খোঁজ
খোঁজ
" monsieur, avez-vous vu ma tête? আমার মাথাটা দেখেছেন কেউ? কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না, কোথায় যে গেল! কবে থেকে খুঁজে চলেছি জানেন! সেই অভিশপ্ত রাতের পর কেটে গেছে আড়াইশো বছর! আজ্ঞে হ্যাঁ, অনেকগুলো বছরই বটে। সেই দিনের পর থেকে নায়াগ্রা নদী দিয়ে বয়ে গেছে কত জল। দূর্গটাও তো পাল্টে গেছে অনেক। এখন আর যুদ্ধটুদ্ধ হয় না এখানে। অনেক লোক রোজ এমনি এমনি ঘুরতে আসে। কত রকমের লোক।কত কত মাথা। কিন্তু কই একটাও তো আমার মত নয়। মাঝে মাঝেই খুব যন্ত্রণা হয় ঘাড়ে। মাথার ওপরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এই তো বছর কিছু আগে রাতের অন্ধকারে কারা যেনো এই ছাদের ঘরে এসেছিল। অনেক সব বড় বড় যন্ত্রপাতি নিয়ে। মুখ চোখে তাদের কেমন যেনো অদ্ভুত ভয়মাখানো সাহস। যন্ত্রগুলো দিয়ে কেমন যেনো সব অদ্ভুত আওয়াজ আসছিল। আমার বারবার মনে হচ্ছিল ওরা আমার সাথে কথা বলতে চাইছে। খুব আনন্দ হল মনে। কেউ তো এখন কথা বলার মত নেই! আর সত্যি বলতে কি কথা বলার জন্য মুখটাই তো নেই ধড়ে। যাই হোক , হাত পা নেড়েচেড়ে অনেক কিছু বলার চেষ্টা করলাম, আওয়াজও করলাম গলা দিয়ে। ওরা মনে হল বুঝতে পেরেছিল আমার উপস্থিতি। আমি সেই আনন্দে একটু বেশিই বোধ হয় হাত পা নেড়ে ফেলেছিলাম। আর তাতেই ঘটলো বিপত্তি। সামনের অস্ত্রশস্ত্র রাখা ঢাউস ডালা খোলা কাঠের বাক্সে পা জড়িয়ে গিয়ে ধড়াম করে ডালাটা বন্ধ হয়ে গেল। ব্যাস। ছেলে মেয়েগুলো ভয় পেয়ে হুড়ুম দুরুম করে অর্ধেক জিনিসপত্র ফেলে রেখেই দৌড় দিল। সেই থেকে একটু বেশিই সামলে চলি। আমাদের ছাদের এই ঘরটা আসলে আমাদের শোবার ঘর ছিল। আর ঘুমের মধ্যেই রাতের বেলা আমরা আক্রান্ত হই । এখন লোকেরা ঘুরে ঘুরে দেখে সেই জায়গাগুলো। আমার সহযোদ্ধারা কেউ আর নেই এখানে। শুধু আমারই মুক্তি হয় নি । কি করে হবে? মাথা ছাড়া যে যেতেই পারছি না এখান থেকে। এই দেখুন কথা বলতে বলতেই কত লোক জমে গেলো এখানে। কি যে এরা দেখে এত এখানে, কে জানে! লোকেরা দেখি আবার হাতে করে ছোট ছোট চৌকো চৌকো জিনিস এনে আমার সামনে ধরে। সেগুলো থেকে মাঝে মধ্যেই কারণে অকারণে ঝলকে ওঠে আলো। জানি না কি হয় তাতে। তবে আমার খুব অস্বস্তি হয়। কেমন যেনো মনে হয় কেউ ছ্যাকা দিয়ে গেল। কেউ কেউ আবার বন্দুকের মত দেখতে বড়ো বড়ো দেখতে যন্ত্রও আনে। তাতেও আলো ঠিকরে ওঠে হঠাৎ হঠাৎ। সেটা আরো জোড়ালো। যাই হোক। অনেক কথা হল । খুঁজে দেখি আবার বিছানা তোষকের ফাঁক ফোঁকরগুলো, যদি কিছু থেকে থাকে সেখানে।"
ঘড়িতে দুপুর তিনটে। কিন্তু এই দুর্গের ঘরগুলোতে পুরনো দিনের সেই পরিবেশ তৈরি করার জন্য ইচ্ছে করেই আলোর ব্যাবস্থা বেশ কম রাখা হয়েছে। অঞ্জন নিচের ঘরগুলো দেখে কাঠের সিড়ি বেয়ে উঠে এলো ওপরে। ছাদের সেই ঘরে কড়ি বড়গার সিলিং বেশ খানিকটা নিচু। তার ওপর জানলাও মোটে দুটো। কিন্তু লম্বা চওড়ায় ঘরখানা বেশ প্রশস্ত। তা আর হবে নাই বা কেন। অত বড় দুর্গের ছাদ বলে কথা। পালিশ করা কাঠের মেঝে জুড়ে ফরাসী সৈনিকদের সেই ঢালাও বিছানা সাজিয়ে রাখা আছে আজও। এখানেই ১৭৫৯ সালের এক অভিশপ্ত রাতে ইংরেজদের অতর্কিত আক্রমণে ঘুমের মধ্যেই ধড় মুন্ডু আলাদা হয়ে গেছিল বহু ফরাসী সৈন্যের। এর কারণ জানতে হলে পিছনে হাঁটতে হবে আরো এক শতক। সপ্তদশ শতকে লেক অন্টারিওর কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এই দূর্গ থেকেই ফরাসীরা নিউ ফ্রান্স নামে মার্কিন মুলুকে তাদের দখলীকৃত বিস্তীর্ণ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য শাসন করতেন। কিন্তু অচিরেই ফরাসিদের এই একচেটিয়া মুনাফা লাভে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় চির প্রতিদ্বন্দ্বী ইংরেজরা। ১৭৫৪ সাল থেকে ফরাসিদের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ানদের যুদ্ধে রেড ইন্ডিয়ানদের পক্ষে সামিল হয় এই ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। তাদের যৌথ আক্রমণের বিরুদ্ধে নয় বছর ধরে চলা যুদ্ধে একসময় কার্যত দিশেহারা হয়ে পড়ে ফরাসী বাহিনী। ফরাসিদের কোণঠাসা করে ইংরেজ এবং রেড ইন্ডিয়ানরা মিলে ঘিরে ফেলে এই গোটা দূর্গ। সেই রক্তক্ষয়ী দিনটা ছিল ১৭৫৯ সালের ৬ই জুলাই। শুরু হয় battle of Niagara। ১৯ দিন ধরে দুর্গের ভেতরে ব্রিটিশ আর রেড ইন্ডিয়ানদের প্রবেশ ফরাসীরা ঠেকিয়ে রাখলেও অবশেষে ইংরেজ আর রেড ইন্ডিয়ানদের সুকৌশল আক্রমণের সামনে ভেঙে পড়ে সব প্রতিরোধ। ২৬ শে জুলাই ইংরেজরা দখল নেয় দুর্গের। যদিও তাদের এই দখলদারি টেঁকে নি বেশিদিন। কয়েক দশক পরেই আমেরিকা পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত হয়। ইংরেজদের হাতছাড়া এই নায়াগ্রা ফোর্ট। বর্তমানে এটি সংরক্ষণ করে মিউসিয়াম হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। দেশ বিদেশ থেকে আসা পর্যটকরা নায়াগ্রা জলপ্রপাত ঘুরে বাড়ি ফেরার পথে একবার ঢুঁ মেরে যান এখানেও।
এই যেমন আজকে। সারাদিন মেঘলা থাকলেও পর্যটকের আনাগোনায় কোনো খামতি নেই। অঞ্জনদের মত অনেকেই সপরিবারে বা বন্ধুদের নিয়ে এসেছেন, ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন চারপাশ। দুর্গের এই ঘরটায় প্রায় প্রত্যেকেই ব্যস্ত এখন নানান জিনিসের ছবি তুলতে। যদিও এই মুহূর্তে লোক খুব বেশি নেই। মিউজিয়াম বন্ধেরও সময় হয়ে এলো প্রায়। অঞ্জন আশপাশটা একটু ঘুরে নিয়ে চোখ রাখলো তার ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে। প্রায়ান্ধকার ঘরে কিছুই তেমন আহামরি ফটো এলো না। খালি মনে হল লেন্সের সামনে দিয়ে ঝুলের মত কিছু একটা যেনো সরে গেলো হঠাতই। অঞ্জন মনের ভুল ভেবে বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দিল না। কিছু শট নিয়ে ক্যমেরাপত্তর গুটিয়ে রওয়ানা দিল নিচের দিকে। বেরিয়ে দেখলো ততক্ষনে ঘোরা শেষ করে নিচে ক্যাফেটেরিয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে শতাব্দী। ঝিরঝির করে হালকা হালকা বরফ পড়তেও শুরু করেছে। দুজনে চটপট দুটো ব্ল্যাক কফি খেয়ে বেরিয়ে পড়ল । আপাতত তিন দিনের সপ্তাহান্তের ছুটি শেষ। চেকলিস্ট মিলিয়ে নায়াগ্রা জলপ্রপাত আর দূর্গ দেখার পালাও শেষ। এবার অনেকটা রাস্তা গাড়ি চালিয়ে ফিরতে হবে সেই ওহিও প্রদেশের ডাবলিন শহরে তাদের ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট মুখার্জি ম্যানসনে।
দুদিন পরে অঞ্জন অফিস থেকে ফিরে ল্যাপটপ খুলে তাদের তোলা ছবিগুলো এডিট করতে বসলো। যে কোনো জায়গা থেকে ঘুরে এলেই অঞ্জন সাজিয়ে গুছিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি দিতে ভালোবাসে। শতাব্দীর আজ বসন্তোৎসব উপলক্ষে স্থানীয় বেঙ্গলি অ্যসোসিয়েশনে নাটকের মহড়া আছে। তাই ফিরতে দেরি হবে তার। অঞ্জন ল্যাপটপে মেমোরি কার্ডটা ঢুকিয়ে দিয়ে চটপট নিজের জন্য একটা ব্ল্যাক কফি আর দুটো গার্লিক ব্রেড নিয়ে আবার এসে বসলো। ল্যাপটপে ছবিগুলো খুলতেই একরাশ খুশি চিকচিকিয়ে উঠলো অঞ্জনের চোখে মুখে। নতুন ফুল ফ্রেম ক্যামেরাতে দুর্দান্ত সব ফটো এসেছে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের। অঞ্জন বেছে বেছে কয়েকটা প্রথমে পোস্ট করলো নিজের পেজে। তারপর নায়াগ্রা দুর্গের ফটোগুলো দেখতে বসলো। অনেকগুলো ছবিই বেশ মন মত হয়েছে। ভালো করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিলে এটাও বেশ একটা শো - কেস করার মত অ্যালবাম হবে। দুর্গের ভেতরে বা বাইরে খুব বেশি আলো না থাকলেও বেশ ঝকঝকে ছবি এসেছে। ক্যামেরাটা তার মানে কম আলোতেও ভালো কাজ করে। এইসব ভাবতে আর দেখতে দেখতে অঞ্জন পৌঁছে গেলো ফোল্ডারের শেষের দিকের ছবিগুলোতে যেগুলো তোলা হয়েছে দুর্গের ছাদের ঘরে। ছবিগুলো দেখে অনেকক্ষন পর বেশ হতাশই হল অঞ্জন। অন্যান্য জায়গার তুলনায় এই ছবিগুলোর মান বেশ খারাপ। মনে হচ্ছে যেন একেবারে সাধারণ মানের কোনো মোবাইল ক্যামেরায় তোলা। ওই ঘরে তোলা গোটা তিরিশেক ছবি এক সঙ্গে বেছে নিয়ে মুছে ফেলতে যাবে এমনই সময় একটা জিনিষ খেয়াল করে কি বোর্ডে থমকে গেলো অঞ্জনের আঙ্গুলগুলো। নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে একটা খুব সরু কিন্তু উজ্জ্বল সবুজ নীলচে আলোর রেখা একেবেঁকে গিয়ে হঠাতই যেনো আধাঁরে মিলিয়ে গেছে। আলোটা কিসের তা অনেক ভেবেও মাথায় আনতে পারলো না অঞ্জন। অথচ সেই ঘরে ওই রঙের কোনো এই ধরনের আলো ছিল না। বাইরে থেকে আসা সূর্যের আলোর প্রতিফলন হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা ছিল না কারণ বাইরে আকাশ ছিল বেশ মেঘলা আর ঘরের সার্শি দুটোই ছিল বেশ মোটা কাঁচে ঢাকা। তাহলে এটা কিসের আলো? ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই যেনো কাঁটা দিয়ে উঠলো সারা শরীর আর তখনই মনে পড়ে গেলো সেই দিনের লেন্সের সামনে দিয়ে হঠাতই কিছু একটা সরে যাবার ব্যাপারটা। বরাবরের ভীতু অঞ্জন আর একা ঘরে বসে থাকতে পারলো না। ঘরের দরজা খুলে বাগানে এসে একা একা পায়চারি করতে লাগলো। এমন সময়ই হঠাৎ চোখের সামনে আছড়ে পড়লো হেডলাইটের জোড়ালো আলোটা। খানিক থতমত খেয়ে ঘোর কাটিয়ে উঠে চোখ কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে দেখল শতাব্দী নামছে গাড়ি থেকে। সেদিন আর ল্যাপটপ খুললো না অঞ্জন। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লো।পরদিন দিনের আলো ফুটে উঠতেই কেটে গেলো মনে জমাট বেঁধে থাকা ভয় আর সকল অন্ধকার। আবার অন্যদিনের মতই চেনা ছকে বাঁধা ছন্দে চলতে লাগলো জীবন। অঞ্জন কাজে কর্মে একপ্রকার ভুলেই গেল ছবিটার কথা। আবার সেটির কথা মনে পড়লো সপ্তাহান্তে একটা ঘটনার পর।
শুক্রবার দিনটা একটু বেশি রাত করেই জেগে থাকে অঞ্জন। সপ্তাহের এই একটা রাত অঞ্জন তুলে রাখে তাঁর নিজের মনের মত করে নিশ্চিন্তে সময় কাটাবে বলে। অঞ্জনের মনের মত কাজ মানে প্রথমেই যেটা থাকে সেটা হল ফটোগ্রাফি আর সেই সাথে নতুন কিছু টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করা, বিভিন্ন জার্নালে সেগুলো নিয়ে লেখালেখি করা বা গান শোনা। আজও সেই মত বসলো ক্যামেরাটা নিয়ে। ভালো করে একটু পরিষ্কার করে হাত দিল নতুন কেনা লেন্সটাতে। লেন্সের সামনেটা আলোর দিকে ধরতেই কেঁপে উঠলো বুকটা। হালকা একটা চুলের চেয়েও সরু দাগ যেন লেন্সের আড় বরাবর চলে গেছে। অঞ্জন অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই তুলতে পারলো না দাগটা। তার মনে পড়লো গেলো হপ্তায় নায়াগ্রা ট্রিপের আগে সব ক্যামেরা আর লেন্সই ভালো করে দেখে নিয়ে তারপরেই ব্যাগে ভরেছিল। তখনও এমন কিছু তার নজরে পড়ে নি। তার মানে এটা হয়েছে ওই নায়াগ্রায় ঘোরাঘুরির সময়। কিন্তু অনেক ভেবেও অঞ্জন মনে করতে পারলো না সেই সময়ের এমন কোনো মুহূর্ত যখন অসাবধানে বা বেখেয়ালে ক্যামেরাটা ব্যাগে ভরেছিল বা ব্যাগটা কোথাও রেখেছিল বলে। শতাব্দীকে ঘুম থেকে তুলে জিজ্ঞেস করেও তেমন কোনো সদুত্তর পাওয়া গেল না। মনটা বেশ খারাপই হয়ে গেলো অঞ্জনের। তখনকার মত লেন্সটা কিট ব্যাগে তুলে রাখতে যাবে এমন সময়ই হঠাৎ মনে পড়লো ঘটনাটা। নিজের মনেই বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো - "আরে এ তো সেই 50mm লেন্সটা যেটা দিয়ে সেই দুর্গের ছাদের ঘরের সব ছবিগুলো তুলেছিলাম আর তখনই তো সেই অদ্ভুত আলোর ফটোটাও উঠেছিল।"
ঘটনা দুটো একই কার্য কারণের সূত্রে গাঁথা কিনা ভাবতে ভাবতে বেশ ঘেমে নেয়ে উঠলো অঞ্জন। আলো না জ্বালিয়েই ও ছুটে গিয়ে খুলে দিল বেসিনের কল। বেডরুম থেকে চুঁইয়ে আসা নাইট ল্যাম্পের নীল আলোয় তখন অদ্ভুত আলো আঁধারিতে মাখামাখি গোটা ওয়াশরুম। মুখে চোখে জলের ঝাপটা দেবার আগে সেই ছায়া ঘেরা আলোতেই আয়নায় মুখ রেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য ভয়ে স্থবির হয়ে গেলো অঞ্জন। এটা কি দেখছে সে! তার সুন্দর সুঠাম মেদহীন শরীরের ওপর আস্ত মাথাটাই তো নেই । ঘাড়ের ওপর থেকে যাকে বলে একেবারে বিলকুল ফাঁকা। ঘটনার আকস্মিকতায় কোনরকমে প্রায় অসাড় হতে বসা আঙ্গুলগুলো জোর করে এগিয়ে দিল সুইচ বোর্ডের দিকে। আর সাথে সাথে একরাশ আলো ঝাঁপিয়ে পড়লো ওয়াসরুমে। অঞ্জন আয়নার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখলো দিব্যি দেখা যাচ্ছে তার রাজপুত্তুরের মত চেহারাখানা। মধ্য চল্লিশেও অঞ্জন মুখার্জির গ্ল্যামার তো কমেই নি ,উল্টে সমবয়সিদের ঈর্শাকে আশকারা দিয়ে জর্জ ক্লুনির মত দিনকে দিন বেড়েই চলেছে তা। আজও আলোতে নিজের ক্লিন শেভ মুখটা দেখতে পেয়ে নিজেই মনে মনে তারিফ করতে করতে ভুলে যেতে চেষ্টা করলো কিছুক্ষন আগের চোখে পড়া হাড় হিম করা দৃশ্যটা। পাছে মনের কোনো দুর্বলতা প্রকাশ পায় তাই শতাব্দীকে ঘটনাটা সম্পর্কে কিছু জানালো না সে। বাকি দুটো ছুটির দিন আর ক্যামেরা নিয়ে বসলো না। বরং শতাব্দীর সাথে শপিং করে, ভালো কিছু মুভি দেখে আর রান্নাবান্না করে কাটিয়ে দিল ।
এই ঘটনার পর কেটে গেছে প্রায় এক মাস। আর তেমন অস্বাভাবিক কিছু হয়নি। যদিও হয় নি বলাটা ভুল, আসলে তেমন কিছু লোকের চোখে পড়ার মত হয় নি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে একটা পরিবর্তন হয়ে চলেছে অবিরত, সেটা ভালই বুঝতে পারছিল অঞ্জন।
মাস খানেকের মধ্যে দীর্ঘদিনের পোড় খাওয়া আইটি আর্কিটেক্ট অঞ্জন আর নিজের পছন্দের টেকনিক্যাল বিষয়ে আর তেমন কোনো ভালো লাগা খুঁজে পাচ্ছিল না সে। বরং অদ্ভুত ভাবে অবসর সময়ে অনেক বেশি করে তাঁকে টানছিল ইতিহাস নির্ভর, বিশেষ করে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস সংক্রান্ত বিভিন্ন ডকুমেন্টরি ফিল্মগুলো। অথচ ছোটবেলা থেকেই সে ইতিহাস বিমুখ। কোনোকালেই ইতিহাস বইতে তেমন কোনো রস খুঁজে পেত না। মাধ্যমিক পরীক্ষায় সব থেকে কম নম্বর এসেছিল এই বিষয়েই। সেদিনই দুগ্গা দুগ্গা বলে নিজের পড়াশোনার জগৎ থেকে বিদায় দিয়েছিল ইতিহাসকে।
অথচ সেই কিনা খোঁজ পেয়ে একদিন যেচে গিয়ে আলাপ করে এলো তাদের সোসাইটিতে দুটো বিল্ডিং পরেই থাকা শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব ইতিহাসের অধ্যাপক বিজয় পট্টনায়কের সঙ্গে। অফিসের সময় চুরি করে দেখে ফেলল শহরের ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা বেশ কয়েকটি নামী মিউজিয়াম এবং শিল্প প্রদর্শনশালা। সপ্তাহান্তের কেনাকাটায় বাড়ির বুকশেলফটির একটি কোনা অচিরেই সেজে উঠলো নতুন কিছু ইতিহাস আর ইতিহাস আশ্রয়ী উপন্যাসের বইয়ে যার বেশিরভাগ লেখাই হয় আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম কিংবা সপ্তদশ - অষ্টাদশ শতকে ইউরোপীয় শক্তিগুলির ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও বিস্তারের আগ্রাসী রণনীতিকে কেন্দ্র করে লেখা। শুধু তাই নয়, রাতের পর রাত কখনো Free State of Jones কখনো The Hurt Locker,Tears of the Sun এর মত ওয়ার মুভি নিয়ে অঞ্জন বুঁদ হয়ে রইলো, যা মাস দুয়েক আগের অঞ্জন কখনো ভাবতেই পারতো না। তার বরাবরই পছন্দের জ্যঁর ছিল হালকা রোমান্টিক কমেডি মুভি। সেই অঞ্জন মাস খানেকের মধ্যেই সকলের চোখের আড়ালে এ ভাবেই আস্তে আস্তে বদলে যেতে লাগলো। শতাব্দী নিজে এককালে ইতিহাসের মেধাবী ছাত্রী ছিল। তাই অঞ্জনের এই শখগুলোকে প্রথম দিকে মনে মনে এক প্রকার প্রশ্রয়ই দিয়েছিল।
তবে কিছুদিনের মধ্যেই অঞ্জনের এই পাল্টে যাওয়া আস্তে আস্তে লোকের নজরে পড়তে শুরু করলো। ততদিনে অঞ্জনের শখগুলো খ্যাপামির পর্যায়ে পৌঁছতে শুরু করেছে। কাঁধ অব্দি ঢেউ খেলানো চুল, চওড়া, পাকানো গোঁফের আড়ালে এই অঞ্জনকে কোনো ভাবেই যেন মেলানো যায় না আগের অঞ্জনের সাথে। বদলে যাওয়া অঞ্জনের অস্বাভাবিক আচরণ প্রথম ধরা পরে শতাব্দীর চোখে । অঞ্জনের মত কাজ পাগল হাসি খুশি একটা লোককে অফিসের কাজ কর্ম ছেড়ে উদভ্রান্তের মত রাতদিন আপন মনে হয় বাড়িতে না হয় বিভিন্ন লাইব্রেরীতে বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতে দেখে শুরু শুরুর দিকে বেশ অবাকই হয়েছিল শতাব্দী। বারবার প্রশ্ন করেও অঞ্জনের থেকে কোনো সদুত্তর না পেয়ে একসময় জিজ্ঞেস করা ছেড়ে দিয়েছিল। অঞ্জনের আশ্চর্য রকমের তিরিক্ষি মেজাজটাও তার একটা বড়ো কারণ। কথায় কথায় রেগে যাওয়া, খারাপ ব্যবহার করা যেনো এই কদিনে মজ্জাগত হয়ে গেছিল অঞ্জনের। তার এই ধরনের আচরণে সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছিল শতাব্দীই।
ইদানিং অঞ্জন আর শতাব্দীর মধ্যে বিশেষ কথাবার্তা হত না। সেদিনের প্রাণখোলা অঞ্জন প্রায় বন্ধই করে দিয়েছিল বাইরের লোকের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করা , আড্ডা দেওয়া বা ঘুরতে যাওয়া। একদিন অফিস থেকে দুপুর বেলা বাড়ি ফিরে হঠাতই কিছু কাগজপত্র নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল । যাওয়ার আগে শতাব্দী চেপে ধরাতে জানতে পারলো অঞ্জন ফ্রেঞ্চ শেখার স্কুলে ভর্তি হয়েছে।
এদিকে অঞ্জন কাজে ভালো হলেও মাস ছয়েক ধরে তার কাজকর্মের প্রতি গাফিলতি অফিস কর্তৃপক্ষের নজর এড়ালো না। তার মত উচ্চ পদমর্যাদার একজন কর্মচারীর অনিয়মিত অফিস আসা, কথার খেলাপের জন্য ক্লাইন্টের কাছে ভালোই মুখ পুড়লো কোম্পানির।কোম্পানির বড় কর্তারা মোটেই এসব ভালো ভাবে নিলো না। তার এই ধরনের বেয়াক্কেলে কীর্তিকলাপ অনেক ওপরে অব্দি জানানো হল। অঞ্জনের এতদিনের তিল তিল করে গড়ে তোলা সুদক্ষ আর্কিটেক্টের ভাবমূর্তি এসব ঘটনায় দিন কয়েকের মধ্যেই একেবারে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। দীর্ঘদিনের পরিচিত সহকর্মী বন্ধুরাও তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল। কোম্পানির তরফে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অঞ্জনের ম্যানেজার এক সপ্তাহ আগে অঞ্জনকে কড়া ভাষায় মেল করে তাঁর কাজের প্রতি গাফিলতির জবাবদিহি চাইলো। আগামীকাল অঞ্জনের সেই চিঠির উত্তর দেবার শেষ দিন। উত্তর সন্তোষজনক না হলে তাকে হয়ত চাকরি ছেড়ে সপরিবারে দেশে ফিরে যেতে হবে। অঞ্জনের মনের যা অবস্থা তাতে সেই সম্ভাবনাই প্রবল। অঞ্জন সেই কথা ভাবতে ভাবতে বিরক্ত হয়ে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছিল। চিন্তা করতে করতে কখন যে সে চেনা ম্যাডিসন স্ট্রিট ছেড়ে ক্রিক রোড ধরেছে খেয়ালও করতে পারেনি। ঘন্টাখানেক পরেও বাড়ি না পৌঁছতে পারায় হুশ ফিরল তার। ঘড়িতে তখন বাজে রাত এগারোটা। মোবাইল অন করে দেখলো তাতে কোনো টাওয়ার নেই। তড়িঘড়ি জিপিএস এ আবার নতুন করে ঠিকানা দিয়ে স্টিয়ারিং সেই মত ঘোরাতে যাবে এমন সময়েই চোখ পড়ল লুকিং গ্লাসে আর একটা কনকনে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। তার শরীরের ওপর এটা কার মাথা? এতো সে নয় , তারই মত প্রায় হুবহু দেখতে যুদ্ধের সাজ পোশাকে কোনো এক রাশভারী সৈন্যের মাথা যেন বসে আছে লুকিং গ্লাসের দিকে তাকিয়ে। দুচোখে জ্বলছে ভাঁটার আগুন। নাকে এই সময় গাড়ির সব কাঁচ বন্ধ থাকা সত্ত্বেও কোথা থেকে যেন আছড়ে এসে পড়লো পুরনো ফরাসী ওয়াইনের গন্ধ। প্রচণ্ড ভয়ে আর উত্তেজনায় দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে অ্যাক্সিলারেটরে পা দিয়ে চাপ দিতেই গাড়ি সজোরে গিয়ে ধাক্কা মারলো সামনের একটা ম্যাপেল গাছে।
পরদিন সকালে স্থানীয় সকল বড় কাগজেই বেরোলো মর্মান্তিক গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টের খবরটা। বেলা যত গড়ালো, শতাব্দীকে সমবেদনা জানাতে মুখার্জি ম্যানসনে পায়ে পায়ে ভিড় জমালেন বন্ধু, সহকর্মীদের দল । নায়াগ্রা দূর্গ থেকে ততক্ষনে বিদায় নিয়েছে দীর্ঘকালের বাসিন্দা সেই বিদেহী আত্মা। তার অনুসন্ধান সম্পূর্ণ হয়েছে। হয়েছে প্রায় আড়াই শতকের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান । হবে নাই বা কেনো। মাস ছয়েক আগেই তো সে ছাদের ঘরে হঠাৎই খুঁজে পেয়েছিল তার হারানো মাথাখানা। কিন্তু বুঝেছিল সেই মাথার মালিক বা শরীরখানা একেবারেই তার অচেনা। তাই প্রথম থেকেই কোনো তাড়াহুড়ো করে নি। বুদ্ধি করে সময় নিয়ে সাজিয়েছে যুদ্ধের ঘুঁটি। ধীরে ধীরে ছয় মাস ধরে শরীরটাকে বশ করেছে । এও তো এক কঠিন যুদ্ধ। জীবনের শেষ যুদ্ধে হারলেও মৃত্যুর পরে এই যুদ্ধটা জিততেই হত তাকে। আর শেষ পর্যন্ত তা জিতেই নিলো সে।

