আদি গ্রহ, এখান থেকেই তো ওদের উৎস হয়েছিল এক কালে। ওরিয়নের তুলনায়, এখানে বিরাজ করে চিরবসন্ত।


এই তো সেই নীল পৃথিবী, যেটা বহুকাল আগে ধ্বংসের মুখে পড়েছিল। সময়ের সাথে, অবিশ্বাস্যভাবে এই প্রায় নিষ্প্রাণ গ্রহ ক্রমে নিজেকে বাঁচিয়ে তুলেছে। বায়ুমণ্ডল বাস করার অনুকূল হয়ে উঠেছে আবারও। 


উন্মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নিলো ইভা। আলিঙ্গন করলো ডোরিয়ানকে ওদের জীবনের নব-বসন্তের সূত্রপাতে। ওদের দেখাদেখি এবার পড ছেড়ে বেরোতে লাগলো অন্যান্যরাও। হাতে হাত রেখে, নতুন সুস্থ হয়ে ওঠা নীল পৃথিবীর বুকে নতুন বসতি, নতুন স্বপ্নরাজ্য গড়ে তুলতে এগিয়ে চলল ইভা-ডোরিয়ান।


সমাপ্ত।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance