Prof Ajoy Kumar Basu

Classics Inspirational Others

4  

Prof Ajoy Kumar Basu

Classics Inspirational Others

লেখক হবার পাগলামি

লেখক হবার পাগলামি

20 mins
156


আমি লিখতে ভালোবাসি। জীবনভোর কয়েক হাজার রিপোর্ট , বিশ্লেষণ , মতামত , রিসার্চ বিবরণ ,ব্যক্তিগত চিঠিপত্র লিখেছি। কিছু কিছু ছাপা হয়েছে সংবাদ পত্রে ,জার্নালে, বইতে, বিভিন্ন সংগঠনের প্রকাশনীতে। সবগুলো কিন্তু বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি আধারিত , বিকাশ সম্বন্ধীয় -মোটামুটি নতুন আবিষ্কার আর নতুন কাঠামো তৈরীর জন্য।

তাই বলে আমি কিন্তু লেখক হয়ে উঠিনি , গল্প, কবিতা, নাটক ,নভেল লেখবার চেষ্টা করিনি। এই প্রবীণ বয়সে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি লেখক হতে , এমন লেখক যার লেখা অনেকে পড়বে , লেখা নিয়ে তর্ক করবে, কয়েকজন অনুপ্রাণিত হবে। মোটামুটি শরৎচন্দ্র , বঙ্কিমচন্দ্র না হলেও , চন্দ্রের আলো না থাকলেও একটা প্রদীপের আলো জ্বালাবার স্তরে পৌঁছবার প্রচেষ্টা।

আমার এই পরিবর্তন একদিন হটাৎ হয় নি। মা সরস্বতী এসে বলেনি এখন থেকে তোমার ডট পেনের সামনে আমি বসলাম। বেশ কবছর ধরে প্রাকটিস করছি , ফেল করছি , মুখ থুবড়ে পড়ছি , কিন্তু লেখা থামাই নি। অনেক বার কাঁদতে হয়েছে , তবে বার কতক আনন্দ ,মজা আর খুশির ছোঁয়াও পেয়েছি। আমার এই অসাধারণ অধ্যবসায় বুঝতে গেলে আমাকে জানতে হবে; তার মানে এই নয় যে আমার মুখশ্রী , গায়ের রং , আমার পূর্বপুরুষদের গুণাবিবরণ জানার দরকার।কিন্তু আমার মানসিকতা , আমার স্বপ্ন ,আমার জীবনদর্শন এগুলো সম্বন্ধে মোটামুটি একটা আন্দাজ থাকলে আমার উদ্ভ্রান্ত লেখার মধ্যে কিছু অর্থ , কিছু সাহিত্য রস পাঠকেরা পাবে , অন্তত আমার সেইরকম মনে হয়।

আমার বিশ্বাস আমি গতানুগতিক নোই ; তবে ঠিক অপ্রকৃতিস্থ যার মনোবৈজ্ঞানিকের সাহায্য দরকার ,সেই স্তরের নোই। তবে হ্যাঁ ,আমি মেষ শাবক নোই যে একজন কিছু বললো আর আমি সেটার পেছনে অন্ধ হয়ে চলবো। আমার কাজ নতুন কিছু আবিষ্কার করা , নতুন বস্তু ,নতুন ধারা ,নতুন প্রণালী আর সেগুলো তাদেরই জন্যে যাদেরকে সমাজ বলে পারবে না, লেখাপড়া নেই , মাঠে ঘাটে কাজ করে ,দূর দূর গ্রামে থাকে। আমার এই যাত্রার শুরু হয়েছিল অনেক বছর আগে - 

ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রদের বলতাম, তোমরা তো অন্যকে জীবন পথে যাবার পথ দেখাবে আর সেটা ভুলে চাকরির জেলখানাতে নিজেদের বন্দি করছো? কেন্দ্রের সরকারকে বোঝাতাম ,আমাদের গ্রামগুলোকে তাড়াতাড়ি এগোতে হবে, অনেক পিছিয়ে আছে ,তাই চাই টেলিভশন, চাই কম্পিউটার যাতে সবচেয়ে কম খরচে ভালো শিক্ষক ,ভালো শিক্ষা গ্রামের ভাঙা স্কুলে পৌঁছতে পারে। বলতাম ,খুব তাড়াতাড়ি গ্রামে গ্রামে ব্যাঙ্ক আনতে হবে আর তাদের চালানোর জন্যে কম্পিউটার , বায়ো মেট্রিক পরিচিতি চালু করতে হবে ; এগুলোর অধিকাংশ ওপরের মহলের পছন্দ হতো না। সবাই বোঝাতো টাকা নেই।

আমি বুঝেছি অভাব টাকার নয় ,অভাব আত্মবিশ্বাসের। যারা একটু ওপরে উঠেছে , তাদের চিন্তা তাদের কাজ অন্যেরা নিয়ে ফেলবে ,তাদের ছেলেমেয়েদের অনেকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। তাই অন্যদের আগে চলবার রাস্তাটা বন্ধ করতে হবে। এটাই তো ভারতের বহু পুরোনো রোগ। আর্যভট্টর পর কয়েকশো বছর বাদে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের গণিত আবার ভারতকে পৃথিবীর সামনে এনেছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে নামী পাঁচটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তিনটে ছিল এই ভূখণ্ডে। গত হাজার বছরে বহু দেশে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হয়েছে ,ভারতে একটিও নয়। শিক্ষার এই অধঃপতন এক মুর্খ দুৰ্বল রাজা শুরু করেছিলেন। তিনি আদেশ দিলেন বাবার পরিচয় ছেলের পরিচয়। রাজার ছেলে রাজা , চাষার ছেলে চাষা , দোকানির ছেলে দোকানি। শুরু হলো এক অঘটন। যারা চিন্তা করতে পারে তারা হাতে কাজ করবে না.যারা খেতে কাজ করবে তারা লেখাপড়া শিখতে পারবে না। ইলেকট্রিক বাল্বের আবিষ্কর্তা এডিসন বলেছেন একটা নতুন আবিষ্কারের জন্যে দরকার ৯৫% কাজের কুশলতা আর ৫% জ্ঞান। দুটোকে আলাদা করে ভারত নতুন রাস্তার সন্ধান বন্ধ করে দিল। এর পর কর্ম করতে অক্ষম পন্ডিতেরা ইতিহাস লিখলেন ,সমাজের আইন বানালেন যাতে তাদের জায়গা উঁচুতে থাকে। দুর্বল ভারত সব বাইরের লোকেদের খেলবার জায়গা হলো। এমনকি আর্যভট্টর পরিশ্রমটাকে মুছে দেওয়া হলো ,তিনি যা করেন নি সেই সব তত্ত্ব তার নামে চালানো হলো আর যেটা করেছেন বহু পরিশ্রমের মাধ্যমে মানুষ সেগুলো ভুলে গেল। সবচেয়ে দুঃখের কথা ভারতের লোক প্রশ্ন করবার সাহস হারিয়ে ফেললো ,নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে গেল। এই মানসিক মহামারী এখনো চলছে। প্রশ্ন করা সমাজের চোখে ঔদ্ধ্যত্য ,শত্রুতার প্রকাশ মানা হয়।


এর ঠিক বিপরীত চিন্তা আমার। আমি স্বপ্ন দেখি আমার ভারতবর্ষ এক বৈজ্ঞানিক দেশ; প্রতিটি ভারতবাসী বৈজ্ঞানিক সম্মত চিন্তা এবং বিশ্লেষণ করছে। পরিবেশ বুঝে নিজের কৰ্তব্য -কৰ্ম ঠিক করছে। আর কুশল ভাবে সেই কাজ করছে। আর তাই আমার নিজের কাজ আমি বেছে নিয়েছি : আমি চেষ্টা করেছি যাতে অবহেলিত ভারতবাসী যেন জ্ঞান ভাণ্ডারে পৌঁছতে পারে আর কাজ করবার কুশলতা প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত না হয়। 

আমার মনের মধ্যে কয়েকটা প্রশ্ন বারবার যন্ত্রণা দিতে থাকে। আমরা তো একটা স্বাধীন দেশ ; তবু কোনো আমাদের অধিকাংশ ,গরীব ,ধনী ,শিক্ষিত অশিক্ষিত সবাই নিজেদের দাস ভাবে ? প্রশ্ন করাকে কেন অসম্মান করা ভাবে ?,এমনকি অনেক সময়ে বিদ্রোহ চোখে দেখে ? আমাদের দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান - টেকনলজি শিখে কেন আলুভাজা , বেবিফুড বিক্রির কাজ করে ? আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি চিনি আর সাইকেল বানাই , তবুও আমাদের সাইকেল সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানের কেন? কেন আমাদের প্রতি একরে চিনির উৎপাদন সবচেয়ে কম ? আমরা সবচেয়ে বেশি মোবাইল ব্যবহার করি ,কম্পিউটারের সংখ্যাও কম নয় , তবুও এগুলোর সবকিছু বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় ,আমরা কিছু বানাই না ,শুধু জোড়ার কাজটা করি। কিন্তু কেন ?

আমি নিজের মন থেকে আমাদের জাতির এই দুর্বলতার কারণ খুঁজেছি। প্রতিটি মানুষ তিনটে ক্ষমতার মধ্যে সীমাবদ্ধ : বোঝবার ক্ষমতা , করবার ক্ষমতা আর নিজের ওপর বিশ্বাসের ক্ষমতা। কোনো মানুষই শূন্য ক্ষমতার নয় , আর কেউই ১০০% ক্ষমতার অধিকারী নয়। আমি মানুষের একটা ছবি এঁকেছি। একটা বিন্দু থেকে তিনটে রেখা ,১২০ ডিগ্রি ব্যবধানে। প্রতিটি রেখা এক একটা ক্ষমতা। একজন মানুষ তার ক্ষমতা অনুযায়ী এক একটা বিন্দু। তিনটে বিন্দু যুক্ত করে একটা ত্রিভুজ। প্রতি মানুষ একটা ত্রিভুজ আর এই ত্রিভুজই তার পরিচয় , তার জীবনের স্থায়িত্ব। তার বোঝবার ,করবার আর আত্মবিশ্বাসের ত্রিভুজের মধ্য়েই তার জীবনের ধারা।


আমার কাছে আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি। আমরা যাদের সমাজের সবচেয়ে নীচে দেখি তাদের ত্রিভুজ খুব ছোট। উচ্চশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ারের আত্মবিশ্বাস খুব কম -একটা অদ্ভুত ত্রিভুজ। আমরা যাদের নেতা ভাবি তাদের সাধারণ মানুষকে বোঝানোর ক্ষমতা খুব বেশী , কিন্তু আত্মবিশ্বাস আর জ্ঞান কম। আমাদের দেশে যারা শাসন চালায়, ন্যায় ,বিজ্ঞান ,শিক্ষা , স্বাস্থ্য , দেশরক্ষা যে কোনো বিভাগেই হোক না কেন , তাদের জ্ঞান আর কর্মক্ষমতা বেশি ,কিন্তু আত্মবিশ্বাস কম। তারা সবসময়ে ভাবে ,এই বুঝি ভুল করলাম ,এই বুঝি অন্য কেউ আমার জায়গা দখল করে নিলো। তাই তারা সবসময়ে চেষ্টা করে যাতে অন্য কেউ তাদের সমান হতে না পারে, তাদের প্রতিযোগী না হয়ে উঠতে পারে। আমাদের দেশ কম আত্মবিশ্বাসের রোগে ভুগছে। তাই আমরা নতুন রাস্তায় চলতে ভয় পাই। তাই আমরা কিছু পুরোনো গল্পকাহিনীকে আমাদের পথ ভাবি , মধ্যযুগের বিশ্বাস, সামাজিক রীতিনীতি আঁকড়ে চলবার চেষ্টা করি।


আমার এক এক সময়ে মনে হয় একটা পুরোনো ঐতিহ্যময় সভ্যতার মুখোশের পেছনে আমরা একটা নিষ্ঠুর জাতি। আমাদের আত্মবিশ্বাস কম তাই ভাবি আমাদের সবাই ছোট করে দেখছে। তাই আমরা অন্যদের অনুকরণ করতে লজ্জা পাই না। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চেয়ে যারা নীচু স্তরে আছে তাদের ওপর নিষ্ঠুরতা দেখাই। অন্যদের বাদ দিলেও আমরা আমাদের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যবহার করি। আমরা ওদের অন্ধ বিশ্বাসের অন্ধকার কুঠুরিতে আটকে রাখি ,তাদের আত্মা -পরমাত্মা বোঝাই না , কেবল বড়ো বড়ো শ্লোক শোনাই। আর এখন তো আমরা আরও নিচে নেমেছি। ছোটবেলা থেকে বোঝাই যে জগৎটা সুন্দর নয় , এখানে চারিদিকে গলা কতবার লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে ; survival of the fittest বলি কিন্তু আমরা তাদের শেখাই না বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির সাহায্যে কিভাবে surviveকরতে হয়। আমরা চেষ্টা করি তাদের মনের মধ্যে গেঁথে দিতে যে তোমার চারদিকে শুধুই শত্রু ; তুমি কি জানো ,নিজে কি করতে পারো সেগুলো দরকারি নয়। তুমি কাকে জানো , কতজনকে ধ্বংস করতে পারো ,সেটাই তোমার পরিচয়। আমরা শেখাই সারা জীবন কোনো নির্ণয় না নিয়ে শুধু অন্যদের আদেশ মেনে সুখে দিন কাটানোর মহামন্ত্র। আমরা শেখাই যত বেশি অন্যদের উক্তি আওড়াতে পারবে ততই সমাজে তোমার দাম বাড়বে। এমনকি স্কুল কলেজে পড়বার সময়েও নিজের কথা লিখবে না,তাতে নম্বর কাটা যাবে। যতটুকু বইতে লেখা আছে সেটাকে মুখস্থ করে লিখবে। নিজের ভাব -ভাষা লাগালে শাস্তি পাবে , কিছু শিখতে হবেনা শুধু মুখস্থ করতে হবে।


আমি তবুও হাল ছাড়িনি। কাজ করেছি বোঝবার আর করবার ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে। আমি জানি আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর পথে যে লোহার দরজা আছে সেটাকে ভাঙা আমার সাধ্যের বাইরে। তার জন্যে অনেক নির্ভিক ক্ষমতাবান সৈন্য দরকার। আজকের দিনেও দেখি ছোটদের শেখানো হচ্ছে ,এখন যারা কষ্ট পাচ্ছে সেটা তাদের গত জন্মের পাপের ফল মাত্র। তাইতো তারা শিখছে প্রভু আর দাসের কারণ ভগবানের দেওয়া পুরস্কার আর শাস্তি। তাই মানুষ -মানুষের ভেদাভেদ এদের কাছে ঈশ্বর সাধনা। 


আমাদের দেশে বিতর্কের স্থান নেই। আমরা ঝগড়া করি ,অন্যদের হেয় করবার পরিকল্পনা করি ,কিন্তু প্রশ্ন করিনা," আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি দুঃস্থ ,তার মানে তারা জন্মেছে গত জন্মের পাপের ফলে। তবে কি আমাদের দেশ সবচেয়ে অধার্মিক দেশ ?"


আমি মানিনা। একটা আশার আলো দেখেছি আমাদের দেশেরই তিন জৈব বৈজ্ঞানিকের কাজে। আমেরিকাতে প্রকাশিত ( Proceedings of Science ) এক জেনেটিক রিসার্চ বলছে , ভারতের বর্ণ বিভাগ ( Caste System ) কোনো সাধুরা করেননি। একজন মূর্খ রাজা নিজেকে আর নিজের লোকেদের বাঁচানোর জন্যে রাজাদেশ দিয়েছিলো ' ব্রাহ্মণের ছেলে ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয়ের ছেলে ক্ষত্রিয় , মুচির ছেলে মুচি ইত্যাদি '। অনেক আশা করেছিলাম এই তথ্য স্কুল কলেজে পড়ান হবে। কিন্তু আমাদের দেশে পন্ডিতেরা এগুলো নিয়ে কোনো আলোচনা করেনি , শিক্ষাবিভাগ এই অসাধারণ কাজ যাকে পৃথিবী সমাজ ব্যবস্থার বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের নতুন পথ মানছে সেটাকে মুছে দিয়েছে। দুর্বল আত্মবিশ্বাসের চাপে বৈজ্ঞানিকেরা সবচেয়ে ঠান্ডা ঘরে ঠেলে দিয়েছে।

এইরকম একটা সময়ে আমার জীবনে একটা দুর্ঘটনা ঘটলো।


হাওড়া স্টেশনে গেছি রাত্তিরের ট্রেন ধরতে। লাউড স্পিকারে জানানো হলো ,'রেক দেরীতে পৌঁছনোর কারণে ট্রেন দেরীতে ছাড়বে ', বেশ বৃষ্টির রাত। আমি দাঁড়িয়ে গীতা প্রেসের বইয়ের দোকানের সামনে। টেবিলে আর তাকে সাজানো নানা রঙের নানা ভাষাতে লেখা গীতা। আমার সঙ্গে এই ধর্ম পুস্তকের কোনো সম্পর্ক ছিল না। অনেকে ভাবে আমি নাস্তিক। আমি কিন্তু মনেপ্রাণে আস্তিক।তবে হ্যাঁ একটু উদ্ভট আস্তিক। আমার বিচারে আমার জীবন আমার আশার থেকেও অনেক বেশি দিয়েছে। আমার মনে হতো যে এত পাবার পরেও আমি যদি আরও কিছু চাই সেটা ভিখারির কাজ হবে। আমি বড়লোক নোই ,কিন্তু ভিখারির পরিচয় নিতে আমার ঘোর আপত্তি। আমার আরও মনে হতো আমি যদি এর ওপরে আরোও কিছু চাই সেটা আমার অজ্ঞাত মঙ্গলদাতাকে অসম্মান করা হবে ,যেন সে বেশ কৃপণ ভাবে আমাকে দিয়েছে। সেজন্যে আমি অঞ্জলি দিই না। কিন্তু আমি মন্দির ,মসজিদ ,চার্চ ,গুরুদ্বারা ,পুজোর প্যান্ডেলে যাই , কারণ আমার সাজানো পুজোর জায়গা দেখতে ভালো লাগে।তার সঙ্গে অনেক মানুষের একত্র হওয়া আমার খুব সুন্দর মনে হয়। সবাই একসঙ্গে অঞ্জলি দেয় , পুরোহিত মশাই দুর্বোধ্যভাষাতে বলে চলে আর সবাই সেগুলোকে রিপিট করে করে তিনবার করে বলে ,আমাকে,টাকা দাও ,ছেলে দাও (মেয়ে নয় ),স্বাস্থ্য দাও ইত্যাদি ,বেশ বড় লিস্ট। সেই সময়ে আমি একটু দূরে দূরে থাকি , কিন্তু যখন প্রণামের সময় আসে আমি প্রাণ ভরে যোগ দি। আমার কাছে প্রণাম কৃতজ্ঞতার স্বীকার -আমার খুব আনন্দ লাগে বলতে ,"হে আমার অজানা শুভাকাঙ্খী ,শুভাকাঙ্খিনী , আমাকে তোমরা যা দান করেছো তার জন্যে মনের ভেতর থেকে তোমাদের ধন্যবাদ দিচ্ছি। "


এর আগে আমার আর গীতার সম্পর্ক প্রায় শূন্য। আমি জানি পরিবারে কেউ মারা গেলে অনেক কপি সস্তার গীতা কেনা হয়। আমি এটাও জানতাম যে স্বামী বিবেকানন্দ , গান্ধীজি , লোকমান্য তিলক আর অনেক অনেক মহাপুরুষেরা বলেছেন যে গীতা থেকেই তাঁরা অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। কিন্তু গীতার কোন জায়গা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন,সেটাকে কিভাবে কাজে লাগিয়েছেন তার বিস্তারিত বিবরণ আমার জানা ছিল না। আমি এটাও জানতাম গীতার কিছু শ্লোক অনেক ব্যবসাদারেরা লাভের জন্যে আর নেতারা দল ভারী করবার জন্যে চোখ কপালে তুলে বারবার আওড়ায়। এটুকুই আমার জ্ঞান ছিল গীতার সম্বন্ধে। তবে একটা প্রশ্ন চিহ্ন মনের মধ্যে থাকতো : গীতা যদি এত ভালো লেখা তাহলে কোনো আনন্দ কিংবা মঙ্গল অনুষ্ঠানে কেউ গীতা পড়েনা কেন ? পৈতে, হাতেখড়ি, বিয়ে ,চারদিনের দুর্গাপুজো কোথাও গীতাপাঠ শুনিনি। আমি স্কুলে বাইবেলের গল্প পড়েছি , কিন্তু গীতার গল্প শুনিনি। কেবল ক্লাশ ত্রি -ফোরে সকালে একটা প্রার্থনা হতো ,মাস্টারমশাই বলেছিলেন সেটা গীতা থেকে নেয়া। কিন্তু তার বাইরে আর কিছু নয়। আমরা সবাই চোখ বন্ধ করে যা বলতাম তার সারাংশ হল : আমরা সবাই অকর্মন্য বোকার দল ; আর আমাদের একজন মাত্র আছেন যিনি আমাদের বাবা-মা ,বন্ধু -শিক্ষক , আমাদের বাঁচবার সম্পদ। আমরা চলছি ফিরছি সব তাঁর দয়া। আরও একটু বেশি দয়ার আশায় তাঁকে বারবার প্রণাম করি। খুব একটা উৎসাহ আমি পেতাম না।


এই প্রার্থনা আর আমার মায়ের বৃস্পতিবারের লক্ষীর পাঁচালির একটা অদ্ভুত মিল আছে। তফাৎ একটাই ,মায়ের পাঁচালি একটা গল্প যেটা বুঝতে পারতাম আর স্কুলের প্রার্থনা প্রাণহীন কতকগুলো অজানা ভাষার শব্দ সমষ্টি। আমি যখন আই আই টি তে পড়াতাম তখন এঞ্জিনীরদের ভদ্রলোক করবার উদ্যেশ্যে জন্যে কিছু বিষয় পড়ানো হতো। মিশরের রাজা কুফু ,হেগেলের দর্শন আরো অনেক কিছু ,কিন্তু গীতা পড়ানো হতো না।

সেই রাত্রে প্রকৃতি আমার আর গীতার মধ্যে ঘটকের দায়িত্ব নিয়েছিল।


বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি। অধিকাংশ যাত্রী ওয়েটিং হলের বেঞ্চি দখল করে বসা , এদিক ওদিক ছোট ছোট দল নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত ,আর কিছু লোক চা খাবারের দোকানের সামনে ভিড় করা। একজন অল্প বয়সি ছেলে বসা গীতা প্রেসের দোকানটাতে ,দুঃখী দুঃখী মুখ ,একলা একলা ভাব। আর আমি ক গজ দূরে ,ভাবছি কি করে সময়টা কাটাবো। কিছু না ভেবেই আমি দোকানের দিকে একটু এগোলাম ,দূরত্ব একটু কম হলো। সেটা দেখে দোকানের ছেলেটির চোখে একটা আশার চমক কটা মুহূর্তের ,তারপর সেই হতাশ বিষন্নতা। তাতেই কাজ হলো। পৌঁছলাম দোকানে ,ভালো করে বইগুলো দেখলাম।

অনেক রকমের সাইজ ,নানা রং আর ছবি দেওয়া মলাট, ইংরিজি ,বাংলা ,হিন্দিতে লেখা। আমি যাকে পছন্দ করলাম সেটা বাংলায় লেখা ,উজ্জ্বল হলুদ আর লাল রঙের মলাট ,ছবিটা রথের ,বসা দুজন - একজন আরোহী , অন্যজন সারথি। জানি কিনবোনা ,তাই প্লানটা ছিল প্রথম কটা অংশ পড়বো ,তারপর শেষ পাতাতে যাবো গল্পের শেষটা জানবার জন্যে।

এই বইটা একটু অন্য রকমের। সবচেয়ে প্রথমে বাংলা হরফে সংস্কৃত শ্লোক ;তার নিচে সন্ধি বিচ্ছেদ করে শ্লোকের শব্দগুলো আলাদা করে লেখা ,তার নিচে দু -কলমে শব্দগুলোর বাংলা অর্থ লেখা। ব্যাস এইটুকু ,কোনো বাক্য নেই ,কোনো ব্যাখ্যা নেই। শব্দের মানে জানো ,নিজেই বাক্য রচনা করো ,অর্থ খোঁজো ,ব্যাখ্যা করো। প্রথম দর্শনেই ভালো লাগলো। এমনটা আগে কোথাও দেখিনি।


মহাভারতের গল্প আমার জানা ,তাই প্রথম শ্লোকের মানে বুঝতে একটুও অসুবিধে হলো না। মহারাজা ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের কাছে যুদ্ধের বিবরণ জানতে চাইছেন। যুদ্ধটা হচ্ছে দুই শরিকের , মহারাজের নিজের ছেলেরা এক দিকে ,আর অন্য দিকে মহারাজের ভাইয়ের ছেলেরা। কুরুরাজ্য কে দখল করবে তা নিয়ে লড়াই। পাতা উলটিয়ে গেলাম শেষ পাতাতে। বুঝলাম সঞ্জয় বলছে ,কৃষ্ণ আর অর্জুন যে পক্ষের তারাই যুদ্ধটা জিতবে। এটাও আগে থেকে জানতাম , নতুন খবর নয়। বইটা বন্ধ করতে যাচ্ছি ,হটাৎ নজর করলাম দুটো শব্দ : যোগেশ্বর আর ধনুর্ধর। কৃষ্ণ যোগেশ্বর - জ্ঞানের শ্রেষ্ঠ আর অর্জুন ধনুর্বিদ্যায় পারদর্শী। রাজা নয় ,সৈন্য নয় , সেনাপতি নয় ,শুধু জ্ঞান আর কর্ম কুশলতা। গীতা বলছে , জীবন যুদ্ধে সেই জিতবে যার কাছে বেশি উন্নত জ্ঞান আর কুশলতা থাকবে।

আমার মনে হচ্ছিল বাইরের অঝোর বৃষ্টি আমার মনের ভেতরে ঝমঝম করে পড়ছে। কত বছর ধরে বলে আসছি ,কাজ করে দেখাচ্ছি যে বিজ্ঞান আর কুশলতা দিয়ে ভারতকে এগোতে হবে; শুনেছে সবাই ,কিন্তু কেউ তাকে বাস্তবের রূপ দেয় নি। আমার জীবন হেরে যাবার ইতিহাস ,মন আর শরীরের ক্লান্তির ইতিহাস। সেই মুহূর্তে আমি অনুভব করলাম বৃষ্টির ধারার সঙ্গে আমার দুঃখ ,অবসাদ ,গ্লানি সবকিছু ধুয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার বছরের কালমহাসাগরের ওপারে দাঁড়িয়ে একজন আমার কথা বলছে। আমারই মতন অনেক অনুসন্ধান করে সেও বলছে , জীবনটা একটা বিরামহীন লড়াই ; জিততে গেলে জ্ঞান আর কুশলতা বাড়াও। আর তাই বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে জীবনের অভিন্ন অংশ বানাতেই হবে।

আমাকে বোঝানো হয়েছিল গীতা জীবন -মৃত্যুর রহস্যের আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণ ,স্বয়ং ভগবানের মুখ থেকে শোনা। আমি দেখলাম গীতা এক রিসার্চ রিপোর্ট। গীতার শেষ শ্লোক অনুসন্ধানের শেষের অংশ ,যেখানে বিশ্লেষণ আর বাস্তবিক পরীক্ষার মূল শিক্ষা ( Inference after theoretical analysis & experimental verification )লেখা হয়। গীতা সুস্থ এবং সুষ্ঠ জীবন চালানোর সংগীত - একে কেন মৃত্যু বাসরে রাখা হয়েছে আমি সেদিন বুঝতে পারিনি। সেই রাত্রে আমার কৌতূহল হলো গীতার সম্বন্ধে একটু বেশি জানবার ; এখন আমি বুঝেছি সেটা শুধু কৌতূহল ছিল না , আমি মনে মনে আনন্দ আর উত্তেজনা পাচ্ছিলাম যে একজন বৈজ্ঞানিকের সন্ধান পেয়েছি যার চিন্তার তরঙ্গমালা আমার চিন্তার তরঙ্গমালার সঙ্গে একই ছন্দে বাঁধা। আমি স্থির করলাম বইটা আমি কিনবো। সাজানো বইগুলোর মধ্যে থেকে আরো একটা বই পেলাম। খুব ছোট আর পাতলা - এতে প্রতিটা শ্লোক আর তার বাংলা অনুবাদ লেখা। একটা বই পেলাম এক সন্ন্যাসীর লেখা গদ্যে গীতা ভাষ্য - শ্লোকের বিশ্লেষণ। পরে আমি ইংরিজি আর বাংলায় লেখা অনেক ভাষ্য কিনেছি। প্রতিটি ভাষ্য অনেক অলংকারময় শব্দে লেখা ,বক্তব্য মোটামুটি একই ,শুধু লেখকের নিজস্ব চিন্তার ওপর গুরুত্বের হেরফের। তবে সেই রাত্রে আমি শুধু প্রথম তিনটে বই কিনেছিলাম। 


আমি জানি আমার আধ্যাত্মিক জ্ঞান নেই , যোগ -পুজো করিনি , সংস্কৃত পড়েছি ক্লাস টেন পর্যন্তই। তাই ঠিক করলাম বিশ্লেষণ -ব্যাখ্যা না করে গীতার কাঠামোটা বোঝবার চেষ্টা করি। তাই গীতার মূল চরিত্র কৃষ্ণের রহস্য জানবার চেষ্টা না করে , গীতাতেই লেখা কৃষ্ণের নানা রূপ ,গুণ , আচার এক জায়গায় করলাম। এই অতি সাধারণ কাজ আমাকে অবাক করে দিলো। দেখলাম ,গীতা দুজন কৃষ্ণের কথা বলছে : দুজনেই অসীম ,অনন্ত ; কিন্তু একজন গণিতের বিচারে ঠিক আর অন্যজন গণিত -বিচারে ভুল।


একটু পরিষ্কার ভাবে বলতে চাই - গণিত বিজ্ঞান বলছে অনন্তের ছোট অংশও অনন্ত , অনন্ত থেকে অনন্ত বিয়োগ দিলে বিয়োগফলও অনন্ত। গীতাতে একজন কৃষ্ণ বলছেন আমি অনন্ত ,তাই আমার বাইরে বা ভেতর বলে কিছু নেই , আমার ভালো -মন্দ ,পাপ-পুণ্য নেই, সৎলোক -অসৎলোক সবই আমি। দ্বিতীয় কৃষ্ণ কিন্তু বেশ বাছাই করে সবকিছুর ভালোগুলোকে বলছেন আমি। হাতি,ঘোড়া ,সাপ , শব্দ ,বর্ণ ,বই ,গান ,সুর ,মানুষ সব কিছুর শ্রেষ্ঠ এই দ্বিতীয় কৃষ্ণ।

প্রথম কৃষ্ণ ক্রিয়া নন , রক্ষক নন ,এই সব সৃষ্ট বস্তু -জীবের কাজ। দ্বিতীয় কৃষ্ণ নিজেই সৃষ্টর বাইরে থেকে সৃষ্টি করেন, পালন করেন ,সংহার করেন , বিচার করেন, পুরস্কার দেন ,শাস্তি দেন। একজন বলেন যে যার লড়াই নিজেকেই করতে হবে ,অন্যজন সাহস দেন যে ভালোদের সুরক্ষা তিনি নিজেই করবেন। প্রথম কৃষ্ণ বলছেন , তোমার নিজস্ব গুণগুলোকে আরও শক্তিশালী করে নিজের জীবনধারা নিজেই তৈরী করো। অন্যজন বলছেন আমি যা বলছি সেটাই সত্য , আর অন্য সব চিন্তা ভাবনা কাজ অসত্য।


প্রথম কৃষ্ণ একজন উঁচু স্তরের বৈজ্ঞানিকের মতন ধীর স্থির যুক্তিবিদ এবং সংযত -বাক। তিনি বলছেন ,যেহেতু তুমিই আমি ,যে পথেই চলোনা কেন আমাতেই পৌঁছবে। অন্যজন তার্কিক ,উদ্ধত ,তাঁর কথা না মানলে ভয় দেখাতেও পারেন। কথার মধ্যে অসঙ্গতি ,তাই নিজের কথা নিজেই অস্বীকার করেন। অনেক বৈজ্ঞানিক আলোচনা কৃষ্ণের মুখে,কোনজনের বোঝবার উপায় নেই। চোখের একটা পরীক্ষা হয় যে কোনো ব্যক্তি রং চিনতে পারে কি না। অনেক রংমেশানো ছবি দেখানো হয় ,তার মধ্যে একটা রঙের কিছু শব্দ লেখা থাকে। সেই শব্দটি যে বুঝতে পারে তার চোখ সুস্থ। আমার মনে হয় কেউ বা কারা ইচ্ছে করে দ্বিতীয় কৃষ্ণ গীতার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে যাতে সবাই না বুঝতে পারে। সব মানুষই সমান এই বিশ্বাস যদি সবাই বোঝে তাহলে একদলকে নীচে রাখা যাবে না ,তাতে কিছু লোকের স্বার্থ এবং প্রতিপত্তি কমে যাবে -তারাই চেষ্টা করেছে গীতার মধ্যে বিভ্রান্তি আনবার।


আমি দুই কৃষ্ণর নাম রেখেছি : বৈজ্ঞানিক কৃষ্ণ এবং অবতার কৃষ্ণ। অদ্ভুত একটা মিল বৌদ্ধদের সঙ্গে। মহাযান গোষ্ঠী বুদ্ধকে অবতার মানে না ,জ্ঞানী জন ভেবে তাঁর অনুশাসন মেনে চলে। হীনযান বুদ্ধকে অবতার ভাবে আর তাঁকেই পুজো করে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রায় সবাই হীনযান মতের বৌদ্ধ। গীতার দুজন কৃষ্ণ ঠিক সেইরকম। বুদ্ধ আর বৈজ্ঞানিক কৃষ্ণ সমস্ত মানব জাতিকে এক সূত্রে গাঁথতে চাইছেন। অবতার কৃষ্ণ আর হীনযান গোষ্ঠী সমাজকে ভাগ করে ,তাই প্রমাণ করতে চায় যে তাদের অবতার অন্যদের অবতারের থেকে বেশি ভালো। আজকের জগতে অবতারবাদ প্রাধান্য পাচ্ছে ; খ্রিষ্টান , মুসলমান , বৈষ্ণব , হীনযান এখন সংখ্যায় অনেক বেশি - এরা প্রত্যেকে অবতারবাদে আস্থা রাখে। আমি চিন্তা করে দেখলাম অবতারবাদ সমাজকে ভাগ করে ঠিক ,কিন্তু এর হাত ধরে মানুষ উন্নতিও করেছে। একটা ছোট ভাগ নতুন পথ দেখিয়েছে ,অন্যেরা তার থেকে শিখেছে আর এগিয়ে গেছে। সুতরাং কোনটা ভালো ,কোনটা মন্দ তার বিচার করা উচিত নয়।


গীতার একটা চিন্তা আমাকে অভিভূত করেছে। এর আগে এটাকে নিয়ে কোনো আলোচনা কিংবা পোস্টার দেখিনি। গীতা বলছে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ক্ষেত্রজ্ঞ , যিনি ক্ষেত্র বোঝেন। কয়েকটা শ্লোকে ক্ষেত্র কি ,তার বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই বর্ণনা অতি আধুনিক Universal Field Theory র হুবহু প্রতিচ্ছবি। প্রকৃপক্ষে আরও একধাপ এগিয়ে। এখানে মানুষের জীবন একটা ক্ষেত্র , Life Field , ভাবা হয়েছে। বলা হয়েছে মানুষের জীবন খালি বস্তু , পঞ্চেন্দ্রিয় আর আবেগ মেলানো একটা সংকীর্ণ স্বত্তা নয়, এটা একটা ক্ষেত্র যার বিস্তার বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড। সেইজন্যে প্রতিটি মানুষ অনন্ত ; স্বত্তা পরিবর্তন করে কিন্তু ক্ষেত্র অবিনশ্বর ,চিরন্তন। উপনিষদে বলা হয়েছে ,শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রঃ। গীতা তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করেছে। আর এটাই মানুষের বর্ণ -শ্রেণী, বিশ্বাস -ধর্ম ভাগকে আঘাত করেছে। এখানে বিশ্বমানবের কল্পনা করা হয়েছে। আমার ধারণা এই উক্তি কেবল বৈজ্ঞানিক কৃষ্ণ করতে পারেন।


আমার মনে হয় গীতাকে কেবল শ্রাদ্ধ বাসরে স্থান দেওয়া ,দুরকম কৃষ্ণ নিয়ে আসা ,গীতার মধ্যে বিশ্বমানবের বিপরীত অনেক শ্লোক ঢুকিয়ে দেওয়া ,এই সব কিছুর পেছনে একটা দূরভিসন্ধি আছে। সেটা হলো যাতে সব মানুষ গীতা না পড়ে ,না বোঝে যে সব মানুষ এক অনন্তের অনন্ত অংশ। তারাই এখনো জিতছে ,অবতার কৃষ্ণকে সামনে রাখা হচ্ছে। হাজার বছর পরে আজকের দিনেও ভারত অধিকাংশ জনগণকে ছোট চোখে দেখছে ,তাদের নিচে রাখবার সবরকম চেষ্টা করে চলেছে। অন্য ধর্মে মানুষের ভেদাভেদ কিছু কম করবার চেষ্টা করেছে ,কিন্তু তার বদলে ধর্ম -ধর্ম অশ্রদ্ধা অসহিষ্ণুতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন বহু রকমের পন্থ জেগে উঠেছে ,তারা সবাই আধ্যাত্বিকতার ওপর দাঁড়িয়ে নেই ,অনেকেই নিজের ক্ষমতা আর সম্পদ বাড়ানোর রাস্তা হিসেবে এই সব পন্থ বা( Cult ) প্রচার করছে। বেশ কিছু লোক ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে জাতিবাদ এনেছে। এতে মানুষের অনেক উপকার হয়েছে , উন্নতির গতি বেড়েছে , কষ্ট কমেছে ,স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। আর এখন তো চেষ্টা চলছে মানুষের সব দৈহিক পরিশ্রম মেশিন দিয়ে করাবার। আগের দিনের শ্রমিক মানুষের মর্যাদা পেত ; এখন শ্রমিক একটা মেশিনের যত্ন পাবে।

আমরা যেটা হারাতে বসেছি সেটা হলো মানুষের সৃজন ক্ষমতা। আজকে পৃথিবীর সব কোণাতে মানুষের দেখা পাই ,অন্য কোনো জীব যা হতে পারেনি। এই অসাধারণ কাজ মানুষ করেছে কারণ মানুষ প্রকৃতিকে ,অন্য জীবকে খেলার বন্ধু ভেবেছে ,তাদের কাছ থেকে শিখেছে আর নিজের জ্ঞান ,আত্মবিশ্বাস আর উদ্ভাবনা শক্তি একত্র করে নতুন নতুন পথ তৈরী করেছে। মানব জগৎ মানুষ হবার আনন্দ আর তৃপ্তি থেকে নিজেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে আর তারই ফলে ভয় পাচ্ছে , কষ্ট পাচ্ছে , এমন কি নিজেদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্ধিয়ান হয়ে উঠেছে।


এখন মানব সমাজের নতুন করে বিজ্ঞানী কৃষ্ণর দরকার ,একটা ধর্মের সাজ পোশাকে নয় , যুক্তি দিয়ে সকলকে বোঝানো যে প্রতিটি মানুষ অমর -জন্মানোর সময়ে সে অমর , মরবার সময়েও সে অমরই থাকবে। স্থান -কাল ভেদে ব্যক্তি পরিচয় ( Entity ) বদলাবে ,কিন্তু মানব ক্ষেত্র অপরিবর্তনীয়। মানুষকে বুঝতে হবে কেবল মাত্র বৈজ্ঞানিক চিন্তন আর প্রযুক্তিক কুশলতা জীবন সংগ্রামের হার -জিৎ নির্ণয় করে। বিজ্ঞানী কৃষ্ণর শিক্ষা স্বর্গ থেকে ভেসে আসা জ্ঞান হবে না। মানুষ মানুষের ভাষায় বোঝাবে সত্যের প্রকৃত স্বরূপ।

মানুষ আর্থিক আর রাজনৈতিক লাভের আশায় বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির সংজ্ঞা পরিবর্তন করেছে। আবার সবাইকে বুঝতে হবে এদের মর্মার্থ। একটা স্থান আর কালের মধ্যে থেকে যাকে আমরা সত্য বলে ভাবি তাকেই আমরা জ্ঞান বলি; এদের মধ্যে একটা অংশ আমরা বিশ্বাস করি সত্য ,আর একটা অংশ আমরা নানা রকম পরীক্ষা -নিরীক্ষা করে দেখি যে আমাদের ভাবনা সব রকম পরিস্থিতিতে একরকম থাকে কি না ? এই বিচারে যেগুলো পাশ করে তাদেরই আমরা বিজ্ঞান (Science ) বলে থাকি। আবার বিজ্ঞানের কিছু অংশ জীবন চলার কাজে ব্যবহার করা হয় -এদেরকেই আমরা নাম দিয়েছি প্রযুক্তি (Technology ); সুতরাং বুঝতে হবে এখন যাকে বলা হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (Science & Technology ),সেটা আজকের দিনে মানব সমাজ যাকে সত্য বলে বিচার করে তারই অন্য্ নাম। মানুষ সারাক্ষণ সত্যকে খুঁজে বেড়াচ্ছে , সারাক্ষণ নতুন সত্য আবিষ্কার করছে ,পুরোনো সত্যগুলোকে ভাঙছে ,নতুন চেহারা দিচ্ছে। এই কাজটাকেই মানুষ জীবন যুদ্ধ নাম দিয়েছে। মানুষ যেদিন এই যুদ্ধটা করবে না , সত্যের সন্ধান থামিয়ে দেবে ,সেদিন মানুষ মানুষ থাকবে না ; তখন মানুষ হবে প্রাণের সুর -ছন্দ -স্পন্দন হীন সুন্দর ভাবে খোদাই করা পাথরের চলমান মূর্তি।


বৈজ্ঞানিক কৃষ্ণর এই বিচার পৃথিবীর সব মানুষের কাছে পৌঁছতে হবে ছোটবেলা থেকে। আমাদের বুঝতে হবে মানুষ -মানুষের ভেদাভেদ বহু হাজার বছর ধরে স্বার্থান্বেশী কিছু লোক করে এসেছে। এখন এই ভেদাভেদ আমাদের জীনের মধ্যে ঢুকেছে।জোর করে আইন বানিয়ে এটা পরিবর্তন করা যাবে না। এক প্রজন্মে মানুষ একে মন থেকে মেনে নেবে না। বেশ অনেক বছর ধরে চেষ্টা করলেই জীনের পরিবর্তন করা সম্ভব।

প্রথম কাজ হবে বিজ্ঞানিক কৃষ্ণের চিন্তাধারাকে লিপিবদ্ধ করা ,দেশ বিদেশের বিভিন্ন ভাষায় আর বিজ্ঞান সম্মত রূপে। এই চিন্তাধারাকে ভিন্ন রূপ দিতে হবে যাতে সেটা ৫ থেকে ১৮বছরের ছাত্র ছাত্রীর কাছে মনোজ্ঞ হয়। মনে রাখা দরকার এই বয়সেই অনন্ত বিশ্বমানবের একটা ছবি তাদের মনের মধ্যে ছাপাতে হবে। সেটাই সে সমস্ত জীবন ধরে রাখতে পারবে।


এই বিচারটাই আমাকে বদলে দিয়েছে।

বৈজ্ঞানিক কৃষ্ণ আমাকে কেবল লেখক হয়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করেন নি , আমাকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছেন যে আমি লেখক হতে পারবোই।

বৈজ্ঞানিক কৃষ্ণ আমাকে পথ দেখিয়েছেন :


"অক্লান্ত চেষ্টা করে উন্নতির পথে চলো,,

"নিজের অন্তর্নিহিত শক্তিকে আরো শক্তিশালী করো,, আর নতুন পথের সন্ধান করো যাতে তোমার শক্তি নিখুঁত হতে পারে,

"চেষ্টা করা তোমার জন্মগত অধিকার, কিন্তু চেষ্টায় সফল না হলে চেষ্টা বন্ধ করবার অধিকার তোমার নেই ,

"মনে রেখো তুমি এক অনন্ত ক্ষেত্র যা সমস্ত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে আছে, তাই অনেক অজানা শক্তি তোমার চেষ্টাকে প্রভাবিত করবে ,

"অন্যদের অন্ধ অনুকরণের সহজ পথ ছেড়ে বিজ্ঞানসম্মত চিন্তা কর,

"নতুনের খোঁজ করো আর নিখুঁত প্রযুক্তি ব্যবহার করো ,

"শেষ বিজয় হবে উন্নত বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির,উন্নত কর্মকুশলতা আর আত্মবিশ্বাসের।"


এটাই আমার লড়াই। আমি চেষ্টা করছি লেখক হয়ে উঠতে, ছোট আর বড় কবিতা লিখতে , মজার আর গুরুগম্ভীর গল্প লিখতে ,প্রতিদিনের ঘটনা আর দার্শনিক তত্ত্ব জমা করতে, জীবনের সত্যি ঘটনা আর কাল্পনিক চিন্তাকে লিপিবদ্ধ করতে। খুঁজছি ভয় আর আনন্দর স্বরূপ। এক কথায় আমি চেষ্টা করছি একজন সত্যিকার সুলেখক হবার জন্যে।


আমার কাছে গীতা শুধু উৎসাহের স্রোত নয় , লেখক হবার এক পাগলামি আমার দেহ মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আমি পাতার পর পাতা গীতা সম্বন্ধে লিখেছি ,একই বিষয়ে নানাভাবে লিখেছি। আমি জানি এগুলো একটাও নিখুঁত নয়। আমি চেষ্টা করে চলেছি মনগ্রাহী লিখতে ,একটা ছবির বই ,একটা ইস্তাহার ,একটা কবিতা , একটা পোস্টার যাতে অনেক ধরণের পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারি।


আমার কল্পনায় দেখি একদল তরুণ ,চেষ্টা করছে  নতুন করে গীতার বিশ্লেষণের ;তারা অনেক মহাপন্ডিতদের লেখা ভাষ্য দেখছে না ,নিজেদের চিন্তাকে  সাজাচ্ছে -গুছোচ্ছে । তার মানে এই নয় যে এই উচ্চ চিন্তাশীলদের অসম্মান করছে,অবজ্ঞা করছে।উদ্দেশ্য একটাই : বৈজ্ঞানিক কৃষ্ণকে পৃথিবীর সামনে নিয়ে আসা। তারা লিখছে গীতার যে যে অংশ ইতিবাচক, মানুষের শক্তিতে আস্থাশীল , মানুষকে উৎসাহ দিচ্ছে যেন তারা নিজেদের বিমুক্তির পথ নিজেরাই বার করে , না ভাবে যে কোনো এক অদৃশ্য মহাশক্তি তাদের জীবন চলার পথ ঠিক করে রেখেছে আর তারা চেষ্টা করেও সেই পথ ছেড়ে নতুন পথে চলতে পারবে না। 


এটা করতে পারলে ,গীতার বাকি অংশ অন্য পথ দেখাবে। মানুষ নিজের ইচ্ছেমতো একটা পথ বেছে নেবে।

সামাজিক রীতিনীতির কৌশলে গীতা আর সাধারণ মানুষকে আলাদা রাখা চলবে না। গীতার শেষের দিকে লেখা আছে যাদের মনে গীতা সম্বন্ধে প্রশ্ন বা সন্দেহ আছে তাদের গীতা পড়বার বা গীতা পাঠ শোনবার অধিকার নেই -এই শ্লোকের কোনো যৌক্তিকতা নেই। এটা এক মানুষের দুর্বলতার সাক্ষর ,তার কেবল আত্মবিশ্বাস খুবই কম নয় ,সে ভয় পাচ্ছে সবার সামনে গীতা নিয়ে কোনো বিতর্ক যেন না হয়। আজকের জগতে এটা একেবারে অচল। পবিত্র গুপ্তকথা (Holy Secret ) আদিম যুগের ভাবনা যা থেকে প্রভু -দাস আর সমাজের উঁচু -নিচু মানুষের বর্ণ বিভাগ শুরু। আজকের আর কালকের ভারতবর্ষকে অন্ধ বিশ্বাসের শেকল ভাঙতেই হবে। আমাদের যুক্তিসিদ্ধ দেশ বানাতে হবে আর সেখানে প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের ওপর আস্থা আর বিশ্বাস রাখতে হবে।


আমাদের সৌভাগ্য যে আমাদের সংবিধান প্রতি নাগরিকের ওপর আস্থার পরিচায়ক। সেই জন্যেই আমরা বহুপন্থী এক নতুন স্বাধীন রাজ্য করবার স্বপ্ন দেখেছি। আমাদের সংবিধান নাগরিকদের সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা চিন্তা,মত ,বিচারধারাকে ভয় পায় না। কারণ একটাই, যে আমরা কোনো মতকেই অসম্মান করি না। তাই কারুর মত মানা হোক কি না হোক নাগরিক দায়িত্বশীল থাকে। রাষ্ট্রের সেটাই সবচেয়ে শক্তিশালী রক্ষাকবচ।


আমি জানি আমার স্বপ্ন আমি পূরণ করতে পারবো না। আমার লিখন ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। একজন সার্থক লেখক একজন অভিনেতার মতন ভাব আর ভাবনা শ্রোতাদের মনে পৌঁছে দিতে পারে। আমি সেই ক্ষমতার আর কুশলতার অধিকারী নোই। তাই তো আমি অপেক্ষা করে বসে আছি সেই লেখকের জন্যে যার লেখা দেশ -বিদেশের কোটি কোটি মানুষকে প্রত্যেকের নিজের বানানো ছোট্ট গন্ডি থেকে মুক্তি দিতে পারে;যাতে তারা সবাই রৌদ্যোজ্জল বিশাল জগতের নাগরিক হয়ে উঠতে পারে। 


আমি অপেক্ষায় আছি সেই সৃজনশীল মানুষের যে প্রতিটি মানুষের মধ্যের অনন্তের পরিচয় সকলের কাছে পৌঁছে দিতে পারে আর উদাত্ত স্বরে বলতে পারে ,

" জাগো , বিশ্বমানব , তুমি অমৃতের সন্তান। "  


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics