Sanghamitra Roychowdhury

Romance Classics

2.7  

Sanghamitra Roychowdhury

Romance Classics

কৃষ্ণকলিকে

কৃষ্ণকলিকে

3 mins
1.0K


যতদূর চোখ যায় সামনে পেছনে ডাইনে বাঁয়ে, সবখানেই শুধু সর্ষের ক্ষেত। সবুজ পাতাগুলো চাপা দিয়ে সর্ষেফুল ক্ষেতভরা, হলুদে হলুদ, ঠিক যেন কাঁচা সোনা। সকালের রোদ পড়ে সে রঙ ঠিকরে বেরোয়। সেই গাঢ় সোনারঙ ঢালা ক্ষেতের মাঝের আলপথ গিয়ে মিশেছে লাল মোরাম বিছানো গাঁয়ের পথে। সে পথের দু'ধারে খড়ের ছাউনি দেওয়া সারি সারি মেঠো ঘর। গাঁ ঘিরে রেখেছে বহু বহু বছরের পুরোনো তাল তমাল সোনাঝুরি গাছের সারি। গাঁয়ের ঠিক মাঝখানটিতে বুড়ো বটগাছের তলায় নিকোনো পোঁছানো বুড়োবাবার থান। সেখানেই গাঁয়ের মুরুব্বিদের বসবার বাঁশের মাচান বাঁধা। পরবে কি বুড়োবাবার মানতপুজোর মেলার দিনে ঐ জায়গাটুকু ঘিরে সামিয়ানা খাটিয়ে ম্যারাপ বেঁধে ওখানে পালাগান, পুতুলনাচ আর বাউল গানের আসর বসে। রাত ভারী হলে মেয়ে মরদ মিলে মিশে হাঁড়িয়া গিলে ধামসা মাদলের তালে তালে পা ফেলে ফেলে নেশায় চুর হয়ে নাচগান করে রাতভর। এই আমার গাঁ, ধরা যাক সে গাঁয়ের নামও কাঁচাসোনা। ঐযে রবিঠাকুরের শান্তিনিকেতন, তার খুব কাছেই আমার গাঁ.... আমার কাঁচাসোনা গাঁ।


শান্তিনিকেতনে পৌষমেলাতে বেড়াতে আসা দূর দূরান্তের শহরের বাবুরা আমাদের গাঁয়ে আসে বুড়োবাবার থানে মেলা দেখতে, বাউলগান শুনতে। যাদের উৎসাহ বেশী তারা রাতভর আমাদের গাঁয়েই থেকে যায়, নাচের দলের সাথে তালে তালে পা মেলায়। তারপর ফিরে যায় ভোর হতেই।




এমনি এক মেলায়ই বুড়োবাবার থানে তাকে দেখা আমার। বসে একমনে বাউল গান শুনছিলো। রাত বাড়তেই তার সঙ্গী সাথীরা ফিরতি পথ ধরলো। তবে সে কিন্তু একলাই রয়ে গেলো, ভারী গান পাগল তো! হঠাৎই আমার চোখে চোখ পড়ে। ভিড়ের মাঝেও একা একা বসেই শুনছিলো গান, হাতে তাল দিয়ে দিয়ে।




বাহ্, মেয়ের ভারী সাহস তো! একলা একলা দিব্যি বসে আছে, কাছাকাছি থেকে এসেছে বলেও তো মনে হচ্ছে না। সাজপোশাকে শহরের ছাপ স্পষ্ট। গায়ের রঙ তার কালো, কিন্তু তা হলে কি হয়? সে কালো যেন আগুন ঝরানো, আগুন ধরানো কালো। সে কালোর আলোয় হ্যাজাকবাতির চড়া আলোও মলিন। চোখ ফেরাতে পারছি না আমি। যতক্ষণ সে ছিলো ততক্ষণ ধরে তাকেই দেখে গেলাম। আমি বেশ তার নাম দিলাম কৃষ্ণকলি।

তার সঙ্গীরা চলে যাবার পরও কেউ এসে তার পাশে বসে নি। ওর চোখেও কাউকে খোঁজার চাউনি নেই। নিশ্চিন্তে হাতে তাল রেখে রেখে বাউলের কন্ঠে শুনে চলেছে, "ও মিলন হবে কত দিনে, আমার মনের মানুষের সনে......." লক্ষ্য করলাম তার চোখের কোণদুটো চিকচিক করছে। অল্প অল্প দুলছে। শরীরে তার গানের সুর খেলে বেড়াচ্ছে যেন। আমি আর থাকতে পারলাম না। গিয়ে বসলাম একেবারে তার পাশটিতে। কান একটু খাড়া করলেই যেন তার নিঃশ্বাসের শব্দও শুনতে পাবো। আহা, পাশে বসেও এত সুখ! আমি তার পাশে গিয়ে বসাতেও তার কিন্তু কোনো ভ্রূক্ষেপই নেই।




দেখতে দেখতে পুব আকাশে টকটকে লাল ঢেলে সূর্য দেখা দিলো, আসরও ভাঙলো। বাউলরা তাদের ঝোলায় পুরে ফেলছে সারারাতের রোজগারের সিধে আর সেফটিপিনে আঁটা দশ বিশ পঞ্চাশের নোট, সব গুনেগেঁথে, গুছিয়ে।

আসর ভাঙতেই সব ঝড়তিপড়তি শ্রোতার দল ফিরতি পথ ধরলো, যে যেদিক থেকে এসেছিলো সে সেদিকে। সেও উঠে পড়েছে, আবার একবার চোখাচোখি হোলো। ছোট্ট একটু হাসি বিনিময়ও। আমি যে এতক্ষণ তার পাশটিতে পরাণসখা হয়ে বসে ছিলাম সেটা সে বোধহয় বুঝেছে। মেয়েদের অনুভূতি ভারী প্রখর, পড়েছিলাম কোথাও।

এবার সে গটগট করে হেঁটে আসরভাঙা হালকা ভিড়ে মিশে গেলো। একাই। আমি পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার চলে যাওয়া দেখলাম। ফিরতি পথে একতারা হাতে বাউল গান ধরেছে, "তারে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গেলেম, আর পেলেম না, দেখেছি রূপসাগরে, মনের মানুষ কাঁচাসোনা.....!"



এখনও প্রতি পৌষমেলায় দূর শহরের কলেজের পড়ানোর চাকরিতে ছুটি নিয়ে কাঁচাসোনায় নিজের গাঁয়ের বুড়োবাবার থানের মেলায় ঠিক ছুটে আসি। দশ বারো বছর ধরেই, ফি বছর, একাই। আরেকবার যদি আমার সে কৃষ্ণকলির সাথে দেখা হয়! অপেক্ষায় আছি, মনের কথাটা বলতে যে বড়ো সাধ তাকে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance