Saptarshi Nag

Drama Crime Thriller

4.0  

Saptarshi Nag

Drama Crime Thriller

সুরুচি হোটেল

সুরুচি হোটেল

5 mins
197


(বিঃ দ্রঃ - সব চরিত্র কাল্পনিক নয়)

এই বিরাট শহরে আদ্যোপান্ত বাঙালি ভাতের হোটেলের অভাব নেই | কিন্তু স্বাদ, আপ্যায়ন, পরিচ্ছন্নতা সবমিলিয়ে পাইকপাড়ার সুরুচি হোটেলের জুড়ি মেলা ভার | অনাদিবাবু আর স্ত্রী বকুল দুজনে মিলে ভারি যত্নে চালান হোটেল | দামটা একটু বেশি বইকি! কিন্তু এমন স্বাদু খাওয়ার পেলে খদ্দের বারবার আসতে বাধ্য | সবজি, মাছ, ডিম সবকিছুরই প্রচুর চাহিদা থাকে | আর, সুরুচি হোটেলের মাংস যারা একবার খান, আবার আসতে হবেই তাদের | আহা, সে কি স্বাদ! তেল, মশলা সব পরিমাণমতো | এক প্লেটে চার পিস মাংস থাকে | দাম ঠিক দুশো টাকা | তাতে কি? মাংস, হার, ঝোল সব চেটেপুটে খায় খদ্দেররা | তেমনই লাজবাব এখানকার মেটে চচ্চড়ি ও | প্রতি প্লেট দেড়শো টাকা | আর মাছের মধ্যে ইলিশ, চিঙড়ি তো আছেই | মাথা দেওয়া মুগডাল আর মুড়িঘন্টের ও চাহিদা ব্যাপক |


ভোরবেলা উঠে বকুল রান্নায় লেগে যায় | আর অনাদিবাবু বাজার করা, আনাজ কাটা ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকেন | মোটামুটি সাড়ে এগারোটা নাগাদ রান্না শেষ হয় | বারোটা থেকেই শুরু হয় খদ্দেরদের ভিড় | চাকুরীজীবি, ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ী কে নেই খদ্দেরের তালিকায় | ভিড় চলতে থাকে প্রায় বিকেল অবধি | তারপরেই দোকানের ঝাঁপি নামান অনাদি | একটা ছেলেকে রেখেছেন টেবিলে খাওয়ার দেওয়া, বাসন মাজা ইত্যাদির জন্য | সে চলে আসে খদ্দের ঢোকার আগেই | তারপরে অনাদি বসে পড়েন হোটেলে ঢোকার মুখেই কাউন্টারে | কাউন্টারের উপরে মা কালির একটা বহু পুরানো ছবি | নিয়ম করে রোজ তা পূজো করেন অনাদি | তার ঠিক পাশে একটা বাংলা ক্যালেন্ডার | কাউন্টার পেরিয়ে লম্বা ফুট বিশেকের জায়গা | চওড়া হবে ফুট আষ্টেক বড়জোর | মোটামুটি ছটা টেবিলে একসঙ্গে চব্বিশ জন খেতে পারেন | টেবিলগুলোর শেষে একটা ছোট্ট হাত ধোয়ার বেসিন | বেসিনের উপরের দেয়ালে একটা লম্বাটে ব্ল্যাকবোর্ড | সেখানে চক দিয়ে খাবারের তালিকা আর দাম লিখে রাখা হয় | আর তার পাশে সুরুচি হোটেলের হেঁশেল | যেখানে বকুল ব্যস্ত থাকে রান্না, প্লেট সাজানো ইত্যাদি হরেক কাজে | যদিও দিনের খাওয়ার দিনেই শেষ হয়, অনাদিবাবু তাও একটা পেল্লায় ফ্রিজ রেখেছেন | কখন কোন কাজে লাগে! রান্নাঘরের পাশেই দু'কামরার ঘর অনাদিদের |


রোজকার মতো আজও ভোরবেলা অনাদি চলে গিয়েছিলেন ডাকের বাজারে মাছ নিতে | মানে যেখান থেকে খুচরো বিক্রেতারা মাছ নেয় | টাটকা পার্শে, পাবদা আর গলদা চিংড়ি পাওয়া গেল | তরিতরকারি কাল রাতেই কেনা আছে | আলু, পেঁয়াজ, আদা, রসুন এসবও রাতেই কেটে রাখেন অনাদি | দিনের কাজটা কিছুটা এগিয়ে থাকে আর কি! হোটেলে ফিরে দেখছেন এরই মধ্যে ডাল, ভাজা হয়ে গেছে | মাংস ও চেপে গেছে | বকুলকে দেখে ভারি মায়া হল তার | উনুনের সামনে ঘেমে নেয়ে গেছে বেচারি | বয়স ও তো কম হল না | পঞ্চাশ ছাড়াতে চলল | অনাদির বয়স এখন ছাপ্পান্ন | বিয়ে হয়েছে প্রায় ঊনত্রিশ বছর হল | ছেলেপুলে হয়নি | বকুলের তিন কূলে কেউ নেই | অনাথ মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেন বাবা পাঁচকড়ি | বাবা - মা দুজনেই গত হয়েছেন বছর দশেক আগে | গিয়েছিলেন তীর্থ করতে অমরনাথ ধামে | সেখানে নাকি ভারি বর্ষায় সব তলিয়ে যায় | বহু লোক মারা যান | বহু লোক নিখোঁজ | বাবা -মা'র কোনো খোঁজ মেলেনি | সুরুচি হোটেল অবশ্য বছর বিশেকের পুরোনো |


'তুমি বাপু মাছগুলো ধুয়ে দাও | আমি মশলা বেঁটে রেখেছি | মাংসটা হলেই মাছ বসাবো |', শাড়ির আঁচলে কপালের ঘাম মুছে বলল বকুল |

' আহা! কি গন্ধ বেরিয়েছে গো মাংসের | আজকাল কি ওসব হোটেল উঠেছে, একগাদা দাম নিয়ে ছাইভশ্ম খাওয়ায় | আর আমার গিন্নির রান্না! আহা! মনে হয় আঙ্গুলগুলোই খেয়ে নি |'

' এবার থামো তো দিকি | বুড়ো মিনসের ন্যাকামির সীমা নেই | সোহাগের ঘটা! আজ এত আহ্লাদ কেন বাপু? চা লাগবে বললেই হয় |'

'আহা, নিজের বৌকে একটু ভালোমন্দ বলবো না নাকি? দাও দাও একটু চা চাপিয়ে দাও দিকি | আমি বরং মাছগুলো ধুয়ে নুন হলুদ মাখাই | যা পেল্লায় চিংড়ি পেয়েচি না, এই দেখো |'

' আচ্ছা ঠিক আছে | যাও এবার বাপু সরো, মাংসতে একটু গরম মশলা দিই |'


সাড়ে এগারোটা নাগাদ কাজের ছেলে রবীন হাজির | ওকে দিয়ে টেবিল চেয়ার গুছিয়ে, সব টেবিলে স্টিলের বড় বাটিতে লেবু, লঙ্কা আর পেঁয়াজ রেখে হাঁক পারলেন অনাদি

'কি গো সব তৈরি তো? '

' আজ কি হয়েছে গা তোমার? আমার কাজ সারা কখন! এবার তুমি খদ্দের সামলাও |'- হেঁশেল থেকে জবাব এল |

শুরু হল খদ্দের আসা | প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব খদ্দেরকে একই রকম আপ্যায়ন করেন অনাদি | খদ্দের ঢুকলে একটা নমস্কার করেন, পরিচিতকে কুশল জিজ্ঞেস করেন | আর খদ্দের বেরোনোর সময় মিছরি-মৌরির বাটি এগিয়ে একগাল হেসে জিজ্ঞেস করবেন ' খাওয়ার ঠিক ছিল তো?'

