STORYMIRROR

Khyali Sikdar

Horror Tragedy Thriller

3  

Khyali Sikdar

Horror Tragedy Thriller

লিপীকা

লিপীকা

11 mins
248

 অবশেষে এসে পৌঁছানো গেল। দেবদারুগড়, স্টেশনের নাম। ফোনটা বের করে কল করবো ভাবছি, পিঠের ওপর একটা আলতো হাতের চাপড় খেয়ে পিছনে ঘুরেই ওর হাসি মুখটা দেখতে পেলাম। 

 -"আরে!" 

 -"আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?", এক গাল হাসি নিয়ে বলল লিপীকা। 

 লিপীকা আমার ছোটবেলার বন্ধু। একসাথে স্কুলে পড়েছি। খেলাধুলো করেছি। দু'জনে মিলে কত দুষ্টুমি করে পাড়ার লোকেদের নাজেহাল করেছি। তারপর যা হয় আর কি। নিজের নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় কলেজ লাইফে আলাদা হয়ে যাওয়া। কলেজ শেষ হলে একবার দুই পরিবারের গেট টুগেদার হয়েছিলো। খুব মজা করেছিলাম ওদের সাথে। তারপর আর দেখা হয়নি। তাও সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে গত কয়েক বছর ধরে ওর সাথে যোগাযোগটা চলেছে।  

 -"না, না, আসতে আবার কীসের অসুবিধা?" 

 -"দে আমি নিচ্ছি।" বলে স্যুটকেসটা আমার হাত থেকে নিয়ে নিলো, "আমার ট্যাক্সিটা... ওই তো, ওখানে দাঁড়িয়ে আছে।" 

 লাগেজগুলো ডিকিতে দিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বসলাম। 

 -"আজ সকাল থেকে ফোন করছি তুলছিস না কেন রে? আমি তো ভাবলাম তুই ঘুম থেকেই উঠিসনি এখনো। কাল এতো রাত অব্দি আমার জন্য এতো কষ্ট করলি..." 

 -"আরে ধুর! তোর জন্য এইটুকু করবো না? তোর থাকতে কোনো অসুবিধা হবে না। তোকে ডিরেক্ট বাংলোতে নিয়ে যাচ্ছি। আগে ফ্রেশ হবি, রেস্ট নিবি। তারপর বিকেলে আমার বাড়ি নিয়ে যাবো।" 

 -"ঠিক আছে, আমার বিশেষ তাড়া নেই।" 

 আমার পোস্টিং নর্থ বেঙ্গলে হওয়ায় আবার কাছাকাছি হলাম আমার প্রিয় বন্ধুর সাথে। ও এখানেই একটা হাইস্কুলে জব করে। আর আমার রেডিও সেন্টারের এমপ্লয়ি হয়ে এখানে পোস্টিং। আমার এখানে আসার কথা শোনার পর থেকেই লিপীকা ভীষণ এক্সাইটেড। এই বাংলোটা লিপীকাই বুক করে দেয়। ওর এক পিসেমশাইয়ের বন্ধুর বাংলো এটা। তাই গতকাল ও-ই এসে চেক করে গোছগাছ সেরে রেখে গেছে। 

 গল্প করতে করতে গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। সামনে ছোট খাটো একটা বাগান। বাংলোটা বিশাল সেটা বাইরে থেকেই বোঝা যাচ্ছে। "বেশ সস্তা দামেই পে‌য়ে গেছি", মনে মনে বলে একটু মজা পেলাম। ঢুকেই বিশাল হল ঘর। 

 -"এতো বড় যায়গা তাই কাল যতটা পেরেছি করেছি। তোর বাসযোগ্য হবে এটুকু বলতে পারি।" 

 -"আহ্! আর কী চাই? এই বিশাল প্রাসাদ আর তোর আতিথেয়তা।" 

 -"সিঁড়ি দিয়ে উঠে এই পাশেরটা তোর বেডরুম। অ্যাটাচ্ড বাথরুম। আর ওই বাঁ'দিকেরটা তোর স্টাডি রুম হিসেবে রেখেছি। আর এইটা কিচেন।", বলে হাত দিয়ে ডানদিকের দরজাটা দেখিয়ে দিল। 

 -"এই, খাবার দাবার সব আছে তো?", ও যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই বললাম। 

 -"হ্যাঁ সব আছে। কিছু চিন্তা করিস না।", একটু থেমে বলল,"মানুষজন কেউ নেই এখানে। তোর মনের মতো একদম। আর পিছনে জঙ্গল। আমি তাহলে আসি। বিকেলে এসে নিয়ে যাব। বাই।" 

 ওর তাড়া দেখে আর আটকালাম না। স্কুলেও যেতে হবে ওকে। বিকেলে তো যাবই ওদের বাড়ি তখন জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। আন্টি আর আঙ্কেলকেও দেখবো অনেকদিন পর। ওনারা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আন্টি নতুন কোনো ডিশ বানালেই আমার সেদিন ওদের বাড়ি ইনভিটেশন থাকতো। ইনভিটেশন কেন বলছি? খাওয়ার ডাক পড়তো। নিজের মেয়ের মতনই দেখতেন আন্টি আমাকে। পুরোনো স্মৃতি মনে করতে করতে আমি বেডরুমে চলে গেলাম। 

 পরিপাটি করে গোছানো ঘর। আমার সেই এলোমেলো, পাগলি বন্ধুটি ঘরকন্নায় বেশ হাত পাকিয়েছে দেখছি। আমি নিজে একদমই গোছালো নই। 

 বেডরুমের জানলা দিয়ে পিছনের জঙ্গল দেখা যায়। দেবদারু গাছ ভর্তি। আসার সময়ও অনেক দেবদারু গাছ দেখেছি রাস্তার দু'ধারে। এ জন্যই বুঝি এমন নাম এ জায়গার। 

 আমি ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে কিচেনে গেলাম। খিদে পেয়ে গিয়েছিল খুব। ব্রেকফাস্ট টু ডিনার আমি যা যা খাই মোটামুটি সবই আছে। কাল রাতে সুপার মার্কেট থেকে গ্রসারি তুলে নিয়ে একবারে ঢুকেছে মেয়েটা। 

 কিচেনের সাথেই ডাইনিং রুম। অনেকটা জায়গা নিয়ে। বাংলোটা সুন্দর হলেও যে পুরোনো তা ঘরের দেওয়াল আর সিলিং দেখলেই বোঝা যায়। 

 এর মধ্যে একবার বাড়ি থেকে কল আসলো ঠিকঠাক পৌঁছেছি কিনা, খেয়েছি কিনা জানতে। খেয়ে নিয়ে বাংলোটা ঘুরে ফিরে দেখতে লাগলাম। এরম একটা বাংলোতে থাকার আমার বহুদিনের ইচ্ছে। অবশেষে সেটা সম্ভব হল। অবশ্য পুরো ক্রেডিটটাই লিপীকার। সস্তায় পাইয়ে দিয়েছে এতো সুন্দর বাংলোটা। 

 স্টাডি রুমটায় ঢুকলাম। স্টাডি রুম বলা যায় না যদিও। অবশ্য লিপীকা বলেছিল স্টাডি রুম হিসেবে রেখেছে, অর্থাৎ স্টাডি রুম আসলে নয় - বানিয়ে নিতে হবে। একটা সোফা আর ঘরের কোনায় একটা টেবিল। আসবাব আর কিছুই নেই। কেমন একটা বিষন্ন ভাব ঘর জুড়ে। দু-একটা ঝুলও দেখছি। হাপিয়ে গেছিলো বোধহয় ও পরিষ্কার করতে করতে। 

 সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁদিক ঘেঁষে মাঝ বরাবর আমার ঘরটা। আমার ঘর আর এই ঘরটা পাশাপাশি। এই ঘরটার সামনে আরো একটা ঘর আছে। ঘরগুলোর মাঝে কমন প্যাসাজ অর্থাৎ করিডর। এবং প্যাসাজটা গিয়ে ধাক্কা খেয়েছে আরেকটা ঘরের দরজায়। বাড়ির উভয় দিকেই একই স্ট্রাকচার। কিন্তু সব ঘরেই তালা ঝোলানো। তালাগুলো দেখে বেশ পুরোনোই মনে হল। তার মানে বহুদিন এ বাংলো অব্যবহৃতই পড়ে আছে। এতো সুন্দর বাংলো... খটকা লাগলো একটু। কিংবা এ-ও হতে পারে লিপীকার জন্যই আমায় সস্তায় ভাড়া দিয়েছে। নাহলে হয়তো ভদ্রলোক মোটা দাম হাঁকাতেন। 

 যা হোক। নিচের ঘরগুলোও একইভাবে সাজানো। কিচেন বাদে মোট ১৪টা ঘর আর দুটো হল ঘর। একা থাকার জন্য একদমই উপযুক্ত নয়। একটা ছমছমে পরিবেশ। যদিও একা বলেই এমন মনে হচ্ছে আমার। নিচের ঘরগুলোতেও তালা দেওয়া দেখে আর এগোলাম না। বরং বাইরেটা ঘুরে নেওয়া যাক। 

 বাগানটা ছোটো খাটো হলেও সাজানো। একদিকে একটা ছোটো দোলনা। আর অন্যদিকটা ফাঁকা। দুই-তিনটে কার পাশাপাশি পার্ক করা যাবে। তিনদিকেই ছোট-বড়ো গাছগাছালিতে ছেয়ে আছে। সবুজ আর সবুজ... কিছু গাছে আবার ফুলও ধরেছে। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। 

 বাংলোটার দুপাশে ফাঁকা, যেখান দিয়ে পিছনে যাওয়া যায়। বাইরে থেকে দেখে বুঝলাম আমার ঘরটার সামনের ঘরের বাইরে ব্যালকনি আছে। প্রথমে এসেই যে ব্যালকনি দুটো বাড়ির দু'পাশে দেখেছি। ব্যালকনিটা পেলে বেশ ভালো হতো। আমার ঘরে নেই। এ ব্যপারে আগেই লিপীকাকে বলা উচিত ছিল। যা হোক, পরে ওকে বলে মালিকের কাছ থেকে চাবি নেওয়া যাবে। 

 পিছন দিকটা বেশ অন্ধকার। লম্বা লম্বা গাছগুলোর মাঝে ডালপালা ছড়ানো গাছগুলো ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে ঘিঞ্জি পরিবেশ সৃষ্টি করছে। মাটির কাছে স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। গা ছমছমে একটা পরিবেশ। কেমন একটা গন্ধ। যেন বহু পুরোনো কোনো ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শরীরটা অবশ হয়ে আসছিলো দাঁড়িয়ে থেকে। কীরকম একটা অস্বস্তি হচ্ছিলো। দুটো চোখ যেন আমায় দেখছে। কিন্তু আমি চোখ দুটোকে দেখতে পারছি না। বেশিক্ষণ দাঁড়ালাম না। চলে এলাম। 

 পরশুদিন অফিস জয়েন করবো। কিন্তু কিছু কাজ বাকি আছে। সেগুলোই সারতে হবে এখন। আগে লাঞ্চ করার জন্য রান্না চড়ালাম। আমার আবার দুপুরে ভাত ছাড়া চলে না। লাঞ্চ করে আমার ঘরে চলে গেলাম। 

 কাজ করতে করতে ঝিমুনি আসছিল। যদিও দুপুরে ঘুমানোর অভ্যেস নেই, কিন্তু একা জার্নি করার জন্য রাতে ঘুমটা ভালো হয়নি। তাই একটু ঘুমিয়ে নেওয়াই ভালো। 

 ঘুম ভাঙলো একটা শব্দে। না, একটা শব্দ নয়। বেশ কয়েকটা শব্দ, অর্থাৎ শব্দগুচ্ছ। এবার অনুভব করলাম সেটা। চোখ খুললাম। ঝড় উঠেছে। আর ঝড়ের দাপটে জানলার পাল্লাগুলো ক্রমাগত খুলে বন্ধ হচ্ছে। দরজাটাও ওভাবে আছড়ে পড়ছে। আমি ধাতস্ত হতে হতে ঝড়টাও থেমে গেলো। হঠাৎ করে এসে হঠাৎ করেই চলে গেলো। যেন আমাকেই জাগাতে এসেছিলো। 

 উঠে চোখে মুখে জল দিলাম।লাইট জালালাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। জানলা বন্ধ না করলে মশা ঢুকে আমাকে নাজেহাল করবে। নতুন রক্ত খেতে ওরা খুব পছন্দ করে। জানলা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলাম আকাশটা তখনও নীলচে হয়ে আছে। মানে আকাশে মেঘ নেই। কেবল হাওয়া দিচ্ছিল তাহলে। যাক্, ওয়েদার নিয়ে ভাবতে হবে না। 

 আমি রেডি হয়ে নিলাম। লিপীকা এখনই এসে পরতে পারে। ওর বাড়িতে যাবো কতদিন পর। ওকে একটা সারপ্রাইজও দেওয়ার আছে। আঙ্কেল আন্টির সামনেই বলবো তাই ওকে আগে থেকে কিছু জানাইনি। নেক্সট মাসে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমারই অফিস কলিগ অনন্তর সাথে। বিয়েটা লাভ-অ্যারেন্জড যদিও। তাও লিপীকাকে সার্প্রাইজ দেবো বলে চেপে আছি ব্যপারটা। ও জানলে আমার ওপর খুব চোটপাট করবে আগে থেকে বলিনি বলে। আমারও ওকে না বলা পর্যন্ত শান্তি হচ্ছেনা। 

 বাড়ি পুরো অন্ধকার। লাইট জ্বালাতে হবে। দরজাটা হাওয়ায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আমি দরজা খুলে বেরোতে যাবো, থমকে গেলাম। সামনে দিয়ে আবছা ছায়ার মতো কী একটা সরে গেলো। হার্টবিটটা ক্ষাণিক কন্ট্রোলে এনে ফোনের ফ্ল্যাশটা জ্বাললাম। নাঃ, কোনোদিকে কিছু নেই। নিজেই নিজেকে দুয়ো দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলাম। যদিও সুইচবোর্ডগুলো লিপীকা দেখিয়ে দিয়ে যায়নি, ও জানে আমি ঠিক খুঁজে নেবো। 

 সুইচবোর্ডে হাত দিতে যাবো এমন সময় লোডসেডিং হয়ে গেল। আমার ঘরের আলোটাও নিভে গেলো। এই হচ্ছে সমস্যা। এরকম সময়ে স্মার্টফোনই ভরসা। কিচেনে ঢুকলাম। যদি কোনো ক্যান্ডেল বা কিছু লিপীকা রেখে গিয়ে থাকে। কিছুই চোখে পড়লো না। 

 অগত্যা নিজের ঘরে এসে টর্চটা বের করলাম। বাইরে একটা আওয়াজ শুনলাম। গেট খোলার। বোধ হয় ও এসে পড়েছে। টর্চ জ্বেলে এগিয়ে গেলাম। দরজা খুলেই সামনে গেট। এখনো গেটের শব্দটা পাচ্ছি। ক্যাঁচ্ ক্যাঁচ্। কিন্ত গেট তো বন্ধ। কেউ নেইও। বেরিয়ে আসলাম। বাঁদিক থেকে আসছে আওয়াজটা। বাঁদিকে টর্চটা ধরতেই অবাক হলাম। সেই দোলনাটা দুলছে। একা একাই। এক ফোঁটা হাওয়া নেই। তাও দোলনাটা দুলে যাচ্ছে। একবার সামনে আসছে। আরেকবার পিছনে যাচ্ছে। আমি এগিয়ে গেলাম সেদিকে। হাত দিয়ে একটা শিকল ধরলাম। মনে হল কেউ বসে বসে দোল খাচ্ছিলো। আমি ধরে থামিয়ে দিতেই সে নেমে গেলো। 

 এমন সময় কিচেন থেকে বাসনপত্রের আওয়াজ এলো। আমি ছুটে কিচেনে গিয়ে ঢুকলাম। সব বাসনপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। তীব্র আক্রোষে কে যেন খাবার আর মশলাপাতির প্যাকেটগুলো ছিন্ন ভিন্ন করে রেখে গেছে। 

 "আআআ!", একটা আর্তনাদ ভেসে এলো হল ঘরের দিক থেকে। আমি বেরিয়ে এলাম। আমার হৃদ্পিণ্ডটা ছটফট করছে। টর্চের আলোয় কোথাও কিছু খুঁজে পেলাম না। 

 জনবসতিহীন অঞ্চলে বিশাল বাংলোর মধ্যে একা একা আমি - ভয় হতে শুরু করেছে। লিপীকাকে একবার ফোন করা উচিত। ও আসতে এতো লেট করছে কেন? ফোনটা ঘরেই রেখে এসেছি। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে পা পিছলে গেলো। আমি টর্চ ফেলে দেখে চমকে উঠলাম। এ কি! রক্ত! রক্ত এলো কীকরে এখানে? রক্তের ধারাটা পিছনের হল ঘরের দিকে এগিয়ে গেছে। আমি তা অনুসরণ করে দরজার সামনে চলে এলাম। কী হতে পারে? কী আছে এ ঘরে? পুরোনো ধাঁচের হ্যাসবল্ট দিয়ে তালা ঝোলানো। কি-হোলে চোখ রেখে দেখার উপায় নেই। আমি তালাটা ধরে সামান্য নাড়লাম। কিছু হলো না। আরেকবার নাড়লাম,"কেউ আছেন?" 

 সঙ্গে সঙ্গে কাঁধে একটা শীতল হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে ঘুরে দাড়ালাম। নাহ্, এদিক ওদিক তাকিয়েও কিছু দেখলাম না। আমার হৃদযন্ত্রটা আবার অস্বাভাবিক গতিতে ছুটতে শুরু করছে। আমি দৌড়ে আমার ঘরে গিয়ে কল করলাম লিপীকাকে। রিং হচ্ছে। আর তার সাথে একটা আওয়াজ আমার কানে ভেসে আসছে। চাপা একটা আওয়াজ। এক তলা থেকেই আসছে আওয়াজটা। নাহ্ লিপীকা রিসিভ করলো না। আরেকবার কল করবো? আওয়াজটা এতক্ষণে থেমে গেছে। আবার কল করলাম। আবার সেই আওয়াজ। ফোনটা কানের কাছ থেকে সরালাম। একটা সন্দেহ আসছে মনের মধ্যে। আমি আস্তে আস্তে নিচে নেমে এলাম। আওয়াজটা বাড়ছে। বন্ধ হয়ে গেলো আবার। কল ড্রপ্ড্। রিকল করলাম। আবার রিংটোনটা বাজলো। এগিয়ে গেলাম শব্দের উৎস লক্ষ্য করে। 

 আমার স্টাডি রুমের সামনের ঘরের নিচের ঘরটা। দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। টর্চের আলো ফেলতে দেখলাম, তালাটা খোলা। দুপুরে এদিকটায় আসিনি বলে চোখে পড়েনি। রিংটোন থেমে গেছে। ফোন ধরা হাতেই ঠেলা দিলাম দরজায়। মরচে ভাঙা শব্দ করে খুলে গেলো সেটা। ফাঁকা, অন্ধকার ঘরের মাঝে একটা চেয়ার দাঁড়িয়ে আছে। ঘরটা ছোটো মনে হচ্ছে। আরো কিছু একটা আছে মনে হচ্ছে ওপরের দিকে। টর্চটা ওপরের দিকে ওঠালাম। 

 এ কি দৃশ্য! ফ্যানের সাথে দড়ি দিয়ে ঝুলছে, ওটা কার লাশ! ওই সাদা সর্ট ড্রেস, ওই জিন্সের জ্যাকেট। হ্যাঁ, এগুলো পরেই তো আমায় স্টেশন থেকে এখান পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো লিপীকা। 

 আমার গলা শুকিয়ে এসেছে। মাথা ঘুরছে। বাইরের দেয়াল ধরে নিজেকে সামলালাম। না, আর এক মুহুর্ত থাকা যাবে না। কে যেন অদৃশ্য হাতে লাশটাকে আমার দিকে ঘুরিয়ে দিলো। ওর চুলগুলো একটা চোখ ঢেকে এলোমেলোভাবে ঝুলছে। আরেকটা চোখে কী করুন দৃষ্টি। যেন আমায় ডাকছে। ওকে একা ফেলে যেতে না করছে। জিভটা এক হাত বেরিয়ে এসেছে ওর ঠোটের ফাঁক দিয়ে। আর দেখতে পাচ্ছি না। একটা খিলখিল হাসি যেন আমার মাথা চিঁড়ে দিচ্ছে। বশ করে দিচ্ছে আমায়। নাহ্ আমাকে পালাতেই হবে এ সবকিছুকে উপেক্ষা করে। 

 আমি দৌড়ে বেরিয়ে এলাম অভিশপ্ত বাংলো থেকে। হাসিটা আমায় সম্মোহিতের মতো ডাকছে বাড়ির ভিতরে। কানে হাত চেপে ছুটতে লাগলাম। নির্জন এলাকায় কার কাছে সাহায্য পাবো? ছুটতে লাগলাম ঊর্ধ্বশ্বাসে। 

 কতটা ছুটে এসেছি জানি না। হঠাৎ একটা আলো চোখে পড়লো। আলোটা এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আহ্! আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। গাড়িটাও দাঁড়িয়ে পড়লো। গাড়ি থেকে দু'জন নেমে এলো। এরা পুলিশ। 

 -"স্যর, স্যর প্লিজ হেল্প, হেল্প মি স্যর!!" 

 -"আরে কী হয়েছে সেটা বলুন আগে।", আমার উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণের উত্তরে বললেন ওঁরা। 

 -"স্যর লাশ, খুন, সুইসাইড... আমি জানি না স্যর। আমাকেও মেরে ফেলবে স্যর! স্যর বাঁচান!", আমার গলা চিঁড়ে কান্না বেরিয়ে আসছে। 

 -"আমার লিপীকা কই?", হঠাৎ চেনা একটা গলা শুনে তাকালাম গাড়ির পিছনের দরজায়। আ-আন্টি! 

 -"জল।", কোনোমতে বললাম। 

 জল খেয়ে একটু ঠান্ডা হলে ওদের গাড়িতে উঠলাম। বাংলোতে যেতে যেতে বললাম পুরো ঘটনাটা। লিপীকার মা ভেঙে পড়েছে। আঙ্কেলের মুখে শুনলাম লিপীকা কাল কোথায় যাচ্ছে তা বাড়িতে বলে বেরোয়নি। সন্ধ্যায় মাঝেমধ্যেই বেরোয়। কালও তেমনই বেরিয়েছিলো। বলেছিলো রাত হতে পারে তাই চিন্তা না করতে। রাতে কল করলে রিসিভ করেনি। ওনারা জানতেনও না যে ও বাংলোতে এসেছে। 

 আমার সাথে কাল রাতে কথা হয়েছিলো ১০:৩০টা নাগাদ। সকালে ওকে ফোনে পাইনি। কিন্তু আমাকে পিক আপ করে এখানে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিলো। একথা জানাই আমি ওনাদের। 

 এতক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। রক্তের কোনো চিহ্ন নেই সেখানে। পুলিশ ডেডবডি নামালো। রয়গর মর্টিস ধরেছে। হত্যা কিংবা আত্মহত্যা অনেক আগেই হয়েছে। ফরেন্সিক রিপোর্ট আসলে কিছুটা ধোঁয়াশা কাটবে। 

 আমাদের থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। সন্দেহের তালিকায় আছি শুধু আমি। বাংলোর মালিক আর অন্যরাও থানায় হাজির হয়েছে। আমাকে জেরা করা হলে আমি বারবার একই কথা বললাম। বাংলোর মালিক মিঃ মাথুরকে একটু নার্ভাস লাগছিলো। কিছু একটা যে লোকাচ্ছেন তা আর কেউ না হোক আমি বুঝেছি। কী লোকাতে চাইছে লোকটা? 

 মিঃ মাথুরকেও পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। উনি যা জানালেন তাতে বোঝা গেলো, লিপীকা আগেরদিন চাবি নিতে গেলে উনি বলেছিলেন উনি ঘর ঠিক করার জন্য লোক পাঠাবেন। কিন্তু লিপীকা কিছুতেই রাজি হয় না আর চাবি নেওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে থাকে। অবশেষে মাথুর লিপীকাকে চাবি দিয়ে দেয়। কিন্তু ও এমন কাজ করবে উনি ভাবতেই পারেনি। 

 ফরেন্সিক রিপোর্ট আসলে জানা গেলো লিপীকা কাল রাতেই মারা গেছে ১১-১২টার মধ্যে। নাহ্, অঙ্ক মিলছে না। তাহলে সকালে... সব গুলিয়ে যাচ্ছে। 

 আমি রাতে ট্রেনেই ছিলাম তার প্রমাণ পেলে পুলিশ আমাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু আঙ্কেল আন্টি শেষ পর্যন্তও আমাকে বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি হয়তো। 

 আমি ওই বাংলোয় আর ফিরে যাইনি। পরে আমাকে অফিসের একটা কোয়ার্টারে রুম শেয়ার করে থাকতে হয়। 

 সেদিনের সেই ঘটনা আমি আজও ভুলতে পারি না। লিপীকার সেই ঝুলন্ত শরীরটা। ও কি সত্যি সুইসাইড করেছিলো? কিন্তু ও তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তাহলে আমার সাথে এমন করলো কেন? নাকি ওই বাংলোয় অন্য কিছু ছিলো? যার জন্য আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ওর প্রিয় মানুষদের ছেড়ে এতো দূরে চলে গেলো! আর আমিও যদি ওই বাংলোতে আরো কিছুক্ষণ থাকতাম, তাহলে হয়তো আমাকেও... কিন্তু তাই-ই যদি হয়, সকালে লিপীকা আমায় কেন নিয়ে গেলো সেখানে, যেখানে আমার বিপদ; তাও বিন্দুমাত্র সতর্ক না করে? 

 আর ওই ঘরটা। কী ছিলো ওই ঘরে? কী ঘটেছিলো সেই রাতে? সত্যিটা আসলে কী? প্রশ্নগুলো আজও তাড়া করে বেড়ায় আমায়। কিন্তু এসবের উত্তর আমি খুঁজে পাই না এখনও। 

 

 

চার বছর পর... 

 

 পরে জেনেছিলাম ওই বাংলোটা হন্টেড ছিল। এক ব্রিটিশ সাহেবের বাংলো ছিল ওটা। এক বল পার্টির রাতে সে খুন হয়েছিল তার প্রেয়সীর প্রতারণায়। মিঃ মাথুর সে ঘটনা জানতেন বলেই বোধহয় সেদিন বারণ করেছিলেন লিপীকাকে সেই বাংলোতে যেতে। 

 কিন্তু আজ আমি অনন্তর কলেজের ছবি ঘাটতে গিয়ে একটা ফোটোতে আটকে যাই। অনন্তর সাথে একটা মেয়ের একাকী ছবি। অনন্ত তাকে দু'হাতে জড়িয়ে আছে আর তার মাথা অনন্তর বুকে। মেয়েটি আর কেউ না। আমারই হারিয়ে যাওয়া সবচেয়ে কাছের বন্ধু লিপীকা। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror