ক্যানভাস
ক্যানভাস
সন্দিপ রায় মন দিয়ে পেপার পড়ছে। না, কোন রাজনীতির বা খেলার খবর নয়। শেয়ার
মার্কেটে বেশ কয়েকশো সূচক পড়েছে, সেটাই মন দিয়ে পড়ছে। দুতিনটে বড়ো কোম্পানির
শেয়ার পড়ায় সন্দিপ একটু চিন্তিত। রাইমা চায়ের গ্ল্যাসটা টেবিলে রেখে জিজ্ঞেস
করল, ‘হোয়াট হ্যাপেনড? এনি থিং রং?’ রাইমা কনভেন্টে পড়া মেয়ে। কথায় কথায়
ইংরাজী বলে ফেলে। তবে নিজেকে জাহির করতে নয়, নিতান্তই অভ্যাস বশত বলে ফেলে।
না, কিছু হয়নি বলে সন্দিপ চায়ের গ্লাসে চুমুক দিল। ‘বাটার টোস্ট, ডিম সেদ্ধ কিছুই
তো খেলে না? কাল অনেক রাত্রে খেয়েছি তো, মনে হয় অ্যাসিড হয়ে গেছে। রাইমা কিছু
বলতে যাচ্ছিল, কি মনে করে কিছু বলল না হয়তো উত্তরটা জানা। অফিসে পার্টি ছিল
কিংবা কোন বন্ধুর বাড়ী থেকে খেয়ে এসেছে। সন্দিপ একটা অ্যাড এজেন্সির ক্রিয়েটিভ
ডিরেক্টর। গত বছর একটা ফেয়ারনেস ক্রিমের অ্যাড বানিয়ে এওয়ার্ড পেয়েছিল।
সন্দিপ আনমনে কিছু ভাবছিল। রাইমা টাই পরাতে থাকে। সন্দিপের ফোনটা বেজে উঠল।
সন্দিপ হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গেই ফোনের ওপার থেকে ভেসে এলো, ‘ শুনেছেন মুখার্জী
আবার মুম্বাই থেকে ব্যাক করছে। আমি কালকেই শুনেছিলাম আপনাকে বলা হয়নি’। ‘ও
তাই ! ভালো তো! ‘মুম্বাই এ যে বেশিদিন টিকবে না সেটা আমি আগেই জানতাম। বাঙালী
ছেলেদের মাছ ভাত- মাংস ভাত না হলে চলে’। ‘আপনি বলতে চাইছেন মুম্বাই এ মাছ, মাংস
পাওয়া যায় না’? সন্দিপ একটু গম্ভীর ভাবে বলল। ‘না, না সেটা বলছি না, আসলে
কলকাতায় থাকার যে মজা সেটা কি অন্য কোথাও পাওয়া যায়’? ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমি
বেড়োচ্ছি বাকি কথা অফিসে হবে। সন্দিপ রায় মোবাইলটা পকেটে পুড়লে, রাইমা বলে,
বুবলাইয়ের জন্মদিন ওর জন্য কি একটা ড্রয়িং সেট কিনে নেবো? ‘কোন বুবলাই’?
‘বুবলাইকে ভুলে গেলে? রঞ্জুদার ছেলে? তোমার তো কিছুই মনে থাকে না দেখছি’? ‘ও
আচ্ছা, মনে পড়েছে। ওকে একটা খেলনা কিনে দাও। ‘কেন ড্রয়িং সেট কিনে দিলে কি
হবে? ‘কিছু হবে না, বুবলাইতো পাবলো পিকাসো হবে না’? রাইমা সন্দিপের মুখের দিকে
চেয়ে আছে। সন্দিপ কি কিছু মিন করতে চাইছে? রাইমা কে অন্যমনস্ক দেখে, সন্দিপ
বলে, তোমার যা ইচ্ছে তাই কিনে নিয়ে যেও, আমি চললুম দেরি হয়ে যাচ্ছে।
সন্দীপ অফিস চলে গেলে, রাইমা টবে লাগানো গাছ গুলোতে জল দিল। হটাৎ করেই মনে
পড়ল, চিলে কোঠার ঘরটা অনেকদিন পরিষ্কার করা হয়নি। দরজা খুলেই একটা সোঁদা
সোঁদা গন্ধ অনুভব করল রাইমা। একটা সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা সন্দীপ এই ঘরে থাকত।
প্রায় ৫ বছর হয়েগেল সন্দীপ এই ঘরে আর ঢোকে না। চারিদিকে সন্দিপের আঁকা
পোট্রে। কোনটা শুধু পেনসিল দিয়ে স্কেচ করা কোনটা জল রং। বছর আটেক আগে
গগনেন্দ্র ভবনে এই রকমই এক পেনসিল দিয়ে স্কেচ করা পোট্রে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল
রাইমা। অনেকটা গায়েপরেই আলাপ করেছিল রাইমা। একটা ডাইরি বার করে অটোগ্রাফ
চাইলে সন্দীপ বলে, ‘অটোগ্রাফ চাইছেন, দিচ্ছি কিন্তু আমি কোন বড় শিল্পী নই, মনের
খেয়ালেই ছবি আঁকি। আপনি সারাজীবন মনের খেয়ালেই ছবি এঁকেযান সন্দিপদা, আপনার
ছবি আন্তর্জাতিক মানের। এরপর সন্দিপের প্রায় প্রত্যেকটা প্রদর্শনীতেই রাইমা
থাকত। সন্দিপের বাবা অনেকদিন আগেই মারা গিয়েছিলেন। মায়ের পেনশেন আর নিচের
তলার ঘর ভাড়ার টাকায় সংসার চলত। রাইমার সাথে যখন বন্ধুত্ব এক বছর গড়িয়েছে
হটাৎ করেই সন্দিপের মা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।সন্দিপ আরও বেশি করে রাইমার
উপর নির্ভরশীল হতে থাকে। সন্দিপের মা মারা যাবার তিন মাস পর একদিন
সন্ধ্যাবেলায় রাইমা সন্দিপের বাড়ী আসে। হাতে একটা বড়ো ব্যাগ। সন্দিপ কিছু বুঝে
উঠার আগেই রাইমা বলে, ‘আমি আজ থেকে এখানেই থাকব’। ‘মানে কি? তোমার বাড়ির
লোক জানে? ওরাতো এখুনী পুলিশে খবর দেবে’। ‘না দেবে না, আমি বাড়িতে বলে এসেছি’
রাইমা ধীর গলায় উত্তর দেয়। কিন্তু তুমি তো জানো, আমি তেমন কিছু করিনা, কি
করে...। উফ! তোমাকে কিছু করতে হবে না, আমি একটা জব পেয়েছি, যা মাইনে পাবো
আমাদের চলে যাবে।
দেওয়ালের এককোণে রাইমার একটা পোট্রে ঝুলছে। পাহাড়ী মেয়েদের মতো সেঁজে বসে
আছে। বিয়ের একমাস পরই দার্জিলিং গিয়েছিল। ঠিক হানিমুন বলা যায় না। সন্দিপ
কারশিয়াং এ একটা স্কুলে ওয়াকসপ করাতে গিয়েছিল। একদিন ওয়াকসপ থেকে সন্দিপ
ফিরলে রাইমা বলে, ‘যদি একসঙ্গে সময়ই না কাটানো যায় তাহলে আর মধুচন্দ্রিমার
মানে কি’? সন্দিপ কিছুক্ষণ চুপ চাপ থাকে তারপর বলে, ‘তুমি একজায়গায় ১ ঘণ্টা বসে
থাকতে পারবে? ‘কেন? তুমি কি টাইটেনিকের মতো ছবি আঁকবে’? রাইমা চোখ দুটো বড়
করে জিজ্ঞেস করে। হ্যাঁ। তবে উইথ কস্টিউম। তোমাকে আমি আজ পাহাড়ি মেয়ে
সাজাবো। প্রথম ১০ মিনিট বসে থাকতে কোন অসুবিধা হয়নি রাইমার। একটু নড়লেই
সন্দিপ বলে উঠে, ‘এই একদম নয়, চুপচাপ লক্ষ্মী মেয়ের মতো বসে থাকো’। এর পর
রাইমা আর কোনদিন পোট্রে করার কথা বলেনি। মডেলদের অসীম ধর্য্যের জন্য অবাক
হয়েছে। একবার সন্দিপকে জিজ্ঞেস ও করে ছিল, ‘তোমার মডেলরা ২-৩ ঘণ্টা বসে
থাকে কি করে? এটা ওদের professionalism এবং dedication দুটোর সংমিশ্রণ।
ওয়াকশপের শেষ দিনে ম্যালে বেড়াতে গিয়েছিল। জানো রাইমা এই বাজারটার পাশে একটা
বুদ্ধ মন্দির আছে, তুমি যাবে? তুমি কি করে জানলে? রাইমা বিস্ময় প্রকাশ করল।
আর্ট কলেজে পড়ার সময় একবার এসেছিলাম। তাই! তোমারা মন্দির দেখতে এসেছিলে
নাকি? তা নয়। আমরা দার্জিলিং বেড়াতেই এসেছিলাম। আমার এক বন্ধু আমাকে নিয়ে
এসেছিল। কেন? আমাদের এক ক্লাসমেটকে ওর ভালো লাগতো কিন্তু কিছুতেই বলতে
পারছিল না। শেষে আমার দায়িত্ব পড়ল তাকে জানানোর। তুমি পিয়নের কাজে সফল হয়ে
ছিলে? রাইমার মুখে একটা হাসি মাখানো বিস্ময়। মেঘনার সাথে আমার আগে থেকে
আলাপ ছিল। আমি ওকে একটা চিরকুট দিলে, সে এক পলক দেখেই সেখানে ফেলে দেয়।
তারপর? আমার কি দূরবস্থা! সবার সামনে চিরকুট দেওয়াটা মনে হয় ঠিক হয়নি। সেই
সময় মনে হচ্ছিল ধরিত্রি তুমি দ্বিধা হও আমি ঢুকে যায়। এটা বেশি বাড়াবাড়ি! সত্যি
বলছি লোকের জন্য এতোটা লজ্জায় কখনও পড়িনি। তোমার চিঠি দেওয়ার সঙ্গে
মন্দিরের কি সম্পর্ক? বলছি, একটু সবুর করুন। এই ঘটনার পর আমি বন্ধুকে বললাম
ভাই তুই মেঘনাকে ভুলে যা, ওর কাঁদতে বাকী, কোথা থেকে শুনেছিল আমি জানি না,
আমাকে টানতে টানতে এই বুদ্ধ মন্দিরে নিয়ে এসেছিল। কিছু দিন পর বন্ধুটা আর্ট
কলেজ ছেড়ে দিয়েছিল। আমার সাথে অনেকদিন কোন কনট্যাক ছিল না। মাস তিনেক
আগে সল্টলেকে একবার দেখা হয়েছিল। একথা সেকথা পর জিজ্ঞেস করলাম কি রে
মেঘনাকে ভুলতে পেরেছিস? ও বলল সেটা মনে হয় আর সম্ভব নয়, এক সাথে ঘর করছি
তো! আমি না এক মিনিট কোন কথা বলতে পারিনি। বন্ধুটা আমার মনের অবস্থা দেখে
বলল, ‘আমরা বুদ্ধ মন্দিরে গিয়েছিলাম তারই ফল পেয়েছি, আমাদের একটা দুবছরের
বাচ্চা আছে, নাম আয়ুস। আমি কিছুটা ধাত্বস্ত হয়ে বললাম বা! কনগ্র্রাচুয়েশন!
কিন্তু কি করে হল। ও তো... । আজ ব্যস্ত আছি একদিন বাড়িতে আয় সব বলব। সন্দিপ
ম্যালের বাজার থেকে একটা স্কার্ফ কিনে দেয় রাইমাকে। রাইমা ঘর সাজানোর কয়েকটা
জিনিস কেনে। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে মন্দিরের কাছে এসে পড়ে। কলকাতার মতো ফল ফুল
দিয়ে পূজো করার রেওয়াজ নেই। মন্দিরের ভিতরে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। রাইমা
কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকল। ভগবানের কাছ থেকে কি চাইলে? বলব কেন? সন্দিপ
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রাইমার দিকে চেয়ে আছে। রাইমা হেসে বলল, ‘পতি দেবতা যেন আর
বেশি সময় দেয় আরও অনেক বেশি ভালবাসে’। তোমাকে একটু কম ভালবাসছি বলছ?
রাইমা মুখে হাসি রেখেই ঘাড় নারাল। কেন তোমার এই রকম মনে হচ্ছে? সন্দিপ একটু
গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করল। এই ধরো আমি তোমাকে জিজ্ঞেস না করেই তোমার ঘরে
এসেছি, তুমি হয়তো কিছুটা বাধ্য হয়ে বিয়েটা করেছ। সন্দিপ কয়েক মুহূর্ত রাইমার
দিকে চেয়ে থেকে বলল, ‘ মানুষের কিছু আবেগ কে অনুভব করতে হয়, মুখে বললে
মাধুর্য্য নষ্ট হয়ে যায়’।
রাইমা জানলাটা খুললে সূর্যের আলো ঘরের এক কোনে রাখা পোট্রের উপর পড়ে।
পোট্রের নিচে ছোটো করে তারিখ লেখা ২৪ শে সেপ্টেম্বর ২০১০। সেই দিন সকাল ৯ টার
সময় রাইমা অফিসের জন্য বেড়িয়ে যায়। যাওয়ার আগে বলে যায় ঘরের ইলেকট্রিক বিল
জমা দিতে এবং কিছু সবজি নিয়ে আসতে। সন্দীপ একটা পোট্রে আঁকছে মন দিয়ে, কানে
কোন কথা ঢুকেছে কিনা বোঝা গেল না। সন্ধ্যে ৭টার সময় ফিরে এসে রাইমা দেখে
ইলেকট্রিক বিলের কাগজ যেখানে ছিল ঠিক সেখানেই পড়ে রয়েছে। ডাইনিং টেবিলের
উপর মুড়ির প্যাকেট, থালা, চায়ের গ্লাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। রাইমা কাঁধের ব্যাগটা
খাটের উপর রেখে চিলে কোঠার ঘরে যায়।সন্দিপ তন্ময় হয়ে ছবি আঁকছে, ঘরের ভিতরে
একজন এসেছে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ঘরের মেঝেতে রং, তুলি কাগজ ছড়ানো। এই নিয়ে
পাঁচ বার চেষ্টা করেও সন্দিপ ঠিক যেমনটা চাইছে ঠিক তেমন ভাবে পোট্রে টাকে
ফুটিয়ে তুলতে পারছে না। তিন বছরের এক সাওতালি বাচ্চা তার মাকে অর্ধেক বিস্কুট
খাওয়াচ্ছে। সন্দিপ চাইছে মায়ের মুখটাতে হাসি এবং একই সঙ্গে ভিতরের একটা কান্না
ফুটিয়ে তুলতে। হাসিটা তো ঠিক আছে কান্নাটা আসছে না! ঘরের ছিটকানি টা লাগাওনি
কেন? রাইমা জিজ্ঞেস করে। রঞ্জু আর শ্যামল এসেছিল, তারপর আর লাগানো হয়নি।
সন্দিপ ক্যানভাস থেকে মুখ না ঘুরিয়েই উত্তর দিল। ‘ইলেকট্রিক বিল জমা দাওনি
কেন’? ‘একবার ভেবেছিলাম যাবো, কিন্তু আর হয়ে উঠল না, থাক আগামীকাল দিয়ে
দেব’। ‘আজকে এই মাসে বিল জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল, কাল জমা দিতে গেলে ফাইন
দিতে হবে। রাইমা কথা গুলো চিৎকার করে বলল। সন্দিপ চুপ করে থাকে। ঘরটার কি
অবস্থা করে রেখেছ , দেখেছ? এখানে কোন মানুষ থাকে? সন্দিপ পরিবেশটা একটু
হালকা করার জন্য বলল, ‘আমার মনে হয় ভূত থাকে! আমি ভূত আর তুমি পেত্নী, কথাটা
বলেই সন্দিপ হাসার চেষ্টা করল। রাইমা একই রকম গম্ভীর হয়ে আছে। চানাচুরের
প্যাকেট শেষ হয়ে গেছে বলনি তো? সন্দিপ বলল। রাইমা আর নিজের নার্ভ কে ধরে
রাখতে পারল না। সে চিৎকার করে বলল, ‘সাট আপ! জাস্ট আই কান্ট টলারেট ইউ। দিন
দিন কেমন হয়ে যাচ্ছ সন্দিপ। তোমাকে সবজি আনতে বলেছিলাম, এনেছ? সন্দিপ
জানলার দিকে চেয়ে আছে। রাইমা মেঝের উপর বসে পড়ল। চোখ দিয়ে জল পড়ছে। সন্দিপ
কি করবে বুঝতে পারছে না। নিজের আঁকা পোট্রের দিকে একবার চাইল। এতোক্ষণ যেটা
দেখে কিছুই হচ্ছে না মনে হচ্ছিল এখন সেটাই এক অসাধারণ ছবি মনে হচ্ছে। রাইমার
চোখের জল যেন ছবিটার মধ্যে ফুটে উঠেছে।
দিন সাতেক হয়ে গেল সন্দিপ একটা পোট্রে বানাচ্ছে। এই বছর প্যারিসে আন্তর্জাতিক
পোট্রেট প্রতিযোগিতা শুরু হবে ২২শে ফেব্রুয়ারী। সন্দিপ অংশ গ্রহণ করতে চায়।
এন্ট্রি ফ্রি যাতায়াত নিয়ে প্রায় ১৫০০০০ টাকা খরচ। ব্যাঙ্কে লাখ খানেক টাকা
আছে। এদিক ওদিক থেকে হাজার দশেক হয়ে যাবে। বাকি ৪০০০০ টাকা কোথায় পাবে?