রান্না তো বটেই, এই ব্যবহার ও দোকানে সারাক্ষণ ভিড় লেগে থাকার আরেকটা কারণ বটে | তার উপর আবার পুরানো খদ্দেরদের সঙ্গে একেবারে বাড়ির লোকের মতো খোশগল্প |

আজ যেমন পাশের আর.জি কর হোস্টেলের ডাক্তারির ছাত্র শুভদীপকে জিজ্ঞাসা করলেন, ' আরে ডাক্তারবাবু, সঙ্গে যে মিষ্টিমতন মেয়েটি আসতো কিছুদিন তাকে দেখছি না যে |'

' কি যে বলবো কাকু, দু'দিন ধরেই বেপাত্তা ও | পুলিশ খুঁজছে | কিন্তু কোনো খোঁজখবর নেই '- একটা মাংস চিবোতে চিবোতে করুণসুরে জবাব হবু ডাক্তারের |

দীর্ঘদিনের খদ্দের পরিমলবাবু এসেই জিজ্ঞেস করলেন, 'মেটে চচ্চড়ি আছে না শেষ?'

মুচকি হেসে চাপা গলায় অনাদির জবাব, ' সরকারি বাবুর খেয়াল না রাখলে আমার দোকান থাকবে নাকি? এক বাটি সরিয়ে রেখেছিলাম | মন বলছিল আজ আপনি আসতেও পারেন |'

গলে গেলেন পরিমল |

একটু দূরের পোস্টঅফিসের বেয়ারা রমেন এক ঢাউস টিফিন বাটি নিয়ে হাজির | বাবুদের জন্য মাংস নিতে | ওকে জিজ্ঞাসা করলেন, ' কি রমেন? আপিসের খবর কি? বড়বাবু আর সেই মেয়েটার ইয়েটিয়ে চলছে নাকি এখনো?'

'আর ওসব খবর! নিজের মালপানির আমদানি বন্ধ এক নতুন সাহেব আসাতে | কি যে হবে?'


এমনি করে দিন এগোতে থাকে | মোটামুটি পাঁচটা নাগাদ সব রান্নাবান্না শেষ হলে দোকানের ঝাঁপ নামিয়ে,রবীনকে বাসনপত্র ধুতে বসিয়ে হিসাবের খাতা নিয়ে বসলেন অনাদিবাবু | বকুল একটু জিরিয়ে নিতে গেল | ঘন্টাখানেক পর, রবীনকে বিদায় দিয়ে কোমরের চাবির গোছাটা থেকে একখানা চাবি বের করলেন অনাদি | বকুল উঠেছে সবে | কালকের মাংস, মেটে সব মাখিয়ে রাখতে হবে নুন -হলুদ -তেলে | ক্যালেন্ডারে আজকের দিনটা দাগিয়ে রাখলেন লাল কালি দিয়ে | এই দিনেই তো মা -বাবাকে... যাক গে |


এরপর গুটি গুটি পায়ে অনাদি এগোলেন চওড়া ফ্রিজটার দিকে | উপর থেকে খোলে এটা, সাধারণ ফ্রিজের মতো লম্বালম্বি না | চাবি দিয়ে মুখটা খুলতেই চকচক করে উঠল অনাদির চোখ |

ফ্রিজের ভেতরে একটা কাটা পা | বরফ জমে শক্ত হয়ে আছে | গড়ন বলে দিচ্ছে কোনো তরুণীর হবে | গত রাতের কথা ভেবে অনাদির শরীরে শিহরণ জাগছে | পাশে বকুল এসে একখানা করাত বাড়িয়ে দিল ওর হাতে | ফ্রিজের এককোণে বরফের ফাঁক থেকে উঁকি মারছে একটা মেয়ের কাটা মাথা | চোখদুটো খোলা | যেন অনাদি আর বকুলকে কিছু বলতে চাচ্ছে |


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama