SHUBHAMOY MONDAL

Drama Horror Tragedy

3  

SHUBHAMOY MONDAL

Drama Horror Tragedy

মিষ্টি সতীন

মিষ্টি সতীন

6 mins
394



- ঠানদি, আমায় সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখবে তো? মা কিন্তু বলে গেছে, তোমার সঙ্গেই সারাক্ষণ থাকতে।

- হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি আমার চোখে চোখেই থাকবে সোনা, শুধু আজ না আজীবন থাকবে, হয়েছে?

- ও ঠানদি, তুলি দিদির মতন আমিও তো বিয়ে হলে চলে যাবো এখান থেকে। তখন কি করে তোমার চোখে চোখে থাকবো?

ঠানদি হেসে ফেলেন - তোমার বিয়ে তো ঠানদার সঙ্গে হবে সোনা! তুমি তো আমার কাছেই থাকবে, জানো না বুঝি?


এই বলেই মিমিকে জড়িয়ে ধরেন সুনিতা দেবী, তারপর দুজনেই হো হো করে হেসে ওঠেন। এই দুই নাতনি ঠাকুমার জুটি ভারী মিষ্টি - ভীষণ হ্যাণ্ডসাম ঠানদা, নারায়ণবাবুর একজন বিয়ে করা বৌ আর অন্যজন হবু বৌ! কিন্তু দুই সতীনের ভারী ভাব - বয়সের ফারাক যদিও ষাট বছরের!


সুনিতাদেবীর দেওরের নাতনি মিমি। তাঁর দেওর আর জা অনেক কম বয়সেই এক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তাঁদের একমাত্র ছেলে প্রদীপ তাঁদের কোলে পিঠেই মানুষ হয়েছে। ওর স্ত্রী শিল্পীও তাঁকেই নিজের শাশুড়ি মানে। বাড়ি আলাদা হলেও সারাক্ষণ একসাথেই ওঠা বসা চলে তাদের। 


সুনিতাদেবীর একটাই মেয়ে, সেই সম্পর্কে তুলি তাঁর নাতনি, মানে দৌহিত্রি, যার বিয়ে হলো মাস খানেক আগে। তুলি বিয়ের আগে এখানেই দাদু দিদার কাছে থাকতো। মিমির সাথে তারও ভারী দোস্তি ছিল। তার বিয়ের পর চলে যাওয়াটা তাই মিমি সহজে ভুলছে না কিছুতেই।


সত্যি কথা বলতে কি মিমি নিজেও তো ক্ষণিকের অতিথি। যে দূরারোগ্য ব্যাধি বাসা বেঁধেছে তার ঐটুকু শরীরে, আর যেভাবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে, খুব বেশিদিন হয়তো... তাই চোখের আড়াল করে না তাকে বাড়ির কেউ। 


প্রদীপ আর শিল্পী যখন যেখানে একবিন্দু আশার আলো দেখতে পায় মিমিকে সুস্থ করে তোলার, সেখানেই দৌড়ায়। সুনিতাদেবী সামলান মিমিকে - সারাক্ষণ চোখের মণির মত, তাঁর একদম প্রাণের দোসর করে রেখেছেন তাকে। 


মিমি নিজেও বোধ হয় এখন বুঝতে পারে, তার যে অসুখ তা আর সারবে না। সেইজন্যই তার মুখে এমন অনেক কথাই বের হয় মাঝে মাঝে, যা হয়তো ওর বয়সী বাচ্চাদের মুখ ঠিক মানায় না। কিন্তু সেটুকুকে প্রশ্রয়ই দেয় বাড়ির সবাই - যেমন করে মন চায় এই ক'টা দিন বাঁচুক মেয়েটা।


এই যেমন সেদিন মিমি বলছিলো সুনিতাদেবীকে - আমি কিন্তু তোমার পিছন ছাড়ছি না ঠানদি। মরে গেলেও আমি তোমার পিছু ছাড়বো না, সারাক্ষণ তোমার চারপাশেই থাকবো। ঠানদা তোমায় ছেড়ে আমায় বিয়ে করবে না তো, আমিও তোমাকে যেতে দেবো না একা তার কাছে, দেখো!


তার এইসব পাকাপাকা বুড়িদের মত কথা শুনে, হেসেই লুটোপুটি খান তার ঠানদি আর ঠানদা। এক এক করে ওদিকে আশার আলো নিভে যেতে দেখে প্রদীপ আর শিল্পী! এত আধুনিক যুগেও কত অসহায় তারা - এইটুকু শিশুর শরীরে প্রবেশ করেছে মারণ রোগ। ডাক্তার সব বুঝেও নিরুপায় - একটু একটু করে নিভে যাবে চোখের সামনে এই ছোট্ট হাসিখুশীতে ভরা অবুঝের জীবনদীপ!

চলে গেলো মিমি তার ক'দিন পরেই। ঐটুকু বাচ্চা, শরীরের এত যন্ত্রণা কখনও প্রকাশ না করে, সবার সামনে হাসি খুশীতে কাটিয়ে, এক নিঝুম রাতে নিঃশব্দে বিদায় নিল পৃথিবী থেকে। কান্নায় ভেঙে পড়লো বাড়ির সবাই - প্রদীপ, শিল্পী, নারায়ণবাবু, তুলি, তুলির বাবা মা। ব্যতিক্রম শুধু তার ঠানদি।


মিমির মৃত্যুর শোকে একবিন্দু জল ঝরেনি তাঁর চোখ থেকে, শুধু নীরব হয়ে গেছেন তিনি। গহীন অরণ্যের নিস্তব্ধ অন্ধকারের নীরবতা যেন ছেয়ে রেখেছে সুনিতাদেবীকে। সেদিন মিমির প্রাণহীন দেহ জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদলো সবাই, তিনি উদাস দৃষ্টিতে নীরব বসে রইলেন। 


নারায়ণবাবু কত জোরাজুরি করলেন স্ত্রীকে - সুনিতা, তোমার সতীন যে চলে গেলো, তুমি কাঁদবে না? তোমার দোসর, প্রাণের দোসর তোমায় একলা ফেলে পালিয়ে গেলো, আর তুমি কাঁদবে না? কাঁদো সুনিতা চিৎকার করে কাঁদো, কষ্ট চেপে রাখতে নেই। তার যে অভিমান হবে তুমি না কাঁদলে, সুনিতা?

না, সুনিতাদেবী কাঁদতে পারেন নি। কি করে তিনি কাঁদবেন - তাঁর কোল জুড়ে যে তখন হাসি মুখে খেলছে মিমি! কেউ দেখতে পাচ্ছে না - সেই অনাবিল হাসি-খুশী মুখে, ঠানদির কোলে চড়ে তার বসে থাকা। তিনি কি করে কাঁদবেন? তিনি কাঁদলেই যে চলে যাবে সত্যিই তাঁকে ছেড়ে তাঁর সেই ছোট্ট সতীন!


সকলেই সুনিতাদেবীর এই বাকরুদ্ধ স্থবির হয়ে যাওয়া দেখে চিন্তিত হয়ে পড়লো। মিমির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়ে গেলো, অন্যান্য পারলৌকিক কাজও ফুরালো। নীরবে চোখের জল ফেললেও প্রদীপ এবং শিল্পীও নিজেদের সামলে নিয়েছে অনেকটা। কিন্তু সুনিতাদেবীর কোন ভাবান্তর নেই। 


তুলিই কয়দিন ধরে দাদু দিদার কাছে রয়ে গেছে - রান্না বান্না ও অন্যান্য কাজ কর্মও সেই করছে। ডাক্তার ডাকা হলো, তিনি পরীক্ষা করে বললেন - ব্লাডপ্রেশারটা একটু লো বাট নর্ম্যালই প্রায়। আর তো কোন অসুস্থতার লক্ষণ নেই সুনিতাদেবীর। তবে স্বাভাবিক খাওয়া দাওয়া না করলে হয়তো পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে।


আপাতত তিনি ওআরএস বা নুন-চিনির সরবত খাওয়াতে বললেন দিনে তিন চারবার করে৷ সঙ্গে নর্ম্যাল খাওয়া দাওয়া করলেই চলবে। ভিটামিন খেতে চাইলে তিনি না হয় পাঠিয়ে দেবেন পরে ক'টা সাপ্লিমেন্টের পাতা।


কিন্তু না, কোনো পরিবর্তন নেই তাঁর মধ্যে! অগত্যা ঠিক করলো সবাই, একটা তান্ত্রিক/ওঝাকেই তবে ডাকা হোক। সেটা শুনে, মিমি চলে যাবার পর সেই প্রথমবার মুখ খুললেন সুনিতাদেবী - যদি চাও, আমি সুস্থভাবে বাড়িতে থাকি, তাহলে ওদের ডাকাডাকির দরকার নেই। আমি ঠিক আছি।


সর্বনাশ! তাঁর গলার আওয়াজ শুনে চমকে গেলো সবাই - এ যে মিমির গলা! তাহলে, মিমির প্রেতাত্মা ভর করে আছে সুনিতাদেবীর ওপর? সেই জন্যই তাঁর এমন অদ্ভুত আচরণ? 

সকলে বাইরে এসে গোপনে পরামর্শ করলো, ঐ তান্ত্রিককেই ডেকে আনা হবে। তাঁকে বলা হবে বৃদ্ধা সুনিতাদেবীকে যথাসম্ভব শারীরিকভাবে সুস্থ রেখে আত্মার প্রভাবমুক্ত করতে। ভবানী তান্ত্রিক এই সব কাজে খুবই দর।


তান্ত্রিক বাড়িতে প্রবেশ করতেই চরম উন্মত্ততা শুরু হলো সুনিতাদেবীর আচরণে। তাঁকে কোনো মতে একজায়গায় বসিয়ে গণ্ডি কেটে দিলেন ভবানী তান্ত্রিক। তারপর শুরু হলো তাঁর ঝারফুঁক প্রক্রিয়া। তিনি আদর করে মিমিকে ডেকে বললেন তার ঠানদিকে কষ্ট না দিতে।

মিমির উত্তর - ঠানদিকে কষ্ট দেব কেন? আমরা তো একসাথেই আছি, বলো ঠানদি?

ঠানদির আওয়াজে উত্তর এলো - হ্যাঁ তো সোনা!

ভবানী কুশ দিয়ে সুনিতাদেবীর গায়ে তাঁর মন্ত্রপূত জলের ছিটা দিয়ে বলেন - এক শরীরে দুই আত্মা থাকতে পারেনা। এই শরীর তোমার ঠানদির। তুমি চলে যাও ওনার শরীর ছেড়ে।

জলের ছিটে লাগতেই, যেন আগনে পুড়ে গেলো তার গা এমন আর্তনাদ করে উঠলো মিমি - না, আমি ঠানদিকে ছেড়ে কখনও যাবো না। আমি তো কথা দিয়েছিলাম ঠানদিকে, বলো ঠানদি? এরা আমায় তাড়িয়ে দিতে চাইছে!

ঠানদির গলায় উত্তর এলো - তাইতো সোনা, তুমি তো আমায় কখনও ছেড়ে যাবে না বলেছিলে। আমিও তোমায় কখনও চোখের আড়াল করবো না, কথা দিয়েছি না? কেউ তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যেতে পারবে না সোনা!

ভবানী তখন - তবে রে - বলে ঝাঁটাপেটা করতে উদ্যত হতেই তাঁর পায়ে এসে পড়লেন নারায়ণবাবু - না, দয়া করে ওকে মারবেন না। ওরা দুজনেই যে আমার বড় আদরের।

ভবানী - আপনার স্ত্রী আপনার আদরের হতেই পারেন, কিন্তু তিনি মোহগ্রস্ত। কোন বিদেহী আত্মা কি আর জীবিতের শরীরে বাস করতে পারে? না তার মঙ্গল হয় তা'তে? আমার এই ঝাঁটার মার খেলে উনি মারা যাবেন না, কিন্তু ভূত পালাবে। উনি সুস্থ স্বাভাবিকভাবেই আবার বাঁচতে পারবেন, বুঝেছেন?

ওদিকে সুনিতাদেবী তখন তাণ্ডব নৃত্য করছেন সেই গণ্ডির মধ্যে! ঘরের মধ্যেও যেন হাওয়ায় ঝড় উঠলো! তাঁর হাতের তীব্র আঘাতে সেই কাঠের ঘরের কড়িকাঠে যেন চিড় ধরলো! পরমুহুর্তেই সেটা ভেঙে পড়লো হুড়মু্ড়িয়ে যজ্ঞের হোমাগ্নির ওপর, ছিটকে পড়লো ঘি চারিদিকে - দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো কাঠ! নিমেষে কাঠের ঘরটা হয়ে উঠলো যেন জতুগৃহ। 

সকলেই ঘটনার আকস্মিকতায় দৌড়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে! সেই গণ্ডির বাধাটা টপকাতে না পেরে - জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গেলেন সুনিতাদেবী। আগুন তাঁর সর্বাঙ্গ গ্রাস করতে শুরু করলে, তবে মিমি মুক্তি দিল তাঁকে।

তখনই দুটো চিৎকার শুনতে পেলো বাইরে থেকে সবাই - প্রাণভয়ে সুনিতাদেবীর আর্তনাদ - বাঁচাও, বাঁচাও আর মিমির অট্টহাসি - বলেছিলাম না তোমায়, মরে গেলেও একা ছাড়বো না ঠানদার কাছে! হা হা হা....

রক্তচক্ষু ভবানী তান্ত্রিক বললেন নারায়ণবাবুকে - বলেছিলাম না, বিদেহী আত্মা কোন জীবন্ত শরীরে প্রবেশ করে তার মঙ্গল করার জন্য নয়! হলো তো? আমায় কাজটা আপনি ঠিকমত করতে দিলে, ওনাকে এইভাবে বেঘোরে মরতে হতো না!

ঠানদা যেন হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন পুরো ঘটনায়। তার ওপর এখন সুনিতা, মিমি আর ভবানীর কথাগুলো শুনে তাঁর মনে হলো, এই সবকিছুর জন্য বোধ হয় পরোক্ষভাবে তিনিই দায়ী। তাই তাঁরই কারণে, তাঁরই দুই প্রিয় মানুষকে হারানোর ব্যথাটা সহ্য হলো না বোধ হয় তাঁরও। 

সকলকে হতবাক করে দিয়ে, তিনিও হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়লেন গিয়ে জ্বলন্ত সুনিতার শরীরটার ওপরে!



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama