Mithun Mondal

Romance Tragedy Others

3  

Mithun Mondal

Romance Tragedy Others

ঃ- সূর্যাস্তঃ-

ঃ- সূর্যাস্তঃ-

12 mins
229


ঃ- সূর্যাস্তঃ-

মিঠুন

‘রাধিকা এডিটিং কমপ্লিট’?শ্রীময়ী জিজ্ঞেস করল।

‘এডিটিং প্রায় শেষ দিদি, এই মাত্র একটা খবর এসেছে, বস বলল ৫টার নিউজে জুড়ে দিতে, ওটাই করছি, জাস্ট ৫ মিনিট লাগবে’।

শ্রীময়ী ঠিক বিকেল ৫টায় খবর পড়তে শুরু করে।

‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনার পর যে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছে তার প্রভাব ভারতেও পড়েছে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘খুব শীঘ্রই একটা বিশেষজ্ঞ কমিটি করে এই মন্দা থেকে বেরোনোর পথ খোঁজা হবে। বিরোধীরা অবশ্য দাবী করছেন শিল্পের জন্য বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে’।

তারপর কয়েকটা রাজ্যের খবর পড়ে, একেবারে শেষ খবরে চলে আসে।

‘এই মাত্র খবর পাওয়া গেল, বিকেল সাড়ে তিনটের সময় ভিক্টোরিয়ার সামনে বাজ পড়ে একজন মারা গেছেন। বিস্তারিত জানার জন্য আমরা চলে যাবো আমাদের প্রতিনিধি শ্যামলের কাছে, হ্যা শ্যামল শুনতে পাচ্ছ’।

 ‘হ্যা শ্রীময়ী, আজ ভিক্টোরিয়ার কাছে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। বাজ পড়ে রবি দাস নামের বছর ২৮ এর এক যুবক মারা যান।বিকেল তিনটের সময় ময়দান সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর ব্জ্র বিদ্যুৎসহ বৃষ্টি শুরু হয়।প্রবল বৃষ্টির সময় কাছের এক টিনের চালের নীচে আশ্রয় নেয়। সেই সময়ই এই দুর্ঘটনাটি ঘটে। শোনা যাচ্ছে ভদ্রলোক স্ত্রীর জন্মদিন উপলক্ষ্যে ভিক্টোরিয়া এসেছিলেন’।

কোন রকমে শ্রীময়ী খবর পড়া শেষ করে ওয়াস রুমে যায়। বুকের ভিতর একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে মুখে আসতে চাইছে। দুএকবার বমি করার চেষ্টা করে, হয় না, চোখে মুখে জল দিয়ে ফিরে আসে এডিটিং রুমে।

‘চোখ মুখ তোমার কেমন লাগছে।কি হয়েছে শ্রীময়ীদি? শরীর ঠিক আছে? রাধিকা জিজ্ঞেস করে।

‘হ্যা ঠিক আছে, একটু জল দাও’। রাধিকা জলের বোতলটা বাড়িয়ে দেয়। শ্রীময়ী একটু ধাতস্ত হয়ে অ্যাপসের দ্বারা একটা গাড়ী বুক করে। মিনিট দশকের মধ্যে গাড়ী চলে আসে অফিসের সামনে। যাওয়ার আগে শ্রীময়ী, রাধিকাকে বলে যায়, ‘আমার শরীরটা ভালো লাগছেনা বলে একটু আগে বেড়িয়ে গেলাম, বসকে একটু বলে দিও প্লীজ’!

‘ও সিওর! নো চাপ!তুমি সাবধানে যেও, বাড়ী পৌঁছে একটা টেক্সট করে দিও’।

শ্রীময়ী একটু হেসে বলে, ‘ঠিক আছে’। শ্রীময়ী গাড়ী করে প্রিন্সেপঘাট যায়।সাড়ে ৬টা বাজে।গঙ্গায় জোয়ার এসেছে। ঢেউ গুলো পারে এসে ধাক্কা মেরে ফিরে যাচ্ছে। সূর্য প্রায় ঢোলে পড়েছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে একেবারে বিলিন হয়ে গেল।শ্রীময়ী একদৃষ্টিতে দ্বিতীয় হুগলী সেতুর দিকে চেয়ে আছে। একটা দুর্ঘটনা কিভাবে মানুষের জীবনকে পাল্টে দিতে পারে। শ্রীময়ীকে প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন পথ দুর্ঘটনা পড়তে হয়। খারাপ লাগে। কিন্তু অনেকটা ডাক্তারদের মতো রুগীর মৃত্যু দেখতে দেখতে গা-সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু বিকেলের দুর্ঘটনার খবর তার মনের ভিতর জমে থাকা ক্ষতকে জাগিয়ে তুলেছে। শ্রীময়ী ভাবে যার স্বামী মারা গেলেন তিনি প্রতি বছর এই দিন নিজেকে ধিক্কার দেবে এই ভেবে কেন সে জন্মদিন উদযাপন করতে ভিক্টোরিয়া গিয়েছিল? যে মানুষটা দুর্ঘটনায় মারা যান, তিনি হয়তো ততক্ষণ কষ্ট পান যতক্ষণ জীবন মরণের সাথে লড়ায় করছেন। কিন্তু যে এই দুর্ঘটনার সাক্ষী থাকে তাকে মনে হয় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বুকের ভিতর এক চিনচিনে ব্যাথা নিয়ে থাকতে হয়। প্রায় ৩ বছর আগে ঘটে যাওয়া এক দুর্ঘটনা শ্রীময়ী রোমন্থন করে। 

       


 

    

II

খুট করে দরজা খোলার আওয়াজ হল। শ্রীময়ী ঘুমের ঘোরেই বিছানার ডান দিকে হাত বাড়ায়। শ্রীময়ী চোখ খুলে দেখে পাশে ঋতব্রত নেই। ঘর অন্ধকার। আঙ্গুলে করে চোখটা ঘোষে ঘুম ছাড়ানোর চেষ্টা করে। ছোট থেকেই শ্রীময়ী একটু ঘুম কাতুরে। একবার বিছানায় শুয়ে পড়লে, মরা মানুষ আর শ্রীময়ীর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। কিন্তু দুদিন আগে একটা ঘটনায় শ্রীময়ী একটু ভয় পেয়ে গেছে।শ্রীময়ীদের একেবারে পাশের এপার্টমেন্টের ঘটনা। সন্ধ্যে সাড়ে ৭টা কি ৮টা হবে। হঠাৎ করে পুলিশের গাড়ী। শ্রীময়ী সবেমাত্র ঘরে ঢুকেছে, ঋতব্রত তখনও আসেনি অফিস থেকে। শ্রীময়ীদের এপার্টমেন্টে এসে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল।পাশের এপার্টমেন্টে একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা একা থাকতেন। দুষ্কৃতীরা এপার্টমেন্টে ঢুকে ভদ্রমহিলাকে খুন করে টাকাপয়সা গয়না গাটি সব নিয়ে গেছে। শ্রীময়ীদের যদিও সিকিউরিটি গার্ড আছে তবুও ভয় হয়! অন্ধকারেই মোবাইলটা খুঁজল। কিন্তু যা হয় আর কি! কাজের সময় কিছু পাওয়া যায় না!কিন্তু অন্ধকারে কিছুক্ষণ থাকলে আমাদের চোখ ধাতস্ত হয়ে যায়। তখন অন্ধকার ঘরেও অস্পষ্ট অনেক কিছু বোঝা যায়। শ্রীময়ীর মনে হচ্ছে দরজার কাছে যেখানে লাইটের সুইচ বোর্ডটা আছে সেখানে কেউ একজন দাড়িয়ে আছে।শ্রীময়ীর গলা শুকিয়ে আসে। আবার বালিশের পাশে হাত বাড়ায়। এবার মোবাইল খুঁজে পায়। কিন্তু মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট আর জ্বালাতে পারে না। শ্রীময়ী চিৎকার করব ভাবে কিন্তু শ্রীময়ীর মনে হচ্ছে গলাটাকে কেউ ধরে রেখেছে। কোনও আওয়াজ বেড়োচ্ছে না। হঠাৎ করে ঘরের আলোটা জ্বলে ওঠে। শ্রীময়ী দেখে ঋতব্রত।তুমি অন্ধকারে কি করছিলে বলার আগেই ঋতব্রত বলে ওঠে, ‘Happy birthday sweetheart’. জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা। ১০০ বছর দীর্ঘায়ু হও!

‘সেই! জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য কেউ অন্ধকারে দাড়িয়ে থাকে! আমারতো হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিলো’।

‘কি করব বলো, পাশের ঘরে ল্যাপটপে দেখলাম ১২টা বাজতে ২ মিনিট বাকী আছে তাড়াতাড়ি শাট ডাউন করে এই ঘরে ঢোকার আগে মোবাইলে দেখি তিন মিনিট বাকী আছে ১২টা বাজতে। বাধ্য হয়েই মিনিট তিনেক দাড়িয়ে ছিলাম তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো বলে।Bye the way তুমি ভূতের ভয় পাও এটা কোনদিন বলনি তো’।

‘হুম! ভূতের ভয় যতটা না পায়, মানুষের ভয় তার থেকে বেশি পায়।চারপাশে কিছু মানুষ রূপে জানোয়ার ঘুরে বেড়াচ্ছে জানো তো? দিল্লীর কেসটা মনে নেই, দুদিন আগে পাশের বাড়ীর চুরি যাওয়া ঘটনাটা মনে আছে তো’?

ঋতব্রতর হাসিখুশি মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়।

‘এই রকম ঘটনা যে আমাদের পাড়াতে ঘটতে পারে কোন দিন ভাবতেই পারিনি। কিছু দিন ধরেই দেখছিলাম জানো তো, দু-তিন জন সামনের পাঁচ মাথার মোড়ে ঘোরাঘুরি করত। এখন আর দেখতে পাইনা।ওরাই ফলো করছিলো কি না কে জানে? ভদ্রমহিলা একা থাকতেন এই খবরটা কেউ ভেতর থেকে দিয়েছে’।

‘পুলিশ এলো তখন বলতে পারতে’।

‘পুলিশকে আমি কি বলতাম, দু-তিন জন মোড়ের মাথায় ঘোরাঘুরি করছিল। তারপর পুলিশ আমাকে ছেড়ে দিত? চার বার থানায় ডেকে জিজ্ঞেস করত, কখন দেখেছেন? কত বয়স ছিল? কত দিন ধরে আসছিল? ওদের কোন স্পেসিফিক ডিটেল মনে আছে কিনা? এতো হ্যাপা পোষায় বলো?মার্চের ইয়ার এন্ডিং এর সময়।অ্যাকাউন্টসের লোকেদের এই সময় কি চাপ থাকে তোমার কোন আইডিয়া নেই। অফিস থেকে ফিরে ১২টা পর্যন্ত কাজ করছিলাম’।

‘ও তাই বলো! আমার জন্য জেগে ছিলে না, অফিসের কাজ ছিল তাই জেগে ছিলে’?

‘সেই! এতো কাজের মধ্যে থেকেও যে তোমার জন্মদিন মনে রেখেছি, সেটার কোন ক্রেডিট নেই! এই জন্য সবাই বলে যতই করো মেয়েদের মন পাবে না’!

‘হুম! খুব কথা শিখেছ দেখছি, কলেজে তো মুখ থেকে কথায় বেড়ত না। আমাকে ভালোবাস সেটাও তো কোনদিন সামনে এসে বলতে পারলে না। আর তুমি কটা মেয়ের সাথে মিশেছ যে মেয়েদের মন পাওয়া নিয়ে কথা বলছ’!

‘খুব ভালো করে মিশেছি বলতে, দুজনের সঙ্গে। তার মধ্যে তুমি একজন’। ঋতব্রত একটু ভেবে উত্তর দেয়। তারপর মিটিমিটি হাসতে থাকে।

শ্রীময়ী চোখ কপালে তোলে, পাশে বোতলে রাখা জল খেয়ে বলে, ‘শুরু করে দিয়েছ? সাধে বলে ‘All men are dogs’. পরকীয়া যতই আইনত স্বীকৃতি পাক্, আমি এই সব নষ্টামি একদম সহ্য করব না, অফিসের না, মেয়েটা? বুঝতেই পারছি, এতো বেশি সময় ধরে অফিসে কেন থাকো’?

‘না ম্যাডাম, আর একজনও এই বাড়ীর, আমার মা যিনি ছোট থেকে আমাকে মানুষ করেছেন’।

‘Very bad joke. বয়স্ক মানুষদের নিয়ে এই রকম ইয়ার্কি মারো কেন’? শ্রীময়ী বিরক্তি মাখা মুখ নিয়ে ওয়াস রুমে ঢুকে যায়। সেখান থেকেই শুনতে পায় ঋতব্রত বলছে, ‘জানো, এই জন্য আমার মা উচ্চমাধ্যমিকের সময় বলেছিলেন, ‘মেয়েদের মন পাওয়া সহজ নয়, তাই মেয়েদের পেছনে না ঘুরে মন দিয়ে পড়াশুনা করতে’।

শ্রীময়ী ওয়াসরুম থেকে বেড়িয়ে বলে, ‘সারাক্ষণ ম্যা ম্যা করো না তো। ৩০ বছর হয়ে গেলে এখনও ম্যাচিওর হলে না’।

‘ঋতব্রত প্রায় লাফিয়ে উঠে বলে, ‘OMG তুমিও তাহলে ৩০ হয়ে গেলে’? এটা শুনে শ্রীময়ীর চোখ দিয়ে আগুন বেড়তেই যা বাকী! সে বলল, ‘কি বললে, আমার ৩০ বছর বয়স! এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি account সামলাও! আমি বস হলে দুদিনে বার করে দিতাম’। 

‘ভাগ্যিস তুমি বস নও। বাই দ্যা ওয়ে তোমার বয়সটা কত’? ঋতব্রত একটা সিগারেট ধরিয়ে জিজ্ঞেস করে।

দেশালাই এর কাঠি যেমন করে জ্বলে ওঠে ঠিক সেই রকম মেজাজে বলল, ‘বয়স যতই হোক, তাতে তোমার কি? কচি মেয়েরা তোমাকে পাত্তা দেবে না। এই শ্রীময়ীর সাথেই বাকী জীবনটা কাটাতে হবে’।

ঋতব্রত সিগারেটের ধোঁয়াটা ছেড়ে হাসতে থাকে।

‘আমার এই ২৯ হল, এটা আমার ৩০তম জন্মদিন, বুঝলেন মশাই’!

‘বুঝলাম’ বলে ঋতব্রত ব্যাগ থেকে একটা কানের দুল বার করে। শ্রীময়ীর সামনে কৌটোটা নিয়ে গেয়ে বলে দেখ, পছন্দ কিনা? আমি বলে এসেছি ম্যাডামের পছন্দ না হলে পাল্টে নেবো’।

গিফট দেখে শ্রীময়ীর মুখে হাসি ফোটে।

‘খুব সুন্দর হয়েছে। পাল্টানোর কোন দরকার নেই’।

ঋতব্রত শ্রীময়ীকে জড়িয়ে ধরতে গেলে বলে, ‘না, আজ কিছু হবে না, আমার ঘুম আসছে’।

ঋতব্রত হাল না ছেড়ে বলে, ‘রিটার্ন গিফট কিছু পাওয়া যাবে না, এটা কিন্তু ঠিক না’!

‘পাওয়া যেতে পারে যদি কাল আমাকে টাইম দাও তো’!

ঋতব্রত মাথা চুলকে বলে, ‘কাল একদম টাইম হবে না গো’!

শ্রীময়ী কিছু বলে না। ঋতব্রত এতো সুন্দর পরিবেশটাকে বাচিয়ে রাখার জন্যই হোক কিংবা বউয়ের মন রাখার জন্য, কাঁচুমাচু মুখ করে বলে, ‘বিকেলের দিকে হতে পারে’।

শ্রীময়ী ঠোঁট উল্টে বলে, ‘বিকেল মানে কটা? ৬টা হলে দরকার নেই’।

‘৬টা না, এই ধরো ৫টা’।

‘না, ৪টেতে যদি আসো তাহলে...’

‘আচ্ছা, তাই হবে, প্ল্যানটা কি’?

‘ওটা সারপ্রাইজ’!

‘আচ্ছা’ বলে ঋতব্রত শ্রীময়ীর ঠোঁটে ঠোঁট রাখে।

মিনিট দুয়েক পর শ্রীময়ী বলে, ‘একে বারে ক্যাবলা! বউকে যেনও প্রথমবার চুমু খাচ্ছে! ঘুমাও এবার’।


শ্রীময়ী সাড়ে তিনটের সময় ঋতব্রতকে ফোন করে বলে ৪টের মধ্যে ভিক্টোরিয়া চলে আসতে। শ্রীময়ী ৪.১৫ তে এসে দেখে ঋতব্রত আসেনি। দুটো টিকিট কেটে অপেক্ষা করতে লাগল। ভিক্টোরিয়ার সামনে বিশাল একটা ময়দান। এটাই কলকাতার ফুসফুস। বেশির ভাগটাই ঘাসে ঢাকা। সামনে বেশ কিছু বাচ্চা ক্রিকেট খেলছে। ময়দান থেকেই শহরের সবচেয়ে উঁচু বাড়ীটা দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার ঘোড়ার পিঠে উঠে চক্কর দিচ্ছে। বেশ কিছু লাভ-বার্ডস ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রয়েছে। ৪.২৫ এ ঋতব্রত এসে বলল, ‘সরি গো, তোমাকে কিছুক্ষণ ওয়েট করতে হল’।

শ্রীময়ী মুখ বেকিয়ে বলে, ‘আজকের দিনেও তুমি আমাকে অপেক্ষা করালে’।

ঋতব্রতর বলার ইচ্ছে ছিল অফিসে যে কিচাপ সেটা তুমি যদি বুঝতে, কিন্তু এখন শ্রীময়ীর সাথে তর্ক করার কোন মুড নেই। শেষে ঋতব্রত বলল, ‘তোমাকে খুব সুন্দরী লাগছে। বেশ ম্যাচিং করা সব কিছু পড়েছ। আমাকেও আগে থেকে বলতে পারতে, আমিও এই কালারের জামা পরে আসতাম’।

‘থাক! অনেক হয়েছে, এখান থেকে বেড়িয়ে আমরা প্রিন্সেপ ঘাট যাবো। ওখানে নৌকো করে গঙ্গা বক্ষে গিয়ে সূর্যাস্ত দেখব’। ভিক্টোরিয়ার ভিতরে গিয়ে দুজনে ছবি তুলল। শ্রীময়ী ঘাসের উপর বসে নুড়ি পাথর নিয়ে খেলতে লাগল। ছোটবেলায় পুরীতে বেড়াতে গেলে ওখানে সুমুদ্র সৈকত থেকে নুড়ি পাথর নিয়ে এসে বাড়ীতে খেলত। মানুষের ভালো লাগার কত বৈচিত্র্য! কারো কাছে নুড়ি পাথর ঘর নোংড়া মনে হয় কারো কাছে আবার ঘর সাজানো। ভিক্টোরিয়া থেকে বেড়িয়ে দুজনে ময়দানে হাটতে লাগল।

ঋতব্রত জিজ্ঞেস করল, ‘ঘোড়ার পিঠে চাপবে’?

‘না, বাবা! ঘোড়ার পিঠে চেপে হাত-পা ভাঙার কোন ইচ্ছে নেই’!

‘আরে আমি তো আছি, পরে গেলে হাসপাতালে ভর্তি করে দেবো’।

‘সেই, এই না হলে বর! কোথায় বলবে, অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তোমার সেবা করব’।

ঋতব্রত হাসতে থাকে। শ্রীময়ী আবার বলে, ‘এই জন্য জানো তো, প্রেমিককে বিয়ে করতে নেই, করলেই ডাল-ভাত হয়ে যায়; আর কোন নষ্ট্যালজিয়া থাকে না’।

‘আচ্ছা বাবা ভুল হয়েগেছে, ক্ষমা দাও! চল পাপড়ি চাট খায়’।

‘খুব ভালো শিখেছ কিভাবে বউকে চুপ করিয়ে দেওয়া যায়’।

ঋতব্রত হাসে। ঋতব্রতর হাসি দেখে শ্রীময়ীর গা-জ্বালা করে। একজন ঝগড়া করার মুডে থাকলে অন্য পক্ষ যদি তাতে অংশ গ্রহণ না করে তাহলে ঝগড়া করার মুডটাই নষ্ট হয়ে যায়। শ্রীময়ী মুখ ভাড় করে বলে ‘চলো’।

পাপড়ি চাট খেতে খেতে ঋতব্রত বলে, ‘ঘোড়ার পিঠে তো চাপলে না, চলো ট্রামে চাপি, যেভাবে মানুষ জীবনের গতি বাড়াচ্ছে, কবে দেখব কলকাতা থেকে ট্রাম উঠে গেছে। ট্রাম এতো আসতে চলে তারপরেও অ্যাকসিডেন্ট হয় কিকরে বলতো’!

‘কবে হল, শুনিনিতো’।

‘কেন, জানো না, জীবনানন্দ দাশ ট্রাম অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন’।

‘হুম’!

‘অনেকে বলেন, তিনি নাকি স্বেচ্ছায় ট্রামের সামনে চলে এসেছিলেন’।

‘একজন কবি জীব্দশায় কোন নাম বা সম্মান পেল না। সেই সময় দুএকটা পত্রপত্রিকায় বিরূপ সমালোচনাও বেড়িয়েছিল’।

ঋতব্রত একটা তেঁতো হাসি হেসে বলে, ‘যারা নতুন কিছু করতে চায় তাদের মনে হয় সমাজ খুব সহজে গ্রহণ করেন না। তাঁর কবিতার স্টাইল ভিন্ন ধারার, তবে তাকে একেবারে কেউ পাত্তা দেননি তা নয়, বুদ্ধদেব বসু খুবই প্রশংসা করতেন তাঁর কবিতার স্টাইল’।

কিছু দূর হেঁটে তারা ট্রামে চেপে বসল। ট্রামে উঠেই ঋতব্রত জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা কবে কলকাতার ট্রাম শুরু হয়েছিল জানা আছে’?

‘কোনটা? ঘোড়ায় টানা না ইলেকট্রিক’?

‘ইলেকট্রিক’?

‘সঠিক সালটা তো মনে নেই, তবে স্বাধীনতার অনেকটা আগেই হবে, এই ধরো ১৯০০ সালের কাছাকাছি’।

ট্রামটা একটা সিগন্যালে দাড়িয়ে গেল। ট্রামের পাশে একটা হলুদ ট্যাক্সির ভিতর একজনকে দেখে ঋতব্রত বলল, ‘এই দেখ, তোমাদের অফিসের বাবুদা না? শ্রীময়ী জানলা দিয়ে মুখ বার করে দেখে বলল, ‘হ্যা’। 

‘বাবুদার তো এখন বিশাল ব্যাপার! দুদিন আগে আমি একবার পার্ক হোটেলে গিয়েছিলাম, দেখি বাবুদা এক এম.পি এর সাথে কথা বলছে’।

‘হ্যা বাবুদা এখন এম.পি, মিনিস্টার ছাড়া কথায় বলে না, সামান্য একজন ট্রেনি জার্নালিস্ট হয়ে ঢুকে ১০ বছরে কোথায় উঠে গেল’।

ট্রামটা একটু যাওয়ার পরেই আবার জ্যামে আটকে যায়।

শ্রীময়ী বলে, ‘চলো নেমে যাই, এখান থেকে ট্যাক্সি ধরে নিই, মিনিট ১৫ এর মধ্যে প্রিন্সেপ ঘাট পৌঁছে যাবো’।

ঘড়ির কাঁটা ৬টা ছুঁয়েছে, দুজনে প্রিন্সেপ ঘাট পৌছালো। সূর্য ঢোলে পড়েছে পশ্চিমের কোলে। দ্বিতীয় হুগলী সেতুকে সামনে রেখে একটা লাল আগুনের পিণ্ড যেন সারাদিন জ্বলে শেষ বিকেলে নিস্তেজ হয়ে পরে অপূর্ব এক স্নিগ্ধতা এসেছে। ঠিক যেমন তিন চার বছরের বাচ্চা সারাদিন দস্যিপনা করে সন্ধ্যেবেলায় মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে।দুজনে একটা নৌকো ভাড়া করে। মাঝি মানা করে দেয় ধারের দিকে না যেতে। ঋতব্রত এক বুক শ্বাস নিয়ে বলে, ‘দারুন লাগছে, আমি এর আগে কোন দিন এই রকম গোধুলিবেলায় নৌকো বিহার করিনি’।

