লেপচা রাজা গ্যাবো আচুক
লেপচা রাজা গ্যাবো আচুক
কালিম্পঙ শহর থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে ছোট্ট পাহাড়ি শহর আলগাড়া। আর সেখান থেকে পেডং যাবার পথে বাঁদিকে অনেকটা ট্রেক করে যাওয়া যায় দামসাং গড়ে। এই দামসাং গড়ের ভগ্নাবশেষে লুকিয়ে আছে এদেশের দামাল পাহাড়ি উপজাতি লেপচাদের এক অনন্য গল্পগাথা। খানিকটা ইতিহাস আর খানিকটা কল্পনার মিশ্রণ এই গল্পে। অবিশ্যি ভুলেও কোনো লেপচাকে যেন না বলা হয় যে এই গল্পে কল্পনার বেশ জায়গা আছে। তাদের কাছে এই গল্প ইতিহাস বটে। আর তাদের বীরত্ব, ত্যাগ আর দুঃখের দলিল। আজও প্রতি বছর ডিসেম্বরের ২০ তারিখে লেপচারা এই দামসাং গড়ে হাজির হয় তাদের ইতিহাসের সেই সুবর্ণ সময়কে শ্রদ্ধা জানাতে। তাদের শেষ স্বাধীন রাজার প্রতি প্রণাম জানাতে। ইতিহাস বড়ই নিষ্ঠুর আর একপেশে । তাই আজও সাধারণ মানুষের কাছে পৌছায় নি লেপচাদের সেই কাহিনী।
সময়টা ১৬৬৪ সাল। তৎকালীন ভারতের পূর্ব প্রান্তে তখন মহাপরাক্রমশালী লেপচা রাজত্বের রমরমা। সেবছর অভিষেক হল লেপচারাজা গ্যাবো আচুকের। রাজার যেমন বিক্রম তেমনি তার প্রজাবাৎসল্য। কোন গরীব প্রজার দুঃখে যেমন তিনি মুক্ত হস্তে দান করেন তেমনি কারো অপরাধে তাকে দেন ভয়ংকর শাস্তি। কথিত আছে তিনি তিনি নাকি ভুডুইজম বা প্রেততত্ত্ববিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। যাকে বলে কালো জাদু। নিজের সমস্ত শত্রুকে নাকি এই কালো জাদুতে মেরে ফেলতেন তিনি। আর এই কালো জাদুতেই লেপচা তখতে বসার সব প্রতিযোগীকে গায়েব করে শেষমেশ তাঁর অভিষেক হয় বিরাট ধূমধামের সঙ্গে। লেপচারা বিশ্বাস করে তাঁর নাকি প্রহরীদের একটা দল চালাত ভূতেরা। আর সেই ভূতের দলকে নিয়ে তিনি সুউচ্চ আলগাড়া পাহাড়ের চূড়ায় বানান এক অত্যাধুনিক দূর্গ যার নাম দামসাং গড়হি। একদিকে এই দুর্গ যেমন সুরক্ষা দিত ভেতরের রাজপ্রাসাদকে তেমনি দুর্গের নজরকুঠুরি থেকে লক্ষ্য করা হত সারা রাজ্যের প্রজাদের গতিবিধি। এই রাজপ্রাসাদের চোরাকুঠুরিতে নাকি থাকতো তাঁর সেই ভূতের দল। সমালোচকেরা বলেন, প্রতিমাসের অমাবস্যার রাতে তিনি কালো জাদুতে তাঁর শত্রুদের মেরে তাদের মাথা দিয়ে নাকি নৈশাহার সারতেন। অবশ্য এটাও কথিত আছে তিনি ছিলেন তৎকালীন উত্তর-পূর্ব ভারতের সেরা মল্লযোদ্ধা। আর এই মল্লযুদ্ধে শত্রু দুয়াচিংকে হারিয়ে তাঁর অপূর্বসুন্দরী মেয়ে নালিমিতকে বিয়ে করেন তিনি। নালিমিত হন পানো অর্থাৎ রাজা গ্যাবো আচুকের সহধর্মিনী পুন্ডি অর্থাৎ রানী। পানো - পুন্ডির সম্পর্ক আজও লেপচাদের লোকগাথাতে অমর- দাম্পত্যপ্রেম ও ত্যাগের প্রতীক হয়ে। লেপচাদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রচলিত থাকলেও পানো গ্যাবো আর বিয়ে করেননি।
