গুলজারের বাঙালিয়ানা
গুলজারের বাঙালিয়ানা
দামিনীতে সানি দেওয়ালের অভিনয় Yash raj এর এতোটাই ভালো লাগে যে ‘ডর’ সিনেমায় তাকে হিরো আর ভিলেনের মধ্যে যে কোন একটা চরিত্রে অভিনয় করার অফার করা হয়। সানি হিরোর রোল বেঁছে নেন।তারপর ভিলেনের চরিত্রের জন্য আমির খানকে অফার করা হয়। আমির ভিলেনের চরিত্র না করায় Yash raj একটু ক্ষুণ্ণও হন। এরপর শারুখ খানকে ভিলেনের চরিত্র অফার করা হয়। বাকীটা ইতিহাস। শারুখ Yash raj ব্যানারে একের পর এক হিট সিনেমার অফার পান। তিনি যদি আমির মতো না করতেন ভিলেনের চরিত্র তাহলে জোর গলায় বলা যায় না শারুখ খুব সহজে সুপার স্টার হতো। কখনও কখনও একটা হটাৎ করে চলে আসা সুযোগ জীবনের গতি পাল্টে দেয়। গুলজারের কাছেও এই রকমই একটা সিনেমায় গান লেখার সুযোগ আসে। যদিও তাঁর কোন ইচ্ছেই ছিলনা সিনেমায় গান লেখা। ‘বন্দিনী’ সিনেমার শুটিং শুরু হয়ে গেছে। হটাৎ করেই গীতিকার শৈলেন্দ্রর সাথে শচিন দেব বর্মণের মনোমালিন্য হয়। গুলজার সেই সময় একটা মোটর গ্যারেজে কাজ করতেন। আর অবসর সময়ে সাহিত্য চর্চা। তিনি সেই সময় আই.পি.টি.এ এর সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। সেই সুত্রেই শৈলেন্দ্রর এবং বিমল রায়ের অ্যাসিসট্যান্ট, দেবু সেনের সাথে আলাপ। শৈলেন্দ্র বিমল রায়কে কথা দিয়েছিলেন তিনি সেই সিনেমায় গান না লিখলেও একজন ভাল গীতিকারকে এনে দেবেন। গুলজার শৈলেন্দ্রর প্রস্তাব প্রথমেই না করে দেন। তিনি বলেন, আমি একজন কবি, সিনেমায় গান লেখা আমার লক্ষ্য নয়। শেষে অবশ্য বন্ধুদের পিড়াপিড়িতে তিনি যান বিমল রায়ের সঙ্গে দেখা করতে। যদিও বিমল রায়ের মনে একটু সন্দেহ ছিল। আগে সিনেমায় গান লেখার কোন অভিজ্ঞতা নেই, পারবে তো? গুলজারের লেখা ‘বন্দিনী’ সিনেমার গান, ‘মোরা গোরা অঙ্গ লই লে’ দর্শকের ভালো লাগে। এই দিকে শৈলেন্দ্রর সাথে শচিন দেব বর্মণের ঝামেলা মিটে যায়।
আবার গুলজার মোটর গ্যারেজের কাজে মননিবেশ করেন। একদিন বিমল রায় গুলজারকে ডেকে বললেন, ‘তুমি গান লিখতে চাও না, সমস্যা নেই, তুমি আমাকে অ্যাসিস্ট করো, মোটর গ্যারাজে গিয়ে নিজের সময় নষ্ট করো না, ওটা তোমার জায়গা নয়’। গুলজার কেঁদে ফেলেছিলেন। তারপর থেকে বিমল রায়ের মৃত্যু(১৯৬৬ সাল) পর্যন্ত ছায়া সঙ্গী ছিলেন। বিমল রায়ের সাথে কাজ করার সময় বাসু চ্যাটার্জী, হৃষীকেশ মুখার্জী, আর.ডি বর্মণের সাথে বন্ধুত্ব হয়। যাদের সাথে কিছু কাজ মাইলস্টোন হয়ে গেছে। সেদিন যদি গুলজার বিমল রায়ের সাথে কাজ না করতেন তাহলে নিশ্চিত করা বলা যায় না যে গুলজার গীতিকার বা ফিল্ম ডাইরেক্টর হতেন।
গুলজারের লেখালেখির অনুপ্রেরনায় বাঙালী লেখকদের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি নিজেই বলেন আমি জন্ম সুত্রে পাঞ্জাবী হলেও আমি মননে বাঙালী। ছোটবেলায় দিল্লীতে থাকার সময় একটা পাবলিক লাইব্রেরী থেকে বই নিয়ে পড়তেন গুলজার। তখন তাঁর ডিটেকটিভ বই পড়তে খুব ভালো লাগত। রাতজেগে একেকদিনি একটা বই পড়ে ফেলতেন। প্রায় রোজ বই পাল্টাতো বলে লাইব্রেরিয়ান একদিন ‘গীতাঞ্জলী’ বইটা দেন। গুলজার এই বইটা বহুবার পড়েন। এবং এই বইটা আর ফেরৎ দেননি। গুলজারের বহুবার বলেছেন, ‘এই একটা বই আমার ডেসটিনেশন পাল্টে দিল’।
৭০-৮০-এর দশকে বলিউডে বেশ কিছু নামী পরিচালক এবং সংগীত পরিচালকের সাথে কাজ করেছেন। তিনি নিজে সিনেমা পরিচালনা করার সাথে অনেক নামী পরিচালকের সিনেমায় ডায়লগ লিখতেন।‘বাবুমশায়, জিন্দেগী অর মৌত সব উপরওয়ালাকে হাতমে হে জাঁহাপনা’ আনন্দ সিনেমার এই ডায়লগ আজও সকলকে নাড়া দিয়ে যায়। যদিও হৃষীকেশ মুখার্জী প্রথমে আনন্দের টাইটেল কার্ডে তাঁর নামটা দিতেই ভুলে যান। সিনেমা রিলিজ করার কয়েকদিন পর ফিল্মের সমস্ত প্রিন্ট ফেরৎ নিয়ে এসে গুলজারের নাম ঢোকানো হয়।
‘মীরা’ সিনেমায় গান গাওয়ার জন্য লতা মঙ্গেশকরকে ঠিক করা হয়। কিন্তু তিনি সেই সময় একটা নন-ফিল্মি অ্যালবাম করার জন্য মীরা সিনেমায় গান গাইতে রাজী নয়। এদিকে লতা গাইবেন না শুনে লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল ও সুর দেবেন না। পঞ্চম মানে আর.ডি বর্মণও সুর দিতে রাজী হলেন না পারিবারিক সমস্যার জন্য। গুলজারের মাথায় হাত। তিনি অনেক ভেবে দেখলেন যদি পণ্ডিত রবি শংকর সুর করেন তাহলে সিনেমাটা বানানো যেতে পারে। তাঁকে ফোন করলে তিনি জানান স্ক্রিপ্ট পাঠাতে। স্ক্রিপ্ট পছন্দ হলে তিনি সুর দেবেন। গুলজার যেন হাতে চাঁদ পেলেন। গুলজার আমেরিকায় যান তাঁকে স্ক্রিপ্ট শোনাতে। তাঁর স্ক্রিপ্ট পছন্দ হয়। তিনি বললেন, ‘সামনে বেশ কিছু কনসার্ট আছে, এই ফাঁকে কিছু সুর করে রাখব, বাকীটা সেপ্টম্বারে বম্বে গিয়ে করবেন। গুলজার বলেছিলেন, আমি যদি এই কনসার্টগুলিতে আপনার সাথে থাকি খুব কি অসুবিধা হবে। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা দরকার, গুলজার বহু রাত বিনিদ্র থেকেছেন খোলা আকাশের নিচে শুধু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কনসার্টে গান শোনার জন্য। গুলজার লন্ডন ও অ্যামস্টারডাম-এ গিয়েছিলেন। গুলজারের মতে তিনি সৌভাগ্যবান ছিলেন বলে এই রকম একটা মিউজিক্যাল জার্নির সঙ্গী হতে পেরেছিলেন। “অ্যামস্টারডাম-এ একটা গির্জার মধ্যে অনুষ্ঠান হচ্ছিল। বেশ কিছু প্রথিতযশা শিল্পী বাজালেন। মাঝরাতের কিছু আগে পণ্ডিতজি বসলেন বাজাতে। আমি অনুভব করলাম একটা রাত কী করে তৈরি হয়। একটু একটু করে কালো থেকে গাঢ় নীল থেকে আরও গভীর কোনও বর্ণহীন রাত। মোহিত ছিলাম, মোহভঙ্গ হল, যখন দেখলাম চ্যাপেলের ছাদের কাছের অনেক উঁচু প্যানেল দিয়ে ভোরের আলো এসে পড়েছে। সেতারে তখন ভৈরবী। ভোরের যেন একটা গন্ধও ছড়িয়ে পড়ছে সুরের সেই মূর্ছনা থেকে। সেই ভোরও ইনিই তৈরি করেছিলেন। মনে মনে ভেবেছিলাম ঈশ্বর খানিকটা নিশ্বচয়ই এই রকম হয়। মীরা সিনেমার গান গুলি গেয়েছিলেন বানী জয়রাম। রবি শংকর কথা রেখেছিলেন। তিনি সেপ্টম্বরে এসে বাকী গান গুলোর সুর করেছিলেন। একদিন গুলজারের স্বপ্নের সাধনা ‘মীরা’ তৈরি হল।
গুলজারের সাথে পঞ্চমের দেখা বিমল রায়ের একটা সিনেমার অলোচনায়। শচিনদেব বর্মণ, পঞ্চমকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন মিউজিক নিয়ে কথা বলতে। পঞ্চম কিছুক্ষণ বসে থাকার পরই উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াত। আর অমনি শচিনদা বলে উঠতেন, হ্যাঁ হ্যাঁ আমি জানি, ও সিগারেট ফুঁকতে গেছে। আমিও উঠে যেতাম ওর সঙ্গে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ও আমায় কখনও বলত, আমি হলে এই গানটা এরকম করতাম। দেখতাম, ওর ভাবনার সাথে আমার ভাবনা মিলে যেত। আর তখনকার কোন একটা সময় থেকেই একটা গাঢ় বন্ধুত্ব শুরু হয়ে গেল। আমার সিনেমায় প্রথম সুর দেবে পঞ্চম। একটা গান তৈরির কথা হল। সেই গানটার আদি-অন্ত, কোথায় থাকবে, কি স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী হবে, পঞ্চমের সবটা জানা দরকার। একদিন রাত বারোটা নাগাদ আমার বাড়ির নিচে এসে হর্ন বাজাচ্ছে পঞ্চম। বলল, ‘নেমে আয়, একটা সুর মাথায় এসেছে’। বাধ্য ছেলের মতো আমিও নেমে গিয়ে চললাম তাঁর সঙ্গে রাত সফরে। গাড়ির ক্যাসেট প্লেয়ারে সে দু-লাইন সুর করে এনেছে। বলল, ‘এই সুরটায় কথা বসিয়ে দে, নয়া হলে হারিয়ে যাবে। আমি বললাম, ‘এখন, এভাবে গাড়িতে বসে, হয় নাকি’? বলল, হতেই হবে। এটাই তোর সিনেমার গান’। অগত্যা। আমি লিখলাম দু-লাইন। তারপর আবার দু-লাইন, তারপর আরও দু-লাইন। রাত ১২টা থেকে ৪টে পর্যন্ত যুগল বন্দি চলল। গানটা তৈরি হয়ে গেল। সেটাই ছিল মিউজিক ডাইরেক্টর পঞ্চমের সাথে চিত্রপরিচালক গুলজারের প্রথম সিনেমা, ‘পরিচয়’। প্রথম গান ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারোঁ’।