‘হুম, জানি তো! এই জন্যই তো তোমাকে নিয়ে এলাম’। পাস দিয়ে একটা জেটি যাওয়ায়, ঢেউ এর ধাক্কায়, নৌকোটা একটু কাত হয়ে যায়। শ্রীময়ী চিৎকার করে ওঠে, ‘দাদা একটু সাবধানে চালান, এখুনি বিপদ হয়ে যেতে পারত’।

‘বাবা কি ভয়! এতো যদি ভয় পাও নৌকোয় চাপলে কেন’?

শ্রীময়ী মুখ বেকিয়ে বলে, ‘তুমি চুপ করো’।

ঋতব্রত উঠে দাড়ায়! শ্রীময়ী আবার চিৎকার করে, ‘তুমি উঠলে কেন’? ঋতব্রত শ্রীময়ীর কথার কোন উত্তর না দিয়ে বলে, ‘ধরো শ্রী, আমাদের নৌকো যদি টাইটেনিকের মতো ভেঙে পরে...’ শ্রীময়ী মাঝখানে থামিয়ে বলে, ‘বিশ্বাস করো এতোটা সময় পাবে না যে তুমি আমাকে বাঁচাবে’।ঋতব্রত হাসতে থাকে।

‘আচ্ছা ঠিক আছে, গঙ্গা বক্ষে যখন ঘুরতে বেড়িয়েছি, একটা ছবি তো হয়ে যাক! এই রকম রোম্যান্টিক মুহূর্ততো সব সময় আসবে না, এসো আমার সামনে এসে দাড়াও।

শ্রীময়ী বলে, ‘আমার ভয় লাগছে গো, ছেড়ে দাও’।

‘আরে নৌকোতো ঘুড়িয়ে নিয়েছে, আর ৫-৭ মিনিটের মধ্যেই পারে চলে যাবো’। শ্রীময়ী ভয়ে ভয়ে উঠে দাড়ায়। দুজনে পাশাপাশি দাড়িয়ে সেলফি তোলে। ঋতব্রত শ্রীময়ীকে ফোনটা দিয়ে বলে, ‘আমি সামনের দিকটাই যাচ্ছি তুমি আমার একটা সিঙ্গেল ছবি তুলে দাও’।প্রিন্সেপ ঘাট থেকে ২৫-৩০ মিটার দূরে নৌকো। জোয়ারের ঢেউ ঘাট থেকে ফিরে যাওয়ার পথে নৌকোকে ধাক্কা মারে, ঋতব্রত টাল সামলাতে না পেরে জলে পড়ে যায়। শ্রীময়ী চিৎকার করে ওঠে, ‘হেল্প’! ঋতব্রত সাঁতার জানত না। রাত্রি ১০ টার দিকে বাগ-বাজার ঘাটে ঋতব্রতর দেহ ভেসে ওঠে।


    দিদি ১০টাকা দাও। শ্রীময়ী পিছন ফিরে দেখে দুজন বৃহন্নলা। শ্রীময়ী তাকিয়ে থাকে। তারা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচায়ি করে আবার বলে, ‘দিদি ১০ টাকা দাও ভগবান তোমার ভালো করবে’। শ্রীময়ী ব্যাগ থেকে ২০ টাকার একটা নোট বার করে দিল। যাওয়ার আগে তারা আশীর্বাদ করে গেল, ‘তোমার বর ভালো হবে তুমি খুব সুখী হবে’! ‘সুখী’ শব্দটা শুনে শ্রীময়ী নিজের মনেই হেসে উঠল। ঋতব্রত চলে যাওয়ার পর সংসারের চেনা ছন্দে তো ফিরেছে কিন্তু জীবনটা অনেকটা নুন ছাড়া তরকারি মনে হয়! সব কিছুই করে কিন্তু কোন কিছুতেই স্বতস্ফুর্ত হয়ে অংশ গ্রহণ করতে পারে না। যেন করতে হয় তাই করা, খেতে হয় তাই খওয়া। শ্রীময়ীর ফোন বেজে ওঠে।

‘হ্যালো’!

‘হ্যালো, শ্রীময়ীদি আমি রাধিকা বলছি, তুমি বাড়ী পৌঁছে গেছ’?

‘না, আমি একটু...’

‘কোথায় আছ বল? আমি আসব’?

‘না, না আসতে হবে না, আমি একটু গঙ্গার ঘাটে এসেছিলাম, ফিরব এবার, বস কিছু বলছিল’?

‘না, না কিছু বলেননি, তুমি বাড়ী ফিরে অবশ্যই আমাকে একটা টেক্সট করো’।

‘আচ্ছা’ বলে শ্রীময়ী ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে একটা A-4 সাইজের পেপার বার করল। পেপারের এক কোনে বছর দুয়েক আগে কার তারিখ। পেপারটা ভাঁজ করে একটা নৌকো বানালো। প্রিন্সেপ ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে নেমে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিল। জোয়ারের সাথে সাথে নৌকাটা ভাসতে লাগল। শ্রীময়ী একদৃষ্টিতে নৌকার দিকে চেয়ে আছে। সে দেখতে পাচ্ছে ঋতব্রত সাঁতরে তার নৌকোয় চেপে বসেছে। মাঝ গঙ্গায় গিয়ে সে নৌকার গায়ে লেখা শব্দগুলো জোরে জোরে পড়ছে;

প্রিয় বন্ধু,

খুব মিস করছি তোমাকে। বর না বলে বন্ধু বললাম বলে রাগ করলে না তো! যদিও তুমি আগে অনেকবার অভিযোগ করেছিলে আমি তোমাকে বরের মতো সম্মান করিনা। মানে ঠিক সম্মান বলতে চাওনি হয়তো, বলতে চেয়েছিলে কোন এক গ্রামের বধূর মতো ভয় পায় না। তোমার বাংলা চিরদিনই খুব খারাপ! প্রথম যেদিন বন্ধুর হাত দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলে সেখানে অজস্র বানান ভুল ছিল। তুমি জানো, সেই বানান ভুল করা চিঠিটাই এখন আবার বেঁচে থাকার রসদ যোগায়। যখনই মন খারাপ করে, তোমাকে খুব মিস করি, চিঠিটা পড়ি, মন শান্ত হয়ে যায়। কি মনে পড়েছে? আচ্ছা কি লিখেছিলে একবার পড়ে শোনায়।

কোন রকম সম্বোধন ছাড়াই তুমি লিখেছিলে,

শ্রী,

আমি তোমাকে এই চিঠিটা কেন লিখছি জানি যা, কারণ তুমি নাচে, গানে, পড়াশুনায় সব কিছুতেই অসাধারণ। তোমার পিছনে সিনিওর, জুনিওর মিলে গোটা দশেক লাইন দিয়ে আছে। আর আমি পড়াশুনায় ঠিকঠাক হলেও আর কোন এক্সট্রা ক্যারিকুলার অ্যাক্টিভিটি নেই। আমি দেখতে বলার মতো নয়। খেলা ধুলাও পারিনা। মোদ্দা কথা আমি খুব সাধারণ। আমি তোমাকে ভালবাসি কিনা জানি না, কিন্তু যখনই আনমনে থাকি তোমার কথা মনে পড়ে। তুমি সামনে আসলে ক্যাবলার মতো চেয়ে থাকি। মনের মধ্যে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ নিয়ে চিঠিটা লিখছি। আমি জানি তুমি চিঠিটা পড়ে খুব হাসবে তারপর হয়তো ছিড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেবে। কিন্তু চেষ্টা করতে দোষ কি...’

ব্ল্যা, ব্ল্যা আরও কত কি লিখেছিলে, থাক, সবটা নাই বা বললাম। তুমি যেমনই হও, তুমি আমারই থাকবে। তুমি ঘুমিয়ে থাকো নিশ্চিন্তে, আমি জেগে আছি দিবারাত্রি।

          ...


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance