Jayita Sarkar

Romance

3.4  

Jayita Sarkar

Romance

শরতের ভালবাসায় (শরৎ কাল )

শরতের ভালবাসায় (শরৎ কাল )

4 mins
1.0K


ফল মিষ্টিতে সাজানো কাঁসার থালাটি হাতে তুলে দিতে গিয়েই চমকে উঠল নির্বাণ। চোখ আর মনের মাঝে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের ঝিলিক বয়ে গেল নিমিষেই। অচেনা চরিত্রটি হঠাৎই চেনা সারির মুখগুলোর মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিয়ে উঠল। 


সকালে আধভাঙ্গা ঘুম চোখে বাইরের দিকে তাকাতেই চিৎকার করে উঠল নিবু,' চা বাগান, আমি পাতা তুলব মামনি।' ট্রেনের গতির সঙ্গে ক্রমে সরে যাওয়া সবুজ গালিচা দেখে নিবুর প্রথম অভিব্যক্তি। নিবু উত্তর কলকাতার ব্যানার্জী বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। বনেদি পরিবারের আবর্তে থাকা নিবুর প্রথম চোদ্দ বছর কেটেছে বনেদিয়ানার চৌহদ্দিতে। স্কুল, ক্রিকেট কোচিং এর আধুনিকতার সঙ্গে পারিবারিক রীতিনীতি, এই নিয়ম বাঁধা জীবনে এবার একটু অন্য বাতাস। 


নিবু মানে নির্বাণ ব্যানার্জী আর তার মামনি, এই বাড়ির সেজ বৌ রূপকথা বনেদি বাড়ির লাগামহীন দুই অসমবয়সী সঙ্গী। সম্পর্কে নিবুর সেজ জেঠি, কিন্তু আদুরে ডাক মামনি। ছোট থেকেই মামনির পায়ে পায়ে ঘরে নিবু, মায়ের থেকেও মামনি তার সময় অসময়ের সঙ্গী। নিবুর মামনি উত্তরবঙ্গের মেয়ে, জলপাইগুড়ি জেলার এক চা বাগানে তার বড় হয়ে ওঠা। তাই মামনির কাছে এই কলকাতা শহরের বাইরের পৃথিবীর গল্প শোনা নিবুর রোজকার রুটিন। প্রতিবারই পুজোর পর মামনি আর তার ছড়দিভাই জলপাইগুড়ি যায়। এবার নাছোড়বান্দা নিবুও এসেছে ওদের সঙ্গে। 


ট্রেন এন জে পি স্টেশনে ঢোকার আগেই ছোট ছোট জমিতে চা বাগান করেছে অনেকেই, ঘুম ভাঙ্গা চোখে প্রথম চা বাগান দেখেই ট্রেন থেকে নেমে পড়ার উপক্রম নিবুর। ছড়দিভাই ওমনি বকা দিয়ে বলল,' তোর বুদ্ধি কবে হবে রে নিবু? আমরা তো এই দশদিন চা বাগানেই থাকব,এরকম হ্যাংলাম করছিস কেন?' ' আমি তো আর তোর মত প্রতিবছর এখানে আসিনি, তাই এরকম করছি,' হালকা ঝগড়ার মুডে দুজনেই। এরমধ্যেই ট্রেন ঢুকল এন জে পি স্টেশনে। ট্রেন থেকে নেমেই দাদুর পাঠান গাড়িতে সোজা বড়দিঘি চা বাগান। 


 শিলিগুড়ি সেবক হয়েই ওরা বড়দিঘির রাস্তা ধরল। শহর ছাড়িয়ে সবুজ ঘেরা জঙ্গলের মাঝে গাড়ি ছুটছে দ্রুত গতিতে। সমতল ছাড়িয়ে পাহাড়ি পথের প্রথম বাঁকেই সবুজে মোড়া পাহাড় আর পান্না সবুজ তিস্তাকে ভালোবেসে ফেলল নিবু। পুজো শেষে শরত বিদায়ের প্রাক্কালে হিমেল বাতাসে মিশে থাকা উৎসবের গন্ধ আর তিস্তাপাড়ের কাশ বনে নিজেকে একাত্ম করা এক কিশোর আজ প্রকৃতি প্রেমে আপ্লুত। 


শরতটা বড্ড প্রিয় নিবুর। শরতের ঢাকের বোল আর দালানে ঠাকুর বানানোর ব্যস্ততায় বই খাতার ছুটি দিয়ে নিবু দৌঁড়ে বেড়ায় এদিক ওদিক। এই ঠাকুর দালান থেকে চিলে কোঠার ঘরে বসে আনমনে কবে যেন অনেকগুলো শরত পেড়িয়ে মামনির নিবু এখন এক ব্যক্তি হয়ে উঠেছে। পড়াশুনো শেষ করে, এখন সে রীতিমত দায়িত্ববান এক মানুষ। বাড়ির পুজোর সব দায়িত্ব এখন তার কাঁধে চাপিয়ে বাবা জেঠুরা অবসরের তালিকায় নাম তুলেছে। ঠাকুর দালানে কাল থেকেই শুরু হবে প্রতিমা তৈরির কাজ। পালপাড়ার এক বাঁধা কারিগর আছে তাদের, তিনিও এসে পড়েছেন ইতিমধ্যেই। 


বাড়ির উঠোনের মাঝে শিউলির আলপনার গন্ধে মেতে উঠেছে গোটা বাড়িটা। সকালের শিশিরে পা ছোঁয়াতেই মনটা কেমন সিক্ত হলো। কই আজ তো সে আর এলো না? গেট পেড়িয়ে সামনের সবুজ বাগানের দিকে তাকাতেই, ওই তো আসছে, আজ একটু দেরি হতেই মন কেমন করে উঠেছিল নিবুর। আর তো মাত্র কটা দিন, তারপরই তো ছুটি শেষ, ফিরে যেতে হবে সেই গণ্ডি জীবনে, এই লুকোচুরি খেলা, বাগানের মাঝে চুপটি করে বসে থেকে অন্যকে চটিয়ে দেওয়া এগুলো খুব মিস করবে নিবু। তাই তো আজ একটু দেরি হওয়াতেই নিবুর মন খারাপ হলো। 'এতো দেরি করলি কেন? আমরা শিউলি ফুল কুড়বো না?' মায়ের শরীরটা ভাল নেই, রাতে ঘুম হয়নি, তাই তো আসতে দেরি হলো,' তুই রাগ করিস নি তো নিবু, ' বলে উঠল রিজি। 


রিজি, নিবুর ফ্রেন্ডলিস্ট এর নতুন মেম্বর। রিজি বরাইক, বড়দিঘি টি এস্টেট এর ম্যানেজার বাংলোর মালির মেয়ে। বাবার সঙ্গে রিজিও আসে কাজে, ছোটখাটো ফাই ফরমাস খাটে, প্রথমবার বাগানে এসেই রিজি এর সঙ্গে ভাব হয়ে যায় নিবুর। মামনি বা দাদু কেউই মিশতে বাঁধা দেয়নি নিবুকে। রিজি বাগানের স্কুলে পড়াশুনোও করে। নিবুকে সে বাগানের ভেতরে নিয়ে যায়, ঘুরিয়ে দেখায় এদিক ওদিক। হাতির হানায় তাদের ঘর ভেঙ্গে যাওয়ার গল্প শোনায়। শরত আকাশে সাদা মেঘের ভেলায় ভাসে বাগানের সবুজ গালিচা আর শহরের বনেদিয়ানা। আভিজাত্য আর সামান্য দিনযাপনের অন্য ভালবাসার চুক্তি হলো তিস্তাপাড়ের সঙ্গে গঙ্গাপাড়ের। 


তিস্তা পেড়িয়ে গঙ্গায় ভাসতেই গড়িয়ে গেল কতগুলো বছর। রিজি মাখা শরতের শিউলি এখন অন্য সন্ধ্যের গন্ধ মেখে ভেসে বেড়ায় ঘিঞ্জি কোন গলি পথে। সেই আলো আঁধারি চোরা গলি বেয়ে ব্যানার্জী বাড়ির দায়িত্ববান কনিষ্ঠ ছেলেটি চলে এলো গঙ্গার স্রোতের মাঝে তিস্তার উজানে। হাতে কাঁসার থালা আর ফল-মিষ্টির বদলে এক মুঠো মাটি নেবে বলে। হাত পেতে থালা নেওয়ার সামান্য স্পর্শ, আর সেই বাগানে নরম হাতের ছোঁয়ায় একটি কুঁড়ি আর দুটি পাতার অনুভূতি যেন মিলে গেল। 


রিজি, একটাই শব্দ নির্বাণের, মুহূর্ত চুপ, যেন শরতের নির্মল আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এলো, শিউলির গন্ধ হঠাৎ কেমন আঁশটে লাগল নাকে। মনের মাঝে তোলপাড় করা কালবৈশাখী। এক নিমিষে প্রথম ট্রেন, সবুজ চা বাগান, লুকোচুরি, সরলতায় মোড়া এক রিজির গল্পে ওলট পালট হয়ে গেল সবটা। ঠিকানা বদল করেছিলি, জানাতে পারতিস, এই শহরে এসে আমার ঠিকানায় প্রথম আশ্রয় হতে পারত তোর, এই গলি আর নামঠিকানা হীন জীবনটা কেন বেছে নিলি তুই? কোন উত্তর এলো না দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা উগ্র সাজের মঞ্জিরার থেকে। 'আমার যে অনেক প্রশ্ন রিজি তোর কাছে, হঠাৎ চিঠি দেওয়া বন্ধ, বাগান থেকে একদিন হারিয়ে গেলি, আমি তোর খোঁজে ছুটে গিয়েছিলাম সেই বাগানের ছোট ঘরে। শূন্য হাতে ফিরে এলাম, তুই কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি?' 


অতীতকে সামনে দেখে এক লহমায় ছিন্ন হলো সমস্ত আভিজাত্য। নিজের পরিচয় ভুলে পুরনো ভালবাসা মাখা এক বন্ধুত্ব এর কাছে হাত বাড়িয়ে দিল নির্বাণ ব্যানার্জী। 'আমি আর রিজি নই, এখানে আমি মঞ্জিরা, বাগানের সবুজ এখন ধূসর হয়েছে, সব হারিয়ে আমি এখন এই বড় শহরে চাকরি করি, এখুনি আমার ক্লায়েন্ট আসবে,' শুহুরে আধুনিকতার ভঙ্গিমাতে নিজেকে ব্যক্ত করল রিজি। কিন্তু এই পরিবর্তনের ইতিবৃত্ত চেপে রেখে, কাঁসার থালাটা নির্বাণ এর হাত থেকে টেনে নিয়ে, নতুন এক থালায় মূর্তি তৈরির মাটি দিতেই, দরজা বন্ধ। বন্ধ দরজার এপাড়ে আর ওপারে গঙ্গা তিস্তায় নিস্তব্ধতায় মোড়া এক ভাঁটার টান। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance