মালনীর টিলা
মালনীর টিলা
গৌতম বাউড়ি শিশ দিতে দিতে ঘুরে বেড়ায় দুপুর থেকে সন্ধ্যে । এই বিষণ্ণ নিস্তব্ধ চা বাগানে তার শিশের ধ্বনিকে খুব বেশি মানবীয় মনে হয়। রাবার গাছের লালচে পাতা অন্ধকার হয়ে আসছে,রোদ সরে যাচ্ছে টিলার চূড়ার দিকে – এইসব মানবিক জঙ্গলে এই তার শেষ আলোকপতন। ছন্দা বাউড়ি বাড়ি ফিরছে। চা গাছে কাঁটা ডালে রঙ দেয়ার কাজ আপাতত শেষ করে ফিরে যাচ্ছে ঘরে।
জঙ্গল থেকে সারি সারি মানুষ বেড়িয়ে আসছে কাঁটা ডাল নিয়ে। টিলার গায়ে লাফ দিচ্ছে বানরের দল, গর্ত থেকে বেড়োচ্ছে শেয়াল - উঁকি দিচ্ছে।
হঠাৎই সন্ধ্যে নামায় আমরা ভয়ে ভয়ে মৃদু আলোয় রাস্তা ধরে হাঁটছি। রাস্তা শেষ হয়না – গোলকধাঁধার মত হাঁটতে হাঁটতে তবু রাস্তা শেষ হয়না। আমাদের পলাতক মন তখন নগর সভ্যতার হাহাকার বোধ করে।
একটা গরুকে তখন তীব্র মানুষ ভেবে, সে পথ ধরে হেঁটে যাই মানুষের আবাসের সন্ধানে । কয়েকজন দেবদূতদের আগুনের ঝলকানিতে শান্ত হয়ে দু'জন দেবদূতকে নিয়ে চলি আমাদের সাথে। আর দেবদূতদের ক্রমশ মানুষ তারপর কেমন সন্দেহ হতে থাকে।
২৩ কেজি চা-পাতার বদলে ১০২ টাকা আর রেশনের চালে তারা বেঁচে যাচ্ছে একরকম। জঙ্গলে আর সব মানুষের মতই তাদের বেদনা মিশিয়ে বেঁচে আছে। তবু আরো কিছু টাকার প্রয়োজন আছে বলেই খাদিম বাজারে তারা ১নম্বর গ্রেডের চা পাতা এনে দেয়।
একা ঘরে রাত্তিরে ছন্দা বাউড়ির এখন আর ভয় করে না। নিজেকে নিয়ে ভাববার কিছু নেই তাই ঘুমিয়ে পড়লেই হয়। খুব সকালে উঠে টিলার মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া খালগুলো থেকে স্বচ্ছ জল তুলে আনতে হবে। ভাত রান্না করতে হবে – চা গাছে কাঁটা ডালে রঙ দিতে হবে।
ছন্দা বাউড়িকে আমাদের নন্দনতাত্ত্বিক চোখে মানবী বলা চলে না নিশ্চয়ই – তবু গল্পের আর সব মানবীর মতই তার সংকট। সেসব পাশে রেখেই কাটিয়ে দেবে আরেকটা রাত।
অজয় তাঁতি বাগানের সর্দার। বাগানের যাবতীয় হিসেব কষতে কষতে বেকায়দা অঙ্কে পিছলে গিয়ে - এখন পঞ্চায়েতের রায়ে তার কুয়োর জল তোলা বারন।
বিজয় গোয়ালা কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ জানেনা।
বহু বছর কেটে গেছে – সদাই বাউড়ি এখনও লাঠি হাতে ভেড়া তাড়ায়। গৌতম বাউড়ি শিশ বাজাতে বাজাতে ঘুরে বেড়ায় সমস্ত বাগান।