কফি হাউস
কফি হাউস
কফিহাউসের আড্ডাটা জমে উঠেছে। তবে আড্ডার থেকে তর্ক বলাটাই মনে হয় ঠিক হবে। তর্কটা তানিয়ার একটা ছবি নিয়ে। এখনও পর্যন্ত ২০০ এর বেশি লাইক এবং একশ জন কমেন্ট করেছে। সকলেই খুব প্রশংসাই করেছে। কেউ কেউ এই রকমও লিখেছে ‘এটা মাষ্টার পিস’।
তানিয়া, আবীরের কয়েকজন কমন ফ্রেন্ড আবার বলেছে, ‘আবীরের শেখা উচিৎ তানিয়ার কাছ থেকে কিভাবে ছবি তুলতে হয়। শুধু DSLR হাতে নিলেই ফটোগ্রাফার হওয়া যায় না। চোখ দরকার’।
এই কথাটাই হজম হচ্ছে না আবীরের। সে ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়াশুনা করে। একটা ডিপ্লোমাও করেছে।
তানিয়া ব্ল্যাক কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, ‘দেখ, আমি বলছি না তুই ছবি তুলতে জানিস না, কিন্তু যে লেবেলে ভাও খাস, ততটা নয়। ইচ্ছে থাকলে যে কেউ ফটোগ্রাফার হতে পারে, এমন কিছু কঠিন কাজ নয়’!
মৃনাল এতোক্ষণ শুনছিল। সে একটুকরো স্যান্ডউইচ মুখে পুড়ে বলল, ‘একদম ঠিক! তাছাড়া ফটোগ্রাফিটাকে ঠিক ফাইন আর্টও বলা যায় না। কি বলো তানিয়া’?
‘আমি আর কি বলব, আবীরই এটা ভালো বলতে পারবে’। তানিয়া হোয়াটস্যাপে টাইপ করতে করতে বলল।
‘আমি মানছি, ফটোগ্রাফি যে কেউ করতে পারে কিন্তু তার জন্য বেসিক কিছু শেখা দরকার। লাইট কম হলে ISO কত করতে হবে, মুভিং ছবি তুলতে গেলে শাটার স্পীড কত রাখা দরকার, কখন অ্যাপার্চার মোডে ছবি তুলবে আর কখন ম্যানুয়াল সেগুলোর জন্য একটু পড়াশুনা দরকার। মোবাইলে ক্লিক করে একটা ছবি ভালো হয়ে গেল, আর তৎক্ষণাৎ নিজেকে বড়ো ফটোগ্রাফার ভাবতে লাগলাম, তাদের অনুরোধ করব, ফটোগ্রাফি নিয়ে একটু পড়াশুনা করতে’।
মৃণাল কফির কাপে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার রিসেন্ট ছবি গুলো সবই ডিপ্রেসিভ কেন’?
‘এটা খুব ভালো প্রশ্ন। মৃণাল তোমার কি মনে হয় সমাজের প্রান্তিক মানুষ গুলো খুব সুখে আছে’? আবীর সিগারেটে টান দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল।
‘ওয়েল! সবাই যে খুব সুখে আছে সেটা বলা যাবে না। কিন্তু পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়ে কি লাভ? এতে কি তাদের জীবন যাত্রার কিছু পরিবর্তন আসছে’?
‘আমি তো তাদের জীবন যাত্রার কিছু পরিবর্তন ঘটাতে চাইছি না। সে ক্ষমতাও আমার নেই। আমি চাইছি একটা ডকুমেন্টেশন। এই সময়ে যারা পিছিয়ে রয়েছেন তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, পুজোপার্বণ ইত্যাদিকে ক্যামেরা বন্দি করে রাখা।সুন্দরী নারীর ছবি তোলার জন্য তো অনেকে আছেন। আমি না হয় পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর ছবি তুলে রাখলাম। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে আমাদের ভারতবর্ষে এরাও থাকতেন। যাদের প্রতিদিন দুমুঠো ভাতের জন্য লড়াই করতে হত’।
তানিয়া এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিল। এবার চিৎকার করে বলল, ‘ভাই, তোমরা একটু থামবে। কফি হাউসে আসলে সবাই কেন আঁতেল হয়ে যায়, বুঝি না। আমরা অন্য কিছু নিয়েও তো কথা বলতে পারি’।
‘হ্যা ঠিক ঠিক, আমরা যে শর্ট ফিল্মটা বানাব ভাবছিলাম সেটা নিয়েও কথা বলতে পারি, কি বল তানিয়া’? মৃণাল বলল।
‘শর্ট ফিল্ম নিয়ে ডিসকাসটা কাল বিকেলে করি, আজ আমার দমদমে ফটোগ্রাফির ক্লাস আছে’? আবীর একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল।
‘বাবু, একদিন ক্লাস না করলে কিছু হবে না’। মৃণাল বলল।
তানিয়া ছোট লেদারের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বলল, ‘এবার আমাকে বেড়তে হবে, মা আজ তাড়াতাড়ি বাড়ী ঢুকতে বলেছে’।
মৃণালও বলল, ‘তাহলে আমিও যাই কাল করুণাময়ীতে দেখা হচ্ছে, তখনই আমরা ডিটেলে ডিসকাস করে নেবো’।
২
বিকেল সাড়ে চারটে বাজে। আবীর পৌঁছে গেছে করুণাময়ীতে। মিনিট দশেক পরে মৃণাল পৌঁছালো।
‘তানিয়া কোথায়’? মৃণাল জিজ্ঞেস করল।
‘জানিনা, আমাকে ডেকে তোমাদেরই পাত্তা নেই’! আবীর একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলল।
‘চলো চা খাই, এর মধ্যে তানিয়া চলে আসবে’।
আবীর একটা সিগারেট ধরায়। মৃণাল চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ঘুরে তাকাতেই দেখে তানিয়া চলে এসেছে।
‘ভাই এবার বলোতো কি শর্ট ফিল্মের প্লট নিয়ে এসেছ’? আবীর একটু গলা চড়িয়ে বলল।
মৃণাল আর তানিয়া একে অপরের দিকে তাকাল। মৃণাল গলা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘এই ধরো একটা ছেলে অনেক গুলো গোলাপ নিয়ে দাড়িয়ে আছে মন্দিরের সামনে। সে অপেক্ষা করছে তার বান্ধবীর জন্য। এরপর একজন ভিখারি ভিক্ষে করতে আসলে ছেলেটি কোন পয়সা দেবে না’। মৃণালকে মাঝখানে থামিয়ে আবীর বলে, ‘বাকিটা আমি বলি। বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করার পরও যখন বান্ধবী আসবে না তখন ছেলেটা ফুলগুলো ওই ভিখারিকে দিয়ে দেবে এবং ওখান থেকে একটা গোলাপ নিয়ে ১০ টাকা ভিখারিকে দেবে’।
‘বাহ! তুমি তো আইডিয়াটা ধরে ফেলেছ দেখছি। আমি এটাই বলতে চাইছিলাম। এর থেকেই বলা যায়,Sometimes two great minds think the same thing.
‘মোটেও না, ইউটিউবে যারা শর্ট ফিল্ম দেখে তারাই বলতে পারবে। এটা অলরেডি হয়ে গেছে’।
‘ও মাই গড! খাতাতে লিখিনি তার আগেই চুরি’! মৃণাল ভাবলেশ হীন হয়ে বলল।
আবীর আর এক কাপ চা নিয়ে বলল, ‘কে যে কার চুরি করছে বোঝা মুশকিল’!
মৃণাল তানিয়ার দিকে তাকায়। তানিয়া আবীরের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমার আইডিয়াটা শোন’।
‘তোর ভুলভাল আইডিয়া শোনার ইচ্ছে আমার নেই’। আবীর সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বলে।
মৃণাল একটু উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘তুমি এতো ইনটলারেন্স কেন? গণতন্ত্রে সবার বলার অধিকার আছে। তুমি না কমিউনিস্ট’!
‘বাবা! কমিউনিস্ট হয়েছি বলে লোকের ভুলভাল কথা শুনতে হবে’?
‘অবশ্যই’! বলে মৃণাল তানিয়াকে তার আইডিয়া শেয়ার করতে অনুরোধ করল।
তানিয়া দুহাত উঠিয়ে সিনেমার ফ্রেম করে বলল, ‘আইডিয়াটা একদম ইউনিক! দুটো ইয়াং ছেলে মেয়ে। বয়স ২২ থেকে ২৪ এর মধ্যে। তারা বাস স্ট্যান্ডে বসে আছে। মেয়েটা বলে যাচ্ছে তারা বিয়ের পর কি করবে। আমরা পূর্ণিমার রাত্রে এক ছাদে বসে আকাশের তারা গুনব। একবার সুমুদ্রে গিয়ে ঢেউ নিয়ে খেলব। আর অন্ধকার ঘরে এফ.এম চালিয়ে দেবো। রাত্রি ১১টার পর পুড়নো দিনের গান শুরু হলে আমরা গেস করব এরপর RJ কোণ গান বাজাবে’।
মৃণাল বলল, ‘বেশ রোম্যান্টিক এবং ইন্টারেস্টিংও। এর পর কি হবে’?
আবীর সিগারেটের ধোঁয়াকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ছাড়তে ছাড়তে বলল, ‘এর পর একটা বাস আসবে, বাসে যখন দুজন উঠতে যাবে, দেখা যাবে ছেলে মেয়ে দুটো অন্ধ’।
‘wow! Fantastic idea! Really unique! তানিয়া তোমাকে আগে বলেছিল’? মৃণাল জিজ্ঞেস করল।
‘ঘণ্টা ইউনিক! তোমাদের জ্ঞান ইউটিউবেই সীমাবদ্ধ! যে কেউ বলে দিতে পারে’।
তানিয়া রেগে বলল, ‘এবার তুই কিছু বল যেটা ইউটিউব কেন? কোন টিউবেই দেখেনি’।
‘দেখ আমার কাছে যা কনসেপ্ট আছে সেটা লিখে দিতে পারি লাখ টাকার! মেঝেতে একটা মাঝ বয়সি লোক শুয়ে আছে। একটা পিঁপড়ে লোকটার ঘারে উঠল। এবার ক্যামেরা জুম করে দেখাবো লোকটার একটা হাত পিঁপড়েটাকে মারতে যাচ্ছে অন্যহাত পিঁপড়েটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। এটা আমি লিখে দিতে পারি এই রকম কনসেপ্টে কোন শর্ট ফিল্ম ইউটিউবে পাবে না’।
তানিয়া হিহি করে হেসে বলে, ‘এই রকম ভুলভাল আইডিয়া নিয়ে কেউ শর্ট ফিল্ম বানায়? কেউ দেখবে? মৃণাল তুমি কি বলো? যে বানাবে সে ছাড়া আর কেউ দেখবে না’।
‘দেখ, দেখা না দেখাটা পরের ব্যাপার। এটা বানানোও খুব কষ্ট সাধ্য। অনেক গুলো পিঁপড়ে ধরে রাখতে হবে। পাওয়ারফুল একটা ক্যামেরা লাগবে। আমাদের DSLR এ হবে না। আর কষ্ট করে যদি বানিয়েও ফেলি কি লাভ? ইন্ডিয়ার কেউ দেখবে না’।
‘একদমই ঠিক! মৃণাল সেনের সিনেমাতো বাংলায় যা না চলেছে তার থেকে বিদেশে অনেক বেশি প্রশংসা পেয়েছে। আমি বিদেশীদের কথা মাথায় রেখেই এটা ভেবেছি। যদি কিছু করি সেটা আন্তর্জাতিক মানেরই হওয়া উচিৎ? কি বলো মৃণাল’? আবীর চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে বলল।
তানিয়া ভ্রুকুচকে বলল, ‘দেখ মৃণাল, পয়সা খরচ করে এতো সময় নষ্ট করে বিদেশীদের জন্য শর্ট ফিল্ম বানানোর কোন মানে হয় না। তোমার মাথাতে কোন আইডিয়া নেই, যেমন আগে আমরা একটা বানিয়েছিলাম। একদম অরিজিন্যাল’!
মৃণাল তানিয়ার দিকে তাকিয়ে একবার আকাশের দিকে তাকায়। কয়েক মুহূর্ত ভাবার ভান করে মাথা চুলকে বলে, ‘আছে একটা! কিন্তু আমাকে কথা দিতে হবে মাঝ পথে আমাকে থামানো যাবে না। আর গল্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনও মন্তব্যও করা যাবে না’।
‘মানে আবার একটা ইউটিউব থেকে ঝাপা কিংবা ফালতু একটা আইডিয়া আমাদের মুখ বুজে শুনতে হবে! এই তানিয়া তুই যাবি, আমার কলেজ স্ট্রীটে কাজ আছে’।
‘আর তোর কাজ! কফি হাউসে গিয়ে বিভিন্ন টেবিলে গিয়ে কফি গেলা ছাড়া তোর কোন কাজ আছে বলে তো আমার মনে হয় না। তার থেকে মৃণাল যে গল্পটা বলছে সেটা শোন ভালো লাগলে শর্ট ফিল্ম বানানো যেতে পারে। মৃণাল তুমি শুরু করো’।
‘আসলে আইডিয়াটা এতোটাই ইউনিক, যে কিভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না। মানে তোমরা ঠিক নিতে পারবে তো’?
‘উফ! তোমার এই ভাট বকা বন্ধ করে প্লীজ শুরু করো আমার কাজ আছে’। আবীর বিরক্তির সাথে কথা গুলো বলে আবার একটা সিগারেট ধরালো।
‘গল্প শুরু করা যেতেই পারে। কিন্তু...’
‘আবার কি হল? তুমি কি বলবে না আমরা সত্যি চলে যাবো’? তানিয়া রেগে বলল।
‘না, না বলব বলেই তো বলছি, কিন্তু বলার আগে এক কাপ চা লাগবে। চা না হলে ব্যাপারটা ঠিক জমছে না। সঙ্গে বাদাম ভাজা মুড়ি হলে ভালো হতো, কিন্তু আপাতত চা হলেই চলবে’।
‘দাড়াও দেখছি বলে’ আবীর চায়ের দোকানের দিকে এগিয়ে গেল।
‘এটাই তো চাইছিলাম, আমি গল্প শুরু করলে তুমি বলবে দারুন হচ্ছে, তারপর...’
তানিয়া হিহি করে হেসে বলল, ‘কেন? ভালো হলে তবেই বলব’।
‘আরে দরকার আছে, তোমাকে বলব, না হলে আবীর মাঝ পথেই থামিয়ে দেবে’। মৃণাল দাঁত বার করে হেসে বলল।
‘আচ্ছা ঠিক আছে, কিন্তু খুব বেশি আঁতেল নয় তো, আম্নে তুমিও পিঁপড়ে মারার গল্প বলবে না তো’? তানিয়া হেসে জিজ্ঞেস করল।
‘পাগল! আমি পিঁপড়ে, মশা মাছির গল্প বলি না, ওটা আবীরের পেটেন্ট! আমি গল্প বলব মানুষ নিয়ে। মানুষের হাসি কান্না, হেরে যাওয়া তারপর...’
‘তারপর জিতে যাওয়া, কেমন জুড়ে দিলাম, বলো’। তানিয়া হিহি করে হেসে বলল।
‘না, এখানে জিতবে না, এখানে হেরে যাওয়াটাকেই গ্লোরিফাই করা হবে, পুরোটাই ইউনিক! এই রকম গল্প আগে কেউ বলেওনি শোনেওনি’।
‘শুনবে কি করে, তুমি তো কোন দিন বলোনি তাই, এবার চা-টা ধরো, নিয়ে গল্প শুরু করো, আমার সত্যি কাজ আছে’।
মৃণাল চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘গল্পটা একজন সাধারণ মানুষের, এখানে কোনো হিরোইজম নেই। সঞ্জয় নামে একটা ছেলে গ্রাজুয়েশনের পর ফিল্মের ভূত চাপে। বছর খানেক শহরের অলিতে গলিতে গজিয়ে ওঠা ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে একটা ফিল্ম ডাইরেকশনের কোর্স করেছে...’
‘আচ্ছা বুঝে গেছি, সঞ্জয় তোমার প্রধান চরিত্র, সে ফিল্ম বানাতে গিয়ে ধাক্কা খাবে তাই তো’? আবীর একটা সিগারেট ধরিয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘এই ভাবে গল্পের শুরুতে প্রশ্ন করলে আমি আর বলব না’। মৃণাল চায়ের ভাঁড়টা টিনের বাক্সে ফেলে বলে।
তানিয়া রেগে গিয়ে বলে, ‘তুই কী স্পীল বার্ক! গল্পের প্রথম লাইন শুনেই শেষ লাইন বলে দিবি। চুপ করে শোন না। মৃণাল তুমি শুরু করো। আর কেউ তোমাকে কোনও প্রশ্ন করবে না’।
‘হ্যা তানিয়া আমরা কোথায় ছিলাম...’
‘ওই তো সঞ্জয়, ফিল্মের কোর্স...’
‘হ্যা, তো ফিল্মের কোর্স করলেই তো কেউ সিনেমা ডাইরেক্ট করতে ডাকবে না, তোমাকে হয় কাউকে অ্যাসিস্ট করতে হবে কিংবা কোন টেলিফিল্ম নিদেন পক্ষে দুচারটে ভালো শর্ট ফিল্ম করতে হবে। সঞ্জয় প্রথমে ঠিক করে একটা প্রথম যে শর্ট ফিল্ম বানাবে সেটা কোন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বর জীবনীকে নিয়ে। প্রথমে সে বেশ কিছু বিখ্যাত ব্যাক্তিত্বকে অ্যাপ্রোচ করে কিন্তু সকলেই না করে দেয়। তারপর অনেক কষ্টে একজন ফটোগ্রাফারকে রাজী করায়। সঞ্জয় তার ইন্টার্ভিউ নেয়। তারপর সেটাতে কিছুটা নিজের কল্পনা মিশিয়ে একটা স্ক্রিপ্ট করে একটা শর্ট ফিল্ম বানায়। প্রথমে ভদ্রলোকের ন্যারেটিভ ভার্সন। তারপর ভদ্রলোক তার যৌবনকালে ফিরে গেলে সেটা একটা চরিত্র দিয়ে অভিনয় করানো হবে। প্রথম সিন কফি হাউসে। কফি হাউসের তিন তলায় এক কোনে টেবিলের এক দিকে বছর ৬০ এর একজন ভদ্রলোক, উল্টোদিকে সঞ্জয়। ভদ্রলোক গল্প বলতে শুরু করে। ছবি তোলার ইচ্ছেটা একদিন হঠাৎ করেই এসেছিল। আমি ছোট থেকে ফটোগ্রাফার হবো এই রকম ভাবিনি। এক শনিবার নন্দনে সিনেমা দেখতে গিয়েছি।টিকিট কাটা হয়ে গেছে। কিন্তু সিনেমা শুরু হতে প্রায় ৩০ বাকী। আমি আর বন্ধু মিলে গগনেন্দ্র ভবনে ঢুকলাম। সেদিন সুন্দরবন নিয়ে কয়েক জন ফটোগ্রাফার ব্যাক অ্যান্ড হোয়াইটে বড়ো বড়ো ক্যানভাসে ছবি নিয়ে তুলে ধরেছে ওখানকার মানুষদের জীবনযাত্রা। আমি কোন তার আগে কোন দিন সুন্দরবন যাইনি। কিন্তু আমার চোখের সামনে তারা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। সেদিনই ভেবেছিলাম আমি যদি ফটো তুলি এই রকম ফটো তুলব। আমার বাবার একটা কোডাকের ক্যামেরা ছিল। আমি প্রথম থেকেই স্ট্রীট ছবি তুলতে শুরু করি। সপ্তাতে একদিন বেড়তাম। খুব বেশি হলে ১০টা ক্লিক করতাম। সারা মাসে একবারই প্রসেস করতাম।প্রথম প্রথম প্রসেস করার পর দেখতাম বেশ কিছু কাপা ছবি তুলেছি। তাই পরের দিকে প্রত্যেকটা ক্লিকের আগে অনেকক্ষণ ধরে ভাবতাম। মাঝে মাঝে চলে যেতাম ইট ভাটায়। সেখানে দেখেছি কত কম পারিশ্রমিকে বাচ্চা ছেলেরা কাজ করছে। অভাবের তাড়নায় কত শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে চিমনীর কালো ধোঁয়ায়। আমি চেষ্টা করতাম আমার ছবির মধ্যে যেন প্রকাশ পায় তাদের আর্তনাদ।আমার ছবি দেখলে বুঝতে পারবে, তারা বলতে চাইছে আমাদের শৈশবের বিনিমনে তোমাদের সৌখিনতা। আমরা না থাকলে তোমাদের ইমারতের ইট এতো সস্তায় পৌঁছাতো না। কখনও চলে গেছি উড়িষ্যার কোন জঙ্গলে। সেখানে গিয়ে দেখলাম জল, জমি আর জঙ্গলের অধিকারের জন্য তারা লড়াই করছে। কিছু অর্থলোভী লোক তাদের বিতাড়িত করে খনিজ পদার্থ উৎপাদন কেন্দ্র গড়তে চায়। আমি তাদের জীবন যাত্রার ছবি তুলে রেখেছি,বলাতো যায় না কবে তারা অর্থের মোহেই হোক কিংবা ভয়ে আমাদের ভিড়ে মিসে যায়! কখনও চলে গেছি ধাপাতে। সেখানে কিছু বাচ্চা ছেলের ছবি রেখেছি যারা জীবনে কিছু না পেয়েও অমিতাভের ছবি নিয়ে ডায়লগ বলে ‘রিস্তেমে মে তেরা বাপ...’ । কফি হাউসের স্টাফদের নিয়েও ছবি তুলেছি। যারা সারা বছর হাসি মুখে কিছু আঁতেলদের কফি সার্ভ করে। একবার বাংলাদেশও গিয়েছি। সেখানে...’
‘আচ্ছা বাংলাদেশের গল্প পড়ে শুনব, তার আগে বলুন আপনি ফটোগ্রাফিকে এতো ভালবাসেন, আপনার কোন দিন মনে হয়নি ফটোগ্রাফিকে প্রফেশন হিসাবে নেওয়া যেতে পারে’?
‘কী বলি বলো তো? এক জন স্বনামধন্য কবি বলে ছিলেন , ‘আজকাল কেউ কোন কিছুকে হবি হিসাবে নিতে চায় না, তুমি ক্রিকেট খেললে সেই লেবেলে খেলতে হবে যেন তুমি জাতীয় দলে খেলতে পারো নিদেন পক্ষে আই. পি. এল এ চান্স পেতেই হবে। তুমি যদি গান গাও তো প্লেব্যাক সিঙ্গার হতে হবে, নিদেন পক্ষে অঞ্জন, সুমনের ধারে কাছে যেতে হবে আর ছবি আঁকলে মকবুল ফিদা হোসেনের নীচে বাঙ্গালী নামবে না। তোমাকে সব কিছুতেই যেন প্রথম হতে হবে, তোমাকে সব কিছুতেই শ্রেষ্ঠ হতে হবে’। ভদ্রলোক এই পর্যন্ত বলে একটু থামলেন। ক্যামেরা জুম করে ভদ্রলোকের মুখটাকে বড়ো করে দেখানো হবে। সঞ্জয়ের চোখ ভদ্রলোকের চোখের দিকে। ভদ্রলোক একটা সিগারেট ধরালেন।
সিগারেটে একটা টান দিয়ে বললেন, ‘তবে আমি কিন্তু ফটোগ্রাফিটাকে প্রফেশন হিসাবেই নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। আমার বিয়ে বাড়ীতে ফটো তোলার কোন ইচ্ছেই ছিল না। সেই সময় মিডিয়া হাউসগুলো ট্রেনী ফটোগ্রাফারদের ৮-১০ হাজারের বেশি দিত না। আমি আমার অফিসে ২০ হাজারের একটু বেশিই পেতাম। বাড়ীতে টাকা দিতে হতো। ফটোগ্রাফি করেও হয়তো দিতে পারতাম। আসলে কিজানো আমি রিস্কটা নিতে পারিনি। নিলে কি হতো জানি না। কিন্তু আজও মনের মধ্যে একটা আক্ষেপ কাজ করে সেটা হয়তো হতো না। আর পাঁচটা ঘরকুনো বাঙ্গালীর মতো আমিও ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলাম’। কথাটা বলেই ভদ্রলোক সিগারেটে শেষ টান দিয়ে উঠে পড়লেন। লোকটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে কলেজ স্ট্রীটের ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল।
গল্প শেষ করে মৃণাল, তানিয়া আর আবীরের দিকে চেয়ে থাকে। কেউ কিছু বলছে না দেখে মৃণাল বলল, ‘কি চলবে’? আবীর কিছু বলে না।
তানিয়া বলে, ‘খারাপ না, তবে ক্যারেক্টার যেন চেনা চেনা লাগছে’।
মৃণাল হাসতে হাসতে বলে, ‘ছবি শুরুর আগেই লিখে দেবো, সব চরিত্রই কাল্পনিক, বাস্তবের কেউ মিল খুঁজে পেলে সেটা কাকতালীয়।
আবীর একটু হেসে বলে, ‘না এটাও ঠিক জমছে না তুমি বরং...’
মৃণাল মাথা চুলকে বলে ‘এটাও হবে না, ঠিক আছে আমার S-9 চলে এসেছে, অন্য কোন দিন অন্য কোন স্টোরি নিয়ে ভাবা যাবে।