সন্দিপ চিন্তা করছে রাইমাকে বললে কি দেবে? গত বছর মানালি গিয়েছিল প্রতিলিপি
প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করতে। কিন্তু প্রথম দ্বিতীয় বা তৃতীয় কিছুই হতে পারেনি।
শুধু পাবলিক চয়েস অ্যায়ার্ড পেয়েছিল একটা মোমেন্টো। এদেশে এতো পলিটিক্স আর
লবি চলে যে নতুন কিছু করাই খুব মুশকিল। সেবার রাইমাকে বড়ো মুখ করে বলেছিল,
‘দেখবে প্রথম পুরষ্কার এক লক্ষ টাকা আমিই পাবো। তোমাকে একটা ডাইমন্ডের রিং
দেবো’। রাইমা মাঝে মাঝে তার পুরানো রিং টা দেখিয়ে বলে, ‘দেখেছ সন্দিপ আমার
ডাইমন্ডের রিং টা কেমন চক্ চক্ করছে। এখন যদি ৪০০০০ টাকা চাই রাইমা কি দেবে?
দেখা যাক! রাইমাকে বলার সাথে সাথেই নাকচ করে দিল। কোথা থেকে দেব? তুমি দিয়ে
রেখেছ? রাইমা বেশ জোর গলায় জিজ্ঞেস করল। সন্দিপ আস্তে আস্তে বলল, ‘না মানে
তোমার নামে ফিক্সড ডিপোজিট আছে না, সেটা যদি ভাঙাতে। আমি ১০০% কনফিডেন্ট
এবার...’ থাক্ থাক্ তোমার আত্মবিশ্বাস তোমার কাছেই থাক। গত বছর ডাইমন্ডের রিং
দিয়েছিলে না? এবছর না হয় থাক। রাইমা একটু ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলল। ‘রাইমা তুমিই
তো চাইতে আমি একজন আন্তর্জাতিক মানের শিল্পী হই, এখন যখন সুযোগ এসেছে,
অল্প কয়েক টা টাকার জন্য পিছিয়ে যাবো। পিছিয়ে যেতে বলছি না তো? তুমি আর একটু
তৈরি হও। সল্টলেকে একটা অ্যাড এজেন্সিতে পোস্ট ভ্যাকান্সি আছে, আমার এক
রিলেটিভ আছে, আমি তোমার কথা বলেছি। আরে এই প্রতিযোগিতায় একবার ফাস্ট
প্রাইজ পেয়ে গেলে আর চাকরী করতে হবে না। মকবুল ফিদা হুসেন তো... । উফ্ থাক,
তোমার মতো কুঁড়ে লোক আর দেখিনি, তুমি তাহলে চাকরী করবে না? তুমি জানো একজন
বিখ্যাত লোক কি বলেছিলেন, ‘ শিল্পীদের কখনও ১০-৫ টা বা ৯ টা ৬ টার টাইম লাইনে
বেঁধে রাখা উচিৎ নয়’। বিখ্যাত লোকটার নাম কি সন্দিপ রায়? রাইমা জিজ্ঞেস করল।
সন্দিপ কোন কথা না বলে দাঁত বার করে হাসতে লাগল। তোমার এই হাসিটা আমার
অসহ্য লাগে। কথাটা বলেই রাইমা বেড়িয়ে গেল। সন্দিপ ঘর থেকেই চিৎকার করে
জিজ্ঞেস করল, ‘টাকা তাহলে দিচ্ছ না’? বার থেকে উত্তর এল ‘না’।
দিন দুয়েক বহু চেষ্টা করে, বন্ধুদের কাছে ধার করে ২০০০০ টাকা জোগাড় করেছে
সন্দিপ। সময় তখন ১০ টা ১১ টা হবে, রাইমা অফিসে গিয়েছে। সন্দিপ একবার
আলমাড়ির ভিতরের লকারটা খুলল। একটা হার, দুটো বালা, তিনটে নাকের নথ্ আর
হাজার দুয়েক টাকা রয়েছে। সন্দিপ ভাবতে থাকে কি করবে? দিন কুড়ির মধ্যে কি
রাইমার হার টা লাগবে? কোথাও তো যাবার প্লান নেই। একবার কম্পিটেশনে জিতে গেলে
আর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না। তখন এই রকম দু-তিনটে হার কিনে দেবে রাইমা কে।
সন্দিপ হারটা বন্ধক দিকে টাকা জোগাড় করে। ঠিক দিন সাতেক পরে রাইমা হারটা
খোঁজ করতে শুরু করে। অফিসের এক কলিগের ছেলের জন্মদিনে নেমন্তন্ন। প্রথমে
আলমাড়ী, বিছানার তলা তারপর নিজের দুতিনটে ব্যাগ প্রায় সব জায়গা খুঁজল। কোথাও
পেল না। রাত্রে ফিরে এসে সন্দিপকে জিজ্ঞেস করল, তুমি আমার হারটা দেখেছ?
তোমার হার! না তো? হারটা আমার দাদু দিয়েছিল, ক্লাস টেন থেকে আমি হারটা আমি
পড়ছি। ও ছাড়! পরে আমি বানিয়ে দেবো। রাইমা কোন কথা বলে না, সন্দিপের মুখের
দিকে চেয়ে আছে। সন্দিপ একটু অসস্তি বোধ করছে। সন্দিপ বলে, ‘কি হবে জিনিসের
জন্য মায়া করে’? রাইমা একটু কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি আমার হারটা বেঁচে
দিয়েছ না’? আমি না তো। কথা টার মধ্যে কোন জোর ছিল না। রাইমা বুঝতে পারে সন্দিপ
কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে। রাইমা সন্দিপের কাছে এসে বলে, ‘আমাকে ছুঁয়ে বলো, তুমি
হারটা বেঁচো নি’। সন্দিপ একটু দূরে সরে গিয়ে বলে, ছেলে মানুষী করছ কেন, বলছি তো
নিই নি। এবারেও কথার মধ্যে কোন জোর খুঁজে পেল না রাইমা। রাইমা আর কিছু
জিজ্ঞেস করে না। বিছানায় শুয়ে পরে মুখ গুঁজে। বালিশ ভিজতে থাকে। সন্দিপ হারটা
বেঁচেছে বলে যত টা না কষ্ট হচ্ছে, সন্দিপ ওর বিশ্বাসে আঘাত করেছে বলে বেশি কষ্ট
হচ্ছে। মা-বাবার সাথে ঝগড়া করে ঘর থেকে বেড়িয়ে এসেছে। প্রায় দুবছর হয়ে গেল,
একদিনও বাপের বাড়ী যায়নি। যে লোকটাকে বিশ্বাস করে বেড়িয়ে এসেছে সেই যদি
বিশ্বাসের মূল্য না দেয়, ভালোবাসার গুরুত্ব না বোঝে তাহলে কার জন্য লড়াই করা।
রাইমার আর বেঁচে থাকতে ভালো লাগছে না। রাত্রি ২ টোর সময় একবার ওয়াস রুমে
গেল। হটাৎ করেই যেন মাথায় ভূত চেপে গেল। বাথরুমে রাখা ফিনাইলের বেশ কিছুটা
অংশ খেয়ে ফেলে। ভিতরের সব কিছু যেন জ্বালা করতে থাকে। বমি পাচ্ছে কিন্তু হচ্ছে
না। বেশ কিছুক্ষণ পর সন্দিপ বাথরুমে যায়। দেখে রাইমা ওয়াক ওয়াক করছে,
ফিনাইলের বোতলটা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে! রাইমার মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। ছুটে নিচের
তলার মাসিমাদের ডাকল। ভোর ৪ টের সময় রাইমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল।
রাইমা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। হাসপাতালে রাইমাকে একটু বমি করানোর চেষ্টা করা হল।
সকাল ৯ টার সময় পুলিশ এলো। রাইমা জানালো কেউ তাকে বাধ্য করেনি ফিনাইল খেতে।
দিন তিনেক পরে রাইমাকে ছেড়ে দিল। তবে সলিড খাবার খেতে মানা করেছে। ডাক্তার
আরও বলল , ‘পাকস্থলীর বেশ কিছুটা অংশ পুড়ে গেছে। সেটা রিকভারী করতে সময়
লাগবে। মাস খানেক পরে একটা ছোটো অপারেশন করতে হতে পারে’। রাইমার বাবা-মা
রাইমাকে বাড়ী নিয়ে যায়। সন্দিপ দিন সাতেক পরে দেখতে গেল রাইমাকে। নিজেকে
অপরাধী অপরাধী মনে করছে সন্দিপ। রাইমার হাত ধরে কাঁদতে থাকে। ‘বিশ্বাস করো
আমি বুঝতে পারিনি তুমি এই রকম বোকার মতো কাজ করবে’ সন্দিপ ভাঙা গলায় বলে।
রাইমা এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে চোখ দিয়ে জল গাল বেয়ে বালিশে পড়ছে। বেশ কিছুক্ষণ
পর রাইমা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কবে যাচ্ছ’? আমি যাচ্ছি না, টিকিট ক্যান্সেল করে
দিয়েছি। রাইমা বিস্ময় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। সন্দিপ আরও বলে, ‘সল্টলেকের অ্যাড
এজেন্সি কোম্পানিতে ইন্টার্ভিউ দিয়ে এসেছি। যাওয়ার আগে রাইমার হারটা বালিশের
পাশে রেখে যায়।
সন্দিপ অফিস থেকে ফিরেই ভাবছে রাইমাকে কিভাবে বলবে কথাটা। হাতে খুব বেশি সময়
নেই। দিন পনেরোর মধ্যেই কলকাতা ছাড়তে হবে। অফিস থেকে ফিরেই এক কাপ চা বা
কফি খায়। রোজ রাইমায় বানায়। এখনও মিনিট ৩০ লাগবে রাইমার ফিরতে। সন্দিপ
নিজেই চা বসাল। রান্নার ঘরের দেওয়ালে একটা ছবি দেখে মায়ের কথা মনে পড়ল। তখন
সবে মাত্র ছবি আঁকা শিখছে। দেওয়ালে মায়ের ছবি আঁকতে গিয়ে দুর্গা মায়ের ছবি এঁকে
দেয়। পরে ঘর রং করার সময় সন্দিপের মা আর ঐ জায়গা টা রং করতে দেয় নি।
সন্দিপের বাবা চাইত না, সন্দিপ সারাক্ষণ ছবি আঁকা নিয়ে পরে থাকুক। টার কাছে ছবি
আঁকাটা বিলাসিতা। মায়ের প্রচ্ছন্ন মদতেই সন্দিপের আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়া।
ক্লাস ট্রেনে পড়ার সময় দিল্লীতে এক ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় নিজের কয়েকটা
ড্রয়িং পাঠায়। নির্দিষ্ট মূল্যের ডাক টিকিট না দেওয়ায় বেয়ারিং হয়ে খামটা ঘরে চলে
আসে। সন্দিপের বাবাকে প্রায় ১০০ টাকা দিয়ে খামটা নিতে হয়। এই নিয়ে দু চার কথা
শুনতে হয়েছিল সন্দিপের মাকে। ছেলেকে বোলো পিকাসো হওয়ার স্বপ্ন দেখা ছেড়ে
ভালো করে পড়াশুনা করতে, নাহলে একটা পিয়নের চাকরীও জুটবে না। এখনও সময়
আছে, ছেলেকে সাবধান করে দিও। ‘তোমারও তো ছেলে, তুমিই বলে দিও। ‘আমার কথা
শনে কই! আমার কোন জমিদারি নেই, চাকরী জোটাতে না পারলে গড়িয়াহাটে ছবি ফেরি
করতে হবে। আ! কি কথার ছিরি! আমার ছেলে অনেক বড় শিল্পী হবে।‘ ওই স্বপ্নই
দেখো’। দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ শুনে সম্বিত ফিরল। ঘরের ভিতর ঢুকেই রাইমা
বলল, ‘জানো ড্রয়িং সেটটা পেয়ে বুবলাই খুব খুশি হয়েছে’। ‘এবার তোমাকে একটা খবর
দিই, আমি চাকরিটা আমি ছেড়ে দিয়েছি’। মানে? তুমি এখন কি করবে? রাইমা উদ্বিগ্ন
গলায় জিজ্ঞেস করল। ‘দেখি কি করা যায়’। সন্দিপ গাম্ভীর্য্য বজায় রেখে সকালের
পেপার পড়তে লাগল। মিনিট খানেক নিস্তব্ধতা। ‘কেন ছাড়লে চাকরি টা? ‘এমনি ভালো
লাগছিল না’। সন্দিপ কথাটা বলেই আড়চোখে রাইমার মুখের দিকে তাকাল। রাইমার মুখে
যেন কালো মেঘের ছায়া, মনের ভিতর যেন ঝড় উঠেছে। ‘এখন কি করবে’? ‘জানি না’।
সন্দিপ একই রকম উদাস গলায় উত্তর দিল। এবার রাইমার ধৈয্যের বাঁধ ভাঙল, জোর
গলায় চিৎকার করে বলল, চাকরি ছাড়বে আগে থেকে বলবে না, আমাকে তো একটা
চাকরী জোটাতে হবে! দিন দিন তুমি কেমন একটা হয়ে যাচ্ছ। তোমার সাথে ... রাইমা
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, সন্দিপ মুচকিয়ে হাসছে দেখে থেমে গেল। সন্দিপের ইচ্ছে
হচ্ছিল আরও একটু রাইমাকে রাগাতে কিন্তু ভরসা পেল না। রাগের মাথায় রাইমা যা
করেছিল, ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছে। সন্দিপ বলল, ‘ব্যাগ গোছাও দিন ১৫ এর মধ্যে
আমরা ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছি। রাইমা হাতে ধরে রাখা টাওয়েলটা সন্দিপের মুখে ছুড়ে বলল,
‘এতক্ষণ বলনি কেন? কোন কোম্পানিতে জয়েন করছ? কি পোষ্ট? কতো হাইক
দিচ্ছে’? ‘কুল ম্যাম! কুল! আগে কিছু খাদ্যবস্তু দাও পেটটা ঠাণ্ডা করি, তারপর সব
বলব’। রাইমা ফ্রিজে রাখা খাবার গুলো মাইক্রোওভেনে ওভেনে গরম করতে দিল।
সকাল সাড়ে ৮ টা বাজছে। অন্যদিন সন্দিপের এই সময় স্নান হয়ে যায়। ইতিমধ্যে
রাইমা দুবার ডেকে গেছে। রাইমা স্নান সেরে হিয়ার ডায়ারে চুল শুকোতে শুকোতে
জিজ্ঞেস করে, ‘কি গো আজ অফিস যাবে না’? অফিস! সেটা আবার কি? ধ্যাত! ভালো
লাগে না, অফিস যদি না যাও বলো, ভাত বসাবো। এতো তাড়াতাড়ি? আরে সব কিছু
গোছাতে হবে তো। একদিনে কি সব কিছু হবে? ও! আজ কি স্পেশাল মেনু হবে শুনি? কেন?
রাইমা ডায়ারের সুইচটা বন্ধ করে জিজ্ঞেস করল। না ভালো কিছু রান্না হলে, আজ
অফিস যাবো না। রাইমা ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, ‘তেল কই
কিংবা সরষে ইলিশ’। বাহ! তাহলে আজ অফিস গিয়ে কাজ নেই! তাড়াতাড়ি উঠে মুখ হাত
ধুয়ে বাজারে যাও। থাক! ডাল, আলু সেদ্ধ ভাত করে দাও বলে, সন্দিপ গায়ে চাদর নিয়ে
আবার শুয়ে পড়ল। রাইমার বকুনি খেয়ে সকাল ১০ টা নাগাদ সন্দিপ বাজার করে আনল।
জলখাবার খেয়ে তিন তলার চিলেকোঠার ঘরটাতে ঢুকল। একটা সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা
কাটিয়েছে । গত পাঁচ বছরে আর আসেনি। জানলার পাশে রাখা ক্যানভাসটার দিকে চেয়ে
আছে সন্দিপ। একটা অসম্পূর্ণ ছবি। পেনসিলে করে স্কেচ করা আছে। দিগন্তরেখা
বরাবর সূর্য উঠছে, একটা ছেলে ছুটে যাচ্ছে । সূর্যের রক্তিম আভাটা করা হয়েছিল।
রাইমা সন্দিপের পিঠে হাত রাখে। ও তুমি? ডাকও নি তো। সন্দিপ চমকে উঠে বলে। ‘তুমি
তন্ময় হয়ে কি ভাবছিলে’? তেমন কিছু না, ছেলেটাও ছুটছে, আমরাও ছুটছি, কোথায় যাবো
জানি না। নাম, যশ, টাকার পিছনে ছুটছি। রাইমা সন্দিপের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে,
শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, আর ইউ হ্যাপি সন্দিপ? ‘নো ম্যান ইজ হ্যাপি ইন হিস ওন
স্টেট’। সন্দিপ বলে। রাইমা আবার জিজ্ঞেস করে ‘ আমি অন্য কারো কথা বলছি না,
তুমি সুখী হয়েছে’? হয়তো! হয়তো বা না! রাইমা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানলার দিকে
চেয়ে থাকে। সন্দিপ এবার জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি সুখী হয়েছে? রাইমা ঘাড় নারে, তারপর
বলে , ‘যদি তুমি চাকরীর পাশাপাশি ছবি আঁকাও চালিয়ে যেতে আরও বেশি খুশি হতাম।
সন্দিপ আরাম কেদারায় বসে বলে ওঠে, ‘জানো রাইমা আমাদের জীবনটা আমার ওই
অসম্পূর্ণ ছবিটার মতো, কিছুটা অংশ কল্পনার রং দিয়ে দেখতে হবে তাহলেই দেখবে
আর কোন আক্ষেপ নেই।