ঃ-সোহাগ-
ঃ-সোহাগ-
গড়িয়া ঢোকার মুখে জ্যামে আটকে গেল গাড়ী। বেশ লম্বা লাইন। সামনে রাস্তা ঠিক করা হচ্ছে। রাস্তার অর্ধেক অংশ খোলা, গাড়ী যাওয়ার জন্য। মিনিমাম ১০ মিনিট লাগবে। ইতিমধ্যে আবার ঋদ্ধিমা ফোন করেছে। কতো দূরে? এই তো ঘরের সামনে এসে জ্যামে আটকে গেছি? দূর! কলকাতার ট্র্যাফিক! ভালো লাগে না! তাড়াতাড়ি এসো কখন থেকে রেডি হয়ে বসে আছি। কথাটা বলেই ঋদ্ধিমা ফোনটা কেটে দিল। অনিমেষ গাড়ীর স্টার্ট বন্ধ করে, সিট বেল্ট খুলে দিয়ে বসল। সোহাগের কথা ভেবে খারাপ লাগছে।একটা মেয়েকে প্রায় ৬ মাস ধরে চিকিৎসা করছে কিন্তু এখনও সুস্থ করে তুলতে পারেনি। জ্বর, পেট খারাপ হলে ওষুধ দিলে ভালো হয়ে যায়। কোন জায়গায় টিউমার হলেও কেটে বাদ দিয়ে ভালো করা যায়। কিন্তু মনের ভিতর ক্ষত হলে? তার চিকিৎসা? ‘একমাত্র সময়’। Time is the best healer. সময় সব কিছু ভুলিয়ে দেয়। শুধুমাত্র নিজের উপর বিশ্বাসটা রাখতে হয়। অনিমেষ এই ছয় মাস ধরে বিশ্বাস যোগানোরই চেষ্টা করছে। কোথাও কি খামতি রয়ে গেল? নাকি ভালোবাসা বস্তুটাই এই রকম! বার বার স্মৃতি নিয়ে থাকতে চায়। অনিমেষ নিজেও তো ঋদ্ধিমাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল। রাস্তার জ্যাম ছাড়ার কোন লক্ষণ নেই। সামনে থেকে একজন গাড়ী ঢুকিয়ে দিয়েছে। অনিমেষ নস্টালজিক হয়ে ভাবতে থাকে ঋদ্ধিমার কথা।
অনিমেষের সাথে ঋদ্ধিমার দেখা হয়েছিল নন্দনে। অনিমেষ দুটো টিকিট কেটে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু তার বন্ধুর দেখা নেই। একা সিনেমা দেখতে পছন্দ করে না অনিমেষ। অনেকবার চেষ্টা করেও যখন বন্ধু ফোন ধরল না তখন বাধ্য হয়েই অনিমেষ টিকিট দুটো বিক্রি করার চেষ্টা করতে লাগল। টিকিট কাউন্টারে হাউস ফুল দেখে কেউ আর লাইনে দাঁড়াচ্ছে না। দু-একজনের কাছে টিকিট বিক্রি করতে গেলে একজন মহিলা বলে উঠল, ‘আপনি টিকিট ব্ল্যাক করছেন? জানেন আমরা আপনাকে পুলিশে দিতে পারি?অনিমেষ কথাটা শুনে হকচকিয়ে যায়, বলতে থাকে ‘না মানে, আমার বন্ধু আসেনি ইত্যাদি ইত্যাদি...’। এই সময় পিছন থেকে ঋদ্ধিমা বলল, ‘এক্সকিউজ মি, দাদা টিকিট দুটো আমাকে দিয়ে দিন’।অনিমেষ মনে মনে ভাবল যাক বাঁচা গেল। এই নিন দুটো টিকিট। ঋদ্ধিমা দুটো একশো টাকার নোট অনিমেষকে দিল। অনিমেষ সব পকেট, পার্স খুঁজেও ৬০ টাকা খুচরো দিতে পারল না। শেষে অনিমেষ বলল, ‘ঠিক আছে আপনি ১০০ টাকাই দিন।ঋদ্ধিমা সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘সেটা হবে না, আপনাকে আমরা চিনিনা... অনিমেষ মাঝ পথে থামিয়েই বলল, ‘দেখুন আমি মাঝে মধ্যেই নন্দনে আসি যদি কোন দিন দেখা হয়, দিয়ে দেবেন’। এই দিকে হলে ঢোকার জন্য লম্বা লাইন পড়ে গেছে, ঋদ্ধিমা একবার বান্ধবীর দিকে তাকায়, তারপর বলে ‘ঠিক আছে যে দিন দেখা হবে সেই দিন দিয়ে দেবো।লাইনে দাঁড়িয়ে ঋদ্ধিমা ভাবতে থাকে কাজটা ঠিক করল না ভুল। পরে যদি ছেলেটা বেশি টাকা চায়? দেখে অবশ্য ছেলেটাকে গোবেচারায় মনে হল। তাও যদি বেশি টাকা চায় কত আর বেশি চাইবে? ৫০- ১০০ বেশি নিশ্চয় নয়।সেটা দেওয়া যেতেও পারে।কত বার তো ব্ল্যাকেও টিকিট কেটেছে। লাইনে দাড়িয়েই ঋদ্ধিমার চোখ এই দিক ওইদিক ঘুরতে লাগল। ছেলেটা যেন চোখের পলকেই হারিয়ে গেল। পিছন থেকে নন্দিনি খোঁচা দিয়ে বলল, ‘কিরে তুই কি ছেলেটার প্রেমে পড়ে গেলি? মানে, লাভ অ্যাট ফাস্ট সাইট’। ‘সাট আপ’!বলেই ঋদ্ধিমা, নন্দিনীর দিকে চোখ বড়ো করে তাকাল। ‘বাবা তুমি আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। ‘আরে আমি ভাবছিলাম ছেলেটা চেনে না, ৪০ টাকা ছেড়ে দিল, ওতো ৬০ টাকা রেখে দিতে পারত’!কি বোকা না! ‘ভীষণ বোকা বলেই নন্দিনি জোরে হাসতে লাগল।
প্রায় ৬ মাস পরের ঘটনা, সন্ধ্যে তখন ৬টা হবে।শিয়ালদহের কাছে এক সরকারী মেডিক্যাল কলেজ কাম হসপিটালে, অনিমেষ ওটি করে বেরোচ্ছে সেই সময় ঋদ্ধিমা করিডর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একটু দূর থেকেই অনিমেষ চিৎকার করে, ‘এক্সকিউজ মি ম্যাম’! অনিমেষের গলার আওয়াজটা মনে হয় একটু বেশিই হয়ে গেছিল। করিডোর দিয়ে হাঁটতে থাকা প্রায় সকলেই পিছনের দিকে তাকাল। ঋদ্ধিমা ঘুরে তাকাতেই, অনিমেষ একটু এগিয়ে এসে বলে, ‘চিনতে পারছেন? নন্দনে দেখা হয়েছিল।আমার বন্ধু আসেনি বলে আপনাকে দুটো টিকিট বিক্রি করেছিলাম। ঋদ্ধিমা একটু অপ্রস্তুত হয়েই বলে, ‘হ্যাঁ মনে পড়েছে আপনি ৪০ টাকা পাবেন’। কথাটা বলেই ঋদ্ধিমা ব্যাগ থেকে ৫০ টাকার নোট বার করে দেয়। ‘সত্যি কথা বলতে টাকার জন্য আপনাকে ডাকিনি, পরে কোন দিন দিলেও চলবে’। অনিমেষ তোতলাতে থাকে। ‘যা বাবা! আপনিতো পাওনাদারের মতো এমন জোরে ডাকলেন! ‘না আপনাকে এখানে দেখে একটু অবাক হয়ে ছিলাম তো! কেউ অ্যাডমিট আছে এখানে’? ‘না আমার পরিচিত দিদির সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। উনি এখানকার স্টাফ। আপনি এখানে’? আমি এখানে এম.বি.বি.এস করছি। এবছর ফাইন্যাল ইয়ার। আপনি কি নিয়ে পড়ছেন? ‘আমি নার্সিং করছি একটা প্রাইভেট হসপিটাল থেকে, এবছর থার্ড ইয়ার’।ও আপনিও আমাদের লাইনে। ভালো! ভালো! ‘কি ভালো’? ঋদ্ধিমা একটা বিশ্বয়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।না কিছু না, বলছিলাম আমরা দুজনেই তো স্টুডেন্ট তাই আমরা আপনি ছেড়ে তুমি বলতে পারি কি? ঋদ্ধিমা মাথা নেড়ে সায় দিল। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে আমাকে ৮ টার মধ্যে হস্টেলে ঢুকতে হবে।আমাকে এবার যেতে হবে। আচ্ছা চলো তোমাকে একটু এগিয়ে দিই। দুজনেই করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। নতুন আলাপ, কি কথা দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। ঋদ্ধিমা ভাবছে বাহ! ছেলেটাকে যতটা গোবেচারা মনে হয়েছিল, ঠিক ততটা নয়।প্রথম দিনেই আপনি থেকে তুমি। আবার এগিয়েও দিতে আসছে।ঋদ্ধিমার যে ব্যপারটা খারাপ লাগছে তা নয়! কিন্তু প্রথম দিনেই বেশি পাত্তা দিলে মুশকিল। তখন হয়তো ভাববে মেয়েটা খুব চিপ। হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে গেছে দুজনে। এবার অনিমেষই জিজ্ঞেস করল, ‘সেই দিনের পর গিয়েছিলে নন্দনে’?দুদিন গিয়েছিলাম। তোমাকে দুদিনই খুঁজে ছিলাম। আরে ছাড়ও ছাড়ও ভারী তো ৪০ টাকা। ঋদ্ধিমা একটু মুচকি হাসল।
অনিমেষ অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও ঋদ্ধিমার ফোন নাম্বারটা জিজ্ঞেস করতে পারল না। প্রথম দেখাতেই ফোন নাম্বার জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কিনা ভাবতে ভাবতেই বাস চলে আসে।ঋদ্ধিমা বাসে ওঠার সময় বলে, ‘তুমি এফ.বি তে আছো? হ্যাঁ। তুমি এফ.বি তে বাংলায় টাইপ করবে অনিমেষ হালদার পেয়ে যাবে।বাস চলে গেলে অনিমেষ নিজের মনেই বলে ওঠে ‘সিট ইয়ার’। নামটাই তো জিজ্ঞেস করা হলো না। হঠাৎ করে অনিমেষের মাথায় আসে এখানে এক স্টাফের সাথে দেখা করতে এসেছিল। প্রায় ছুটতে ছুটতে হাসপাতালে ঢুকল। একজন ব্যাচমেট ছুটতে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কি রে পেসেন্টের সিরিয়াস কেস নাকি? সুইসাইড না অ্যাকসিডেন্ট? অনিমেষের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। দু-একটা ওয়ার্ড ঘুরেই একজন পরিচিত নার্সের সাথে দেখা হল।অনিমেষ তার কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল, ‘রত্নাদি একটু আগে একটা মেয়ে এসেছিল, কার সাথে দেখা করতে জানো’? ‘এখানে তো অনেক ছেলে মেয়েই আসে, কার সাথে দেখা করতে এসেছিল কি করে বলি বলতো! ‘না এখানে এক স্টাফের সাথে দেখা করতে এসেছিল। বয়স ১৯-২০ হবে।ফর্সা, একটু পাতলা, চোখে কালো রঙের চশমা, আমার যতদূর মনে পড়ছে নীল রঙের সালোয়ার কামিজ পড়েছিল’। তুমি এতো কিছু জানো আর তাকে জিজ্ঞেস করতে পারনি, ও কার সাথে দেখা করতে এসেছিল। অনিমেষ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলে, ‘ছাড়ও তোমাকে দিয়ে হবে না, আমি খুঁজে নেবো। ১১ নাম্বার ওয়ার্ডে ঢুকে দেখে তনিমা ঘোষ একটা রুগীর স্যালাইন পাল্টে দিচ্ছে।
অনিমেষ একটু দূর থেকেই বলে, ‘তনিমাদি একবার আসবে’? তনিমা ঘোষ, অনিমেষের দিকে না তাকিয়েই উত্তর দেয়, ‘আমি যেতে পারব না, এখানে অনেক কাজ আছে, দুটো পেসেন্টকে ইঞ্জেকশন দিতে হবে। একটু থেমে তাছাড়া আমি অন্য ওয়ার্ডের কোন কাজ আমি করতে পারব না’। ‘আরে তোমাকে কাজের জন্য ডাকছি না, অনিমেষ একটু কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘একটু আগে তোমার সাথে কোন মেয়ে দেখা করতে এসেছিল’।‘হ্যাঁ! কি হয়েছে’? ‘না একটু আগে করিডোর দিয়ে যাচ্ছিল দেখলাম’। ‘আমাদের ওখানকার মেয়ে নার্সিং পড়ছে, ভালো মেয়ে! বিয়ে করবে’? ‘কি যে বল না! নিজেরই কেরিয়ারের ঠিক নেই। মেয়েটার নাম কি’? ‘বিয়ে করবে না তো, নাম জেনে কি করবে’? ‘আরে নামটা বল না? আমি ফ্রেন্ডশিপ করব’।‘না! না! ওসব হবে না, ডাক্তারদের আমি হাড়ে হাড়ে চিনি।দুদিন ফষ্টিনষ্টি করবে তারপর ছেড়ে দেবে’।তনিমা ঘোষ বেশ জোর গলায় কথা গুলো বলে। ‘সবার সাথে আমার তুলনা করছ? আমাকে এতোদিন ধরে দেখছ? ঠিক আছে বলতে হবে না’। অনিমেষ একটু রাগ দেখিয়ে চলে যেতে যায়। ‘ঋদ্ধিমা রায়, নৈহাটি রেল কলোনিতে বাড়ি’। অনিমেষ মনে মনে ভাবে যাক, রাগ দেখানটা কাজে এসেছে।‘ Thank you দিদি’ বলে অনিমেষ বেড়িয়ে যায়।