সেসময় লেপচাদের প্রধান শত্রু ছিল ভুটানি রাজা নামগিয়াল ডুকপা। ডুকপারাজার নেতৃত্বে বারংবার লেপচাদের উপর আক্রমণ হানা হচ্ছিল। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌছায় গ্যাবো ১৬৬৮ সালে তিব্বতে যান পঞ্চম দালাই লামার সাহায্য চাইতে। যাই হোক বারংবার আঘাত হেনেও পর্যুদস্ত হয় ডুকপারা। বেশ কয়েকবার যুদ্ধ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে তাঁদের। এক যুদ্ধে নাকি গ্যাবোর হাত পর্যন্ত কাটা যায়। কিন্তু জাদুবলে তৎক্ষণাৎ হাত গজিয়ে যায় তাঁর। আর তা দেখে ভয়ে পিছু হটে ভুটানিরা। শেষে গ্যাবোর কাছে শান্তির প্রস্তাব পাঠান ডুকপারাজা। আবেগপ্রবণ রাজা সাদরে গ্রহণ করেন প্রস্তাব। যুদ্ধবিরতি হল অবশেষে। দুরাজ্যে ফিরল শান্তি। আর রাজাকে ভুটানে নিমন্ত্রণ জানালেন ডুকপারাজা নামগিয়াল। রানীর অমত থাকলেও সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেন আবেগপ্রবণ রাজা গ্যাবো। তারপর ভূতেদের কাছে রানী নালিমিতকে রেখে সৈন্যসামন্ত নিয়ে রওনা হন ভুটানে। সেখানে দুদিনব্যাপী চলতে থাকলো শান্তিউৎসব। রাজার সম্মানে চলল মহাভোজ। খানাপিনায় ডুবে গেলেন আচুক আর তাঁর সৈন্যরা। রাজা নিজে মদ্যপ হয়ে নামগিয়ালকে জড়িয়ে ধরলেন। তৎক্ষণাৎ তাঁর মাথার উপর নেমে এল তরবারির আঘাত। মুন্ডু ধড় থেকে আলাদা হয়ে গেল। যাতে জাদু দিয়ে মাথা জোড়া না লাগাতে পারেন, ধড়ে দিয়ে দেওয়া হল ছাই। রাজার কাটা মুন্ডু লাগল চিৎকার করে রানী নালিমিতের নাম নিতে লাগল।ছটফট করতে করতে শেষমেশ নিশ্চুপ হয়ে গেলেন শেষ লেপচা রাজা গ্যাবো আচুক। তাঁর সমস্ত সৈন্যকে বন্দি বানানো হল। আর তাঁদের চোখের সামনে চেল নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হল তাঁদের প্ৰিয় রাজার দেহ। খবর পৌঁছাতে দামসাং এ নেমে এলো শোকের ছায়া। দুঃখে দামসাং পাহাড় থেকে নিচে ঝাঁপ দিলেন রানী নালিমিত। তাঁর দেহ যখন পড়ছিল সেটা নাকি দেখে একটা কালো শিংওয়ালা হরিণ। আর আজও নাকি প্রতি অমাবস্যায় সেই পাহাড়ের নিচের জঙ্গলে শোনা যায় সেই কৃষ্ণমৃগের আর্তনাদ। আর সেই জঙ্গল আজ পরিচিত রাণীবন নামে। আলগারার একদম কাছেই সিল্লারি যাওয়ার পথে এই বনদর্শন করেন লেপচারা রানীমার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।
এরপর ভুটানিরা দখল করে দামসাং গড়। লেপচারা স্বাধীনতা হারায়। প্রায় পৌনে দুশো বছর রাজত্ব চালানোর পর অবশেষে ১৮৬৪ সালে ইংরেজদের হাতে পরাস্ত হয় তারা। ব্রিটিশ কামানের গোলায় ধ্বংস হয় একসময় লেপচাদের শান দামসাং গড়হি।
কথিত আছে রাজার দেহের কিছু অংশ শেষপর্যন্ত পাওয়া যায় গরুবাথানের নিকটে চেলনদীর উপর। তাই আজও এখান দিয়ে যাওয়ার সময় ভুটানিরা নতজানু হয়ে, মাথার টুপি খুলে ডান হাত মাথায় ঠেকিয়ে আচুকরাজাকে শ্রদ্ধা জানায় আর নিজেদের পূর্বপুরুষের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ক্ষমা চায়।
ইতিহাসের পাতায় স্থান না পেলেও লেপচাদের হৃদয়ে চিরঅমর পানো গ্যাবো আচুক আর পুন্ডি নালিমিত।