মহামারীর কবলে
মহামারীর কবলে


প্রিয় ডায়েরি,
আমার এই গল্প বর্তমান পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে,
" বলছিলাম কি পাশের বাড়ির কাকিমা কাল ওদের বাড়িতে সন্ধ্যে বেলা ইনভাইট করেছেন। ওনার ছেলে এসেছেন সাত,আট দিন আগে বিদেশ থেকে, সঙ্গে বিদেশি বৌমা। এই প্রথম নাকি সে এদেশে এলো, তাই সবাইকে ডেকে একটা ছোটখাটো গেট টুগেদার করতে চান আর কি। সেই সুবাদে সকলে ওনার ছেলের বউ কে দেখেও নেবে। শুধু হাতে তো আর যাওয়া যায় না তাই কি দেওয়া যায় বলোতো?"
স্বাতী জিজ্ঞেস করলো অরুণ কে।
অরুণ টিভি তে নিউজ দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক ভাবে উত্তর দিলো, "ছাড়ো না এখন এসব গেট টুগেদার। পুরো বিশ্ব এখন সংকটে আছে, করোনা ভাইরাস নিয়ে।আর তুমি এইসব গেট টুগেদার নিয়ে পড়ে আছো। তার ওপর আবার বিদেশ থেকে এসেছে বলছো। কোনো দরকার নেই যাবার ওখানে"। স্বামীর এধরণের কথায় স্বাতী একটু মনোক্ষুণ্ন হলো। ভাবলো কোনোদিন ই তো এসব অনুষ্ঠান বাড়ি নিয়ে অরুণের মাথাব্যথা ছিল না। আজ আর নতুন করে কি ভাববে। তার থেকে বরং স্বাতী নিজেই কিছু নিয়ে নেবে, কাল যখন যাবে। ঘটনাটি মাস খানেক আগের। তখন চীনের পর ইতালিতেও করোনা তার করাল ছায়ায় গ্ৰাস করতে শুরু করেছে অগণিত মানুষকে। অরুণ স্বাতীকে সাবধান করলো নিউজ দেখতে দেখতে। স্বাতী ব্যাপারটাকে অতটা গুরুত্ব দিলো না।অরুণ তো সারাক্ষণ নিউজ নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করেই।তাই স্বাতী আর কথাটা আমল না দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
পরের দিন নিউজ পেপারে,টিভিতে করোনা নামক মহামারীর কবলে গোটা পৃথিবী যে কি ভীষণ বিপর্যস্ত তার প্রমাণ পাওয়া গেল। আর তার সঙ্গে এটাও জানা গেল যে, এটা ভীষণভাবে সংক্রমিত একটা রোগ। আর তার ফলেই ভারতের বাইরে এর মৃত্যু মিছিল শুরু হয়ে গেছে। লাশের পাহাড়ে কে কার শেষকৃত্য করবে? গোটা দেশ এক একটা মৃত্যুপুরী তে পরিণত হচ্ছে। সংক্রমণের সূত্রপাত চীনে হয়েছে, কিন্তু সেটি ক্রমশঃ পাশ্চাত্য দেশ গুলোতে ও ছড়িয়ে পড়ছে। আর এটাও এতদিনে প্রমাণিত হয়েছে যে এটা জন সংযোগ থেকেই সংক্রমিত করছে সবাইকে। অরুণ স্বাতীকে বললো ,"তুমি আজ ওই গেট টুগেদারে যাবে না,আর বুকান কে তো নিয়েই যাবে না। ওরা বাইরে থেকে এসেছে বলছিলে না?"
স্বাতী আবার বিরক্তিকর স্বরে বললো অরুণকে, " ওসব বাইরে হচ্ছে, আমাদের দেশে না, বুঝলে।"
সন্ধ্যে বেলা স্বাতী অরুণের কোনো কথা না শুনেই বুকানকে নিয়ে পাশের বাড়ির কাকিমা র গেট টুগেদারে গিয়েছিল যথারীতি।
এর পরের ঘটনা আরোও মারাত্মক। ইতিমধ্যেই করোনা তার ভয়াল থাবা ভারতেও বসাতে শুরু করে দিয়েছে। ত্রিশুর(Thrissur, Kerala তে ভারতের প্রথম করোনা আক্রান্তের সন্ধান ও পাওয়া যায়। তারপর ধীরে ধীরে মহারাষ্ট্র, গুজরাট, বিহার, দিল্লী, পশ্চিমবঙ্গ সর্বত্রই করোনা আক্রান্তের সন্ধান পাওয়া গেছে। বিদেশে বসবাসকারী এদেশের মানুষ জনের আত্মীয় স্বজন, ছেলেমেয়ে যারা ই এদেশে এসেছে, তাদের বেশিরভাগই করোনার বাহক। কিছু শিক্ষিত দুর্বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের হঠকারিতার জন্য আজ ভারতের ও বিভিন্ন জায়গায় করোনার বাহক ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেশের সর্বত্র লক আউটের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও এই ভয়াবহ মারণ ব্যাধি থেকে আমরা কেউই পুরোপুরি নিশ্চিন্ত না। কারণ লক আউট ঘোষণা হবার পূর্বেই আমাদের দেশে এর বাহকরা অবিলম্বে এসে বসবাস করছে হয়তো। অনেক ক্ষেত্রে ই তাদের আত্মীয় স্বজনরা জেনেশুনে তাদের ঘরে লুকিয়ে রাখছে। এদের মধ্যে অনেকেই আবার পাবলিক প্লেসে ঘোরাঘুরি ও করেছিল হয়তো এর আগে। যেখানে যেখানে এরা গেছে, সব জায়গায় , আরোও কিছু করোনা বাহক কে ছেড়ে এসেছে হয়ত নিজের অজান্তেই।
রাত্রি বেলা নিউজে ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে শুনে স্বাতী মনে মনে একটু ভয় পাচ্ছিলো। অরুণের কোনো কথা না শুনেই সে কাল নিজে তো গিয়েই ছিল , সঙ্গে বুকানকেও নিয়ে গিয়েছিল। ওইটুকু শিশু, যদি কিছু হয়? ভয়ে স্বাতী ঘামতে থাকে। ওর ভয়ের আরও এক কারণ , বুকানকে কাল ওই বিদেশি বউ আদর করে চুমু ও খেয়েছিল তো। কিন্তু কি করে বলবে স্বাতী একথা অরুণ কে। সারারাত ছটপট করতে থাকে ও চিন্তায়। ওর চিন্তা আরো বেড়ে গেলো যখন সাতদিন পর পাশের বাড়ির ওই কাকিমা কে হসপিটালে ভর্তি করতে হলো অসুস্থতার কারণে। ইতিমধ্যে সরকার থেকে প্রত্যেকটা রাজ্যে করোনা আক্রান্তদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বাতী পরদিন সকালে শুনলো ওই কাকিমার করোনা টেস্ট পজিটিভ পাওয়া গেল। স্বাতীর পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে গেল মনে হলো। কাল তো কাকিমা ও বুকানকে জড়িয়ে অনেক চুমু খেয়েছেন,আদর করেছেন।বুকান তো বেশির ভাগ সময় কাকিমার কাছেই ছিল কাল। কাকিমাই তো কাল ওকে কোলে নিয়ে বসেছিল। আর সংক্রমণ জনিত রোগ যেহেতু, তাহলে তো বুকান ও সংক্রমিত হয়েছে। ও তো আজ শুনেছিল টিভিতে নিউজে যে এটা বাচ্চাদের আর বয়স্ক মানুষদের বেশি সংক্রমিত করছে।
স্বাতীর পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। ও দৌড়ে বুকানের কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো। না আজ অরুণকে বলতেই হবে পুরো ব্যাপারটা।আর চেপে রাখা ঠিক হবে না।
সন্ধ্যে বেলা অরুণকে সমস্ত ঘটনা জানালো স্বাতী। বুকানকে নিয়ে ওরা ডাক্তারের কাছে গেল ,আর এক মূহুর্ত ও সময় নষ্ট না করে। দুর্ভাগ্য ক্রমে বুকান ও করোনা নামক এই ভয়াবহ রোগের বাহক হয়ে গিয়েছিল ততক্ষণে।ওর টেস্ট এর রিপোর্ট ও পজিটিভ পাওয়া গিয়েছিল। ওকে আইসোলেশান এ রাখার ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন ডাক্তারবাবু।স্বাতীর দুচোখ বেয়ে জলের ধারা। ওইটুকু একটা প্রাণ কে আজ ওর জন্য কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। আর স্বাতী নিজেও কি কম ভোগ করবে এই কদিন। এক মায়ের থেকে তার বাচ্চাকে আলাদা করে দিলে ,সেই মায়ের অবস্থা তো জীবন্মৃত হয়ে যাবার মতই। বুকানকে যখন স্বাতীর কোল থেকে নিয়ে যাচ্ছিল, বুকান ভীষণভাবে কান্নাকাটি করছিল। কিছুতেই ও নিজের মাকে ছেড়ে যেতে চাইছিল না। স্বাতীর বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছিল, ওর মনে হচ্ছিল ওর বুকের পাঁজর গুলো কেউ খুলে নিয়ে যাচ্ছে।কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো ও।ওকে তো অরুণ অনেকবার বারণ করেছিল,বুকানকে সঙ্গে না নিয়ে যেতে। ও শোনেনি তখন।আজ ওর নির্বুদ্ধিতার ফল বুকানকে ভোগ করতে হচ্ছে প্রতি পদে পদে। স্বাতী আর অরুণ কেও টেস্টের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যদিও ওদের রিপোর্ট নেগেটিভ ছিল।তাও ঘর থেকে সবাইকেই বেরোতে বারণ করা হয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশানুযায়ী দেশের প্রত্যেক জনগণকেই ঘরবন্দি থাকতে বলা হয়েছে। নিজের সুরক্ষা, পরিবারের সুরক্ষা তথা সমগ্ৰ দেশের সুরক্ষার জন্য । এই মহামারীকে নিজের ঘরে স্বেচ্ছায় আনবেন না।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রত্যেক টি নাগরিককে তার নিজের সুরক্ষার স্বার্থে, পরিবারের সুরক্ষার স্বার্থে,তথা দেশের সুরক্ষার স্বার্থে ঘরবন্দী থাকতে হবে।যেহেতু এটা একটা জন সংক্রমিত রোগ, তাই একমাত্র এর থেকে বাঁচার উপায় ঘরে থাকা।আর দেশের কথা না হয় পরেই ভাবলেন, নিজের পরিবারকে রক্ষার দায়িত্ব তো আপনার ই। ঘরে থাকুন, সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
নমস্কার
কলম রাখলাম।