Jayita Sarkar

Tragedy Classics Inspirational

4.5  

Jayita Sarkar

Tragedy Classics Inspirational

ম্যারাথন

ম্যারাথন

5 mins
421



হাতে একখানা স্টিলের টিফিন বক্স। ধুলো মাখা স্কুল ইউনিফর্ম, জুতোর বালাই নেই, ছুটতে ছুটতে রাস্তার পাশে বড় বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল নিশান। গেট খুলে সটান ভেতরে ঢুকতে যেতেই, আরে আরে করতাসজ কী? ঘর মুছতেসি, দ্যাখোস না নাকি? চেঁচিয়ে উঠল মা। নিশানের মা নমিতা, এই বড় বাড়িতে মাসমাহিনের মাসি। মায়ের সঙ্গে মিলিয়েই এই বাড়ির গিন্নিই ওর নামটা রেখেছিলেন নিশান। না হলে এই পোড়া মাথায় এতো আধুনিক নাম আসে নাকি? গিন্নির কথাতেই নিশানকে রেল লাইনের ওপারের বাড়ির পাশের প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করিয়েছে নমিতা। 


নিশান এখন সাত বছরের। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে সে। পড়াশুনোতে যে খুব মনোযোগী সেটা বলা যাবে না। স্কুলে গিয়ে শেষ সারিতেই বসে, মিড মিল এর অপেক্ষা ফুরোলেই ফুরুত হয় স্কুল থেকে। তারপর এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়ায়। কখনও রেল লাইন এর ধার ধরে দৌড়ে বেড়ায়, কখনও রেলের খেলার মাঠের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। মা সন্ধ্যেতে বাড়ি ফিরে চিল চিৎকার করে ঘরে ফেরায় তাকে। এতো ছুটিস কেন রে তুই? তোরে আমি কোন লাগামে আটকামু, এই মুর্খ মাথায় আসে না। এক সেকন্ডে জবাব, 'আমারে তুমি আটকাইতে পারবা না, আমি দৌড়ে সেরা হমু।'


আজ স্কুলে স্পোর্টস ডে। তাতেই 200মিটার দৌঁড়ে অংশ নিয়েছিল সে। প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হয়েছে নিশান। পুরষ্কার হিসেবে একটা স্টিলের দু থাকের টিফিন বক্স। আর সেটা হাতে নিয়েই আবার ছুটেছে সে। 'দেখস কইছিলাম না, আমি দৌঁড়ে সেরা হমু, হইছি। তাই তোমারে কইতে আইলাম।' নিশানের গলা পেয়েই বেডরুম থেকে বেড়িয়ে এলেন গিন্নি। কী রে নিশান শুধু মা কে বলেই পালিয়ে যাচ্ছিস? একটু লজ্জায় জিভ কেটেই ঠকাস করে প্রণাম করল বাড়ির কর্ত্রীকে।সহবত ভালোই শিখেছে সে। ফ্রিজ থেকে একটা মিষ্টি বের করে পুড়ে দিল নিশানের মুখে।'আরও পুরষ্কার আনতে হবে রে তোকে', বললেন নিশান এর বড়বাড়ির জেঠিমা। 


নমিতা পাঁচবাড়িতে মাস মাহিনার কাজ করে। নিজের পরিশ্রম দিয়েই নিশানকে বড় করছে সে। নিশান এখন একটু দূরের হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছে। বড় হলেও দৌঁড়ের অভ্যেস যায়নি উল্টে বেড়ে গিয়েছে। এখন ভোরবেলা উঠে প্রায় 5কিমি দৌড়য় সে। কী জানি কী লক্ষ্য তার? নিয়ম করে বড় বাড়ির জেঠিমার কথা মতো প্রতিবার স্কুলের দৌঁড়ের প্রথম পুরষ্কার রয়েছে তার ঝুলিতে। কিন্তু তার জন্য এতো দৌঁড়ের কী প্রয়োজন? নমিতা জিজ্ঞেস করলে এখন আর কোন উত্তর দেয় না সে। চুপ করে থাকে। 


নিশানের স্বপ্ন শহরে প্রতিবার মহালয়ার দিন যে ম্যারাথন হয় সেখানে অংশ নেবে। সেখানে প্রথম হয়ে আরও বড় লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাবে সে। তাই রোজ একটু একটু করে নিজেকে তৈরি করছে। পুজো আসতে এখনও বেশ কয়েকমাস বাকি। হাতে কয়েকমাস থাকলেও প্রাকটিস এর কোনো খামতি নেই নিশানের। 


বর্ষা পেড়িয়ে নীলাকাশ, আকাশে সাদা পেঁজা মেঘের আনাগোনা। কাশফুল, শিউলির গন্ধমাখা ভোরে আগমনীর সুর। প্রাকটিস এর কারণে শরতের সকালগুলোকে আরও ভাল করে অনুভব করে নিশান। বাতাসে হিমেল হাওয়া থাকলেও ঘাম ঝরছে তার শরীরে। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পা ছুটছে। কড়া পরিশ্রমের মধ্যে নিজেকে বেঁধেছে সে। এখন সকালের পাশাপাশি বিকেলেও নিয়ম করে দৌড়চ্ছে নিশান। 


যত পরিশ্রম তত বাড়ছে খিদে, বয়সেও তো বেড়েছে সে। নমিতার প্রাণ ওষ্ঠাগত, এতো খিদে মেটাবে কী করে? ওই তো গুনতি টাকা। তা দিয়েই বাড়ি ভাড়া, স্কুলের মাইনে, খাওয়া পড়া সব মিলিয়ে সামলে উঠতে পারছে না। এর মধ্যে নিশান বায়না জুরেছে দৌড়তে গেলে জুতো চাই। 'অত দামি জুতা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই বাপু। তরে দৌড়াইতে হবে না' স্পষ্ট জানিয়ে দিল,নমিতা। 'ও মা, ও মা পুজার সময় তো সব বাড়ি থেকে তোমারে বকশিস দেয়, ওটা দিয়া একজোড়া জুতা কিনে দিবা?' ' যা টাকা দেবে তা দিয়ে একটা ধার শোধ করার আছে, ওসব বায়না ছাড়, লেখাপড়াটা একটু মন দিয়া কর দেখি। ' 


কে শোনে কার কথা? নিশান সকাল সন্ধ্যে দৌঁড়ে চলেছে। আর কত দৌড়াবি রে পোলা? এই দৌঁড় থামব না, পাশের বাড়ির জ্যাঠারে উত্তর দিল নিশান। 'আচ্ছা তবে এইবার প্রাইজ আইন্যা আমাদের বস্তির নামখান কাগজে উঠা দেখি।' হবে হবে, আসুক মহালয়া। আর মাত্র দুদিন বাকি, জুতো কেনা হয়নি, বস্তির এক চিলতে ঘরে চুপ করে বসে আছে নিশান। আর দৌঁড়তে যাওয়া হবে না তার। নাম এন্ট্রির সময় মা কে না জানিয়েই বড়বাড়ির জেঠিমার থেকে টাকা নিয়েছিল সে। এখন জেঠিমার কাছেও আর চাইতে পারবে না। 


নমিতা ফিরল কাজ থেকে। 'কিরে কি হইল ? যাইস নাই দৌড়াইতে?' মায়ের মুখের ওপরে কোনদিন কথা বলেনি নিশান। কিন্তু নিজের ইচ্ছে পূরণ না হওয়াতেই মায়ের ওপর রেগে গেল। 'কেন যামু আমি? দৌঁড়তে যামু না, জুতা নাই আমার,' বলেই অঝোরে জল তার চোখে। কাছে টেনে নিল নমিতা। এক চিলতে ঘরে মা ছেলের এক জীবন লড়াইয়ের ভালবাসা। 'দেখ আজ বকশিস পাইছি, যা তোর কী লাগব নিয়ে আয়।' কিন্তু ধার শোধ হবে কী করে? ও হবে খন। ছেলের মুখে হাসি দেখে মায়ের শান্তি। 


এলো মহালয়ার সকাল, মা এলো ঘরে, নিশান গেল তার প্রথম ম্যারাথন এর স্টার্টিং পয়েন্টে। নমিতা আজ কাজে যায়নি। ছেলের পথ চেয়ে ঠায় বসে আছে চালহীন বারান্দাটায়। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে নামল, ছেলের আর দেখা নেই। দিশেহারা নমিতা ছুটল বড়গিন্নির কাছে। কিরে নমিতা, নিশানকে নিয়ে আসিস নি? ' কেমনে আনমু ওরে, সেই যে ভোরবেলা গেল, ছেলে এহনো ঘরে ফেরে নাই গিন্নি মা।' সে কী কথা? দাঁড়া তোর দাদাবাবুকে বলছি খোঁজ করতে। এদিক ওদিক ফোন করেও কোনো হদিশ মিলল না। 


পুলিশের কাছে যেতে নারাজ নমিতা। ওই এক চিলতে ঘরে বসে নিজের মনেই বলে চলেছে, বাপটাও এমনি করে উধাও হইল, ব্যাটাও তাই। দুদিন কেটে গেল, কোনো খবর নেই, ম্যারাথন আয়োজনকারী ক্লাবের সঙ্গে যোগযোগ করে বড়গিন্নি জানালো সেদিনের প্রতিযোগিতায় নিশান জেতেনি। তবে কী সেই কারণেই বাড়ি ফিরল না? কোথায় পালালি রে নিশান? ? ? চিৎকার করে কেঁদে উঠল নমিতা। 


বছর পেড়িয়ে গেলেও কোনদিন কোনো ফোন আসেনি নিশানের। নমিতা বড়গিন্নিরে বলে, 'আমারে না করুক আপনারে তো একটা খবর দিতে পারে, ছেলেটা আমার বাইচা আছে নাকি কে জানে?' বড়গিন্নি আশা দেখায়, একদিন তোর নিশান ঠিক আসবে। দেখবি ম্যারাথন জিতেই বাড়ি ফিরবে সে। 


একি হঠাৎ কী হইল দেশে? দোকানের ঝাঁপ বন্ধ, রাস্তায় মানুষজন নেই। সকলে ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছে। গিন্নিমা অগ্রিম টাকা দিয়ে জানিয়ে দিলেন, 'কাল থেকে ঘরেই থাকবি, কাজে আসবি না।' হ্যা শুনসি আমি, দেশে একটা জীবাণু আইছে। এই দুর্দিনে নিশানটা যে কই আছে? ? মায়ের মন...


ঘরেই আছে নমিতা, গিন্নির আদেশ মতো তেমন বের হয়না। যদিও জল আনতে রাস্তার কলে লাইনে দাঁড়াতে হয় তাকে। এভাবেই একা শূন্য ঘরে কর্মহীন জীবন কাটছে নমিতার। হঠাৎই জীর্ণ ঘরে কড়া নাড়ছে কেউ। ক্যাডা রে এতো রাতে? ? দরজা খুলতেই চারিদিক আরও স্তব্ধ হয়ে গেল। মা আমি পারছি, ম্যারাথন জিতেই তোমার কাছে আইলাম। ' তুই জিতেছিস ? ? প্রাইজ কোথায়?' চোখ নিচু হয়ে যায় নিশানের। রাস্তার হালকা আলোতে ছেলের পায়ের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল নমিতা। ছেঁড়া চটি, দু পায়ে ফোঁসকা, ক্লান্ত শরীর। আর বুঝতে বাকি রইল না কিছু। নিশান আজ জীবনের দীর্ঘ ম্যারাথন জিতে ঘরে ফিরেছে। মায়ের ঋণ পরিশোধের জন্য সেদিন হেরে পালিয়ে গিয়েছিল বড় শহরে। কাজ মিলেছিল এক কারখানায়। কিন্তু কারখানার কাজ বন্ধ। তাই সামান্য জমানো টাকা মায়ের হাতে তুলে দিতেই শত শত মাইল পথ পাড়ি দিয়েছে নিশান। সত্যি জীবনের সব থেকে বড় ম্যারাথনে বিজয়ী সে। মাকে জড়িয়ে ধরে নিশান চিৎকার করে বলে উঠল , ' আমি প্রাইজ আনছি মা, আমি প্রাইজ আনছি।


 





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy