মুক্তির স্বাদ
মুক্তির স্বাদ
আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগের কথা।
তখন আমি মেদিনীপুর জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামের অখ্যাত এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দিদিমণি হিসেবে সদ্য যোগ দিয়েছি। জীবনের প্রথম চাকরি। স্বভাবতই মনে অনেক আশা আর চোখে একরাশ রঙিন স্বপ্ন। সেই সাথে কিছু করে দেখানোর অদম্য প্রত্যয়।
কিন্তু হলে হবে কি। জন্মাবধি শহরের সুখী জীবনে চশমা এঁটে বইয়ে মুখ গুজে গুবরে পোকার মত বেড়ে ওঠা দিদিমনিটি আসলে জীবনের অঙ্কে যে বড্ড কাঁচা তা প্রমাণ হল কিছুদিনের মধ্যেই। ছাত্ররা বিদ্যালয়ে আছেন বটে, তবে শুধু ঐ নাম ডাকার খাতায় । ঠিক যেমনটি আমাদের দেশে নদী -নালা ,গাছপালা বেঁচে থাকে মানচিত্রের নীল সবুজ রঙে। বুঝলাম, গাঁয়ের বেশিরভাগ মানুষের রোজ যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় সেখানে লেখাপড়া করা বিলাসিতা বৈকি। তবে সহকর্মীদের এব্যপারে কারুরই কোনো মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হল না। তারা প্রায় সকলেই ' আসি ,যাই, মাইনা পাই ' নীতিতে বিশ্বাসী।
চাকরিতে প্রথম মাস ফুরোলে সাকুল্যে পাঁচটি ক্লাস করে কড়কড়ে টাকাগুলো হাতে নিতে বেশ কষ্টই হচ্ছিল আমার। কিন্তু না নেবার মত মহানুভবতা দেখানোর জায়গাতেও ছিলাম না আমি। বাড়িতে বয়স্ক মা বাবাকে দেখাশোনা, সংসার চালানোর জন্য ওই টাকা কটা সত্যিই দরকার ছিল।
শেষমেশ পড়ুয়াদের জোগাড় করতে অনেক ভেবে একটা উপায় ঠাউরেছিলাম। ঠিক করেছিলাম সময় করে একে একে সকলের বাড়ি যাবো। নিজে গিয়ে একবার দেখবো, কেন তারা আসে না স্কুলে।
তেমনি এক ছাত্রের বাড়িতে গেছিলাম ,শনিবারের এক দুপুরে। ছাত্রটির নাম মনে আছে এখনো, মিহির আলি। বাড়ি না বলে বড় গোছের একখানা চালাঘর বলাই ভালো। দেখলাম বাড়ির দাওয়ায় এক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা এক মনে পট আঁকছেন। আসলে এই গ্রামটাই এক আজব গ্রাম। এখানে ঘরে ঘরে বাস করেন এমনই কিছু রঙিন মানুষ।তাদের কলজে ভরা গান আর তারা তুলিতে মেশান প্রাণ। তারা যখন কথা বলেন ছবিতে, তখন এক আকাশ রামধনু নেমে আসে মাটিতে। চোখে লেগে থাকে সুরের সুরমা। পেশায় তারা চিত্রকর কিন্তু আদতে জাদুকর।তারা তুলির টানে হারিয়ে যাওয়া মাটির গল্প বলেন ।তাতে লেগে থাকে তেঁতুল বিঁচি আর বেলের আঠার গন্ধ। তাঁদের ছবিতে পুরানের দেব-দেবীরা হয়ে ওঠেন ঘরের মানুষ, প্রাণের দোসর।এ গ্রামের বাঁকে বাঁকে চলতে চলতে চোখে পড়ে এমনি নানা চিত্র গাঁথা। মাটির ঘরগুলো যেনো কোনো নাম না জানা শিল্পীর আর্ট গ্যালারি। আমি তেমনি এক ঘরের আঙিনায় দাঁড়িয়ে ওই দুই পটুয়া দম্পতিকে দিদিমনি হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম - " আচ্ছা, মিহির কোথায় বলতে পারেন?"
- "ঘরে আছে। ডাকতেছি।" বলে ভদ্রমহিলা ডাক পারতেই আমার ছাত্রটি গুটিগুটি পায়ে এসে হাজির হল। কতই বা বয়স হবে তার । এই নয় কি দশ । ততক্ষনে তার মা মানে সেই চিত্রকর ভদ্রমহিলা এসে বিছিয়ে দিলেন মাদুর। আমি তাতে বসে শুধোলাম - "স্কুলে আসো না কেন?" ছাত্র আমার ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে রইল। ছাত্রের মা বলল পাশ থেকে -" ও ইস্কুলে গেলি চলবেক লাই। ওর বাপে এখন হাটে যেতি পারে না। পা ভেঙ্গি গেছে। এই ছেলেই যায়। পট বেঁচে পয়সা আনে। বড়টা ক্ষেতে যায়। পড়ালিখা কি গরীবের ব্যপার?"
আমি মিহিরকে প্রশ্ন করলাম - ' তুমি কি পড়তে রাজি আছো? রাজি থাকলে আমি নয় বিডিও সাহেবকে বলে তার অফিসের মিটিং হলে রাতের দিকে পড়াতে পারি। পারলে রাতের খাওয়াটুকুরও যখন যেমন পারবো, ব্যবস্থা করবো নয়।"
মিহির প্রস্তাবে সায় দিল।
এইভাবে মিহিরসহ জনা পনেরো ছেলের বাড়ি গিয়ে আমি তাদের রাজি করিয়েছিলাম পড়াশোনার ব্যাপারে। প্রশাসনিক সাহায্যও পেয়েছিলাম যথেষ্ট। এই ভাবেই আবার নতুন উদ্যমে শুরু করলাম আমার শিক্ষকতা জীবন ।
তারপর কেটে গেছে বেশ কিছুদিন।
একদিন পড়াতে পড়াতে জিজ্ঞেস করলাম - "বলো তো সমাজ কাকে বলে?" আমার এই ছাত্ররা বেশিরভাগই ছিল বেশ মনোযোগী এবং সপ্রতিভ। অনেকেই উত্তর দেবে বলে হাত তুললো। আমি বললাম - "সুষেন, তুমি বলো।"
সুষেন বললো -" তবে একটা গান গাই দিদিমণি? পটের গান? "
আমি বললাম -" আগে উত্তরটা শুনি। তারপর হবে নয় । "
শুষেন বললো - " ওই গানটাই উত্তর, দিদিমণি"। আমি বললাম -" তাই নাকি? গাও তবে। ভালোই হবে।"
সুষেন খুশি হয়ে প্রথমে বন্ধুদের সাথে কিসব পরামর্শ করল। তারপর বলল - "আমরা সবাই মিলে গাইবো। তোমাকে শুনাব। "
আমি বললাম -" বেশ। তাই হোক"।
মিহির তখন এগিয়ে এসে খড়ি হাতে বোর্ডে আঁকতে লাগলো কয়েকটা মাছের ছবি আর সকলে তার সাথে গলা মিলিয়ে গাইতে লাগলো -
"দাঁড়িয়া মাছের বিয়ে করাতে চলো গো, রঙ্গিলা I
কই মাছ বলছে দেখো, কানের পানছড়া হবো গো রঙ্গিলা II
পাবদা ভেটকি বলছে দেখো ,তোমার হাতের চুড়ি হবো গো রঙ্গিলা I
চিংড়া মাছ বলছে দেখো, তোমার বিয়ের ঢোলক বাজাইবো গো রঙ্গিলা II
ভেটকি শিং বলছে দেখো, তোমার নাকের নদ হবো গো রঙ্গিলা I
মৈরোলা মাছ বলছে দেখো, তোমার বিয়ের ডুলিন হইয়া যাবো গো রঙ্গিলা II
ভোলা মাছ বলছে দেখো, তোমার মিষ্টির হাঁড়ি লইয়া যাবো গো রঙ্গিলা I
চিংড়া মাছ বলছে দেখো, তোমার বিয়ের হারমোনিয়াম বাজাইবো গো রঙ্গিলা II
পুঁটি মাছ বলছে দেখো ,তোমার মাথার টিকা হবো গো রঙ্গিলা I
বুয়াল মাছ বলছে দেখো, ব্যাটা সব শালারে খাবো গো রঙ্গিলা II
দাঁড়িয়া মাছের বিয়ে করাতে চলো গো রঙ্গিলা II"
গান শেষ হলো । সেই সাথে আঁকাও।
আমি বললাম - "চমৎকার। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর"?
সুষেণ হেসে বললো -" বুঝলেনি দিদিমণি? এইটাই সমাজ। আমরা এই ছোট ছোট মাছগুলার মতই একসাথে মিলে মিশে আনন্দ করে থাকতে চাই।আর কিছু পয়সাওয়ালা বড়মানুষের ব্যাটা খালি আমাদের ঠকিয়ে সব কেড়ে লয়। "
আমি বোকার মত বললাম - "তোমরা তো জাত শিল্পী। তোমাদের আঁকা পটের কদর তো বিশ্বজোড়া।"
এইবার আমার আরেক ছাত্র রহমত মল্লিক আমাকে মাঝপথে থামিয়ে বলল - "সে তো আমাদের আঁকার দাম। কিন্তু আমাদের কোনো দাম লাই। তাই আমাদের পেটেও ভাত লাই। "
মিহির শান্ত গলায় বলেছিল সেদিন - "এ ভাবে আর কাজ করবো নি দিদিমণি। লোকে খালি ঠকায়। শিখতেই হবে লিখাপড়া । না হলি চির কাল ধার করি আর পরের গোলামী করি কাটাতি হবে আর আমাদের রক্তে যে মিশে আছে রং আর তুলি, সেও একদিন শুকিয়ে ঝরে যাবে।"
ওদের কথা শুনে চুপ করে বসে ছিলাম বহুক্ষণ।আর কিছু সেদিন শেখানোর মত অবস্থায় ছিলাম না আমি। বরং আমিই ওদের থেকে শিখেছিলাম 'সমাজ কাকে বলে'। তাদের গাওয়া পটের গান ছিল আসলে তাদেরই সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবনের এক গীতিআলেখ্য। জীবনের শিক্ষা বোধ হয় একেই বলে। এই গানের মোড়কে কি কঠিন বাস্তবকেই না প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তুলে ধরছে তারা। আমাদের চারপাশের দুনিয়া তো এমনি। কিছু মানুষের ভেকধারী ভালোমানুষি নিজেদের অজান্তে কতই না আঘাত হানে আমাদের রোজকার জীবনে। আমাদের ছোট ছোট ভালোলাগা -ভালোবাসায় সাজানো বাগান এভাবেই তো বারবার গুড়িয়ে যায় অন্য কারুর অন্যায় হঠকারিতায়,পেশী-আস্ফালনে।
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো কিন্তু তাতে বোধ হয় ঠিক পোয়েটিক জাস্টিস করা হত না গল্পের প্রতি। তাই সেটুকুর তাগিদে বলে রাখি আরো কয়েকটি কথা।
আমি আমার সেই প্রথম চাকরিটি ছেড়ে দিই তার বছর দুয়েক পর এবং যুক্ত হই অধ্যাপনার কাজে। স্কুল ছাড়ার আগে মিহির, সুষেনরা আমায় কথা দিয়েছিল, যে ভাবেই হোক ওরা পড়াশুনো করবেই। মাঝে মাঝে চিঠি লিখত আমায়। আমারই পরের দিকে সময় করে উত্তর দেওয়া হয়ে উঠতো না। তবে এটুকুই আমার স্বান্তনা ছিল যে ওই কদিনে কিছু ছাত্রকে অন্তত আমি বিদ্যালয় অভিমুখী করতে পেরেছি, কিছুটা হলেও দিতে পেরেছি শিক্ষার আলোয় মুক্তির স্বাদ।
তারপর কেটে গেছে আরো পনেরোটি বছর। প্রথম কর্মস্থলের কারুর সাথেই পরের দিকে তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না।
গত মাসে একদিন খবরের কাগজে হঠাৎই চোখে পড়ে একটা খবর- 'মেদিনীপুর জেলার নয়াগ্রামের চিত্রকর মিহির আলী রাষ্ট্রপতি পুরস্কারে ভূষিত হলেন। তিনি বর্তমানে কলকাতা আর্ট কলেজে পটচিত্র সংক্রান্ত গবেষণার কাজে যুক্ত।' দেখেই বুকটা ফুলে উঠেছিল ছাত্রের গর্বে।
আমি নেট ঘেঁটে বহু কষ্টে মিহিরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলাম। দেখলাম, মিহির ভোলেনি আমায়। ফোনটা ছাড়ার আগে বলেছিল সেদিন -" মাছগুলো এখন বাঁচতে শিখে গেছে দিদিমণি। এখন আর মরবার ভয় নেই। "