আর একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল।আমি একটা গানের লিরিক্স লিখে নিয়েগেছি, ‘তুনে শাড়ি মে উরস লিয়া চাবিয়াঁ ঘর কী’। পঞ্চম শুনে বলল, ‘এটা কোন গানের লাইন? তুই আবার এটাকে কবিতা বলছিস? এরকম খটখটে কথা গানের হয়? গুল্লু তুই ঠিকঠাক কিছু লিখতে পারিস না? আবার এই লাইন গুলো ধরিয়ে দিয়ে বলছিস আমায় সুর দিতে’? কিনারা সিনেমায় ‘এক হি খোয়াব’ গানের দুটো লাইন দেখে আবার বলল, ‘শোন তুই বরং এই লাইনগুলো দিয়ে একটা সিন বানিয়ে নে, আর আমায় অন্য লাইন দে’।আমি নির্বিবাদী লোক। বললাম, ‘দ্যাখ পঞ্চম সেটা হতেই পারে, তবে কিনা তোর সঙ্গে যখন কাজ করি, তখন প্রথা ভাঙব বলেই করি তো। তাই... আর কিছু বলল না পঞ্চম। সুর করতে আরম্ভ করল। গানটা তৈরি হয়ে যাবার পর কেবল একটা জায়গায় গিটারে কিইইচ করে স্ক্রিচিং সাউন্ড চলে এলো। পঞ্চম আবার একবার টেক নিতে চাইছিল। কিন্তু আমি মানা করলাম। তখন পঞ্চম আবার আমায় চ্যালেঞ্জ দিল, দেখি সিনেমায় তুই কী ভাবে তুই ম্যানেজ করিস। সিনেমা শেষে পঞ্চম দেখতে এলো। গানটার একটা দৃশ্যে হেমাজি আর ধর্মেন্দ্র ক্যারাম খেলছিল। একবার স্ট্রাইকার সেট করার আগে ধর্মেন্দ্র স্ট্রাইকারে একটা চুমু খেয়ে নেয়। ওই চুমু খাওয়ার সময়টায় আমি গিটারের সাউন্ডটাকে ব্যবহার করি। পঞ্চম বলল, ‘আরে, তুনে তো কামাল কর দিয়া গুল্লু।
পঞ্চমের সাথে গুলজারে বন্ধুত্ব কতোটা গভীর ছিল তাঁর আক্ষেপ থেকে বোঝা যায়। ‘ পঞ্চম বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেল, না? অবশ্য ওর তো সবেতেই তাড়া ছিল। চা করতে বলেছে হয়তো, চা এলো, বড্ড গরম। কিন্তু পঞ্চমের তো সময় নেই। কেন নেই অবশ্য কেউ জানে না। কোথাও যাওয়ার নেই। কিন্তু তাড়া আছে। সুর ভাঁজতে ভাঁজতে গরম চায়ের কাপে বোতল থেকে কিছুটা জল ঢেলে ঠাণ্ডা করে চা খেয়ে নিত। সে যে আগে আগে জীবনের পাট চুকিয়ে দেবে, সেটা বোধ হয় আশ্চর্যের নয়। কেবল একটাই আফশোস হয়। আমি রয়ে গেলাম বটে, কিন্তু অর্ধেকটা মতো। আমার অনেকটা পঞ্চমের সাথে চলে গিয়েছে তো। তাই এখনকার গুলজার বোধ হয়, আধা-অধুরা।
গুলজারের উর্দুর পরে যে ভাষা তাঁর সবচেয়ে প্রিয় তা হল বাংলা। আজকের বাঙালি প্রজন্ম ঝরঝরিয়ে বাংলা পড়তে ও লিখতে পারার মধ্যে কোন গৌ্রভ বা আনন্দ কোনওটাই অনুভব না করলেও গুলজার স্বপ্ন দেখেন একদিন বাংলায় কবিতা লিখবেন। বাংলার প্রতি অমোঘ, ঐন্দ্রিজালিক আকর্ষণে আজ তিনি অনর্গল বাংলা বলতে, পড়তে এবং লিখতে পারেন।
(তথ্য সূত্র পান্তাভাত)