লাল গোলাপ
লাল গোলাপ
"এটা শুধু তোমার জন্য " একগুচ্ছ টকটকে লাল গোলাপ দিতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো দীপ্ত। লাল গোলাপ দিতি খুব পছন্দ করে। অথচ আজ দিতি ওর দিকে তাকিয়েও না তাকাবার ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল। আজ দীপ্ত আর দিতির বিয়ের পুরো পাঁচ বছর পূর্ণ হলো। সেই উপলক্ষ্যে দীপ্ত দিতিকে ফুলটা দিতে গিয়েছিল। কিন্তু দিতির এই আচরণ প্রতিটা মূহুর্তে দীপ্তকে কতোটা কষ্ট দিচ্ছে, সেটা দিতি বুঝতে চায় না। হয়তো বা বোঝবার কোনো চেষ্টাও করে না।
অথচ এই দুমাস আগে অবধি দিতি দীপ্তকে কষ্ট দেবার কথা কল্পনাতে ও আনতো না। নরম ,শান্ত স্বভাবের দিতি তো সবাইকে ভালো বাসতে পারে।কষ্ট কি করে দিতে পারে। কিন্তু গত দু মাস ধরে দিতি প্রতিটা মূহুর্তে বুঝিয়ে দিচ্ছে দীপ্ত কে যে, ও দীপ্তকে আর পছন্দ করছে না নিজের লাইফে।
দীপ্ত একবার ভেবেছিল যে, দিতির বাবা, মাকে ডেকে কথাটা বলে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার এটা ভেবে চুপ করে গেছে যে, ওনাদের বয়স হয়েছে। যদি এইসব জেনে ওনারা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই নিজের মনের মধ্যে সব কষ্ট চেপে রেখে, প্রতি মূহুর্তে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছে সে, আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
"কিছুই আর ঠিক হবে না দীপ্ত।" মনে মনে ভাবছে দিতি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। এখন ও যাবে না বেডরুমে। আগে দীপ্ত ঘুমিয়ে পড়ুক, তারপর ও যাবে। কারণ দীপ্ত ওর কাছাকাছি এলে,ও এই অভিনয় টা কিছুতেই করতে পারবে না যে। ধরা পড়ে যাবে ও দীপ্তর কাছে। তখন ও সত্যি কথা টা বলতে বাধ্য হবে দীপ্ত কে। তার থেকে তো এটাই ভালো যে, দীপ্ত ওকে খুব খারাপ ভাবুক। ওকে ভুল বুঝুক প্রতিটা মূহুর্তে। তখন আর দীপ্তর ওকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হবে না। কারণ দিতি জানে, সত্যি টা জানলে দীপ্ত সহ্য করতে পারবে না। দিতি নিজেও কি দুমাস আগে জানত যে, ওদের দুজনের এই সুখের ঘরে, দুঃখের কালরাত্রি প্রবেশ করতে চলেছে। দীপ্ত ভীষণ ভালোবাসে বাচ্চা। আর তাই বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় ওরা দুজনে একটা ফুটফুটে বাচ্চার প্লানিং করেছিলো। দিতির যখন পিরিয়ড মিস হয়েছিল, তখন ও মনে মনে খুব খুশী হয়েছিল। ভেবেছিল সব একেবারে কনফার্ম করে দীপ্তকে খবরটা দেবে। গাইনোকলজিস্ট ডঃ সেন যখন বুঝতে পেরেছিলেন ব্যাপারটা, তখনই উনি আরও কয়েকটা টেষ্ট করাতে বলেছিলেন দিতিকে।
আর তারপর যখন সব রিপোর্ট চলে এসেছিল, তখনই উনি দিতিকে বলেছিলেন, হাজব্যান্ড কে ডেকে দিতে। কিন্তু দিতি কিছুতেই রাজি হয়নি। বলেছিল যা বলবার ওকেই বলতে। ও সবকিছু শোনার জন্য প্রস্তুত। ডঃ সেন যখন বলেছিলেন, যে দিতির ইউট্রাসে এই মুহূর্তে একটা বেবি না, একটা টিউমার প্রতিদিন বেড়ে চলেছে একটু একটু করে। আর এই টিউমার অপারেশন করবার পর আর দিতি কোনো দিন ই মা হতে পারবে না। দিতি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। কিন্তু না এতটা ভেঙ্গে পড়লে কি করে চলবে। দীপ্ত কে এই নিষ্ঠুর সত্যি টা কিছুতেই জানতে দেবে না ও। তাহলে তো দীপ্ত নিজেকে সামলাতে ই পারবেনা।
তার থেকে বরং ও নিজেকে দীপ্তর কাছে এতটাই ঘৃনা র পাত্রী করে তুলবে ওর খারাপ ব্যবহারের মাধ্যমে যে
দীপ্ত নিজেই ওকে ওর জীবন থেকে বের করে দিতে চাইবে। আর ও দীপ্তর জীবন থেকে চলে গেলে, দীপ্ত আবার নতুন করে সংসার করতে পারবে।
আর তাই পরিকল্পনা মাফিক ও এক এক ধাপ এগিয়ে চলছে। এই তো আজ ই ওদের বিবাহ বার্ষিকীর দিনে ও দীপ্তকে নিজের খারাপ ব্যবহার দিয়ে বুঝিয়ে দিলো যে, ও কতোটা খারাপ মেয়ে। দীপ্ত র ভালোবাসা ওর কাছে কতোটা অর্থহীন। কিন্তু সত্যি ই কি তাই? দীপ্ত র সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে ও নিজেও কি ভালো আছে। কতটা কষ্ট ও পাচ্ছে ,তা ও নিজে জানে। কিন্তু না। ও কিছুতেই দীপ্ত কে বুঝতে দেবে না যে, ও এটা অভিনয় করছে।
"দিতি" খুব আবেগঘন কণ্ঠে দীপ্ত ডাকলো ওকে।
"এ কি, দীপ্ত এখনও জেগে কেন আছে? ও তো এজন্যই যাচ্ছে না এখন দীপ্ত র কাছে। আবার এদিকেই তো আসছে মনে হচ্ছে। ওর সামনে দীপ্ত এলে , ও কি পারবে নিজেকে সামলাতে? যদি সব গোলমাল হয়ে যায়?"
দীপ্ত দিতির একেবারে কাছে এগিয়ে এলো। তারপর দিতি কে নিজের দিকে ফেরালো। দিতির মুখটা নিজের দুহাতে ধরে ওর সামনে নিয়ে এলো।
"না কিছুতেই পারা যাচ্ছে না। দীপ্তর পুরুষালি গন্ধ ওর নাকে। একটা কেমন যেন ঘোরলাগা, আচ্ছন্নতা ওকে গ্ৰাস করছে। পুরুষের গন্ধের এই মাদকতা অস্বীকার করার শক্তি ওর নেই। দিতিকে তুলে নিয়ে বেডে গেলো দীপ্ত। নিজের দিকে টেনে জড়িয়ে ধরলো পরম আবেগে।
তারপর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,"দিতি আমি জানি তুমি কেন এরকম ব্যবহার করছো আমার সঙ্গে। সব জানি আমি। ডঃ সেন আমাকে সব বলেছেন।"
চমকে তাড়াতাড়ি নিজেকে দীপ্তর কঠিন বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করতে গেল। কিন্তু দীপ্ত সেইভাবেই ওকে চেপে ধরে থাকলো নিজের বুকের সঙ্গে। তারপর ও দিতিকে বললো ,"তুমি কি করে ভাবলে যে, আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি নিজে যে কষ্টটা পাচ্ছ, সেটা আমি বুঝতে পারবনা। তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে যদি তোমার মনই না পড়তে পারলাম এতদিনে, তাহলে তোমাকে এতদিন কি ভালোবাসলাম দিতি। তোমার মনের খবর রাখাটাও আমার দায়িত্ব। আর একটা কথা, অভিনয় টা তুমি এখনও অতটাও ভালো শিখতে পারোনি ম্যাডাম।"
দিতি আর নিজের আবেগ সম্বরণ করতে পারলো না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো দীপ্তকে জড়িয়ে। তারপর বললো,"তোমার কথা ভেবে করেছি সব। তোমাকে সন্তান না দিতে পারার কষ্ট থেকে করেছি এসব। আমি তোমার জীবন থেকে চলে গেলে, তুমি আবার নতুন করে শুরু করতে পারবে, তাই করেছি এসব।"
------কিন্তু দিতি তখন ও যদি আমার সন্তান না হয়, তখন তুমি কি করবে। পারবে তো নিজেকে ক্ষমা করতে। এই পৃথিবীতে বহু মানুষ আছে, যারা সন্তান সুখ থেকে বঞ্চিত। তারা বেঁচে আছে তো নিজেদের নিয়ে। সেরকম হলে আমরা সন্তান দত্তক নিতে পারি। তাকে নিজেদের সন্তান স্নেহে বড়ো করে তুলব। কিন্তু তাই বলে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। এটা কোনোদিন ভাবতে পারবনা আমি"।
তারপর উঠে টেবিলের উপর রাখা লাল গোলাপ গুলো দিতির হাতে দিয়ে বললো, "বি লেটেড অ্যানিভার্সারি ডিয়ার"। ঘড়ির কাঁটা তখন নতুন দিনের অপেক্ষায়.