কুসংস্কারের বিরুদ্ধে
কুসংস্কারের বিরুদ্ধে
না আমি কাকিনের সাথে বিয়ের শাড়ি কেনাকাটা করতে যাব। চন্দ্রাণী জেদ ধরে বসেছে। ওর মা রেবা কত করে ওকে বোঝাচ্ছে তাও নিজের সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও নড়ছে না। চন্দ্রাণীর কাকিমা অপর্ণাকে চন্দ্রাণী কাকিন বলে ডাকে । চন্দ্রাণীর বাবা পরিতোষের একটি ভাই ছিল। তিন বছর আগে ভাই অলকেশ হঠাৎ করে একটা এক্সিডেন্টে মারা যায়। অপর্ণা জীবনে দুঃসময় ঘনিয়ে আসে। পনেরো বছরের মেয়েকে নিয়ে জীবন সংগ্রামে নেমে পড়ে। অলকেশ প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করত বলে এককালীন টাকা পেয়েছিল। ভাগ্যিস অপর্ণার বিউটি পার্লার টা ছিল তাই রক্ষে। অপর্ণা একসময়ে বিউটিসিয়ান কোর্স করে নিজেদের বাড়ির একতলায় লেডিশ বিউটি পার্লার খুলেছিল। এক তলাতেই ও বর্তমানে মেয়েকে নিয়ে থাকে। দোতলায় ভাসুর পরিবার নিয়ে থাকে ।একই বাড়িতে থাকলেও হাঁড়ি আলাদা দুই পরিবারের।তবে মিলমিশ আছে দুই জায়ের মধ্যে। অপর্ণা বিউটিসিয়ান হিসাবে বেশ ভালো। খুব ভালো কাজ জানে। প্রথমে নিজেই সব করত। এখন একটা হেল্পার রেখেছে। মোটামুটি ভালোই চলে পার্লারটা। চন্দ্রাণীতো সাজগোজের ব্যাপারে পুরোটাই কাকিনের ওপর ভরসা করে। তার মতে কাকিনের সাজগোজের সেন্স দারুণ। আই ভুরু প্লাক থেকে শুরু করে ফেসিয়াল সবটাই অপর্ণার কাছ ছাড়া কারোর থেকে করে না। এমন কি কোন্ অনুষ্ঠানে কি পোশাক পরবে তার সাথে ম্যাচিং জুয়েলারী কি পরবে সেটার ব্যাপারেও অপর্ণার পরামর্শ নেওয়া চাই। তাই সে জেদ ধরেছে কাকিনকে ছাড়া সে বিয়ের শাড়ি কিনতে যাবেনা। কাকিনের পছন্দেই সে শাড়ি কিনবে। কিন্তু সমস্যা টা অন্য জায়গায়। রেবা মুশকিলে পড়েছে। অপর্ণা বিধবা বলে ওকে নিয়ে যাওয়ার তার ইচ্ছে নেই। কারণ ওর অশুভ ছায়া মেয়ের জীবনে যদি পড়ে। সাত পাঁচ ভেবে রেবার মাথা খারাপ হয়ে যাবার জোগাড়। কিন্তু মেয়েকে খুলে সবটা বলতেও পারছে না। আজকালকার মেয়ে এসব বিশ্বাস করবে না। উল্টে রেবাকে অপমানকর কথা শোনাবে। তাও রেবা চেষ্টা করল মেয়ের মতের পরিবর্তন করতে । চন্দ্রাণী কে বলল, তোর ছোটো মাসি তো যাবে আমাদের সাথে, কাকিনকে যেতে বলার কি দরকার? পার্লার ফেলে কি করে যাবে? এই কথা বলে কোনো লাভ হল না। চন্দ্রাণী বলল, কাকিনের সাথে আমার কথা হয়ে গেছে। পার্লারে ঊর্মি দি ওই সময়টায় থেকে ম্যানেজ করে নেবে। ছোটো মাসি যাচ্ছে যাক না, কাকিনও যাবে।কাকিনকে ছাড়া আমি শাড়ি পছন্দই করতে পারব না। রেবা মনে মনে ভাবল, এই মেয়েকে কি করে বোঝাব আমি! আর অপর্ণাই বা কি, চাঁদ যেতে বলল অমনি রাজি হয়ে গেল!আরে বাবা তুই বিধবা, মঙ্গল অমঙ্গলের কথা একবারও ভাবলি না! অবশেষে মা, ছোটো মাসি, কাকিনের সাথে চন্দ্রাণী বিয়ের বেনারসি , অন্যান্য শাড়ি কিনতে গেল। শুভম আর চন্দ্রাণী একই অফিসে চাকরি করে। সেখান থেকেই দুজনের ভালোবাসা হয়। দুই বাড়ির অভিভাবকের সমর্থনে এখন দুজনের চার হাত এক করে দেওয়া হবে। দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এগিয়ে এল। চন্দ্রাণী মাকে বলল, মা বিয়েতে আমি কাকিনের কাছে সাজব। এবার রেবা নিজেকে সামলাতে পারল না। বলল, চাঁদ তোকে স্বাধীনতা দিয়েছি বলে যা ইচ্ছে তাই করবি সেটা মা হয়ে কিছুতেই আমি সহ্য করব না। কারণ আমি তোর মা, আমার থেকে কেউ তোর ভালো বুঝবে না। মা হয়ে একজন বিধবাকে দিয়ে তোর বিয়েতে তোকে সাজিয়ে আমি অমঙ্গল কিছুতেই ডেকে আনতে পারব না।অনেক নাম করা ব্রাইডাল মেকাপ আর্টিস্ট আছে। তারা তোকে সাজাবে। আর কোনো কথা হবে না। আমার কথাই শেষ কথা। চন্দ্রাণী মায়ের কথা শুনে বলল, ওহ! এতক্ষণে বুঝেছি আমার বিয়ের শাড়ি কিনতে যাবার সময় কাকিন যাতে না যায় তার জন্য ছল ছুতো করে কত কারণ দেখাচ্ছিলে। তুমিও যেনে রাখ মা এই শতাব্দীর মেয়ে হয়ে তোমার কু সংস্কারকে আমি কিছুতেই প্রশ্রয় দেব না। তুমি মনে করছতো কাকিন যদি আমাকে সাজায় কাকিনের মত আমিও বিধবা হব।এই কথা শুনে রেবা উত্তেজিত হয়ে বলল, চুপ কর চাঁদ ,যা মুখে আসছে তাই বলছিস! চন্দ্রাণীও উত্তেজিত হয়ে বলল, তুমিও জেনে রাখ কাকিনের কাছে ছাড়া আমি কারোর কাছে সাজব না। আর যে ব্রাইডাল মেকাপ আর্টিস্ট আমাকে সাজাবে সে উইডো কি উইডো নয় কি করে বুঝবে? রেবা বলল, সব জেনে শুনে তাকে দিয়ে সাজাবো। সেই মুহূর্তে অপর্ণা মাংস রান্না করে রেবাদের জন্য একবাটি মাংস নিয়ে আসছিল। ঘরের বাইরে থেকে মা মেয়ের সব কথা শুনে মনটা ওর ভেঙে গেল। খুব কষ্ট পেল। ঘরে গিয়ে রেবার হাতে মাংসের বাটিটা দিল। শান্ত গলায় নিজের কষ্টটা লুকিয়ে বলল, চাঁদ তোর মা ঠিক বলছে, তুই ছোটো অনেক কিছু নিয়ম জানিস না। একজন বিধবাকে বিয়ের অনুষ্ঠানে থাকতে নেই, কনে সাজাতে নেই তাতে অমঙ্গল হয়। চন্দ্রাণী বলল, আমি এসব মানি না। আমি শুধু ভাগ্যকে মানি। ভাগ্যে যেটা থাকবে সেটা কখনও আটকানো যায় না। সমাজের এই নিয়মগুলো কে সৃষ্টি করেছিল জানি না, তবে এগুলো আসলে নিয়ম নয়, কতগুলো অশিক্ষিত, নির্বোধ মানুষের তৈরি কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। তুমি যদি আমাকে না সাজাও বা আমার বিয়ের কোনো অনুষ্ঠানে কাকিনকে থাকতে না দাও তাহলে শুভম কে সব বলব এবং বিনা অনুষ্ঠানে, বিনা আরম্বরে,বিনা সাজে শুধু রেজিষ্ট্রি করে বিয়ে হবে আমাদের।আশা করি শুভম এ যুগের তাই ওর আমার মতই মানসিকতা হবে। ও আমার সিদ্ধান্ত কে সমর্থন করবে। বাবাকে এখনি গিয়ে আমার সিদ্ধান্ত টা জানায়ে আসছি। অপর্ণা মুশকিলে পড়ল। অনেক বোঝালো চন্দ্রাণী কে। চন্দ্রাণী সেই নিজের মতে অনড় রইল। রেবা আর কি করবে বাধ্য হল মেয়ের সব সিদ্ধান্ত মেনে নিতে। পরিতোষের কানে কথাটা পৌঁছল না। পৌঁছলে সেও চন্দ্রাণী কে সমর্থন করত চন্দ্রাণী সেটা ভালো করেই জানত। চন্দ্রাণীর বিয়েতে অপর্ণা শুধু যে ওকে সাজিয়েছিল তা নয় বিয়ের প্রত্যেকটা আচার অনুষ্ঠান সামনে থেকে দেখেছিল। অপর্ণা চন্দ্রাণীকে এত সুন্দর করে সাজিয়েছিল সবাই ওর সাজের প্রশংসা করেছিল। বিয়ের অনেক বছর কেটে গেছে। চন্দ্রাণী শুভমের একটি মেয়েও হয়েছে। বর্তমানে দুজনে মেয়েকে নিয়ে সুখে সংসার করছে।
তনুচ্ছায়া মুখার্জী-
