STORYMIRROR

Ananya Podder

Drama Classics Inspirational

3  

Ananya Podder

Drama Classics Inspirational

মায়ের স্বীকৃতি

মায়ের স্বীকৃতি

6 mins
254

ভুবনেশ্বর বাবু ও সৌদামিনী দেবীর ভরা সংসার | ভুবনেশ্বর বাবুর দুই ছেলে, বড়ো ছেলে শচীন্দ্রনাথ ও ছোট ছেলে মানবেন্দ্রনাথ | শচীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়ে গিয়েছে | শচীন্দ্রনাথের স্ত্রী চারুবালা একদম সাধাসিধে | সংসারে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি সবাইকে খুশি করতেই সে সদা ব্যস্ত | স্বামীর মন জুগিয়ে চলতেই তার দিন কাবার হয়ে যায় | ব্যবসায়ী স্বামীর মেজাজে সে খুবই তটস্থ | তার উপর চারুবালার প্রথম সন্তান হিসেবে মহুয়া হওয়াতে শচীন্দ্রনাথ একটু মনোক্ষুণ্নই হয়েছিল | তার এত বড়ো ব্যবসা সামলানোর জন্য তার তো পুত্রসন্তানই চাই | মেয়ে সন্তান কি করে এই ব্যবসার উত্তরাধিকারী হবে? তাই সে একটু চারুবালার উপর রুষ্ট, যেন কন্যাসন্তান হওয়ার জন্য সেই দায়ী ||

এ দিকে মানবেন্দ্রনাথ দাদার ঠিক বিপরীত | খুবই সাদাসিধে ও খোলা মনের মানুষ | এই ব্যবসা পত্তর তার বুদ্ধিতে ঠিক আসে না | তাই সে পোস্ট অফিসের কেরানীর চাকরি করেই খুশি | এ বার বাড়িতে তার বিয়ে দেওয়ার পালা | সৌদামিনী জানতেন যে মানবেন্দ্রনাথ যে রকম সহজ সরল তাতে তাঁদের মৃত্যুর পর সে তার দাদার সাথে বুদ্ধিতে পেরে উঠবে না | ভুবনেশ্বর বাবুর অতো বড়ো কাপড়ের ব্যবসা শচীন্দ্রনাথ একার দখলে নিয়ে নিয়েছে | ছোট ছেলে ব্যবসা বুঝিনা বলে ব্যবসার সব অধিকার ছেড়ে দিয়ে সরকারের কেরানি হয়েছে | তাই তাঁদের অবর্তমানে বড়ো ছেলে যাতে ছোট ছেলেকে সম্পত্তি থেকে ঠকাতে না পারে তাই শচীন্দ্রনাথের বুদ্ধির সমকক্ষ এক জনকে খুঁজতে হবে যে কিনা তার ছোট ছেলের ঢাল হয়ে তাকে রক্ষা করবে ||


তাই সৌদামিনীর কথা মতো ভুবনেশ্বর বাবু অলকানন্দাকে পছন্দ করেন ছোট ছেলের বৌ হিসেবে | অলকানন্দা খুবই নির্ভীক প্রকৃতির এবং নিজের খেয়াল খুশিতে চলা একটি মানুষ | সে জানতো তার স্বামী নিতান্তই গোবেচারা গোছের | বৌকে ভালোবাসতে গেলেও যেন তার সবার অনুমতির প্রয়োজন হয় | তবুও অলকানন্দা, মানবেন্দ্রকে ভীষণ ভালোবাসে | শচীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করেন অলকানন্দার ছোঁয়ায় যেন চারুবালাও মাঝে মধ্যে বাহির বাতাসের মতো আচরণ করে তখন সে একটু মনে মনে ভয়ই পায় | বৌয়ের উপর তার আধিপত্য নিয়ে সে মাঝে মাঝে চারুবালাকেও সাবধান করে | এ ভাবেই দিন চলছিল ||


বছর দুয়েক পরে ভুবনেশ্বর বাবুর বাড়িতে খুশির হাওয়া উঠেছে | প্রায় একই সময়ে চারুবালা আর অলকানন্দা মা হতে চলেছে | শুধু ভয়ে দিন কাটাচ্ছে বাড়ির বড়ো বৌ | সে শুধু ছোট বৌকে বলে "এবার যদি ছেলে না হয় ছোট, তবে তোর ভাসুর ঠাকুর আবার বোধহয় বিয়ে করবেন | তিনি যদি আমায় ত্যাগ দেন, তাহলে আমার মরণ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকবে না | "


ছোট বৌয়ের এসব কথা ভালো লাগে না | সে বড়ো জাকে বোঝায়, "সন্তান ঈশ্বরের দান | তাকে ভালোবেসে গ্রহণ কোরো দিদি |" তবুও সে মনে মনে ভয় পায়, পুত্রসন্তান না হলে বোধহয় সত্যিই চারুবালা আত্মহত্যা করবে | সেও তার বড়ো জায়ের জন্য মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে |

অবশেষে সেই শুভক্ষণ উপস্থিত হয় | দুই বৌয়েরই পুত্রসন্তান লাভ হয় | কিন্ত ছোট বৌয়ের ঘরে যে সন্তান আসে সে প্রতিবন্ধী | তার দুটি পায়ের একটি পা সম্পূর্ণ ভাবে তৈরিই হয়নি মায়ের জঠরে | বড়ো ছেলে ব্যাঙ্গ করে বলল, "ছোট বৌ তার উদ্দাম আচরণের সাজা পেয়েছে |"

অলকানন্দা হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, "খবরদার যদি আমার ছেলের সম্পর্কে একটাও বাজে কথা বলা হয় | সে শরীরে প্রতিবন্ধী, মনে নয় | পৃথিবীতে মনের প্রতিবন্ধী মানুষগুলিকে নিয়ে যদি চলা যায়, তবে ও তো আমার রাজা | আমার সন্তান হবে মনের রাজা, মনুষ্যত্বের রাজা |" তাই অলকানন্দা ছেলের নাম রাখে রাজা | চারুবালার ছেলের নাম হয় জয় | শচীন্দ্রনাথের বড়ো আশা, জয় বড়ো হয়ে বিশ্ব জয় করবে |

জয় আর রাজার বেড়ে ওঠার মধ্যে কোনো অন্তরায় ছিল না | তার লালন পালনে ছোট বৌ কোনো ব্যবধান তৈরিই হতে দেয়নি কখনো | বড়ো ভাসুরের সাথে প্রতিক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে গিয়েছে অলকানন্দা | সে ছেলের অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠান হোক, বা ছেলের বড়ো স্কুলে পড়ার ব্যাপারে হোক, সব বিষয়েই সে সব সময় রাজার অধিকারকে হারতে দেয়নি | সমাজ রাজাকে করুণা করতো, কিন্তু মা শেখাতো শক্তিশালী হতে | ছোটবেলা থেকে রাজা পেয়েছে বাবার মতো সহজ সরল মন ও মায়ের মতো বলিষ্ঠ আচরণ | আর ছোট বৌ ও তার ছেলের এই সব লড়াইয়ে পাশে ছিলেন ভুবনেশ্বর বাবু ও সৌদামিনী দেবী |


শচীন্দ্রনাথ ছেলের লেখাপড়ার বিষয়ে খুব একটা গুরুত্ব দিতেন না | কিন্তু ছোট বৌ প্রায় জোর করেই জয়ের পড়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো | ভাসুরের সাথে যত গন্ডগোলই থাকুক না কেন, জয়ের প্রতিও তার অপত্য স্নেহ লোককে অবাক করে দিতো | দুই ভাই অলকানন্দার সাহচর্যে সুন্দর ভাবে বড়ো হতে লাগলো | শচীন্দ্রনাথ প্রথম দিকে লড়াই চালালেও পরে ছোট বৌয়ের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয় |

এই ভাবে অনেকগুলি বছর পেরিয়ে যায় | জয় বাইরের শহরের চাকরিতে কর্মরত | আর রাজা ওকালতির কাজে ব্যস্ত | দুই ভাইয়ের মধ্যে ভীষণ ভাব | শহরে একটি ফ্লাট কিনে দুই ভাই একই সঙ্গে থাকে | একই সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে ফেরে | দুই মায়ের আদর দুই ছেলে ভাগ করে নেয় | মা ছেলের সম্পর্ক দেখলে বলা মুশকিল কে কার সন্তান | শচীন্দ্রনাথেরও বয়স হয়েছে | সে বুঝতে পেরেছে, তার ব্যবসা দেখাশুনা করার জন্য কোনো ছেলেই তৈরী নয় | তাই সে তার এক বন্ধুর ছেলেকে ব্যবসার সহকারী হিসেবে রেখেছে | সেই ছেলেটিই তার ব্যবসার দেখভাল করে | ছেলেটি বেশ ভালো ও বিশস্ত | তাই শচীন্দ্রনাথও ব্যবসার বিষয়ে একটু শিথিলতা দেখাতে শুরু করেন |

কিন্তু কথায় আছে, যেখানে বিশ্বাস, সেখানেই বিস্বাসঘাতকতা | তলে তলে শচীন্দ্রনাথের অগোচরে সমস্ত ব্যবসার উপর দখল নেয় সেই বিশ্বাসঘাতক | নকল কাগজ পত্র তৈরী করে শচীন্দ্রনাথের সমস্ত ব্যবসাকে নিজের করে নেয় | শচীন্দ্রনাথ পথে বসেন | তিনি যখন জানতে পারেন তখন সব শেষ |


খবর যায় শহরে দুই ছেলের কাছে | তারা বাড়ি ফিরে বুঝতে পারে সমস্ত ঘটনা | এর পর আসরে নামে রাজা | তার এত দিনের বিদ্যে ও অনুশীলন এবার নিজের লোকের জন্য কাজে লাগানো | দীর্ঘ দুবছরের লড়াইয়ে সে জেঠুর সমস্ত ব্যবসিক সম্পত্তিকে ছিনিয়ে নিয়ে আসে | তার যে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে দেখে তাকে অবজ্ঞা করেছিল তার জেঠু, সেই আজ বড়ো হয়ে মানসিক ও আইনি লড়াইয়ে জেঠুকে দেখিয়ে দিলো, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কোনো প্রতিবন্ধকতাই নয় |


আজ বাড়িতে ধুমধাম করে অনুষ্ঠান হচ্ছে | শচীন্দ্রনাথ তার সমস্ত ভুলের সংশোধনের আনন্দে বাড়িতে উৎসবের আয়োজন করেছেন | সবাই খুব খুশি | এর মধ্যেই চারুবালা অলোকানন্দাকে বলে ওঠে, "ওরে ছোটো, আজ তোর ভাসুর ঠাকুরকে সত্যি কথাটা বলে দিলে হয় না | তাকে জানালে হয় না যে জয় নয়, রাজাই আমাদের সন্তান |"


অলকানন্দা প্রমাদ গোনে | "না দিদি, সেদিন তোমার ঘর বাঁচাতে তুমি যে সন্তানকে স্বীকৃতি দিতে পারোনি, আজ তাকে নাই বা স্বীকৃতি দিলে নিজের সন্তান হিসেবে |" রাজা আমার সন্তান হিসেবেই জগতে পরিচিত ছিল, পরিচিত থাকবে | ভগবান ওকে প্রতিবন্ধী করে পাঠিয়ে ছিলেন | তাতে ওর অপরাধ কোথায় ছিল? তুমি মা হয়ে ওকে গ্রহণ করতে পারছিলে না | জগৎ সংসার ওকে কি চোখে দেখতো?"


চারুবালা কেঁদে ওঠে | সে বলে, "তুই যে দয়া আমার রাজার উপর করেছিস, তার কৃতজ্ঞতা আমি কি ভাবে জানাবো জানিনা |"

ছোটো বৌ উত্তর দেয়, "দয়া সেদিন আমি ওই ছোট্ট শিশুটাকে করেছিলাম না, করেছিলাম তোমাকে | তোমার স্বামী তোমায় প্রতিবন্ধী ছেলের জন্ম দেওয়ার জন্য কি শাস্তি দেবে, সেই ভেবে ছেলেকে অস্বীকার করেছিলে | তাই আজ নতুন করে এই স্বীকৃতিটুকু নাই বা দিলে ! "

আজ বাড়ির এত আনন্দের মাঝেও এক মা তার ভুলের স্বীকৃতি করছে চোখের জলে | সেদিনের সেই ভুল আজ তাকে মায়ের স্বীকৃতি থেকে দূরে রেখে দিলো | একেই বোধহয় বিধির বিধান বলে !!



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama