রাজকুমার মাহাতো

Drama Classics Inspirational

4.8  

রাজকুমার মাহাতো

Drama Classics Inspirational

ক্যাবের ড্রাইভার

ক্যাবের ড্রাইভার

5 mins
546



অফিস থেকে আসা যাওয়াটা এখন ক্যাবেই হয়। প্রতিদিন তা বলে নয়। ওত টাকা পয়সা নেই । সপ্তাহে এক দুই দিন আমি অফিস যাই আর বাড়ি আসি। 


সেরকম‌ই আজ‌ও ওলা বুক করেছি। কিন্তু পরপর পাঁচটা ওলা আমার লোকেশন শুনে নিজে থেকেই ক্যানসিল করে দিল। আর এখন আবার ক্যাবের নতুন নাটক হয়েছে, ক্যাস নেই বললেই ক্যাব ক্যানসিল। এই ইস্যু গুলো দিয়েই পাঁচজন ক্যানসিল করল আমার বাহন হতে ।


ছয় বারের মাথায় বাহন এল। ড্রাইভার এর নাম মহম্মদ রফিক।গাড়িতে বসতেই তার প্রথম প্রশ্ন " দাদা কুথায় যাবেন?" হিন্দি ভাষি মানুষ বাংলায় কথা বললে যা হয় আরকি।মটকা গরম হয়ে ছিল, আটা দিলে রুটি হয়ে যাওয়ার মত। গাড়ি থেকে বেরোনোর ভান করে বললাম " ব্রেস ব্রীজ এর দিকে যাব। অসুবিধা আছে? নেমে যাব?" আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন " না না, কেন এয়সে বোল রহে হ্যায়? বুক নেহি করতে ফির।"

আমি বললাম "এখন আমার বাড়ি যাওয়া আপনাদের উপর নির্ভর করে বুঝলেন! আধঘন্টা ধরে ট্রাই করছি , কারোর জায়গা নিয়ে সমস্যা তো কারোর অনলাইন পেমেন্ট নিয়ে। এত সমস্যা থাকলে গাড়ি বেড় করেছেন কেন দাদা আপনারা?"

রফিক বলল " দাদা গাড়িটা ঘুরিয়ে নেব?" 

রেগে বললাম " না সামনে থেকে বাঁ দিকে নিয়ে নিন।"

সে বেচারা তাই করল। আর লুকিং গ্লাসে আমাকে দেখে নিল বার দুয়েক। 


এই ভবানিপুর এলাকা সকাল বিকেলে নিজের পথ পরিবর্তন করে। সকালে যে রুটে গাড়ি ইন করে বিকেল থেকে সেই রুট দিয়েই সব গাড়ি আউট হয়। মানে ওয়ান ওয়ে হয়ে যায়। 


রফিক ভুল করে রং রুটে ঢুকে গেল। আমিও আর কিছু বলিনি‌ । এমনিতেই বললাম মটকা গরম হয়ে ছিল। হঠাৎ দেখলাম সামনে থেকে দুটো পুলিশ বাইকে করে এসে গাড়িটাকে সাইড করতে বলছে। বুঝে গেলাম আজ কপালে দুঃখ। মটকা তখন ঠিক কি রিয়াকসান দেবে সে নিজেই বুঝতে পারছে না। 


যাই হোক, রফিক গাড়ি থেকে নামল। আমি গাড়িতেই বসে‌। পিছনে দেখলাম রফিক হাত জোড় করে পুলিশটিকে কিছু একটা বলছে। তারপর দৌড়ে আমার কাছে এসে বলল " দাদা দুই হাজার টাকার কেস দেবে বলছে। আপ থোড়া বোলিয়ে না। হসপিটাল যা রহেথে হামলোগ, আপকা জলদি থা। "

আমি মনে মনে ভাবলাম যদি এখন হাসপাতালের কথা বলি তাহলে তো কোভিড বলে না অ্যাম্বুলেন্সে পুরে দেয়। আমি বললাম " না না আমি পারব না।"

রফিক মুখটা শুকনো করে চলে গেল। আমি পিছন ঘুরে দেখতে থাকলাম।


আবার প্রায় মিনিট পাঁচেক পর রফিক দৌড়ে এল আমার কাছে " ভাইয়া দোশো রুপয় দিজিয়ে না।" বলে রাখি আমি ওলাটা পোস্টপেড এ বুক করেছিলাম ‌। সুতরাং, রফিককে টাকা দেওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠেনা‌। আমি বললাম " আমার তো পোস্টপেড এ বুকিং, ক্যাস দেব কেন?"

সে বলল " সকাল থেকে পাঁচশ টাকা রোজগার করেছি , আর এলোগ সাতশ রুপয় মাঙ্গ রাহা হ্যায়। নেহিতো কোর্টসে লাইসেন্স ছুড়ানা হোগা।"

ওর মুখটা দেখে আমি আর কিছু বলিনি। দুশ টাকা বের করে দিলাম। 


কিছুক্ষণ পর ও গাড়িতে এসে বসে গাড়িটা চালাতে শুরু করল। আমি জানতাম আমার দুশ টাকা আমি পাবনা আর। কারন এদিকে ওলা বিল পোস্টপেড এ বানাবে আর ওদিকে দুইশ গেল।


তাকিয়ে দেখলাম রফিকের দিকে‌ । মুখটা দেখে মনে হল অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছে ও। এত বিষন্নতা কোন মানুষের মধ্যে এক ঝটকায় তৈরি হতে পারে আমি বুঝতে পারিনি। আমার দিকে তাকিয়ে বলল " সুবহ সে পাঁচশ কামায়া থা দাদা। ও ভি গয়া‌ । উপরসে আপকা দোশো। "

জিজ্ঞেস করলাম " বাড়িতে কে কে আছে? " 

বলল " মা , বিবি ওর এক সালকা এক বাচ্চা"!

একটু থেমে আবার বলল " আপকা দোশো রুপয় ক্যায়সে দু? "

আমি বললাম " ওত ভেবোনা মন দিয়ে গাড়িটা চালাও। আমার লাগবে না"

কিছু না বলে গাড়িটা দৌড় করাল রফিক।


মিসেস এর ফোন এল আমার। তাকে সব খুলে বললাম। সে তো আমাকে কি কি সব বলল " বোকা, হাঁদা , দানিরাজা, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বললাম " দুশ টাকা নিয়ে কেউ বড়লোক হয়ে যাবে কি? আমার মনে হল তাই দিলাম। আমি নিশ্চয় না দিলে সে জোড় করত না।"

বৌ রেগে বলল " বেশি হয়ে গেছে টাকা?"

বললাম " এখন আছে দিয়ে দিই,যখন থাকবে না বাটি নিয়ে স্টেশনে বসব।"

শুনে ফোনটা কেটে দিল মা চন্ডী।


রফিক আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো । আমি আর কিছু বলিনি। আমার বাড়ির সামনে নামিয়ে ও চলে গেল। আমিও একবার টাকার কথা তুলিনি রফিকও কিছু বলল না। ঘরে ঢুকে গেলাম আমি, রফিক নিজের রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল।


কি ভাবলেন এখানেই শেষ? না শেষ হয়নি এখনও। 


প্রায় মিনিট দশ পরে একটা আননোন নম্বর থেকে ফোন এল । রিসিভ করে বললাম " হ্যালো"..

ওপার থেকে আওয়াজ এল " দাদা, ও ওলা ড্রাইভার বোল রাহা হু। আপকা ঘরকা বাহার খাড়া হু‌ । থোড়া আয়েঙ্গে?" আমি ভাবলাম কি হল রে বাবা। কিছু ফেলে এলাম নাকি। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম রফিক দাঁড়িয়ে সামনে। বললাম " কি হলো?"

রফিক হাতে থাকা দুটো একশ টাকার নোটটা আমার দিকে এগিয়ে বলল " আপকা‌ রুপয় দাদা"।

আমি বললাম " আমি তো বললাম দিতে হবেনা, তাও আবার এতটা তেল পুড়িয়ে এলে কেন?"

রফিক বলল " জীবনে অনেক লোক দেখা হ্যায় দাদা, ওলামে ক্যাস থোড়া পহলে মাঙ্গনে সে সব কোয়ি সোচতা হ্যায় উসকা আঁখ মাঙ্গ লিয়া। পহেলি বার আপকো অপনে‌ মর্জিসে এয়সে করতে দেখা। "

আমি বললাম " আরে ধুস। রাখো ওটা। তোমার তো টাকাটা গেল। আমার তো তবু দুশ তোমার তো পাঁচশ"!

মাথাটা নিচু করে রফিক বলল " ও লোগ পাঁচশ হি লিয়া দাদা, ম্যায়নে ঝুট বোলকে আপসে দোশ জাদা লে লিয়াথা।"

আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। রফিক আবার বলল " ভেবেছিলাম বলব না,তাই আপকো কুছ নেহি বোলা উতরনে তক। লেকিন রহে নেহি পায়া দাদা, মেরা জমির মেরেকো কোস রাহা থা। ইসলিয়ে ফির বাপস আয়া! মাফ কর দিজিয়েগা দাদা!"

ওর প্রতি কেমন জানিনা একটা শ্রদ্ধা জন্মে গেল হঠাৎ করে। আমি একটু হেসে বললাম " এই সাহসটা সবার থাকেনা রফিক। তোমার এই সাহস আছে মানে তুমি একজন সৎ মনের মানুষ। " ততক্ষণে চন্ডী মাতা ( আমার বৌ) বাইরে বেরিয়েছে এবং সব শুনছে। আমার তো ভয়ে সেই অবস্থা আর'কি। এই না একটা কষিয়ে থাপ্পড় মেরে দেয় রফিককে।  


কিন্তু আমাকে অবাক করে আমার পেছন থেকে চেঁচিয়ে বললেন চন্ডী " ওটা রেখে দাও। বাচ্চাদের কিছু কিনে দিও, আর এরকম কোরো না। বুঝলে?"

রফিক‌ও আর কিছু না বলে " আসছি দাদা, আসছি বৌদি বলে" বেড়িয়ে গেল।


আমি ঘরে ঢুকে ভাবলাম তিনি কিছু একটা কটু বলবেন , কিন্তু তিনি বললেন " সত্যি সৎ হলে মনুষ্যত্ব জেগেই যায়। বলো?"


উত্তরে মাথা নাড়লাম।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama